তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খাল থেকে অবৈধভাবে পারশে মাছের পোনা আহরণ করে ফিরছিলেন জেলেদের একটি দল। বনের ভেতর দিয়ে তাঁদের দ্রুতগতির ট্রলার এগোচ্ছিল লোকালয়ের দিকে। এমন সময় সেখানে হাজির হন বনরক্ষীরা। তাঁদের দেখে মাছ ফেলে পালিয়ে যান জেলেরা।

পরে ট্রলার থেকে ৩০ কেজি পারশে মাছের পোনা উদ্ধার করেন সুন্দরবনের কোবাদক ফরেস্ট স্টেশনের বনরক্ষীরা। আজ রোববার ভোরে সুন্দরবনের খুলনার কয়রা উপজেলার চরামুখা গ্রামসংলগ্ন কপোতাক্ষ নদে এ ঘটনা ঘটে।

সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা পারশে মাছের পোনা নিয়ে কয়রা বন আদালতে নিয়ে আসতে দুপুর হয়ে যায়। আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কয়রার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, উদ্ধার করা পারশে মাছের পোনাগুলো আদালতে আনা হয়েছে। আদালত ভবনের কাছে গর্ত খোড়া হচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন বনকর্মী। তাঁরা জানান, আদালতের নির্দেশে মৃত পারশে মাছের পোনাগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলা হচ্ছে।

সুন্দরবনের কোবাদক ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোপন সংবাদে জেনেছিলাম, সুন্দরবন থেকে অসাধু জেলেরা অবৈধভাবে পারশে মাছের পোনা আহরণ করে লোকালয়ে ফিরছেন। এরপর কয়েকজন বনরক্ষীকে নিয়ে সুন্দরবনের আড়পাঙ্গাসী নদী ও কপোতাক্ষ নদের মাঝামাঝি এলাকায় আমরা ওত পেতে থাকি। আমরা ভোরের আবছা আলোয় দেখতে পাই, একটি ট্রলার খুব ধীরগতিতে কপোতাক্ষ নদ ধরে লোকালয়ের দিকে যাচ্ছে। টর্চলাইটের আলো ফেলতেই জেলেরা ট্রলারের গতি বাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। আমরা তাঁদের পিছু নিই। কিছুদূর গিয়ে জেলেরা ট্রলার ফেলে পালিয়ে যান।’

আনোয়ার হোসেন জানান, ওই ট্রলার তল্লাশি করে ৩০ কেজি পারশে মাছের পোনা ও নিষিদ্ধ ঘন ফাঁসের জাল জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।

পোনা ধরার জন্য ব্যবহৃত জালের কারণে নষ্ট হয় লাখ লাখ প্রজাতির জলজ প্রাণী। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পাইকগাছা লোনাপানি গবেষণা কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি পারশে পোনা আহরণের বিপরীতে ১১৯ চিংড়ি, ৩১২ প্রাণিকণা ও ৩১টি অন্য প্রজাতির মাছের পোনা ধ্বংস হয়।

সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা জানান, সুন্দরবনে ট্রলার চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সংঘবদ্ধ একটি চক্র বনের ভেতর ও পাশের নদ-নদীতে পারশে মাছের পোনা ধরছে। আহরণ করা পোনা আনা-নেওয়ার নিরাপদ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কপোতাক্ষ নদ ও শিবসা নদী। এক কেজি পারশে পোনার দাম দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা।

পোনা শিকারে জড়িত কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সুন্দরবন অভয়ারণ্যের নদীতে তাঁদের পোনা ধরতে প্রতিটি ট্রলারে ৮ থেকে ১০ জন জেলে আর ঘন দীর্ঘ মশারি জাল থাকে। জাল একবার টানলে দুই থেকে তিন মণ পারশে পোনা পাওয়া যায়। দুই দিন পরপর এসব ট্রলার পোনা নিয়ে বন থেকে লোকালয়ে ফিরে আসে। সুন্দরবনে কোনো অভিযান পরিচালনার আগেই রিয়াছাদ আলী নামের একজন দালাল জেলেদের জানিয়ে দেন। সতর্কসংকেত পেয়ে তাঁরা বনের মধ্যে পালিয়ে থাকেন। অভিযান শেষ হলে আবার তাঁরা পোনা ধরতে শুরু করেন।

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবনের অভ্যন্তরে কোথাও পারশে পোনা ধরার সুযোগ নেই। তারপরও অসাধু কিছু ব্যক্তির কারণে সুন্দরবন সুরক্ষায় আমাদের ভালো উদ্যোগগুলো নষ্ট হচ্ছে। জনবলসহ নানা সংকট থাকা সত্ত্বেও আমরা পারশে পোনা নিধন বন্ধে চেষ্টা করছি। এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন দরবন র

এছাড়াও পড়ুন:

উপকূল রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ধস, প্লাবনের আশঙ্কা সুন্দরবন তীরবর্তী জনপদে

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মালঞ্চ নদীর চর দেবে গিয়ে উপকূল রক্ষা বাঁধের পাঁচ নম্বর পোল্ডারের সিংহড়তলী অংশে ভয়াবহ ধসের সৃষ্টি হয়েছে। শনিবার দুপুরে শুরু হওয়া ধস আজ সোমবার আরও গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এর আগে শুক্রবার রাতে আকস্মিকভাবে চুনকুড়ি ও সিংহড়তলী এলাকায় চর দেবে যাওয়ার পর থেকেই বাঁধে ধস শুরু হয়।

খবর পেয়ে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে কাজ করছেন।

ধস একেবারে জনবসতির কোল ঘেঁষে হওয়ায় গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নদীতে জোয়ারের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাঁধের অবশিষ্ট দুই থেকে আড়াই ফুট অংশ যে কোনো সময় নদীতে বিলীন হতে পারে। এতে সুন্দরবন তীরবর্তী কয়েকটি জনপদ লবণ পানিতে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মালঞ্চ নদীর ছয়টি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিলেও সিংহড়তলী অংশের অবস্থা সবচেয়ে সংকটাপন্ন। তারা জানান, দ্রুত বিকল্প বাঁধ নির্মাণ করা না হলে পরবর্তী জোয়ারে সাত থেকে আটটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।

স্বেচ্ছাসেবক আব্দুর রাজ্জাক সমকালকে বলেন, ‘মাত্র সাত-আট মাস আগে এখানে মাটির কাজ হয়েছিল। বাঁধের পাশে অতিরিক্ত মাটি নেওয়ায় বাঁধ অনেকটা খাড়া হয়ে ছিল। কয়েকদিন ধরে ফাটল দেখা দেয়ার পর শনিবার থেকে ধস শুরু হয়। পাউবো তাৎক্ষণিকভাবে জিওশিট চাপিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করলেও শনিবার রাতে সবকিছু ধসে যায়।’

স্থানীয় বনজীবীদের নেতা বাবলুর রহমান সমকালকে বলেন, শনিবার দুপুরে বাঁধের প্রায় ৩০ ফুট অংশ নদীতে ধসে পড়ে। রোববার সকালের জোয়ারে আরও এক দফা ধসের পর বাঁধের অবশিষ্ট উচ্চতা এখন মাত্র দেড় থেকে দুই ফুট। তিনি বলেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সিংহড়তলী, চুনকুড়ি, হরিনগর, যতীন্দ্রনগর, ছোট ভেটখালীসহ অন্তত সাতটি গ্রাম তাৎক্ষণিকভাবে প্লাবিত হতে পারে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য নীপা রানী সমকালকে বলেন, ছয় নম্বর ওয়ার্ডের অন্তত ছয়টি অংশে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। সিংহড়তলীর অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বসতবাড়ির পাশে ভাঙন দেখা দেয়ায় এলাকাবাসী উদ্বাস্তু হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। অনেকেই ইতোমধ্যে একাধিকবার সর্বস্ব হারিয়েছেন।

ঘটনাস্থলে থাকা পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দীন সমকালকে বলেন, শনিবার বিকেলে ভাঙন কবলিত অংশে শতাধিক জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হলেও তাতে ভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়নি। এখন বাঁধের ভেতর দিয়ে ৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের রিং বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। তিনি জানান, রোববার রাতের মধ্যে বিকল্প বাঁধ নির্মাণ শেষ করা গেলে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. রনী খাতুন সমকালকে বলেন, স্থানীয়দের সহযোগিতায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ভাটার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। পানি নামলে শত শত গ্রামবাসীকে নিয়ে ভাঙন রোধে পুনরায় কাজ শুরু করা হবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবনের মধুসহ ২৪ পণ্য পেল জিআই সনদ
  • বাচ্চাসহ ভালুকের বিচরণ, সতর্কতা
  • সুন্দরবনে হরিণ শিকারে যাওয়া ব্যক্তির লাশ উদ্ধার, মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা
  • মধ্যরাত থেকে কাপ্তাই হ্রদে ৩ মাস মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা
  • চেয়ারম্যানের দপ্তরে বুধবারও অবস্থান করবেন কর্মকর্তারা
  • ‘তোর সময় শেষ’ লেখা চিঠির সঙ্গে কাফনের কাপড় পাঠিয়ে সাংবাদিককে হুমকি
  • সৌন্দর্যের সন্ধানে সুন্দরবনের গহীনে : দ্বিতীয় পর্ব
  • প্রস্তাবিত রাজস্ব নীতি বিভাগে সচিব হিসেবে শুল্ক ও কর কর্মকর্তা পদায়নের দাবি
  • সুন্দরবনে অস্ত্রসহ বনদস্যু আটক
  • উপকূল রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ধস, প্লাবনের আশঙ্কা সুন্দরবন তীরবর্তী জনপদে