মুরগি কাপাসি দেখে মুনিয়ার ‘অ্যালার্ম কল’
Published: 14th, February 2025 GMT
রাজশাহীতে পদ্মা নদীর চরের খাঁড়ি। চারপাশে ঘন নলবনের মধ্যে বসে আছে লাল মুনিয়া। পাখিপ্রেমী একটি দল সন্তর্পণে নলবনের মধ্যে দাঁড়িয়ে লাল মুনিয়া দেখছে। মিনিট পাঁচেক যেতে না যেতেই হুট করে পাখিগুলো ‘অ্যালার্ম কল’ দিয়ে লুকিয়ে গেল।
ওই দলের সদস্যরা ধারণা করলেন, আশপাশে হয়তো কোনো শিকারি প্রাণী হাজির হয়েছে। সেটা দেখার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকলেন। এরপর তাঁরা দেখলেন, ধীরগতিতে বাতাসে ভর করে উড়ে আসছে মুরগি কাপাসি পাখি।
ওই দলে ছিলেন সেভ ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড নেচারের রাজশাহী শাখার সভাপতি ইমরুল কায়েস। তিনি জানান, সম্প্রতি শিকারি পাখি মুরগি কাপাসির হাত থেকে লাল মুনিয়ার আত্মরক্ষার ওই দৃশ্য দেখেছেন। সেই সঙ্গে ক্যামেরাবন্দী করেছেন মুরগি কাপাসির আকাশ থেকে নেমে আসার ছবি।
মুরগি কাপাসি বাংলাদেশে বিরল পরিযায়ী পাখি। এর ইংরেজি নাম ‘Hen Harrier’। শীতে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের হাওর ও প্রত্যন্ত এলাকায় পাওয়া যায়। উত্তর ও মধ্য আমেরিকা, ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ায় এদের বিস্তৃতি। তবে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে মুরগি কাপাসি পাওয়া যায় না।
ইমরুল কায়েস জানান, সেদিন পাখি দেখার জন্য সেভ ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড নেচারের কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে বের হয়েছিলেন। তাঁরা রাজশাহী শহরের আইবাঁধের নিচে নৌকায় পদ্মা নদী পার হয়ে চরের মধ্যে নেমে যান। উদ্দেশ্য পদ্মার চরের কিছু লাজুক পাখি দেখা, যারা দূরের একটি খাঁড়িতে থাকে। তাঁরা প্রায় ১৫ কিলোমিটার হেঁটে ওই খাড়ির কাছে পৌঁছান। সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। চরের মাঝখানে তাঁরা প্রায় দুই কিলোমিটার লম্বা একটা খাড়ির কাছে পৌঁছান। সামনেই পেয়ে যান কিছু অপূর্ব সুন্দর লাল মুনিয়া। কিছুক্ষণ পর পাখিগুলো ছোটাছুটি করে একটা সতর্কডাক (অ্যালার্ম কল) দিয়ে লুকিয়ে যায়। তখনই তাঁরা বুঝতে পারেন, পাখিগুলো শিকারি প্রাণী উপস্থিতি টের পেয়েছে। এবং সত্যিই দেখা গেল আকাশ থেকে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে একটি মুরগি কাপাসি। এরা ছোট পাখি পেলেই ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু লাল মুনিয়া সতর্ক হয়ে যাওয়ার কারণে তাকে ফিরে যেতে হয়। মুরগি কাপাসি খাঁড়ির এমাথা থেকে অপর মাথা পর্যন্ত একবার চক্কর দেয়। তাঁদের দিকেও একবার তাকায়। তারপর পাখিটি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়।
মুরগি কাপাসি জলাভূমি, পানির ধারের খোলা মাঠ, তৃণভূমি, আবাদি জমি ও পাহাড়ের পাদদেশে বিচরণ করে। সচরাচর একা থাকে। পরিযানের সময় অন্য কাপাসির সঙ্গে দেখা যেতে পারে। শিকারের সন্ধানে এরা বালিয়াড়ি, খোলা মাঠ, জলাভূমি ও জলাশয়ের সামান্য ওপরে উড়ে বেড়ায়।বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক বললেন, মুরগি কাপাসি শিকারি পাখি। এদের কম দেখা যায়। তবে এরা বিশ্বে বিপদমুক্ত। এর আগে তিনিও রাজশাহীতে পদ্মার চরে মুরগি কাপাসি দেখেছেন। বাংলাদেশ বন্য প্রাণী আইনে এ প্রজাতিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়নি।
এ পাখি সম্পর্কে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ-পাখি (খ-২৬)’ বলছে, ‘ছেলে ও মেয়েপাখির চেহারা ভিন্ন। ছেলেপাখির লেজ, মাথা, বুক ও পিঠ কালচে ধূসর। ডানার প্রান্ত-পালকের আগা ব্যাপক কালো। লেজ-ঢাকনির সরু ফিতা সাদা, পেট ও ডানার নিচের অংশ সাদা। মেয়েপাখির পিঠ কালচে বাদামি, ঘাড় ফিকে ও লেজউপরি-ঢাকনিতে স্পষ্ট সাদা ফিতা। পেটে মোটা লম্বালম্বি বাদামি দাগ ও ডানার নিচে ডোরা থাকে। ছেলে ও মেয়েপাখি উভয়ের চোখ সবুজে-হলুদ। ঠোঁট শিঙ-কালো। ঠোঁটের ঝিল্লি হালকা হলুদ। মুখ পাটকিলে এবং পা ও পায়ের পাতা হলুদ। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহতলে লম্বালম্বি দাগ ও চোখ বাদামি। ২টি উপপ্রজাতির মধ্যে সি সি সায়ানিয়াস বাংলাদেশে পাওয়া যায়।’
শিকারি পাখি মুরগি কাপাসি জলাভূমি, পানির ধারের খোলা মাঠ, তৃণভূমি, আবাদি জমি ও পাহাড়ের পাদদেশে বিচরণ করে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী কৃষিশ্রমিক
‘১৫-২০ বছর ধইরা (ধরে), ই-খলায় (ধান মাড়াই ও শুকানোর স্থান) কাজ করি আমরা। আমরারে ৫০০ টেকা (টাকা) রোজ দেইন (দেন), আর বেটাইনতে (পুরুষরা) পাইন ৭০০ থেকে ৮০০ টেকা, দুপুরে আমরারে চিড়া-গুড় দেওয়া অয় (হয়) হেরার (পুরুষদের) লাগি ভাতের ব্যবস্থা করা অয়।’
কথাগুলো বলছিলেন তাহিরপুরের শনির হাওরপারের কালীবাড়ির সামনে একটি খলায় ধান শুকানো, ঝাড়াই ও বাছাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকা দুই নারীশ্রমিক গীতা বর্মণ ও লক্ষ্মী রানী বর্মণ।
কেবল তাহিরপুরের ধানের খলায় নয়। হাওর এলাকাজুড়েই ধানের খলায় কাজ করা নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের মজুরিতে বৈষম্য রয়েছে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা সদরের নতুনপাড়ার বারীক মিয়ার খলায় কাজ করছিলেন, পাশের লক্ষ্মীপুর গ্রামের মধ্যবয়সী নারীশ্রমিক প্রেমলতা বিশ্বাস। কখন কাজে এসেছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, সকাল ৮টায়। কয়টায় ছাড়বেন কাজ, বললেন বিকাল ৫টায়। মজুরি কত জানতে চাইলে বললেন, দিনে ৫০০ টাকা। পুরুষ শ্রমিকরা কত পায় প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, ৭০০ টাকা। আপনাকে কম দেওয়া হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রেমলতা বলেন, ‘ই-দেশও নিয়মওই এইটা, বেটাইনতে (পুরুষরা) বেশি পায়।’
মধ্যনগরের বংশিকুন্ডা গ্রামের বাসিন্দা হাসিনা বেগম জানান, ধান মাড়াই, শুকানো ও গোলায় তোলার কাজ করেন তিনি। প্রতিদিনই সকালে আগে কাজে লাগেন এবং কাজ শেষে সবার পরে ফেরেন তিনি। কিন্তু মজুরি দেবার সময় তাঁকে দেওয়া হয় ৫০০ টাকা। পুরুষ শ্রমিককে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকাও দেওয়া হয়।
দিরাই উপজেলার রাজাপুর গ্রামের বড় গৃহস্থ সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছত্তার মিয়ার ভাষ্য, রাজাপুরে নারী কৃষিশ্রমিক কমে গেছে। পাশের ইসলামপুরে এখনও বেশির ভাগ কাজ করেন নারীরা। ওখানে নারী ও পুরুষ শ্রমিক অর্ধেক-অর্ধেক। এবার পুরুষ ও মহিলা শ্রমিককে কত টাকা চুক্তিতে গ্রামের বড় কৃষকরা কাজে লাগিয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, পুরুষ ২০ দিনে ১৬ মণ ধান এবং নারী শ্রমিকদের ৮ মণে করানো হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি এই মজুরি বৈষম্যের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে বলেন, ‘আমি এ নিয়ে কথাও তুলেছি, কিন্তু অন্যরা তাতে বিরক্ত হন, তারা বলেন, চেয়ারম্যান সাবে রেইট বাড়িয়ে সবাইকে বেকায়দায় ফেলতে চান।’
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, হাওরের ফসল উৎপাদনে সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় কৃষি শ্রমিকের চাইতে এক সময় বেশি ছিল নারী শ্রমিক। মজুরি বৈষম্যের কারণে এদের অনেকে এলাকার কাজ ছেড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে চলে গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি গৌরী ভট্টাচার্য্য বললেন, কৃষিতে মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে গ্রামীণ এলাকা ছেড়ে উপজেলা, জেলা ও রাজধানীর গার্মেন্টসমুখী হয়েছে হাজার হাজার নারীশ্রমিক। কৃষি ছাড়াও অন্যান্য পেশায়ও মজুরি বৈষম্য থাকায় নারীর উপস্থিতির সংখ্যা কমছে।
গৌরী ভট্টাচার্য্য আরও বলেন, এখনও জাতীয় পরিচয়পত্র করতে গিয়ে কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত পুরুষদের পেশা কৃষক লিখলেও নারীর ক্ষেত্রে হয় না। নারীর প্রতি এমন বৈষম্য বন্ধ করতে হবে।