পুরুষতান্ত্রিকতার শিকল ভাঙার মানসে ও নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি নারী জাগরণের আলোকবর্তিকা, নারীশিক্ষার অগ্রদূত। ১৮৮০ সালে রংপুরের মিঠাপুকুরে তাঁর জন্ম। সেখানে নির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হয় বেগম রোকেয়ার নামে। এ বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করে। সম্প্রতি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাংশ প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ করার দাবি জানিয়েছে। দাবির পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি যুক্তি চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও।
নাম পরিবর্তনের পক্ষের শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিগত হাসিনা সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামটি পরিবর্তন করে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ করে। রংপুর শহরে বেগম রোকেয়ার নামে একটি সরকারি মহিলা কলেজ আছে। একই নামে পাশাপাশি দুটি সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিচয় দিতে অস্বস্তিতে ভোগেন। 
তবে নারী জাগরণের অন্যতম অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয় রাখার পক্ষে থাকা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, বেগম রোকেয়ার লেখা ও কর্ম সারাবিশ্বে স্বীকৃত। বেগম রোকেয়ার বাড়ি রংপুরে হওয়ায় তাঁর নামের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় একটি আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। নাম পরিবর্তনের দাবির পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে তারা মনে করেন। এদিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অপরিবর্তিত রাখার দাবি জানিয়েছেন নারী অধিকারকর্মীরা।

‘নাম পরিবর্তনের কোনো কারণ নেই’
খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করার ঘোষণা মোটেও যৌক্তিক না। নাম পরিবর্তনের কোনো কারণ দেখছি না। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার, শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী আচার-আচরণ, অগণতান্ত্রিক, জবাবদিহিহীনতার কারণে একটা গণআন্দোলন হলো। সরকারের পতন হলো। নতুন সরকার এলো। নতুন প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এসব বিষয়ের সঙ্গে কিন্তু বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর বাড়ি রংপুরে। সেখানে তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয় হবে। এতে তো কোনো সমস্যা নেই। যেমন দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা এ ব্যক্তিরা দলীয় চিন্তা বা অন্যকিছুর ঊর্ধ্বে। সেখানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করার কোনো কারণই নেই। যিনি নারীর অধিকার, নারীর বিরুদ্ধে অযৌক্তিক আচার-আচরণের বিরুদ্ধে লিখেছেন, তাই তাঁর নামই থাকছে না। এটি খুব ভুল সংকেত দিচ্ছে। এ ধরনের পদক্ষেপ জনগণ কোনোভাবেই গ্রহণ করবে না। আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আছে। আমরা চাই সরকার এগুলোকে আমলে নিয়ে পরিবর্তন করুক। আমরা চাই দেশটিকে ভালোর দিকে নিয়ে যাক। চিন্তা করা উচিত– বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা তাদের প্রায়োরিটির মধ্যে পড়ে কিনা।
গণঅভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল। তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেছেন। সমন্বয়কও ছিলেন। তাহলে এখন তারা কোথায়? কেনই বা তারা এসব গ্রহণ করছেন। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী নারীরা কেন পিছিয়ে যাচ্ছেন? এগুলো সবারই প্রশ্ন। এটাতো আমরা আশা করি নাই।

 

‘দাবিটি অযৌক্তিক ও অসম্মানজনক’
ডা.

ফওজিয়া মোসলেম
সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সমাজের অবরোধ ভাঙার জন্য, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়, নারীর মুক্তির জন্য আজীবন যে সংগ্রাম করে গেছেন, তারই ফলে নারীরা আজ শিক্ষা, খেলাধুলা, জ্ঞানচর্চাসহ বিভিন্ন পেশায় এসে সমাজ ও দেশের জন্য অবদান রাখতে পারছেন। সমাজে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার এই স্বপ্নদ্রষ্টার নামে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের জন্য যে দাবি উঠেছে, তা নারীসমাজের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। বেগম রোকেয়ার নাম পরিবর্তনের দাবিটি অযৌক্তিক ও অসম্মানজনক। নারীমুক্তির অগ্রসেনানী মহিয়সী নারীদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব স্থাপনা রয়েছে, যা আগামী প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস, সেগুলোর নামও অপরিবর্তিত রাখতে হবে।

‘যে যুক্তিগুলো দাঁড় করানো হয়েছে, তা কোনোভাবেই    ঠিক নয়’
কামরুন নাহার, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, নারীপক্ষ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করার পক্ষে যে যুক্তিগুলো দাঁড় করানো হয়েছে, তা কোনোভাবেই ঠিক নয়। এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কোনো স্থানের নামে যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে পারে, তেমনি বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামেও অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেবল বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই রয়েছে। একই এলাকা বা শহরে একই নামে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকার উদাহরণও কম নেই। ধর্মীয় কুসংস্কার এবং সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নারীর শিক্ষা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে উপমহাদেশের আলোকবর্তিকা বেগম রোকেয়া। জন্মস্থানে তাঁর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই থাকতে পারে। সেই নাম কে দিল বা কার শাসনামলে হলো সেটি ধর্তব্য হতে পারে না। এই দাবি মেনে নিলে নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি বিরোধীদের সমর্থন করে নারীমুক্তি আন্দোলনের নির্ভীক প্রতিভা বেগম রোকেয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হবে। 

‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হবে অন্যায়’
মজনুন নাহার, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ 

নবজাগরণে নারী শিক্ষাক্ষেত্রে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অবদান কোনো অংশে কম নয়। ১৯০৯ সালে স্বামীর মৃত্যুও নারীশিক্ষায় ব্রতী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে অবদমিত করতে পারেনি। এগিয়ে গেছেন তিনি নতুন চিন্তাধারায়। অটল থাকেন নিজ লক্ষ্যে। তিনি অবশ্যই বাংলার নারী জাগরণ ও শিক্ষার অগ্রদূত। তিনি সমাজ সংস্কারকও বটে। কারণ, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্যই আজ আমরা গর্ব করে নারীশিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারি। এখানে পারিবারিক পরিচয় কিংবা লিঙ্গীয় পরিচয়ের জন্য বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের কথা আসবে কেন? এমন দাবি বুঝে বা না বুঝে নারীবিদ্বেষীদেরই পক্ষাবলম্বন করার নামান্তর। এ বিষয়ে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। সচেতন থাকতে হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হবে অন্যায়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব গম র ক য় র ন ম র জন য অবদ ন জ গরণ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

চোখে আলো ফেলা নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার জেরে কৃষককে হত্যা

ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় চোখে টর্চলাইটের আলো পড়া নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার জেরে ছুরিকাঘাতে এরশাদ আলী (৩৫) নামের এক কৃষক নিহত হয়েছেন। আজ শুক্রবার সকালে উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম সোহাগীপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

নিহত এরশাদ আলী উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম সোহাগীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। খবর পেয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পশ্চিম সোহাগীপাড়া গ্রামে মানিক মিয়ার মুদিদোকানে যান এরশাদ আলী। এ সময় এরশাদ আলীর চোখে টর্চলাইটের আলো ফেলে বিরক্ত করেন একই গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে সাকিব মিয়া। এ নিয়ে দুজন বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ালে স্থানীয় লোকজন মিটমাট করে দেন। পরে এরশাদ আলীসহ সবাই যে যার মতো বাড়িতে চলে যান।

স্থানীয় সূত্র জানায়, আজ শুক্রবার সকাল ছয়টার দিকে এরশাদ আলীকে ডেকে নিয়ে আবার কথা-কাটাকাটি ও মারামারিতে জড়ান সাকিব ও তাঁর সঙ্গে আসা কয়েকজন। একপর্যায়ে এরশাদ আলীকে ছুরিকাঘাত করা হয়। স্থানীয় লোকজন আহত এরশাদ আলীকে উদ্ধার করে ধোবাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে অভিযুক্ত সাকিব মিয়াসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশ।

ধোবাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল মামুন সরকার বলেন, পুলিশ তিনজনকে আটক করেছে। নিহত এরশাদ আলীর শরীরে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন আছে। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাইবান্ধায় চোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা
  • রূপগঞ্জে ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষে লিফলেট বিতরণ 
  • চোখে আলো ফেলা নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার জেরে কৃষককে হত্যা