কানাডার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় ৫০ হাজার বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীকে ‘গড়হাজির’ (নো-শো) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁরা পড়াশোনার অনুমতি (স্টাডি পারমিট) নিয়ে আসার পরও পড়াশোনা শুরু করেননি। ২০২৪ সালের মার্চ-এপ্রিলে প্রকাশিত দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী স্টাডি পারমিট নিয়ে যাওয়ার পরও পড়াশোনা শুরু করেননি।

ভারতের গণমাধ্যমগুলো বলছে, প্রায় ২০ হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থী কানাডায় যাওয়ার পর কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেননি বা পড়াশোনা শুরু করেননি। ভারত সরকারের কাছে এসব শিক্ষার্থীর অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য বা রেকর্ডও নেই। গণমাধ্যমগুলোর প্রশ্ন, এ শিক্ষার্থীরা এখন কোথায়।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কিছু শিক্ষার্থী কানাডায় গিয়ে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছেন। কতজন যুক্তরাষ্ট্র চলে গিয়েছে তার হিসাব কানাডার কাছে নেই। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো দেশে যাওয়ার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে তাঁরা কোথায় আছেন তা নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।

আরও পড়ুনবিশ্বব্যাংকে ইন্টার্নশিপের আবেদন শুরু, ঘণ্টাপ্রতি বেতন, নেই ইংরেজি ভাষা পরীক্ষা১৫ জানুয়ারি ২০২৫

ভারতের গণমাধ্যম ইকোনমিক টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছে, কানাডায় প্রায় ২০ হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থী, যাঁদের নাম কর্তৃপক্ষের কাছে অজানা, তাঁরা শিক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে নিজেদের ভরণপোষণের জন্য বিভিন্ন ধরনের চাকরি বেছে নিয়েছেন। অনেক শিক্ষার্থী ভুয়া কলেজের কারণে প্রতারিত হয়েছেন। শিক্ষার্থীরা কানাডায় পৌঁছানোর পর জানতে পেরেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভুয়া বা সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। অন্যরা ইচ্ছাকৃতভাবে কানাডায় কাজে প্রবেশের জন্য ছাত্র ভিসাব্যবস্থার অপব্যবহার করেছেন, দেশটির টিউশন ফি আগে থেকে পরিশোধ না করার নীতিকে কাজে লাগিয়েছেন।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এখন তাঁদের থাকার খরচ বহন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের চাকরি শুরু করেছেন। কিছু শিক্ষার্থী যাঁরা সত্যিকার অর্থে পড়াশোনা করতে চান কিন্তু সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি, তাঁরা কম পরিচিত কলেজ থেকে অফার গ্রহণ করে পড়ছেন।

হরিয়ানার পঞ্চকুলার ২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থী কানাডার ব্র্যাম্পটনের নামী কলেজে ভর্তি হয়েছেন ভেবে কানাডায় পৌঁছান। কিন্তু ভর্তির চিঠিতে ঠিকানাটি ছিল একটি ছোট অফিসের, সেখানে কোনোও শ্রেণিকক্ষ ছিল না। তিনি বলেন, ‘তারা (কলেজ কর্তৃপক্ষ) আমাকে বলল ক্লাস শিক্ষার্থীতে পূর্ণ আছে এবং আমাকে তারা অপেক্ষা করতে বলল। সপ্তাহ যখন কেটে গেল, আমি বুঝতে পারলাম কলেজটি ভুয়া। ভাগ্য ভালো ১২ লাখ “টিউশন ফি”র মধ্যে আমি মাত্র ৪ দশমিক ২ লাখ রুপি পরিশোধ করেছিলাম।’

আরও পড়ুনট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগ বন্ধ করতে চান, পারবেন কি ১২ জানুয়ারি ২০২৫

হরিয়ানার ওই শিক্ষার্থী কেবল ফোনে শিক্ষার্থীদের এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এই এজেন্ট চার লাখ রুপি দেওয়ার পর তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন, অতিরিক্ত ঋণ না নিয়ে খণ্ডকালীন কাজের মাধ্যমে বাকি ফি তিনি দিতে পারবেন। এরপর তিনি স্থানীয় একটি পেট্রলপাম্পে কাজ শুরু করেন।

গুজরাটের ভালসাদ এলাকার ২৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থী স্বীকার করেছেন, তিনি ২ বছরের জন্য ৭ দশমিক ৫ লাখ রুপি ফি দিয়ে একটি কমিউনিটি কলেজে ভর্তি হয়েছেন। কানাডায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রির খরচের চেয়ে এটি গড়ে তিন গুণ কম। তিনি বলেন, ‘আমার এলাকার অনেকেই এটা করেছেন এবং আমিও তা–ই করেছি। এটাই ছিল আমার একমাত্র উপায়। তা ছাড়া যাঁরা ভালো কলেজে ভর্তি হয়েছেন, তাঁরাও আমার মতো একই কাজ করেছেন। তাঁদের অনেকের ২৫ লাখ বা তার বেশি ঋণ আছে।’ বর্তমানে তিনি দুটি চাকরি করছেন খরচ মেটানোর জন্য। একটি রেস্তোরাঁয় ও অন্যটি রাতে খাবার ডেলিভারির কাজ।

টাইমস অব ইন্ডিয়া যে যে শিক্ষার্থীর খোঁজ পেয়েছে বা তাঁদের সম্পর্কে জানতে পেরেছে, তাঁদের বেশির ভাগই গুজরাট, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা। বেশির ভাগেরই গল্প একই ধরনের। তেলেঙ্গানার খাম্মাম এলাকার ২৬ বছর বয়সী যুবক সারেতে একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু কখনো ক্লাসে যাননি। তিনি এখন একটি মুঠোফোনের দোকানে পূর্ণকালীন কাজ করেন, এতে প্রতি ঘণ্টায় মেলে সাত ডলার। একইভাবে অন্ধ্র প্রদেশের ওঙ্গলের ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী টরন্টোতে ডেলিভারি এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।

আরও পড়ুনকানাডা দ্বিতীয় বছরের মতো বিদেশি শিক্ষার্থী কমাচ্ছে, কমবে ১০ শতাংশ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

ছাত্রদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, কিছু ছাত্র কানাডাকে অবৈধভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের দ্বার হিসেবে ব্যবহার করছেন। সাবেক ফেডারেল অর্থনীতিবিদ ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ হেনরি লটিন বলেন, নিখোঁজ ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই সীমান্ত অতিক্রম করেননি বরং কানাডায় কাজ করছেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের চেষ্টা করছেন। গত বছর কানাডায় আশ্রয় দাবি করা বিদেশি ছাত্রদের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কমপক্ষে ১০ শতাংশ ছাত্র ভিসাধারীর হিসাব পাওয়া যায়নি।

কানাডা ২০১৪ সালে চালু হওয়া International Student Compliance Regime-এর অধীনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বছরে দুবার প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে স্টাডি পারমিটের শর্ত মেনে ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস করছে কি না, তা নিশ্চিত করা যায়। ২০২৪ সালের মার্চ-এপ্রিলে প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘নো-শো’ হার ভিন্ন। ফিলিপাইনের নো-শো হার ২ দশমিক ২ শতাংশ, চীনের ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ইরানের ১১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং রুয়ান্ডার ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ।

বাংলাদেশ থেকে এ সময় পড়তে যাওয়া মোট ১১ হাজার ৯৪৮ জন। যার মধ্যে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কানাডায় এসে ইউনিভার্সিটি বা কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি অর্থাৎ তাঁরা পড়াশোনার জন্য সেখানে যাননি। ভারতের ক্ষেত্রে প্রায় ২০,০০০ শিক্ষার্থী নো-শো হিসেবে রিপোর্ট হয়েছে, যা তাদের মোট শিক্ষার্থীর ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

আরও পড়ুনকানাডায় পড়তে আসা ৫০ হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী ‘গরহাজির’, কোন দেশের কত১৬ জানুয়ারি ২০২৫

অনেকেই ধারণা করছেন, স্টাডি পারমিটের আসা শিক্ষার্থীরা বড় বড় শহরগুলোতে অবৈধভাবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন। উল্লেখ্য, কানাডায় ওয়ার্ক পারমিট না থাকলে বৈধভাবে কোথাও কাজ করা সম্ভব না। এ বিরাট সংখ্যার বিদেশে শিক্ষার্থীদের আগামীতে বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। কানাডার চিকিৎসাব্যবস্থা সরকারি। সে কারণে কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে তাঁকে সরকারি চিকিৎসা নিতে যেতে হবে, তখন পুলিশ ধরে ফেলতে পারে। অন্যদিকে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কানাডা খুব শিগগিরই কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।

দেশটির সাবেক অর্থনীতিবিদ হেনরি লোটিন প্রস্তাব দিয়েছেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের কানাডায় আসার আগেই পূর্ণ টিউশন ফি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা তৈরি করা উচিত, যাতে ভুয়া আবেদনকারীদের সংখ্যা কমানো যায়। রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেন পুলিশ (আরসিএমপি) এই ইস্যুতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং তদন্ত চালাচ্ছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ২০ হ জ র ক জ কর কর ছ ন র জন য ধরন র সরক র দশম ক করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

একজন চা শ্রমিকের দিনে আয় ১৭৮ টাকা

হবিগঞ্জে ছোট-বড় মিলেয়ে চা বাগানের সংখ্যা প্রায় ৪১টি। এসব বাগানের বাসিন্দা প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে, স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ চা পাতা উত্তোলনে জড়িত।

চা বাগানে একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়। এর বিনিময়ে মজুরি পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো বাগানে নিয়মিত এই মজুরিও দেওয়া হয় না।

শ্রমিকদের দাবি, দৈনিক মজুরি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করতে হবে। বর্তমানে যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চলে না। প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে চা শ্রমিকদের নৈমিত্তিক ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে।

আরো পড়ুন:

বৈষম্য কেন? নারী শ্রমিকেরা পান না সমান মজুরি

ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার, পেশা বদলাচ্ছেন কৃষি শ্রমিকেরা

সরেজমিনে কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকরা ছোট্ট কুঠুরিতে গাদাগাদি করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসবাস করেন। পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, দু-বেলা পেটভরে খেতে পারেন না।

শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘‘দুই বছর অন্তর চা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি ও সমস্যা নিয়ে চা বাগান মালিক পক্ষের সংগঠনের সঙ্গে চা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিনিধির বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে বৈঠক হয়েছে। সে সময় ৮ টাকা ৫০ পয়সা বৃদ্ধি পেয়ে মজুরি ১৭৮ টাকা ৫০ নির্ধারিত হয়েছে।’’

শ্রমিকদের কষ্টের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই টাকায় চলা যায় না। দেশের কোথাও এতো সস্তা শ্রমের দাম নেই। বর্তমানে একজন কৃষিশ্রমিক দিনে ৫০০-১০০০ টাকা আয় করেন, একজন  রিকশাচালকের প্রতিদিনের আয় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। সেখানে একজন চা শ্রমিক পান ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। এজন্য তাকে প্রতিদিন ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়।’’

চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে নাটক ও গানের মাধ্যমে দাবি জানিয়ে আসা জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি প্রতীক থিয়েটারের সভাপতি সুনীল বিশ্বাস বলেন, ‘‘দৈনিক ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা মজুরিতে শ্রমিকদের চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। অচিরেই মজুরি ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হোক। এছাড়া, শ্রমিকদের আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’’

ঢাকা/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ