বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদল নয়
Published: 15th, February 2025 GMT
পুরুষতান্ত্রিকতার শিকল ভাঙার মানসে ও নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি নারী জাগরণের আলোকবর্তিকা, নারীশিক্ষার অগ্রদূত। ১৮৮০ সালে রংপুরের মিঠাপুকুরে তাঁর জন্ম। সেখানে নির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হয় বেগম রোকেয়ার নামে। এ বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করে। সম্প্রতি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাংশ প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ করার দাবি জানিয়েছে। দাবির পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি যুক্তি চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও।
নাম পরিবর্তনের পক্ষের শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিগত হাসিনা সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামটি পরিবর্তন করে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ করে। রংপুর শহরে বেগম রোকেয়ার নামে একটি সরকারি মহিলা কলেজ আছে। একই নামে পাশাপাশি দুটি সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিচয় দিতে অস্বস্তিতে ভোগেন।
তবে নারী জাগরণের অন্যতম অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয় রাখার পক্ষে থাকা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, বেগম রোকেয়ার লেখা ও কর্ম সারাবিশ্বে স্বীকৃত। বেগম রোকেয়ার বাড়ি রংপুরে হওয়ায় তাঁর নামের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় একটি আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। নাম পরিবর্তনের দাবির পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে তারা মনে করেন। এদিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অপরিবর্তিত রাখার দাবি জানিয়েছেন নারী অধিকারকর্মীরা।
‘নাম পরিবর্তনের কোনো কারণ নেই’
খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করার ঘোষণা মোটেও যৌক্তিক না। নাম পরিবর্তনের কোনো কারণ দেখছি না। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার, শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী আচার-আচরণ, অগণতান্ত্রিক, জবাবদিহিহীনতার কারণে একটা গণআন্দোলন হলো। সরকারের পতন হলো। নতুন সরকার এলো। নতুন প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এসব বিষয়ের সঙ্গে কিন্তু বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর বাড়ি রংপুরে। সেখানে তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয় হবে। এতে তো কোনো সমস্যা নেই। যেমন দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা এ ব্যক্তিরা দলীয় চিন্তা বা অন্যকিছুর ঊর্ধ্বে। সেখানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করার কোনো কারণই নেই। যিনি নারীর অধিকার, নারীর বিরুদ্ধে অযৌক্তিক আচার-আচরণের বিরুদ্ধে লিখেছেন, তাই তাঁর নামই থাকছে না। এটি খুব ভুল সংকেত দিচ্ছে। এ ধরনের পদক্ষেপ জনগণ কোনোভাবেই গ্রহণ করবে না। আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আছে। আমরা চাই সরকার এগুলোকে আমলে নিয়ে পরিবর্তন করুক। আমরা চাই দেশটিকে ভালোর দিকে নিয়ে যাক। চিন্তা করা উচিত– বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা তাদের প্রায়োরিটির মধ্যে পড়ে কিনা।
গণঅভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল। তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেছেন। সমন্বয়কও ছিলেন। তাহলে এখন তারা কোথায়? কেনই বা তারা এসব গ্রহণ করছেন। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী নারীরা কেন পিছিয়ে যাচ্ছেন? এগুলো সবারই প্রশ্ন। এটাতো আমরা আশা করি নাই।
‘দাবিটি অযৌক্তিক ও অসম্মানজনক’
ডা.
ফওজিয়া মোসলেম
সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সমাজের অবরোধ ভাঙার জন্য, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়, নারীর মুক্তির জন্য আজীবন যে সংগ্রাম করে গেছেন, তারই ফলে নারীরা আজ শিক্ষা, খেলাধুলা, জ্ঞানচর্চাসহ বিভিন্ন পেশায় এসে সমাজ ও দেশের জন্য অবদান রাখতে পারছেন। সমাজে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার এই স্বপ্নদ্রষ্টার নামে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের জন্য যে দাবি উঠেছে, তা নারীসমাজের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। বেগম রোকেয়ার নাম পরিবর্তনের দাবিটি অযৌক্তিক ও অসম্মানজনক। নারীমুক্তির অগ্রসেনানী মহিয়সী নারীদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব স্থাপনা রয়েছে, যা আগামী প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস, সেগুলোর নামও অপরিবর্তিত রাখতে হবে।
‘যে যুক্তিগুলো দাঁড় করানো হয়েছে, তা কোনোভাবেই ঠিক নয়’
কামরুন নাহার, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, নারীপক্ষ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করার পক্ষে যে যুক্তিগুলো দাঁড় করানো হয়েছে, তা কোনোভাবেই ঠিক নয়। এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কোনো স্থানের নামে যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে পারে, তেমনি বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামেও অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেবল বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই রয়েছে। একই এলাকা বা শহরে একই নামে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকার উদাহরণও কম নেই। ধর্মীয় কুসংস্কার এবং সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নারীর শিক্ষা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে উপমহাদেশের আলোকবর্তিকা বেগম রোকেয়া। জন্মস্থানে তাঁর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই থাকতে পারে। সেই নাম কে দিল বা কার শাসনামলে হলো সেটি ধর্তব্য হতে পারে না। এই দাবি মেনে নিলে নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি বিরোধীদের সমর্থন করে নারীমুক্তি আন্দোলনের নির্ভীক প্রতিভা বেগম রোকেয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হবে।
‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হবে অন্যায়’
মজনুন নাহার, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ
নবজাগরণে নারী শিক্ষাক্ষেত্রে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অবদান কোনো অংশে কম নয়। ১৯০৯ সালে স্বামীর মৃত্যুও নারীশিক্ষায় ব্রতী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে অবদমিত করতে পারেনি। এগিয়ে গেছেন তিনি নতুন চিন্তাধারায়। অটল থাকেন নিজ লক্ষ্যে। তিনি অবশ্যই বাংলার নারী জাগরণ ও শিক্ষার অগ্রদূত। তিনি সমাজ সংস্কারকও বটে। কারণ, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্যই আজ আমরা গর্ব করে নারীশিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারি। এখানে পারিবারিক পরিচয় কিংবা লিঙ্গীয় পরিচয়ের জন্য বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের কথা আসবে কেন? এমন দাবি বুঝে বা না বুঝে নারীবিদ্বেষীদেরই পক্ষাবলম্বন করার নামান্তর। এ বিষয়ে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। সচেতন থাকতে হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হবে অন্যায়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব গম র ক য় র ন ম র জন য অবদ ন জ গরণ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আদাবরে কুপিয়ে হত্যা: তিনজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিল সেনাবাহিনী
রাজধানীর আদাবরে আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধে রিপন সরদার (৪২) খুনের ঘটনায় তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। গতকাল মঙ্গলবার রাত নয়টার দিকে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, রিপন হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ইমন ওরফে ভাইগ্না ইমন ওরফে দাঁতভাঙা ইমনকে তাঁর দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে দুটি সামুরাই উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ইমন হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁদের সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
সেনাবাহিনী জানায়, গতকাল ভোরের দিকে রাজধানীর আদাবর থানার বালুর মাঠ এলাকায় বাসায় ঢুকে রিপন নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। কিশোর গ্যাং এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে অভিযোগ। পরে আহত অবস্থায় রিপনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে তিনি মারা যান।
৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, গতকাল সকালে বালুমাঠ এলাকায় একটি হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়। বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করে জানা যায় এলেক্স সবুজ, মনির ও ইমন এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অবস্থান নির্ণয় করে অভিযান চালিয়ে ইমন ও তাঁর দুই সহযোগীকে দুটি সামুরাইসহ গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযান চালানোর কিছুক্ষণ আগে সবুজ ও মনির সেই জায়গা থেকে পালিয়ে যান। তাই তাঁদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। বাকিদের গ্রেপ্তারে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার সকাল সাতটার দিকে আদাবরের ১০ নম্বরের বালুর মাঠ এলাকায় ‘বেলচা মনির’ ও ‘রাজু গ্রুপে’র মধ্যে এ মারামারি হয়। ‘বেলচা মনিরের’ লোকজন ‘রাজু গ্রুপের’ রিপনকে হাঁসুয়া দিয়ে কুপিয়ে আহত করে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিপন সরদারের মৃত্যু হয়।
আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম জাকারিয়া প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও বিরোধকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাটির বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
আরও পড়ুনআদাবরে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মারামারিতে নিহত ১১৮ ঘণ্টা আগেতবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিপন সরদারের ছেলে ইমন সরদার গতকাল দাবি করেন, রিপন মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন না। রিপন পেশায় চা–দোকানি। বেলচা মনিরের লোকজনের সঙ্গে দুই দিন আগে তাঁর বাবার কথা-কাটাকাটি হয়। এর জেরে তাঁর বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তাঁর মা আরজু বেগমও আহত হয়েছেন। তাঁদের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়।
পুলিশের ভাষ্য, নিহত রিপন সরদার মাদক কারবারি রাজুর চাচাতো ভাই। ‘রাজু গ্রুপ’ ও ‘বেলচা মনিরের’ নেতৃত্বে আদাবরের ১০ ও ১৭ নম্বর এলাকায় মাদক ব্যবসা হয়। ওই বিরোধের জেরেই এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে। নিহত রিপনের বিরুদ্ধে ভোলায় একাধিক মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।