বাংলাদেশে ‘সিনক্রিটিজম’ বা সমন্বয়বাদের প্রভাব, বিশেষত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঐতিহ্য ও সমসাময়িকতার অনন্য সংমিশ্রণ তুলে ধরে। সিনক্রিটিজম বলতে বিভিন্ন ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিশ্বাসের মেলবন্ধন বোঝায়, যা আমাদের অঞ্চলে বহু শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে। এই সমন্বয়বাদের বিপরীতমুখী প্রবণতায় সংঘাতের চিত্রও আমরা দেখতে পাই; রামু সহিংসতা (২০১২), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হামলা (২০১৬), পূজামণ্ডপে হামলা ও সহিংসতা (২০২১), শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হামলা (২০১৫), ভাস্কর্য বিতর্ক (২০২০), বিভিন্ন মাজার ও ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা (২০২৪-২৫)।
বাংলাদেশের মাটি বহুমুখী সংস্কৃতি ও ধর্মের মিলনস্থল। বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম সংস্কৃতি এ অঞ্চলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বাউল ও সুফিবাদ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সমন্বয়ের ভিত্তি তৈরি করেছে। এই সংস্কৃতির মূলে রয়েছে মানবিকতা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের অমলিন চেতনা। এর বাইরেও বিভিন্ন আঞ্চলিক উৎসব যেমন নবান্ন, পৌষ সংক্রান্তি, বৈশাখী উদযাপনেও বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ দেখা যায়। এ ধরনের সমন্বিত উৎসব সমাজে সহনশীলতা ও স্থানীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করে।
বাংলাদেশে সিনক্রিটিজম সহজিয়া ও রক্ষণশীল ধারার মধ্যে সমন্বয় করতে চায়। সহজিয়া ধারা মূলত লোকজ, প্রাকৃত ও সহজ সাধনার পথে পরিচালিত আধ্যাত্মিক ও সামাজিক দর্শন, যেখানে আচারবিধির চেয়ে মানবিক সম্পর্ক, সমন্বয় ও সরলতায় জোর দেওয়া হয়। এটি কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের সীমার মধ্যে বাঁধা থাকে না। অন্যদিকে, রক্ষণশীল দর্শনে ধর্মীয় শুদ্ধতা, নিয়মানুবর্তিতা, সামাজিক আচারকে কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। এই ধারা বিশেষত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্প্রদায়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
এ দুই ধারার মধ্যকার মৌলিক সংঘাত একসময় সমন্বয়েও রূপ নিতে পারে। সহজিয়া ধারা যেমন রক্ষণশীল সমাজকে নমনীয় করে তুলতে পারে, তেমনই রক্ষণশীলতাও সহজিয়াকে কাঠামোগত স্থিতিশীলতা দিতে পারে। বাংলাদেশের লোকায়ত ও ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিতে এ দুই ধারার সহাবস্থান সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখে। সহজিয়া-রক্ষণশীল ধারা দুটির মিশ্রণে যে সিনক্রিটিজমের প্রকাশ ঘটে, তা অনেক সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিরোধ ও সংহতির দ্বৈত চেহারা সৃষ্টি করে। যেমন স্থানীয় বিভিন্ন উৎসব বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে কিছু অংশ সহজিয়া পথ মেনে চলে, কিছু অংশ রক্ষণশীলতায় গুরুত্ব দেয়।
বিগত কয়েক দশকে, বাংলাদেশে সিনক্রিটিজম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। অনেক রাজনৈতিক শক্তি ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সিনক্রিটিজম ধারা প্রচার করে; কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে প্রায়শ বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যানারে একদিকে যেমন বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ঐক্যের কথা বলা হয়, অন্যদিকে ক্ষমতা ধরে রাখতে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার স্থানকে সংকুচিত করা হয়। আবার কিছু রাজনৈতিক দল একদিকে ধর্মীয় সংহতির কথা বলে, অন্যদিকে কিছু অংশকে প্রান্তিকীকরণ বা নিপীড়নের মাধ্যমে অন্য অংশের সমর্থন আদায়ে কৌশল গ্রহণ করে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে হামলা বা নিপীড়ন ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক কৌশল এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে সিনক্রিটিজম ধারণা, যা মূলত ঐক্যের জন্যই ছিল, এক ধরনের বিভ্রান্তিকর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সিনক্রিটিজমের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো মানবিকতা ও সহনশীলতা। ধর্ম ও সংস্কৃতির মিশ্রণে সমাজের মধ্যে উদারতার চর্চা গড়ে ওঠে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষের মধ্যে গভীর সম্প্রীতি গড়ে তোলে। আজকের বাংলাদেশে যেখানে বিভাজনের রাজনীতি প্রকট; সিনক্রিটিজমের ইতিবাচক প্রভাব সমাজে প্রশান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে।
যদিও সিনক্রিটিজম ধারণাটি মূলত সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, এর অপব্যবহারের কারণেও সমাজে সংকট দেখা দিতে পারে। রাজনৈতিক শক্তিগুলো প্রায়শ সিনক্রিটিজমের আড়ালে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগায়। বিশেষ করে সামাজিক অস্থিরতার সময়ে এই প্রবণতা অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা কিংবা মিথ্যাচারের মাধ্যমে তাদের অধিকারে আঘাত করা হয়। এসব ক্ষেত্রে সিনক্রিটিজমের ধারণাটি ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়, যেখানে ধর্মীয় সহনশীলতার বদলে কেবল বিভাজন ও দখলদারি নীতি কার্যকর থাকে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হতে পারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চালানো কিছু হামলা। এসবে রাজনৈতিক ইন্ধনের অভিযোগ আছে। এমন অনেক ঘটনায় রাজনীতির নামে ধর্মীয় সহিংসতার প্রবণতা বেড়েছে।
বাংলাদেশে সিনক্রিটিজমের রাজনীতি ইতিহাস এবং সামাজিক পরিসরে প্রভাবিত এক জটিল প্রেক্ষাপটকে নির্দেশ করে। দেশের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য সিনক্রিটিজমের একটি প্রাকৃতিক সংমিশ্রণ হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়ের একটি অংশ। তবে রাজনীতির এই প্রভাব অনেক সময় ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও মেলবন্ধনের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত এবং এক ধরনের বিভ্রান্তিকর পরিবেশ তৈরি করে।
সিনক্রিটিজমের প্রকৃত সৌন্দর্য বুঝতে হলে আমাদের প্রতিটি ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমাদের সমাজে এই ধারণা যদি সহনশীলতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে শক্তিশালী ও সংহত জাতি গড়ে তুলতে পারব। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক এবং সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা, যাতে সিনক্রিটিজমের মিশ্রণকে শুধু রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নয় বরং সামাজিক সমন্বয়ের মাধ্যম হিসেবে দেখা যায়। সিনক্রিটিজমের এই রাজনীতি শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি আমাদের সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারে, যেখানে সংহতি, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা সমাজকে আরও মজবুত করে তুলবে।
রিমেল সরকার: সংগীতশিল্পী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক প রবণত আম দ র সহজ য ব যবহ সমন ব ধরন র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
কারা বেশি কাঁদেন?
কান্না একটি এমন একটি স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর মানসিক প্রক্রিয়া যা শরীরকে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ‘‘যারা বেশি কাঁদেন তাদের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এর কারণ কখনও মানসিক কখনও শারীরিক আবার কখনও পারিপার্শ্বিক বিষয়।’’ বেশি কান্না করা মানুষের আচরণে বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
উচ্চ মানসিক সংবেদনশীলতা
এই ব্যক্তিরা সাধারণত অন্যের আবেগ ও অনুভূতি খুব সহজেই বুঝতে পারেন এবং গভীরভাবে অনুভব করেন। সামান্য ঘটনায় তারা বেশি প্রভাবিত হন।
আরো পড়ুন:
যেসব কারণে মানুষ স্বর্ণ জমায়
বিশ্বে কারা বেশি পড়েন, কোন বই বেশি পড়েন?
সহানুভূতির প্রবণতা
যাদের মধ্যে সহানুভূতির মাত্রা বেশি, তারা প্রায়শই বেশি কাঁদেন। তারা নিজেদের পাশাপাশি অন্যের কষ্টেও সহজে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
মানসিক চাপ বা বিষণ্নতা
দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা বিষণ্নতার কারণে মানুষ বেশি কাঁদতে পারে। কান্না এক্ষেত্রে জমে থাকা মানসিক চাপ কমানোর একটি উপায় হিসেবে কাজ করে।
হরমোনের প্রভাব
হরমোনের তারতম্য, বিশেষ করে নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে, কান্নার প্রবণতাকে প্রভাবিত করতে পারে। ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের মতো হরমোনের মাত্রা কান্নার সাথে সম্পর্কিত।
অতীত অভিজ্ঞতা
অতীতের কোনো দুঃখজনক বা আঘাতমূলক ঘটনা মানুষের মধ্যে সহজে কেঁদে ফেলার প্রবণতা তৈরি করতে পারে।
যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কান্না
কিছু মানুষের জন্য কান্না হল নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করার একটি উপায়, কারণ তারা হয়তো কথা বলে তা প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
উল্লেখ্য, যদি অতিরিক্ত কান্না দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে বা বিষণ্নতার লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়, তাহলে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ঢাকা/লিপি