শুক্রবার প্রথম আলো অনলাইনে একজন পাঠকের মন্তব্য দিয়েই লেখাটি শুরু করি। তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ নিরাপত্তাহীন ও আতঙ্কিত বোধ করছে। কেউ কথা বলে না। কারণ, তারা এই “হিংস্র জনতার” মুখোমুখি হতে ভয় পায়। সাংবাদিকেরা চুপ হয়ে গেছে, এমনকি নিজেদের রক্ষা করতেও ভয় পেয়েছে। সবাই নিরাপদে থাকার জায়গা খুঁজছে। ভাবছি, লেখক-সাংবাদিকদের কী হয়েছে? কোথায় মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা? তারা সবাই নিশ্চুপ থাকে।’

প্রথমেই পরিষ্কার করে নিই পাঠক যাদের ‘হিংস্র জনতা’ বলছেন, তারা আসলে জনতা নয়, সংঘবদ্ধ অপরাধী। আইনের প্রতি অনুগত মানুষ একত্র হলে আমরা তাদের জনতা বলি। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে যখন কিছু ব্যক্তি পরিকল্পিতভাবে অপরাধ সংঘটিত করে, ব্যক্তি বা স্থাপনায় হামলা করে, তখন তারা জনতা থাকে না, অপরাধী হয়।

যেকোনো সমাজ বা রাষ্ট্র টিকে থাকে কতগুলো মৌলিক নীতি ও আদর্শের ওপর। সেখানে কেউ কারও ওপর হস্তক্ষেপ করবে না, একজন অপরজনের ওপর মত চাপিয়ে দেবে না। দিলে সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। যদি সরকার ব্যর্থ হয়, নৈরাজ্য তৈরি হয়। মানুষ আতঙ্কিত বোধ করে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে মব ভায়োলেন্সে অন্তত ১১৪টি ঘটনায় ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আইনের শাসন থাকলে এটি হওয়ার কথা নয়। 

আওয়ামী লীগের আমলে যখন মব ভায়োলেন্স বা আইনশৃঙ্লা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে কথা উঠত, তখন ক্ষমতাসীনেরা পাত্তা দিতেন না। বলতেন, ‘সাংবাদিকদের চোখ খারাপ’ বলে ভালো কিছু দেখতে পায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কেউ কেউ এ রকম দোহাই দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেন, গত ১৫ বছর নিশ্চুপ ছিলেন কেন? এটাও নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার কৌশল। চেয়ারের মানুষ বদলায়, চরিত্র বদলায় না।  

সাম্প্রতিক কালের কয়েকটি উদাহরণ দিলেই মব ভায়োলেন্স কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা বোঝা যাবে। গত সপ্তাহে গুলশানে ৮৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে প্রচুর অবৈধ অস্ত্র, কোটি কোটি টাকা ও আওয়ামী লীগের দোসররা পালিয়ে আছেন বলে গুজব ছড়িয়ে মধ্যরাতে দুর্বৃত্তরা অভিযান চালাল; এর আগে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ডাকাত পড়েছে বলে দুই ব্যক্তিকে হত্যা করা হলো; লালমাটিয়ায় ধূমপানকে কেন্দ্র করে বাগ্‌বিতণ্ডায় দুই নারীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হলো। কিন্তু এসব ঘটনায় সরকারকে তেমন উদ্বিগ্ন হতে দেখি না। 

অপারেশন ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১০ সহস্রাধিক। এরপরও অপরাধীরা কেন বেপরোয়া, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। মব ভায়োলেন্সের ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও পরিষ্কার নয়। আইনের ভাষায় যারা অপরাধ করবে, তারাই ডেভিল। কিন্তু সরকার কোনো কোনো ডেভিলকে ধরেছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেও না দেখার ভান করছে। বিভিন্ন স্থানে যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, যারা অন্যের বাড়ি দোকান–অফিস, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ঘাট ইত্যাদি দখল করে আছে, তাদের বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। 

আরও পড়ুননারীকে দমন–পীড়নের নতুন পন্থা, কোনো সমাধান নেই? ৬ ঘণ্টা আগে

এর সঙ্গে পেশাদার অপরাধীরাও যুক্ত হয়েছে কিংবা কারও রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অপরাধ দমনে সরকারের ভূমিকা প্রধান হলেও নাগরিকদেরও দায় আছে। সরকার তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। কিন্তু আমরা নাগরিকেরাই কি দায়িত্ব পালন করছি?

যখন কোথাও মব হয়, নারীকে হেনস্তা করা হয়, নাগরিকদের দায়িত্ব আক্রান্তের পাশে দাঁড়ানো ও আক্রমণকারীকে আইনের হাতে সোপর্দ করা। কিন্তু অনেক ঘটনায় নাগরিকেরাই আইন নিজের হাতে তুলে নেন। লালমাটিয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করা যায়। দুই তরুণীকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যে মন্তব্য করেছেন, তা অত্যন্ত আপত্তিকর। একদিকে তিনি দুই তরুণীর প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁদের যাঁরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করলেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছু বললেন না।

আরেক উপদেষ্টা বলেছেন, সেখানে আপসরফা হয়ে গেছে। কিসের আপসরফা? দুই তরুণী যেভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন, সে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এভাবে নারীকে হেনস্তাকারীকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যায় না। ওই নারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে বিধি মোতাবেক সেটিরও ব্যবস্থা নেওয়া যেত। তা নিশ্চিত করাই তো স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব, আপসরফা করা তো তাঁর কাজ নয়।  

আবার আসি পাঠক বন্ধুর শেষ মন্তব্যে। যে সমাজে সাংবাদিকেরা নিশ্চুপ থাকেন, মানবাধিকারকর্মীরা অন্যায়কে মুখ বুজে মেনে নেন, সে সমাজে মব সংস্কৃতিই জোরালো হয়। কেবল সাধারণ মানুষ নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এর সংস্কৃতির শিকার হন।  প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গত ছয় মাসে পুলিশের ওপর ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। 

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানা এলাকার আউটার রিং রোডে এক পুলিশ সদস্যের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে দেখা যায়, হামলা করে এসআই ইউসুফ আলীর পোশাক ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। অসহায় অবস্থায় অঝোরে কাঁদছেন তিনি। গত সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘যখন পুলিশের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে, তখন আর আবেগ ধরে রাখতে পারিনি, কেঁদে ফেলেছি।’

যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মব থেকে রেহাই পান না, তখন সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে, কার কাছে প্রতিকার চাইবে? 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: মব ভ য় ল ন স প রথম আল সরক র র আইন র অপর ধ র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচনের রোডম্যাপে কবে যাত্রা শুরু করবে বাংলাদেশ

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে মাস দেড়েক আগে বলা হয়েছিল, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। এ দেশে গত ১৫ বছরে সতি্যকার অর্থে কোনো নির্বাচন হয়নি। নির্বাচন না থাকার কারণেই স্বৈরাচারী শাসন চেপে বসতে পেরেছিল।

নাগরিক কোয়ালিশনও অনেক আগেই নির্বাচনের জন্য ‘ফেব্রুয়ারি রোডম্যাপ’ দিয়েছিল। কিন্তু সরকার থেকে এখনো কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। এদিকে জোর গুজব উঠেছে, আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু তারিখ বললেই কি নির্বাচন হয়?

২.

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা অনুযায়ী আমরা কি আদৌ কিছু শুরু করতে পেরেছি, নাকি আবারও সেই পুরোনো অভ্যাস, অর্থাৎ সময়ক্ষেপণ, সন্দেহ আর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য অব্যাহত রয়েছে? বাস্তবতা হচ্ছে, গত ১৩ জুন লন্ডনে তারেক রহমান ও সরকারপ্রধানের বৈঠক হলেও এরপর আর কোনো গঠনমূলক অগ্রগতি নেই।

অনেকেই ভাবছেন, নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট সময় হাতে আছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন মানে হাতে তেমন সময় নেই। বাস্তবতা হলো, সরকার যদি সত্যিই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে চায়, তাহলে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই বড় সিদ্ধান্তগুলো চূড়ান্ত করতে হবে। আর তা করতে হলে এখন থেকেই খুব জোরেশোরে কাজ শুরু করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানেই নিয়ন্ত্রিত প্রহসন। এ জন্য আমাদের হাতে যেসব কাজ রয়েছে: 

ক. ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কারের জন্য জুলাই চার্টার।

খ. নির্বাচন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য ন্যূনতম সংস্কারসহ নতুন আইন প্রণয়ন।

গ. ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ।

ঘ. নির্বাচন কমিশনের মাঠপর্যায়ে প্রস্তুতি। এর মধ্যে আছে অমোচনীয় কালিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের বিশাল ক্রয়াদেশ এবং লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা।

এই কাজগুলো সময়মতো না হলে তারিখ শুধু ক্যালেন্ডারের পাতায় লেখা থাকবে; নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হতে পারে; গণতন্ত্র ফিরবে না। এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে তা দেশকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।

৩.

এ স্থিতাবস্থার প্রথম কারণ ঐকমত্যের ঘাটতি। অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, এনসিপি, জামায়াত—সব পক্ষই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে সন্দেহের চোখে। সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে গত বছরের জুলাইয়ে আন্দোলন করলেও এখন তাদের সবার পথ আলাদা। সংস্কার নিয়ে সবার আলাদা মত।

নাগরিক কোয়ালিশনের মূল যেসব প্রস্তাব ছিল, তার মধ্যে উচ্চকক্ষে আনুপাতিক বণ্টন নিয়ে বিএনপিসহ দু–একটি দল ছাড়া আর সবার মধ্যে স্পষ্ট মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একেকজন একেক রকম মত দিচ্ছে।

অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে যদিও সবাই একমত হয়েছে, এরপরও নারী আসনে সরাসরি ভোট নিয়ে এখনো কোনো পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নেই। নিরপেক্ষ নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে এখনো আলোচনা এগোচ্ছে না।

নাগরিক কোয়ালিশনের ৭ দফা সংস্কার প্রস্তাব ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের জন্যই প্রয়োজনীয় ছিল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে আবার তা বিবেচনা করার অনুরোধ রইল।

৪.

এদিকে কোনো রাজনৈতিক দলই নিজেদের দলীয় বা অভ্যন্তরীণ সংস্কারের কাজ শুরু করেনি। এত সব ডামাডোলে তা হারিয়েই যাচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজনীতি করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে, নতুন রাজনীতির নিজ নিজ দলকে উপযোগী করে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে।

 এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বললেও প্রশাসন এখনো ‘ধীরে চলো’ নীতিতে আছে। নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তি ও তালিকা হালনাগাদ খুব ধীরগতিতে চলছে।

এই অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেটে নির্বাচন কমিশন ২ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। এর মধ্যে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করতেই ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা খরচ হবে, যা ২০২৪ সালের নির্বাচনের খরচের প্রায় কাছাকাছি। বাজেট বরাদ্দ হলেও কাজে গতি নেই। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে আস্থা পাচ্ছে না।

২০২৪ সালের নির্বাচনে পুলিশ, র‍্যাব, আনসার, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাড়ে ছয় লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন আমাদের পুলিশ কি প্রস্তুত? গোপালগঞ্জের অবস্থা দেখে এ প্রশ্নের উত্তর মনে হয় সবাই জেনে গেছেন।

পত্রিকায় এসেছে, গাড়ির অভাবে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের প্যাট্রোলিং ব্যাহত হচ্ছে। এই গাড়িগুলো কবে কেনা হবে? ২০২৪ সালে নির্বাচনের জন্য শুধু পুলিশের জন্যই বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। এবার কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে, সেটা এখনো জানা যায়নি।

এবার নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি বুথে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি, রাতে পাহারা এবং বিস্ফোরণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২ লাখ ১০ হাজারের বেশি বুথে এই সিসিটিভি ক্যামেরার আয়োজন বিশাল কর্মযজ্ঞের ব্যাপার।

এ ছাড়া নির্বাচনের জন্য অমোচনীয় কালি থেকে শুরু করে বিশালসংখ্যক স্টেশনারি পণ্য প্রয়োজন হয়, টেন্ডারের মাধ্যমে কিনতে বেশ কয়েক মাস সময় লাগে। কিন্তু এসবের জন্য এখনো কোনো টেন্ডারের প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। এগুলো ছোটখাটো ব্যাপার হলেও অত্যাবশ্যকীয় এবং সময়সাপেক্ষ।

৫.

এদিকে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে নির্বাচন কমিশন কাজ করছে। তাঁদের বিবেচনায় রাখলে দেশের বাইরে প্রায় দুই কোটি ভোটার আছেন। নির্বাচনে কোন পদ্ধতিতে তাঁদের করা যুক্ত হবে কিংবা এত কম সময়ে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশে থাকা আমাদের দূতাবাসগুলোর আরও গতিশীলতা দরকার।

 এদিকে সীমানা নির্ধারণ এখনো ঝুলে আছে। কোন এলাকা কোন আসনে পড়বে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। ব্যাপারটি ঠিক না হলে প্রার্থীরা প্রস্তুতি নেবেন কীভাবে? সীমানা ঠিক না করে নির্বাচনের ঘোড়া ছুটিয়ে লাভ নেই।

প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ায় নির্বাচন মানে প্রায় বছরব্যাপী প্রস্তুতির একটি প্রক্রিয়া। এদিকে ঘোষিত সময় থেকে মাত্র সাত মাস আগে বাংলাদেশে এখনো আইনকানুন আর সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা চলছে।

তবে ব্যয়ের দিক থেকে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ করতে যাচ্ছি। ভারতের তুলনায় জনপ্রতি প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। কিন্তু এই খরচ জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারছে না।

৬.

আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু দেশের মানুষ নয়, আন্তর্জাতিক মহলও। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ভারত, চীন—সবাই বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা চায়। কিন্তু স্থিতিশীলতা মানে শুধু একটি নিয়ম রক্ষার ভোট নয়। সংস্কার আর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে এ নির্বাচনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন হবে। আমরা যদি নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান না করি, বাইরের চাপ আরও বাড়বে।

এদিকে মানুষের মধ্যে  হতাশা বাড়ছে। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। তারা ভেবেছিল, এবার কিছু বদলাবে। কিন্তু এখন দেখছে আবারও সময়ক্ষেপণ আর দোষারোপের রাজনীতি। তাদের যদি আবারও হতাশ করা হয়, তাহলে অনাস্থা আরও গভীর হবে। এটা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্যও ভয়ংকর।

এদিকে অর্থনীতিও ঝুলে আছে; নেই বড় কোনো বিনিয়োগ। যে কোটামুক্ত সরকারি চাকরির জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে দৃশ্যমান কোনো কাজ চোখে পড়ছে না। ফলে বেকারত্ব বাড়ছেই।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কাঠামোগত সংস্কারের কোনো বরাদ্দ নেই। ধারণা করা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে তবেই নতুন সরকার সংস্কারমুখী বাজেট নিতে পারবে। নতুন বিনিয়োগ আসা, আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) পরবর্তী কিস্তি পাওয়া—সবই এই সংস্কারের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু নির্বাচন দেরিতে হলে অর্থনীতিও সংকটে পড়বে।

৭.

সামনে কী হতে পারে? যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হয় এবং এ রকম অরাজকতা চলতেই থাকে, তাহলে সরকার যেকোনো সময় নির্বাচন পিছিয়ে দিতে পারে। এতে নতুন করে সংকট তৈরি হবে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় ভয়—ক্ষমতার নতুন পুনর্বিন্যাস হবে; গণতন্ত্র ফিরবে না। বিশ্বাসের সংকট আরও প্রকট হবে। সে রকম কিছু হলে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়দায়িত্ব নিতে হবে।

বিগত স্বৈরাচারী সরকার এ দেশের মানুষের মনমানসিকতা অনেকখানি বদলে ফেলেছে, যার অনেক কিছুই আমরা শুনতে পাচ্ছি। আমাদের দরকার মানুষের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, যা হতে হবে সুষ্ঠু ও অবাধ। আর তার জন্য শুধু সরকার নয়, সব দলকেই নিশ্চয়তা দিতে হবে।

এ রকম অবস্থায় বড় দলগুলোর জন্য একটি সর্বসম্মত ‘রাজনৈতিক নৈতিকতা সনদ’ প্রণয়ন করতে পারে নির্বাচন কমিশন বা নাগরিক সমাজ। এর ভিত্তিতে দলগুলোই ‘কন্ডাক্ট সেল’ করে সরকারকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে।

৮.

এখনো কিছু সময় হাতে আছে। আমরা যদি টাইমলাইন নির্ধারণ করে এবং সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে কাজ শুরু করতে না পারি, তাহলে সরকার বদলাবে ঠিকই, কিন্তু পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত পাল্টাবে না।

সেপ্টেম্বরের মধ্যেই যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হয়, সংবিধান সংস্কারের খসড়া তৈরি হয়, ভোটার তালিকা আর সীমানা নির্ধারণ শেষ হয় এবং সব দল যথাসাধ্য আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে, তাহলেই শুধু এই নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হবে।

বিগত স্বৈরাচারী রেজিম এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। তাই একটি নির্বাচনের জন্য আমাদের সবারই দায়দায়িত্ব নিতে হবে। আর যদি তা না পারি, ইতিহাস আমাদের কখনো ক্ষমা করবে না।

সুবাইল বিন আলম সদস্য, নাগরিক কোয়ালিশন

[email protected]

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ