ভালোবাসা কুড়ানোর মধ্যে অন্যরকম আনন্দ আছে: পুতুল
Published: 17th, February 2025 GMT
পুতুল সাজিয়া সুলতানা। নন্দিত কণ্ঠশিল্পী, লেখক ও উপস্থাপক। গতকাল প্রজেক্ট রেজা পুতুল ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নতুন একক গান ‘শীতের একলা রাতে’। এ আয়োজন, বর্তমান ব্যস্ততা ও অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে।
যে ভাবনা থেকে ‘শীতের একলা রাতে’ গানের জন্ম সেই গল্পটা জানতে চাই...
জীবন বিষাদে ভরে গেলেই যে মানুষ একাকিত্ব বেছে নেয়, এটা ভাবা ভুল। জীবনকে দারুণভাবে অনুভব করার জন্যও অনেকে একা হয়ে যায়; সেই কথাটাই ‘শীতের একলা রাতে’ গানটিতে তুলে আনা হয়েছে। এ গানের জন্ম নিয়েও আলাদা কোনো গল্প নেই। বলতে শোনা যায়, কল্পনার জাল বুনতে বুনতেই গানটি লিখে ফেলা। এরপর সৈয়দ রেজা আলী আমার লেখা গীতিকথায় সুর বসিয়ে সংগীতায়োজনের মধ্য দিয়ে গানটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছে।
সৈয়দ রেজা আলীর সঙ্গে জুটি বেঁধে বেশ কিছু একক গান তৈরি করেছেন। একক গানের বাইরে অ্যালবাম নিয়ে কখনও ভেবেছেন?
একটি ইপি [এক্সটেন্টেড প্লে] অ্যালবাম করা যায় কিনা, তা নিয়ে দু’জনেই বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছি। যেখানে ‘শীতের একলা রাতে’সহ আরও চারটি গান রাখতে চাই। গান যেহেতু তৈরি করাই আছে, সে ক্ষেত্রে এ বছরের যে কোনো সময় অ্যালবাম রিলিজ করতে পারি। তবে চূড়ান্ত ঘোষণাটা দিতে চাই আগে অ্যালবামের নামকরণ করার পর।
সবসময় মেলোডি গানকে প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। অ্যালবামের গান নিয়েও কি একই রকম পরিকল্পনা আছে?
শ্রোতাদের প্রত্যাশা তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত নানা ধরনের গান করেছি। কিন্তু যখন স্পষ্ট হয়েছে, শ্রোতারা আমার কণ্ঠে মেলোডি সুরের গান শুনতে বেশি পছন্দ করেন, তখন থেকে তাদের ভালোলাগাকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছি। কারণ, শ্রোতাই আমার শক্তি-সাহস-অনুপ্রেরণার উৎস।
স্টেজ শোর এ মৌসুমে অনেকে নানা প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আপনাকে টিভি আয়োজনে বেশি দেখা যাচ্ছে, কারণ কী?
স্টেজ শো একটু কম করছি। যেখানে গান শুনিয়ে নিজে আনন্দ পাই, সে ধরনের অনুষ্ঠানগুলোতে পারফর্ম করি। অন্যদিকে টেলিভিশনের ব্যস্ততা সারাবছরই থাকে। সেখানে নানা ধরনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দর্শক-শ্রোতার ভালোবাসা কুড়ানোর মধ্যে অন্যরকম এক আনন্দ আছে। তাই টেলিভিশন আয়োজনগুলো কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না।
এবার লেখক পুতুলের খবর জানতে চাই। আপনার ‘শিল্পীসত্তার ব্যবচ্ছেদ’ বইটি নিয়ে পাঠকদের প্রতিক্রিয়া কেমন?
‘শিল্পীসত্তার ব্যবচ্ছেদ’ নিয়ে পাঠকদের কী প্রতিক্রিয়া– তা এখনও জানার সুযোগ হয়নি। একুশে বইমেলার প্রথমার্ধ তো সেভাবে জমেনি। বাকি অর্ধেকটায় বইপ্রেমীদের সমাগম বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সে হিসেবে দুই সপ্তাহ পর পাঠক প্রতিক্রিয়া কিছুটা বোঝা যাবে। সে যা-ই হোক, যশ-খ্যাতির মোহে লেখালেখি করি না বলে এসব নিয়ে ভাবছিও না। লেখালেখিটা নেশা, তাই লেখার মধ্য দিয়ে এমন কিছু তুলে ধরতে চেয়েছি, যা পাঠককে কিছুটা হলেও যাপিত জীবন, সমাজ-সংসার নিয়ে কিছুটা হলেও ভাবাবে। তাই শিল্পীজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকেই ফিকশন লেখা শুরু করেছিলাম। এখন ‘শিল্পীসত্তার ব্যবচ্ছেদ’ বইটি যদি পাঠকদের কিছু আনন্দ দেয়, ভাবনার খোরাক জোগায়– তা হলেই খুঁজে পাব সৃষ্টির আনন্দ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন
কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ।
এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।
একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।
দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।
পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।
ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।
এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।
বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।
এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”
যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।
বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।
নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”
তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।
প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।
এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।
ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”
শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
ঢাকা/এস