ছোট ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হন অন্য দুই ভাই
Published: 9th, March 2025 GMT
মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুরসহ আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের বাসিন্দা সাইফুল ইসলামকে একজন সন্ত্রাসী হিসেবে চেনেন। এলাকাবাসীর ভাষ্য, আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মানুষকে মারধর, নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর জন্য এলাকায় তিনি ‘হিটার সাইফুল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সম্প্রতি অবৈধ বালু উত্তোলন নিয়ে প্রতিবেশী জেলা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহজাহান খানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান। এর জেরে সাইফুলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হন তাঁর অন্য দুই ভাই।
সাইফুল খোয়াজপুর ইউনিয়নের সরদার বাড়ির মৃত আজিবর সরদারের ছোট ছেলে। ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি। হামলায় সাইফুলের মেজ ভাই আতাউর রহমান সরদার (৩৫) ও চাচাতো ভাই পলাশ সরদারও (১৭) নিহত হন। গুরুতর আহত বড় ভাই অলিল সরদার (৪০) আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
আরও পড়ুনমাদারীপুরে তিন ভাইকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা, গ্রেপ্তার ৩৮ ঘণ্টা আগেনাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রত্যক্ষদর্শী একজন প্রথম আলোকে বলেন, পূর্ববিরোধ থেকে সাইফুলকে টার্গেট করেই মোল্লা, আকন ও খান বংশের লোকজন হামলা করেন। তখন তাঁর দুই ভাই ও চাচাতো ভাইয়েরা সাইফুলকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলে তাঁদের ওপরও হামলা হয়। মূলত সাইফুলকে মারার টার্গেট নিয়ে হামলা করা হয়েছিল। সাইফুলের জন্যই তাঁর অন্য দুই ভাই মারা গেলেন।
আট মাস আগে খোয়াজপুর এলাকার হোসেন সরদার নামের এক বালু ব্যবসায়ীকে চাঁদার টাকা না দেওয়ায় হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছিলেন সাইফুল ও তাঁর লোকজন। এ ঘটনায় সাইফুলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও কয়েক দিন পর জামিনে মুক্তি পান। পরে আবার এলাকায় অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।
হোসেন সরদার সাইফুলের বংশের চাচা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাইফুলের নিকটাত্মীয় হয়েও ছাড় পাই নাই। আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় এমন কোনো অপকর্ম নেই, সে করে নাই। কেউ তার কথা না শুনলেই মারধর করত। আমাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে দুই পা ও হাত ভেঙে দেয়। আমি এখনো শয্যাশায়ী। আমার মতো বহু মানুষকে সাইফুল পঙ্গু বানিয়েছে। যে তার পথে কাটা হয়েছে, তাঁকে খুন করেছে।’
হত্যার ঘটনায় নিহত সাইফুলের মা সুফিয়া বেগম বাদী হয়ে ৪৯ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় সরদার বংশের হোসেন সরদারকে প্রধান আসামি, মতিউর রহমান সরদারকে ২ নম্বর আসামি ও কৃষক দলের নেতা খান বংশের শাহজাহান খানকে ৯ নম্বর আসামি করা হয়েছে।
সুফিয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তিন ছেলেকেই ওরা খুন করতে চাইছিল। খুনি শাহজাহান খান, মতিউর সরদার ও হোসেন সরদার লোকজন নিয়ে এই খুন করে। ওরা মসজিদে ঢুকেও রক্ষা পায় নাই। ওরা আমার দুই ছেলেকে মাইরা ফেলছে। বড় ছেলের অবস্থাও ভালো না। যারা আমার বুক খালি করেছে, ওদের ফাঁসি চাই।’
আরও পড়ুনমাদারীপুরে বালুর ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বে তিন ভাইকে কুপিয়ে হত্যা০৮ মার্চ ২০২৫স্থানীয় ও নিহত সাইফুলের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, খোয়াজপুরে কীর্তিনাশা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছিলেন সাইফুল। এ নিয়ে প্রতিবেশী কৃষক দল নেতা শাহজাহান খানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান। বালু ব্যবসা ও টেকেরহাট এলাকার হাট ইজারা নিয়ে কয়েক দিন আগে দুজনের লোকজনের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এসবের জেরে সাইফুলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন প্রতিপক্ষের লোকজন।
অভিযুক্ত শাহজাহান খান ঘটনার পর থেকে পলাতক। এ ব্যাপারে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া মেলেনি।
তবে প্রধান আসামি হোসেন সরদার প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের পতন হলেও সাইফুলের দাপট কমেনি। বিএনপির লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এলাকায় আগের মতো নৈরাজ্য সৃষ্টি করে আসছিলেন। তাঁকে সন্দেহ করে আসামি করেছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডে তিনি জড়িত নন। বিএনপির লোকজন হামলার সঙ্গে জড়িত।
মাইকে ক্ষমা চেয়েও রক্ষা হয়নিপ্রতিপক্ষের ৬০–৭০ জন দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা করলে সাইফুল বাড়ির সামনের একটি মসজিদে আশ্রয় নেন। তখন তাঁর দুই ভাই এবং তিন চাচাতো ভাইও মসজিদে ঢুকে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। পরে মসজিদের মাইকে হামলাকারীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রাণ ভিক্ষা চান সাইফুল। পাশাপাশি চিরদিনের জন্য এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপরও হামলাকারী ব্যক্তিরা মসজিদের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে সাইফুল ও তাঁর ভাইদের কুপিয়ে জখম করেন। সাইফুল ও তাঁর দুই ভাইয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করে তাঁদের বসতঘরে আগুন দিয়ে পালিয়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শী এক নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মসজিদের মাইকে সাইফুল তার অপরাধের ক্ষমা চায়। কিন্তু হামলাকারীরা কেউ তার কথা শোনে নাই। মসজিদের মতো পবিত্র স্থানে ঢুকে এভাবে কুপিয়ে মানুষ হত্যা করবে, আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারি নাই। যারা খুনি, তারাও অপরাধী, আর যারা খুন হয়েছে তারাও এলাকার চিহ্নিত অপরাধী।’
এলাকা পুরুষশূন্যতিন ভাইকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার পর থেকে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা গেছে। আজ রোববার সকাল থেকেই এলাকায় লোকজনের চলাচল সীমিত। গ্রেপ্তারের আতঙ্কে এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। যাঁরা এলাকায় আছেন, এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন।
সরেজমিনে খোয়াজপুর টেকেরহাট ঘুরে দেখা যায়, হাটবাজারে মানুষের উপস্থিতি কম। নারীরা বাড়ির বাইরে বের হলেও পুরো গ্রামই প্রায় পুরুষশূন্য। এলাকায় আবার সংঘর্ষ বা অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এলাকার বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
তবে মাদারীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো.
এদিকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় বিকেল পাঁচটার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে তিন ভাইয়ের লাশ বাড়িতে পৌঁছালে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনেরা। পরে ইফতারের আগমুহূর্তে জানাজা শেষে তাঁদের মরদেহ খোয়াজপুর ইউনিয়নের সরদার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মাদারীপুরে নিহত তিন ভাইয়ের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় সদরের খোয়াজপুর ইউনিয়নের সরদার বাড়িউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ হজ হ ন খ ন হ স ন সরদ র প রথম আল ক মসজ দ র র ল কজন সরদ র ব র সরদ র এল ক র এল ক য় ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
‘আমরার এইতা দিবস-টিবস দিয়া কী অইব’
ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা ২০ মিনিট। মাথার ওপর প্রখর রোদের উত্তাপ। প্রচণ্ড গরমে ত্রাহি অবস্থায় একটু বিশ্রাম নিতে গাছের ছায়ার খোঁজে ক্লান্ত পথিক। এমন সময় ঘর্মাক্ত শরীরে একটি ভবন নির্মাণের কাজ করতে দেখা গেল কয়েকজন শ্রমিককে। তাদের একজন তোঁতা মিয়া, অপরজন হাবিবুল।
হাবিবুল পাথর ভরেই যাচ্ছেন, তোঁতা মিয়া সেগুলো মাথায় করে একের পর এক টুড়ি ছাদ ঢালাইয়ের জন্য পৌঁছে দিচ্ছেন নির্দিষ্ট স্থানে। সেখানেও বালু-পাথরের মিশ্রণ করছেন আরও কয়েকজন। তাদের কর্মযজ্ঞের এক ফাঁকে কথা হয় তোঁতা মিয়ার সঙ্গে।
আলাপকালে তোঁতা মিয়া বলেন, ‘সারাদিন কাম (কাজ) কইরা ৫০০ ট্যাহা (টাকা) হাজিরা পাই। এইডি দিয়া কোনোমতে বউ-পুলাপান নিয়া দিন পার করতাছি। মে দিবস-টিবস কী কইতারতাম না। আমরার মতো গরিব মানুষ কাম না করলে পেডে ভাত জুটতো না এইডাই কইতারবাম।’
গতকাল বুধবার ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণকাজ করার সময় এসব কথা বলেন তোঁতা মিয়া (৪৫)। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার আকুয়া এলাকায়। এ সময় কথা হয় আরেক নির্মাণ শ্রমিক একাদুল মিয়ার সঙ্গে। একাদুলও জানেন না মে দিবস কী। তিনি বলেন, ‘এই কাম কইরা খাইয়া-না খাইয়া বউ-পুলাপান লইয়া কোনোরহমে দিন পার করতাছি। বর্তমান বাজারো জিনিসপাতির দাম বাড়লেও আমরার মজুরি বাড়ে না। পাঁচ বছর আগেও যা পাইতাম, অহনও তাই পাই।’ তিনি বলেন, ‘কয়েক ট্যাহা সঞ্চয় করবাম এই বাও (উপায়) নাই। অসুখ অইয়া চার দিন ঘরে পইড়া থাকলে না খাইয়া থাহন লাগব। আমরার এইতা দিবস-টিবস দিয়া কী অইব?’
আজ বৃহস্পতিবার মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এই দিনটি সারাবিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয় নানা আয়োজনে। কিন্তু যাদের অধিকার আদায়ের জন্য এ দিনটি পালন করা হয়– তারাই জানেন না দিবসটি সম্পর্কে। তাদের আরেকজন দিনমজুর রাজন মিয়া। রাজন জানান, এসব দিবসে তাদের মতো গরিব মানুষের কোনো লাভ-লোকসান নেই।