কক্সবাজারে সমুদ্র উপকূলে পেতে রাখা জালে আটকে পড়ে মারা যাচ্ছে গভীর সাগর থেকে সৈকতে ডিম পাড়তে আসা মা কাছিম। একটি বেসরকারি সংগঠনের তথ্যমতে, গত আড়াই মাসে সৈকতের ৫০টির বেশি পয়েন্টে ভেসে এসেছে ২৪০টির বেশি মা কাছিম। সব কটি অলিভ রিডলে প্রজাতির। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ও পেটে ডিম ছিল।

সরেজমিন চিত্র

সম্প্রতি কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, একটি মরা কাছিম ভেসে এসেছে। কাছিমের পেছনে একটি পা নেই। মাথাতেও আঘাতের চিহ্ন। কয়েকটি কুকুর মরা কাছিম নিয়ে টানাটানি করছে। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় পরে মরা কাছিমটি বালুচরে পুঁতে ফেলেন স্থানীয় জেলেরা।

নাজিরারটেক এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন (৪৫) বলেন, প্রতিদিন নাজিরারটেক থেকে সমিতিপাড়া পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সৈকতে এক–দুটি করে মরা কাছিম ভেসে আসতে দেখা যায়। মৃত কাছিমগুলো কুকুর খেয়ে ফেলে। আর কিছু কাছিম বালুতে পুঁতে ফেলেন স্থানীয় লোকজন।

১ কিলোমিটারে ৩টি মৃত কাছিম

সৈকতে ভেসে আসা মরা কাছিমের তথ্য সংগ্রহ করেন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের কর্মীরা। গত আড়াই মাসে মহেশখালীর সোনাদিয়া থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার সৈকতে ২৪০টির মতো মরা কাছিম ভেসে আসার তথ্য জানান সংগঠনটির সভাপতি দীপক শর্মা। তিনি বলেন, আগে সোনাদিয়া, কলাতলী, টেকনাফের বাহারছড়া ও সেন্ট মার্টিনে মরা কাছিম ভেসে আসত। এখন পর্যটকে জমজমাট থাকা সুগন্ধা, লাবণী ও কলাতলী পয়েন্টেও মরা কাছিম ভেসে আসছে। সৈকতজুড়ে মরা কাছিম পড়ে আছে। প্রতি এক কিলোমিটারে তিনটি করে মরা কাছিম ভেসে আসছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ মরা কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন এবং পেটে ডিম দেখা গেছে। কিন্তু কী কারণে এবং কীভাবে কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই।

সংগঠনটির তথ্যমতে, গত জানুয়ারি মাসে ১৩৫টি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৮৭টি মরা কাছিম সৈকতে ভেসে আসে।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গবেষণার কাজে সেন্ট মার্টিনে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ চৌধুরী। ওই দিন তিনি সেন্ট মার্টিন সৈকতে দুটি মরা কাছিম ভেসে আসতে দেখেন। তিনি বলেন, কাছিমের শরীরে ছেঁড়া জাল ও রশি মোড়ানো ছিল। অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা কারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মা কাছিমের ডিম পাড়তে আসার উপস্থিতি অনেক কমেছে।

এত কাছিমের মৃত্যুর কারণ

সমুদ্র উপকূলে মাছ ধরে ৬৫ হাজারের বেশি ট্রলার। বেশির ভাগ ট্রলারেই ফাঁসজাল ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই শ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার আছে, যারা গভীর সাগরে ট্রল নেট (টানা জাল) দিয়ে মাছ ধরে। কাছিম নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, গভীর সমুদ্র থেকে উপকূলের দিকে ডিম দিতে আসার সময় ট্রল নেটে আটকে পড়ে মা কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে। এ ছাড়া জাহাজ বা ট্রলারের আনাগোনা বাড়ার কারণে প্রপেলার কিংবা অন্য কিছুর ধাক্কায় আঘাত পায় কাছিম। এর পাশাপাশি অন্য প্রজাতি, বিশেষ করে হাঙরের মতো জলজ প্রাণীর আক্রমণ কিংবা দূষণের কারণেও কাছিম মারা যেতে পারে। এ নিয়ে গবেষণা দরকার। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস অলভি রিডলে কাছিমের ডিম পাড়ার সময়।

সাগরে নিষিদ্ধ জালে আটকে পড়ে বহু কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক মো.

জমির উদ্দিন। তবে এখন পর্যন্ত কতটি মরা কাছিম সৈকতে ভেসে এসেছে, তার পরিসংখ্যান তাঁর দপ্তরে নেই।

সৈকত থেকে কাছিমের পাড়া ডিম সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে সংরক্ষণের মাধ্যমে বাচ্চা ফোটানোর কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম)। নেকমের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম বলেন, ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে কক্সবাজার সৈকতে মা কাছিমের ডিম পাড়া শুরু হয়েছে। কিন্তু সাগরের যত্রতত্র পুঁতে রাখা নিষিদ্ধ বিহিন্দি, ফাঁস ও কারেন্ট জালে আটকে পড়ে অসংখ্য মা কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে। ১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আড়াই মাসে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ১৩০টির বেশি মরা কাছিম ভেসে আসার তথ্য তাঁদের কাছে আছে।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিমুল ভূঁইয়া জানান, গত ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি দুই দিনে সৈকতে ভেসে এসেছিল ৬৮টি মরা কাছিম।

পেটে ডিম থাকে বলে হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ছুটে আসা মা কাছিম ক্লান্ত থাকে। সামান্য আঘাতে কাছিমের মৃত্যু ঘটে। প্রজনন মৌসুমে বিপুলসংখ্যক কাছিমের মৃত্যু উদ্বেগের উল্লেখ করে নেকমের উপপ্রকল্প পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, দিন দিন ডিম পাড়ার জায়গা সংকোচিত হয়ে পড়ছে।

সৈকতে ভেসে আসা বেশির ভাগ মরা কাছিম ও কাছিমের ডিম কুকুর ও গুইসাপ খেয়ে ফেলছে দাবি করে দীপক শর্মা বলেন, কক্সবাজার উপকূলের দেশি-বিদেশি কয়েক হাজার ট্রলার মাছ শিকার করছে নিষিদ্ধ ফাঁদজাল দিয়ে। এসব জালে আটকে পড়লে বাঁচার উপায় থাকে না সমুদ্র পরিবেশ রক্ষার ঝাড়ুদার হিসেবে পরিচিত শত শত মা কাছিমের। এ বিষয়ে জেলেদের সচেতন করার কোনো কর্মসূচি চোখে পড়ে না। সামুদ্রিক কাছিমের সুরক্ষার নামে বেসরকারি কয়েকটি সংস্থা বালুচর থেকে কাছিমের ডিম সংগ্রহ এবং ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর প্রজননব্যবস্থা চালু রাখলেও মা কাছিমের মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।

তবে জালে আটকে পড়লে আঘাত না করে কাছিম ছেড়ে দিতে ট্রলারের জেলেদের নির্দেশনা দেওয়া আছে বলে দাবি কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের। তিনি বলেন, এরপরও কেন মা কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান দরকার।

বিলুপ্তির পথে অলিড রিডলে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ চৌধুরী বলেন, ১০ থেকে ১২ বছর আগেও গভীর সমুদ্র থেকে দল বেঁধে এই সৈকতে এসে ডিম পাড়ত হক্সবিল, গ্রিন টার্টল ও অলিভ রিডলে—এই তিন প্রজাতির কাছিম। কয়েক বছর ধরে হক্সবিল ও গ্রিন টার্টল আর ডিম পাড়তে আসছে না। দুই বছর ধরে অলিভ রিডলের ডিম পাড়তে আসার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।

মেরিন বায়োলজিস্ট আবদুল কাইয়ুম বলেন, নির্জন সৈকতে কচ্ছপ ডিম দিতে আসে। নানা কারণে ডিম দেওয়ার স্থানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পর্যটনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি সৈকতে আলোকসজ্জা, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়া, ডিম ছাড়ার মৌসুমে বিচ ডাইভিং, খেলাধুলা, সৈকতে হাঁটা ইত্যাদি কচ্ছপের ডিম দেওয়ার পরিবেশ নষ্ট করছে।

গত বছরের ১৮ মার্চ উখিয়ার ছেপটখালী সৈকত থেকে বুকে ‘চিপট্যাগ’ (শনাক্তকরণ যন্ত্র) লাগিয়ে সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল অলিভ রিডলে প্রজাতির দুটি মা কাছিমকে। চিপট্যাগ লাগানোর উদ্দেশ্য ছিল পরের বছর প্রজনন মৌসুমে কাছিম দুটি একই সৈকতে ডিম পাড়তে আসে কি না এবং প্রতি বছর কী পরিমাণ কাছিম সৈকতে ডিম পাড়তে আসে, তা দেখা ও তথ্য সংগ্রহ করা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, ওই কাছিম দুটির খোঁজ নেই।

এর আগে ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন দফায় তিনটি অলিভ রিডলে মা কাছিমের পিঠে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে সাগরে অবমুক্ত করা হয়েছিল। উর্মি, বাসন্তী ও সাগরকন্যা নামের কাছিমগুলোর বিষয়েও কোনো তথ্য জানা যায়নি।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর ব শ র স কত উপক ল ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে

দেশের মোট শ্রমিকের ৮৪ দশমিক ১ শতাংশের কোনো দায়দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র । শ্রমিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। কোনো রকম আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নেই। কর্মস্থলের পরিচয়পত্র নেই। কাজের ক্ষেত্রে অন্যায়ের শিকার হলে তাদের শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী,  অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার।

বিশালসংখ্যক শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রের এ রকম অবহেলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত ২১ এপ্রিল পেশ করা কমিশনের ২৫ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। 

দেশের শ্রম খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত ১৯ সদস্যের কমিশনপ্রধান ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। জানতে চাইলে গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। শ্রম আইনে অন্য সব শ্রমিকের মতো একই অধিকার এবং সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের জন্য ভাতার কথা বলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের জন্য এ সুবিধার সুপারিশ করা হয়নি। কারণ, তারা চাকরি শেষে কমবেশি কিছু আর্থিক সুবিধা পান।’ 

কমিশনের এ সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে নিয়মিত নজরদারি রাখার কথাও জানান তিনি। 

এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার মহান শ্রমিক দিবস পালন করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি থাকবে। এ দিনও কাজ করতে হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দিবসটি পালনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’। 

বিবিএসের গত নভেম্বরে প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার। তাদের মধ্যে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তির ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। 

দেশে শ্রমশক্তি বলতে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে যারা কর্মে নিয়োজিত এবং বেকার জনগোষ্ঠীর সমষ্টিকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা সাত দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টার বেতন, মজুরি বা মুনাফার বিনিময় অথবা পরিবারের নিজস্ব ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদনের কাজ করেছেন জরিপে তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার যারা কর্মক্ষম কিন্তু কোনো কাজে নিয়োজিত নন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ খুঁজে বেড়ান এবং ওই সময়ে কাজের সুযোগ পেলে সে কাজ করতে প্রস্তুত তাদের বেকার বলা হয়েছে। এ হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লাখ ৬০ হাজার। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক কারা 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা–আইএলওর আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদের সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্ট্যাটিসিয়ান্স–আইসিএলসির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেসরকারি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা খানামালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যেগুলোর আইনি সত্তা নেই, পরিপূর্ণ হিসাব নেই, উৎপাদনের হিসাব দিতে হয় না এবং বেসরকারি ও অনিবন্ধিত–এরকম খাতকে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতের শ্রমিকদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বলা হয়। 

মূলত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বেশি। কৃষিতে ৯৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। শিল্প খাতে ৮২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের বড় অংশই গ্রামে থাকেন। 

বিবিএস বলছে, গ্রামের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সংখ্যায় তারা ৪ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার। শহরের শ্রমিকদের এ হার কিছুটা কম। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় এক কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। নারী শ্রমিকদের ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকেন।

শ্রম আইনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ কমিশনের 

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহশ্রমিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য শ্রম আইনে সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র, নিরবচ্ছিন্ন কাজ এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, এসব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা হিসেবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলাদা অফিস অথবা ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সব ধরনের তথ্য নিয়ে তথ্যভান্ডার করা, পরিচয়পত্র দেওয়া এবং অবসর ভাতা চালুসহ বেশ কিছু সুপারিশ করে কমিশন। 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রবীণ শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতার সুপারিশ 

রাষ্ট্রের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা। অবসরের পরও কিছু সুবিধা পান তারা। তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা সারা জীবন খাটুনির পর প্রবীণ বয়সে আরও কষ্টে থাকেন। কারণ সামান্যতম কোনো সুবিধা পান না তারা। এ বিবেচনা থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য অসরকালীন ভাতা বা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণের কথা বলা হয় এতে। দরিদ্র বেকার শ্রমিকদের বয়স্কভাতা এবং তাদের প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও অন্যান্য চাহিদা বিবেচনায় বয়স্কভাতার পরিমাণ নির্ধারণের কথা বলেছে কমিশন। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের পেশা ও খাত অনুযায়ী সংগঠিত হওয়া, প্রতিনিধিত্ব করা ও নিয়োগকারী, তাদের সমিতি করার সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে। 

প্রাতিষ্ঠানিকের ৫৫ খাতেও ন্যূনতম মজুরি নেই 

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। এখনও অনেক শিল্প খাতকে ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। মালিকপক্ষ যা দেয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এরকম অন্তত ৫৫টি খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়নি। 

শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের স্বীকৃত শিল্প আছে ১০২টি। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের মজুরি বোর্ড হয় সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে। অর্থাৎ, গত তিন যুগ ধরে একই মজুরি চলছে এ খাতে। জানতে চাইলে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম গতকাল সমকালকে বলেন, ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪৭টি শিল্প রয়েছে। নতুন করে দুটি শিল্পকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা হবে। আরও ২০ শিল্পকে এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি পুনঃনির্ধারণে বোর্ড গঠন হয়েছে। মালিক পক্ষ এ-সংক্রান্ত সভায় আসছে না। এ অবস্থায় করণীয় জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চেয়েছে মজুরি বোর্ড। 

টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে তিন যুগ ধরে একই মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা ইসলাম বলেন, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের আর অস্তিত্ব নেই। খাতটি হয়তো বিলুপ্ত ঘোষণা করা হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ