বেশ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেগুলোতে ছিনতাইয়ের অভিযোগে ধরা পড়া ব্যক্তিদের নির্মমভাবে পেটানোর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। প্রচুর মানুষ এতে উল্লাস করছেন এবং মারধরে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যাও সেখানে কম নয়। সেসব ভিডিওর নিচে যেসব মন্তব্য আছে তাতেও প্রচুর মানুষের উল্লাস লক্ষণীয়। অর্থাৎ, একটা বড় অংশের মানুষ এই ঘটনায় খুশি এবং তাঁরা মনে করেন ছিনতাইকারীদের এভাবেই শাস্তি দেওয়া উচিত। এটাই ‘উচিত’ বিচার।

এর আগে কয়েক দিন ধরে রাজধানীসহ সারা দেশে ছিনতাই ও ডাকাতির ভিডিও আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখতে পেয়েছি। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষ ভীষণ উদ্বিগ্ন। সারা দেশে এমন ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা সন্ধ্যার পর পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হতে চাইছেন না।

যদিও আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে এবং এটা আরও উন্নত হতে থাকবে।’ হয়তো তাঁর কথাই ঠিক। মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ারও হয়তো কারণ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো মানুষ এই কথা অবাস্তব বলে ধরে নিয়ে তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। মানুষ ঠিকই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কদিন আগে চলন্ত বাসে তিন ঘণ্টা ধরে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে।

কিশোরগঞ্জের ভৈরবের অদূরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ভুয়া পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে ডাকাতি হয়েছে। এমনকি গাজীপুর জেলায় প্রকাশ্যে ২০–২৫ জন মানুষ রামদা নিয়ে বাজারে স্লোগান দিতে দিতে চাঁদাবাজি করছে, এমন দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এসব প্রকাশ্য চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা আমরা জানি না। ফলে, উদ্বেগ কমছে না।

এরপরও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যখন দাবি করেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে’ তখন আর কীই-বা বলার থাকতে পারে! যদিও ‘গত ছয় মাসে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৪৫টি, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি।’ (‘অপরাধীরা বেপরোয়া, আতঙ্কে মানুষ’, প্রথম আলো, ২৫ ফেব্রুয়ারি) এই পরিসংখ্যান পুলিশের।

আমরা জানি, ঝামেলার ভয়ে ছোটখাটো চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগ জানাতে সাধারণ লোক অনেক সময় থানায় যায় না। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্রটি এর চেয়ে অনেক খারাপ হওয়ারই কথা।

এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার জন্য বিএনপিকে দায়ী করত, সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও খারাপ পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছেন। অনেকেই দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইতে পারে সেটা অস্বাভাবিকও নয়। নানা লোকের নানা স্বার্থ থাকবে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাজই হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঠিক রাখা। কাউকে দোষ দিয়ে নিজের দায়মুক্তির সুযোগ নেই এখানে।

আরও পড়ুনবাস ডাকাতিতে পড়ার অভিজ্ঞতা ও কিছু সমাধান২০ ঘণ্টা আগে

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাত তিনটায় সংবাদ সম্মেলন ডেকে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁরা শুধু দিনেই কাজ করেন না, রাতেও কাজ করেন। কিন্তু মানুষ ‘কাজ’ দেখার চেয়ে কাজের ফলাফল দেখতে বেশি আগ্রহী। আমাদের দেশে দায়িত্বপ্রাপ্তরা সাধারণত নিজেদের কাজ নিয়ে সর্বদা খুশি থাকেন, দায় নেওয়ার সংস্কৃতি এখানে গড়ে ওঠেনি। ফলে এসব গালভরা কথার চর্চাই যে চলতে থাকবে ভবিষ্যতে—এমনটা মনে করাই সংগত। যাহোক, দেশের মানুষ এ মুহূর্তে নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ শঙ্কায় আছে, এটা হলো বাস্তবতা।

এমন বাস্তবতায় মানুষের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। জায়গায় জায়গায় ‘মব’ তৈরি হয় এবং ‘গণপিটুনির’ মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। তখন দেখা যায় অনেক নিরীহ মানুষও আক্রান্ত হন। ২০১৯ সালের ১৮ থেকে ২০ জুলাই ছেলেধরা সন্দেহে তিনজন পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার মধ্যে রাজধানীর বাড্ডায় তাসলিমা বেগম রেনু (৪০) নামের এক নারীকেও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তখনো দেশের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাসংকট তৈরি হয়েছিল এবং সারা দেশে ছেলেধরা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। এবারের আতঙ্কের নাম ‘ছিনতাইকারী’।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের পুলিশের দুর্বলতার সুযোগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে—এটা সত্য। কিন্তু প্রায় সাত মাস পার হওয়ার পরও পরিস্থিতি ঠিক না হওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়। ৫ আগস্টের পর থানা থেকে লুট হওয়া সব অস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি। এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র নিয়ে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড জড়িত হচ্ছে অপরাধীরা। পুলিশের উচিত হবে এই অস্ত্র উদ্ধারে গুরুত্ব দেওয়া। থানা লুট করে কারা অস্ত্র নিয়েছে, সেটা বের করতে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নিতে হবে। এতসংখ্যক অস্ত্র অপরাধীদের হাতে রেখে দেশে স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা কঠিন হবে।

সে ক্ষেত্রে পুলিশ যেন ঠিকঠাক কাজ করে, আইনের ফাঁক গলে যাতে প্রকৃত অপরাধীরা ছাড়া পেতে না পারে, আমাদের সেই ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি আইনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। সেটাই হবে টেকসই ব্যবস্থা। সেটা না করে রাস্তায় ছিনতাইকারীদের পিটিয়ে মেরে ফেলা কোনো সমাধান হতে পারে না।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর যখন মানুষের আস্থা কমে যায়, তখনই দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়। এমন অবস্থার সুযোগ নিয়ে শত্রুতার জেরে রাস্তায় ‘মব’ তৈরি করা সহজ হয় এবং অনেকেই সেই সুযোগ নেন।

প্রশ্ন হলো—ছিনতাইকারী বা অপরাধী হলেই কি এভাবে মেরে ফেলা যাবে অথবা পেটানো যাবে? এককথায় এর উত্তর—‘না’। কোনো অবস্থাতেই সাধারণ মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। বিচারের জন্য দেশে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ আছে। আইন প্রয়োগ করার জন্যও সংস্থা আছে। কাজগুলো তাদের। কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের নয়। অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে, কোনো অবস্থাতেই পেটানো বা পিটিয়ে মেরে ফেলা যাবে না।

অনেকেই হয়তো বলবেন পুলিশ ঘুষ খেয়ে অপরাধীদের ছেড়ে দেয়। আইনের ফাঁকফোকর গলে বাইরে এসে অপরাধীরা আবার একই অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। কথাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সত্য।

সে ক্ষেত্রে পুলিশ যেন ঠিকঠাক কাজ করে, আইনের ফাঁক গলে যাতে প্রকৃত অপরাধীরা ছাড়া পেতে না পারে, আমাদের সেই ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি আইনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। সেটাই হবে টেকসই ব্যবস্থা। সেটা না করে রাস্তায় ছিনতাইকারীদের পিটিয়ে মেরে ফেলা কোনো সমাধান হতে পারে না। সভ্য রাষ্ট্র হতে হলে আগে নিজেদের সভ্য হতে হবে। আত্মরক্ষার জন্য যতটুকু বল প্রয়োগ করা উচিত ততটুকু করা মানুষের অধিকার। কিন্তু অপরাধীদের বেঁধে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মেরে ফেলা বা মব তৈরি করা বন্ধ করতে হবে।

মেহেদি রাসেল কবি ও প্রাবন্ধিক
[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর স থ ত র ই ব যবস থ আম দ র স অপর ধ র র জন য ক জ কর হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

‎পূজাকে  ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি

‎নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, আইনসৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরে সকল ধর্মমত, সকল  সম্প্রদায় তারা একত্রিত হয়েছে।

সকলেই সার্বিক সহয়তা করছে যাতে করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা উৎসব সুন্দর ভাবে পজলন করতে পারে। পূজাকে ঘিরে  একটি গোষ্ঠি চাইবে পূজা উৎসব নষ্ট করে দেয়ার জন্য। 

সে জন্য আমাদের তৎপরতা রয়েছে। আমাদের  গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তার পাশাপাশি র‍্যাব, বিজিবি,  সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশবাহিহনী সবাই কাজ করছে যাতে করে সুন্দর ভাবে পূজা উৎসব শেষ করতে পারি।

‎‎মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর)  শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ৫নং ঘাটে দূর্গা পূজার প্রতিমা বিসর্জনের স্থান পরিদর্শনকালে তিনি এ নির্দেশনা দেন।

‎দূর্গা পূজা বিজয়া দশমী শেষে প্রতিমা বিসর্জনের সময় যেকোনো অপ্রীতিকর দূর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সুন্দর ভাবে প্রতিমা বিসর্জনের স্থান নিরাপদ রাখতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন জেলা প্রশাসক।

‎‎জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, নারায়ণগঞ্জের ২২৩টি পূজা মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে পূজা উদযাপনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এবং সম্প্রীতি বজায় রেখে বর্তমানে পূজা উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে।

‎‎এসময় তিনি প্রতিটি মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে ও নির্বিঘ্নে পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথ সহযোগিতার নির্দেশনা দেন।

‎‎তিনি বলেন, সকলে মিলে সব উৎসব উদযাপন করাই বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরব।

‎‎এসময় জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‎পূজাকে  ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি
  • নুরুল হকের ওপর হামলার ঘটনায় জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন
  • ১৭ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ, নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই হাজার সদস্য
  • ফরিদপুরে অবরোধ শনিবার পর্যন্ত স্থগিত
  • আসন্ন নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নির্দেশ ডিএমপি কমিশনারের