দখলে সংকুচিত সূতিখালী নদীতে ধানের আবাদ
Published: 8th, March 2025 GMT
উত্তরাঞ্চলে এক সময়ের দুই খরস্রোতা নদী সূতিখালী ও করতোয়া। নিয়মিত পণ্য নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নৌযান চলাচল করত। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন হাজারো মানুষ। নদীর পানি সেচের পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হতো। কিন্তু দখল-দূষণে সংকুচিত হয়ে নাব্য হারিয়েছে নদী দুটি। আগের মতো মাছ মেলে না। পৌরসভার নালার সংযোগ দেওয়ায় পানি কালচে হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, আবর্জনায় হচ্ছে ভরাট। পানি না থাকায় নদীর বুকে হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ। খনন করে নদী দুটিতে নাব্য ফেরানোর দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। এরই মধ্যে একটি নদী খননের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
একসময় বাজারে সূতিখালী নদীর মাছের ব্যাপক চাহিদা ছিল। দখল-দূষণে নদী সংকুচিত হয়ে শুকিয়ে যাওয়ায় মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে কারেন্ট জালে অবাধে মা মাছ ও পোনা শিকার করায় বংশবিস্তারও ব্যাহত হচ্ছে। বেড়া উপজেলার নাজিম বাজারে ৩৫ বছর ধরে মাছ বিক্রি করা সুকান্ত হালদার বলেন, এখন অনেক জেলে অপরিচিতদের কাছে সূতিখালীর নামেই মাছ বিক্রি করেন। এতে তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যায়।
একসময়ের খরস্রোতা সূতিখালী এখন পানিশূন্য। সরু খালে পরিণত হওয়া নদীর দুই পারে চলছে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ। পাবনা জেলার একসময়ের মৎস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত খরস্রোতা নদীটি এখন মৃতপ্রায়। আগের মতো দু’কূল ভাঙা উত্তাল স্রোত নেই। তলদেশ ভরাট হয়ে দখল-দূষণে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। দেশি মাছও আর আগের মতো মেলে না।
সাঁথিয়া উপজেলা মৎস্য অফিস ও বেড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দুই উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা সূতিখালী নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ কিলোমিটার। কৃষক নদী থেকে সেচ দিয়ে ফসল ফলাতেন। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় শ্যালো মেশিন বসিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। এতে ভূগর্ভের স্তরও নেমে গেছে। ফলে ফসল উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
বেড়ার বৃশালিখা গ্রামের কৃষক হামিদুল ইসলাম বলেন, সূতিখালীর পানি ধান ও রবিশস্য আবাদে সেচে ব্যবহার করা হতো। এতে খরচ কম হতো। এখন নদীটি পলিমাটি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় আগের মতো পানি পাওয়া যায় না।
বর্তমানে সূতিখালী নদীর একাংশ পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের পানি নিষ্কাশন খাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। পানির অভাবে নদীটি বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় থাকে পানিশূন্য। এতে জীববৈচিত্র্য, মৎস্য, কৃষি অর্থনীতি, নৌ-যোগাযোগ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সাঁথিয়া উপজেলার সোনাতলা গ্রামের কাছে ইছামতী নদী থেকে উৎপত্তি সূতিখালী নদীর। দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে একটি ধারা পশ্চিমে ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহরের ওপর দিয়ে চলনবিলে মিলিত হয়েছে।
অপর ধারাটি পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে বেড়া উপজেলার অধিননগরে হুড়াসাগর নদে মিলেছে। এদিকে ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর অংশের সূতিখালী নদীর প্রায় পুরোটাই দখল হয়ে গেছে। সাঁথিয়া ও বেড়া অংশ দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। অথচ একসময় দেশি মাছের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে পুঁটি, চাপিলা, মাগুর, ট্যাংরা, কৈসহ প্রায় সব ধরনের দেশি মাছ পাওয়া যেত।
বেড়া পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম বলেন, সূতিখালী নদী খননের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সারাদেশে (৬৪ জেলা) খাল খনন প্রকল্প ফেজ টু-তে আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন হলে খননকাজ শুরু হবে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ভিসা ও প্রযুক্তি দিয়ে আসিয়ানে সংযোগ বাড়াচ্ছে চীন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের সদস্যরা এখনও মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকা। এসব দেশে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ কম থাকায় গবেষণা ও উন্নয়নে তেমন অগ্রগতি নেই। প্রযুক্তির সীমিত বিস্তারের কারণে আজও এই অঞ্চলটি পেছনে পড়ে আছে। শিল্প খাতে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও নিম্নমানের শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়নেও অঞ্চলটি পিছিয়ে।
প্রতিরক্ষা খাত দুর্বল হওয়ায় পরিবর্তিত ঝুঁকি ও হুমকির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহস নেই দেশগুলোর। এ কারণে মিয়ানমার সংকটে শক্তিশালী কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না জোটটি। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বহিরাগত শক্তি এই অঞ্চলে ক্রমশ জেঁকে বসছে। বিশেষ করে চীন বিনিয়োগের পাশাপাশি ভিসা ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে আসিয়ানে সংযোগ বাড়াচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমার সংকট নিয়ে আসিয়ান এখনও বিভক্ত। একদিকে চীনের প্রভাব আসিয়ানকে মিয়ানমারে পদক্ষেপ নিতে বাধা দিচ্ছে, অন্যদিকে বহিরাগত শক্তির ওপর নির্ভরতা নিজেদের সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। আঞ্চলিক নেতৃত্ব এবং ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপটে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা না রাখায় মিয়ানমার সংকট গভীর হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই অঞ্চল ঘিরে চীন প্রতিরক্ষাসহ নানা খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। থেমে নেই যুক্তরাষ্ট্রও। উৎপাদন ও প্রযুক্তি খাতে যথেষ্ট উন্নতি না করতে পারায় দেশগুলো সামনের দিকে অগ্রসর হতে বাধা পাচ্ছে।
শক্তিশালী শাসনব্যবস্থার অভাবে তারা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এই অবস্থায় এই অঞ্চলে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো হলো- ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।
১০ দেশের এই জোটটির লক্ষ্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। আসিয়ানে গড় মাথাপিছু আয় প্রায় ৫ হাজার ৩০০ ডলার এবং দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার।
আসিয়ান কোন দিকে ঝুঁকছে, যুক্তরাষ্ট্র না চীন- এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ নিক্কেই এশিয়ায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশগুলোর উচিত বেইজিংয়ের প্রবৃদ্ধি থেকে লাভবান হওয়া। তিনি ভারতের সঙ্গেও বাণিজ্য বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।
অন্যদিকে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কলিন্স চং ইউ কিট মনে করেন, আত্মরক্ষার নিজস্ব শক্তি ও ক্ষমতা অর্জন না করা পর্যন্ত আসিয়ান দেশগুলোকে মার্কিন নিরাপত্তার ছাতার তলেই থাকতে হবে।
অধ্যাপক কলিন্স ইউরেশিয়া রিভিউকে বলেন, গত কয়েক দশক ধরে আসিয়ান দেশগুলো নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভর করেছে। হঠাৎ করে চীন এই অবস্থানে যেতে পারবে না। আসিয়ান দেশগুলো এটা ভালো করেই জানে। যদিও বেইজিংকে এই অঞ্চলের প্রধান অর্থনৈতিক বিকল্প ও সম্পদের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে দেখা হয়।
গালফ নিউজের সিনিয়র বিশ্লেষক বলরাম মেনন মনে করেন, অনেক বছর ধরে আসিয়ানসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে আসছে। অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্র ভোক্তা বাজার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিনিয়োগও বাড়াতে চায় ওয়াশিংটন।
থাইল্যান্ডের মাহিদোল ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক উইলিয়াম জে জোন্স মনে করেন, আসিয়ান রাষ্ট্রগুলোকে বহিরাগত শক্তির কাছে ঐক্যবদ্ধ বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদর্শন করতে ইচ্ছুক হতে হবে। ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতির পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে পূর্ব এশিয়াও। এজন্য আসিয়ানকে বাস্তবসম্মতভাবে একটি ঐক্যফ্রন্ট উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
আসিয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করছে চীন
ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে আসিয়ান ও চীনের মধ্যে সহযোগিতার গভীরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। চীন দেশগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়তে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহারকে গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা চীনকে এআই প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পরামর্শ দিয়েছেন।
এছাড়া চীন আঞ্চলিক সংযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য চালু করেছে ‘আসিয়ান ভিসা’। আন্তঃসীমান্ত ভ্রমণ এবং আঞ্চলিক একীকরণে এটি চীনের বড় পদক্ষেপ।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান মনে করেন, নতুন ভিসা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করবে।
গত ২৭ মে কুয়ালালামপুরে হয়ে গেল আসিয়ান-চীন-জিসিসি (উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ) শীর্ষ সম্মেলন। তিনটি পক্ষ তাদের নিজ বাজারকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে বিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ উন্মোচন করতে পারে। তিন পক্ষের সম্মিলিত শক্তি বিশ্ব অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকে নতুন রূপ দিতে পারে।
ক্ষমতার আধিপত্য বজায় রেখেছে ওয়াশিংটন
অধ্যাপক কলিন্স চং ইউ কিট মনে করেন, আসিয়ানে প্রযুক্তিগত আধিপত্যসহ অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতে আগামী ৫০ বছর ওয়াশিংটন প্রধান ভূমিকায় থাকবে। এই সময়ের মধ্যে দেশগুলোতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বিভাজন ঘটতে পারে। ফলে বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তার জন্য তারা বিদেশি শক্তির ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই সুবিধা নেবে যুক্তরাষ্ট্র।
কঠোর নিরপেক্ষতা থাকা সত্ত্বেও আসিয়ান দেশগুলো প্রায় নিশ্চিতভাবেই নতুন সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে বলেও মনে করেন কলিন্স চং। তিনি বলেন, দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান কেন্ত্রিক এই সংঘাত শুরু হতে পারে। এই সংঘাতে ওয়াশিংটন যুক্ত হয়ে পড়লে দক্ষিণ চীন সাগরে চীন বেকায়দায় পড়বে। ফলে আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে আরও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা থাকবে।
সূত্র: গালফ নিউজ, ইউরেশিয়া রিভিউ, ইস্ট এশিয়া ফোরাম