ছাত্রজীবনে আমাদের এক বন্ধুর একটি ছড়ার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। ‘উর্বরা ক্ষেত খাদ্য নাই– খাদ্য দিয়ে পেট ভরাবে, শাসকদের সাধ্য নাই’। এ প্রেক্ষিতে ফিরে দেখার সুযোগ আছে যে দেশে খাদ্য সংকট কোথায়? এটি কি খাদ্য উৎপাদনে, আমদানিতে, সংরক্ষণে, নাকি বিনিময়ে, বণ্টনে? এই লেখায় প্রথমত আমরা সেটিই খুঁজে দেখার চেষ্টা করব। খাদ্য সংকট কত গভীর ও খাদ্য নিরাপত্তা কত দরকার, তা বোঝা যায় যখন মধ্যবিত্তরা পর্যন্ত টিসিবির ট্রাক সেলের লাইনে দাঁড়িয়ে চাল-ডাল জোগাড়ের চেষ্টা করে। কিন্তু কর্মজীবী মানুষ কাজ করবে, নাকি টিসিবির ট্রাকের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে রোজকার মজুরি থেকে বঞ্চিত হবে? এ প্রশ্ন থাকায় অনেকে ট্রাকের পেছনে লাইনে আসতে পারে না। যদি সবাই আসতে পারত, তবে চিত্র ভয়াবহ হতো।

 

খাদ্যনীতি হলো খাদ্যশস্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, গুদামজাতকরণ, পরিবহন, বিতরণ ও বিপণনের কাজে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ। এর উদ্দেশ্য হলো, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কৃষকদের অধিক খাদ্য ফলনে উৎসাহ দেওয়া, ফসল তোলার সময় কৃষকদের কাছ থেকে ভর্তুকি মূল্যে বা উৎসাহজনক দামে খাদ্যশস্য কেনা। দেশে উৎপাদিত শস্যের সুষ্ঠু সরবরাহ এবং বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। নিম্ন আয়ের ব্যক্তির কাছে খাদ্যপ্রাপ্তি সহজ করা। শস্যের উৎপাদন খরচ এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে সংগতি রেখে খাদ্যমূল্য স্থির রাখা। উৎপাদিত কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে সংগৃহীত খাদ্যের যথাযথ সংরক্ষণ। দুর্যোগকালীন অবস্থা মোকাবিলার জন্য ‘খাদ্য মজুত’ ব্যবস্থা অথবা দুঃসময়ে ব্যবহৃত শস্যভান্ডার গড়ে তোলা। খাদ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। খাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে শক্তিশালী করে ক্রমান্বয়ে খাদ্যে ভর্তুকি কমিয়ে আনা ইত্যাদি। 

 

খাদ্য নীতিমালার বাস্তবায়নে নিম্ন আয়ের ব্যক্তির কাছে খাদ্য পৌঁছাতেই রেশন কার্ড প্রয়োজন। সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা চালু করলে গরিব ও মধ্যবিত্তদের খাদ্যের প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। আমরা যদি আমাদের খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তার ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব ’৪৭ থেকে ’৯৩ পর্যন্ত উপমহাদেশের প্রথম যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়েছিল ‘বিধিবদ্ধ রেশনিং’ নামে, তার পটভূমি ছিল ’৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। এরপর গ্রাম এলাকায় চালু হয়েছিল ‘সংশোধিত রেশনিং’। আবার ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষে আমরা আরও ব্যাপক মৃত্যুযজ্ঞ থেকে রেহাই পেয়েছিলাম ‘বিধিবদ্ধ রেশনিং’ ছাড়াও কাজের বিনিময়ে খাদ্য– কাবিখা, ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট ভিজিডি একযোগে চালু ছিল বলে। ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে আরও অনেক বেশি লোক মারা যেত যদি তাদের রেশন কার্ড না থাকত। বর্তমানেও সরকার জরুরি ভিত্তিতে সর্বজনীন রেশন কর্মসূচি চালু করতে পারলে আসন্ন খাদ্য সংকট থেকে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হবে। 

 

এই দেশ স্বাধীন করার যুদ্ধ করেছিল যে গরিব মানুষ, তারা সামাজিক নিরাপত্তা বিশেষত খাদ্যনিরাপত্তা কেন পাবে না? একের পর এক ১৪ প্রকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু ও বন্ধ করা হয়েছে এ দেশে শুধু দুর্নীতির কথা বলে। প্রথমত, এটি দুর্ভাগ্যের যে একটি স্বাধীন দেশে বিশ্বব্যাংক এবং ইউএস এইডের ‘দুর্নীতির জন্য রেশনিং বন্ধের’ ভুল পরামর্শ কেন বাস্তবায়িত করতে হবে? দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি দমন করা তো সরকারেরই দায়িত্ব। মাথাব্যথা হলে নিরাময়ের ব্যবস্থা নিন, মাথা কেটে ফেলবেন কেন? কিন্তু সরকার মাথা কেটেই রেশন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দুর্নীতি বন্ধ না করে রেশন বন্ধ করে দিয়েছিল। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের পর খাদ্যগুদামের শস্য রিলিজ করে গুদাম খালি করার প্রশ্ন এসেছিল, কৃষকদের থেকে বোরো মৌসুমের ক্রয়কৃত ধান রাখার জায়গার জন্য। এই গুদাম খালি করার প্রয়োজন থেকে নানা খাদ্যভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালুর প্রশ্ন এসেছিল! তাই সব মিলিয়ে ১৪ প্রকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু ও বন্ধ করা হলো বটে, কিন্তু নাগরিকরা শেষ বিচারে সামাজিক নিরাপত্তা পেল না। এতগুলো উদ্যোগের পরও আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না। অথচ পাশের দেশ ভারত তাদের রেশন বন্ধ না করে আধার কার্ডে যুক্ত করে ‘দুয়ারে রেশন’ ইত্যাদি স্লোগানে কিছু সুফল সৃষ্টি তথা সামাজিক নিরাপত্তা কিছুটা করতে পেরেছে। কারণ তারা মাথাব্যথায় মাথা না কেটে উল্টো রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার দাঁড় করাতে আইনগত বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে। আইনি অধিকারে রূপান্তর করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে তারা পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাইজেশন করেছে।


আমাদের চিত্রে বোঝা যায় কৃষকের উৎপাদনে সমস্যা নয়, সরকারের বণ্টন নীতিতেই সমস্যা। তাই আমরা মনে করি, দরিদ্রের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের মূল্য সহায়তা এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ– তিনটিই সম্ভব সর্বজনীন রেশন চালুর মাধ্যমে। তাই দ্রব্যমূল্যের যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তাও মোকাবিলা করা সম্ভব এই সর্বজনীন রেশন প্রক্রিয়াতেই। 


জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবস থ আম দ র উৎপ দ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সিআইডিতে বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত বিষয়ে আন্তর্জাতিক কর্মশালা

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে ‘সম্ভাব্য অবৈধ মৃত্যুর তদন্তসংক্রান্ত মিনেসোটা নীতিমালা’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর (ইউএনআরসি) কার্যালয় এবং বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) যৌথ আয়োজনে ৩০ ও ৩১ জুলাই ঢাকার সিআইডি সদর দপ্তরে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় সিআইডি।

কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন সিআইডির প্রধান ও বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. ছিবগাত উল্লাহ। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘সিআইডি এখন একটি আধুনিক, তথ্যভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠছে। মানবাধিকার রক্ষা ও বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে প্রমাণনির্ভর নিরপেক্ষ তদন্ত অপরিহার্য এবং এ ধরনের আন্তর্জাতিক কর্মশালা আমাদের সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করে।’

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতিসংঘের বিচারবহির্ভূত, সংক্ষিপ্ত বা ইচ্ছামতো মৃত্যুবিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক মরিস টিডবল-বিন্‌জ। তিনি বলেন, মিনেসোটা নীতিমালা একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ড, যা সন্দেহজনক মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা সৃষ্টি করে। উপস্থাপনায় তিনি লিবিয়া ও ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্তের উদাহরণ তুলে ধরেন।

কর্মশালার শুরুতে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার শম্পা ইয়াসমীন দেশের ডিএনএ ও ফরেনসিক সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করেন। দুই দিনব্যাপী এই কর্মশালায় অংশ নেন দেশের বিভিন্ন পুলিশ ইউনিটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিচারক, চিকিৎসক ও ফরেনসিক সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধি এবং প্রযুক্তি ও অনুসন্ধান-সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা।

আলোচনার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল, আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী মৃতদেহ শনাক্তকরণ (দুর্যোগে নিহত ব্যক্তি শনাক্তকরণ), নিরপেক্ষ ফরেনসিক প্রতিবেদন তৈরির কৌশল, মানবাধিকার সংরক্ষণে তদন্তকারীদের নৈতিক ও পেশাগত দিকনির্দেশনা এবং বাস্তব ক্ষেত্রভিত্তিক কেস স্টাডি উপস্থাপন।

বিশেষ অধিবেশন পরিচালনা করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মমতাজ আরা, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক জান্নাতুল হাসান এবং সিআইডির ডিএনএ বিশ্লেষক আহমেদ ফেরদৌস। তাঁদের আলোচনায় জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত অপরাধের তদন্তের অগ্রগতি, সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জও উঠে আসে।

সমাপনী দিনে বক্তারা বলেন, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের তদন্তপ্রক্রিয়াকে আরও মানবিক, কার্যকর ও স্বচ্ছ করা সম্ভব। সিআইডির প্রধান ভবিষ্যতে ফরেনসিক সক্ষমতা সম্প্রসারণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

সমাপনী বক্তব্যে মরিস টিডবল-বিন্‌জ বলেন, আইনবহির্ভূত মৃত্যুর তদন্তে প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রাম্যমাণ ডিএনএ পরীক্ষাগার, ঘটনাস্থলে মরদেহ শনাক্তকরণ পদ্ধতি ও অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগে জাতিসংঘ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সিআইডিতে বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত বিষয়ে আন্তর্জাতিক কর্মশালা