ভিজিএফ কর্মসূচির চালের বস্তায় এখনও শেখ হাসিনার নামসহ স্লোগান
Published: 15th, March 2025 GMT
শরীয়তপুরে নিবন্ধিত জেলেদের মাঝে বিতরণ করা ভিজিএফ (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) কর্মসূচির চালের বস্তায় এখনও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামমহ স্লোগান লেখা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সাত মাস অতিবাহিত হলেও সরকারি চালের বস্তায় তার নাম থাকার বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চললেও শনিবার দুপুর পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যা অনেকের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
জানা যায়, শরীয়তপুর জেলার জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিবন্ধিত ১৫ হাজার ৪৪৬ জন জেলের মাঝে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় বিনামূল্যে চাল বিতরণ করা হয়। প্রতি জেলেকে দুই মাসের জন্য ৮০ কেজি চাল দেওয়া হয়, যা ৩০ কেজি ওজনের বস্তায় প্যাকেট করা ছিল। তবে বিতরণ করা চালের বস্তাগুলোর গায়ে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে— ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’।
কিছু জায়গায় কালো রঙের স্প্রে দিয়ে স্লোগানটি ঢাকার চেষ্টা করা হলেও বেশিরভাগ জায়গায় এটি স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। জেলার প্রায় প্রতিটি ভিজিএফ চাল বিতরণ কেন্দ্রে এমন বস্তা পাওয়া গেছে। চাল বিতরণের সময় অনেকেই বস্তাগুলো দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং এর পেছনের কারণ জানতে চান। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকার পরিবর্তনের পরও পুরোনো সরকারের নাম ও স্লোগান সম্বলিত চালের বস্তা বিতরণ করা পরিকল্পিত কোনো কর্মকাণ্ড কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ:
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, চাল বিতরণের আগে তারা বিষয়টি খেয়াল করেছিলেন এবং কিছু জায়গায় বস্তাগুলোর গায়ের লেখাটি মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে অনেক জায়গায় এই প্রচেষ্টাটি যথাযথভাবে করা হয়নি, যার ফলে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
কোদালপুর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন খান বলেন, ‘গত বুধবার খাদ্যগুদাম থেকে চালের বস্তাগুলো এনে জেলেদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। আমরা কিছু বস্তার ওপর শেখ হাসিনার নাম কালো কালি দিয়ে মুছে দিয়েছিলাম, কিন্তু অনেক বস্তায় নাম ও স্লোগান স্পষ্টভাবে থেকে যায়। এতে জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শরীয়তপুর জেলা আহ্বায়ক ইমরান আল নাজির বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও তার সরকারের এমপিরা ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও তৃণমূল থেকে সচিবালয় পর্যন্ত তার অনুগতরা রয়ে গেছে। তারা বিভিন্নভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারি চাল জনগণের করের টাকায় কেনা হয়, এটি কোনো দলের ব্যক্তিগত দান নয়। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরও চালের বস্তায় তার নাম থাকা দুর্ভাগ্যজনক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা খাদ্য অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে অনুরোধ জানাই, দ্রুত এসব বস্তা নিষিদ্ধ করা হোক। অন্যথায় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে এর দায়ভার রাষ্ট্র কিংবা জনগণ নেবে না।’
দক্ষিণ তাঁরাবুনিয়া ইউনিয়নের চাল বিতরণের ট্যাগ অফিসার ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘৫ আগস্টের পর দেশে নতুন সরকার আসাং প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন এসেছে। তাই এসব বস্তার পরিবর্তনও করা উচিত ছিল। চালের বস্তায় পুরোনো সরকারের নাম থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর উচিত পরবর্তী চাল বিতরণের আগে এসব বস্তার পরিবর্তন নিশ্চিত করা।’
এ বিষয়ে শরীয়তপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে এসব চালের বস্তা কেনা হয়েছিল এবং সেসময় সরকারিভাবে এসব বস্তায় শেখ হাসিনার নাম ও স্লোগান সংযোজন করা হয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পর নতুন সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, এসব বস্তা থেকে নাম মুছে ফেলার জন্য। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি স্প্রে দিয়ে নামটি মুছে দেওয়ার, তবে কিছু জায়গায় তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী চাল বিতরণের সময় বিষয়টি আরও কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং যদি কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি অবহেলা করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সরকার পরিবর্তনের সাত মাস পরেও ভিজিএফ কর্মসূচির চালের বস্তায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম থাকার বিষয়টি সাধারণ মানুষের মাঝে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। স্থানীয়দের অনেকেই মনে করেন, এটি ইচ্ছাকৃতভাবে রাখা হয়েছে, যাতে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন, পুরনো মজুত থেকে চাল বিতরণ করায় এমনটি হয়েছে। তবে জনগণের দাবি, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চ ল ব তরণ র ব তরণ ক সরক র র ভ জ এফ ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
চিনি-লবণের অনুপম পাঠ
চিনি আর লবণ– দুটিই সাদা ও ঝকঝকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক হলেও তাদের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সরল অথচ গভীর সত্যটি আমাদের চারপাশের সমাজের প্রতিচ্ছবি। আজ যখন মানুষ শুভাকাঙ্ক্ষীর মুখোশ পরে এগিয়ে আসে, আমরা বুঝতে পারি না– কে চিনি, কে লবণ। এই বিভ্রমের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। তার ফলে সমাজে জন্ম নিচ্ছে ভাঙন, ক্ষয় ও ব্যথার করুণ কাব্য।
শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে প্রতারণার ছায়া আজ সমাজের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও বন্ধুত্বের আবরণে, কখনও আত্মীয়তার মোড়কে, আবার কখনও নির্ভরতার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের বারবার আহত করে। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গন বা পারিবারিক জীবন– বিশ্বাসের অবক্ষয়ের নির্মম চিত্র আজ সর্বত্র বিদ্যমান। সবচেয়ে আপন বলে যার হাত ধরেছি, সেই হাত কখন যে ছুরি হয়ে ফিরে আসে– বলা দুষ্কর।
সম্প্রতি রাজধানীর উপকণ্ঠে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে। বৃদ্ধ মা তাঁর তিন সন্তানকে অকুণ্ঠ বিশ্বাস করে সব সম্পত্তি লিখে দেন। সন্তানরা কথা দিয়েছিল– শেষ দিন পর্যন্ত মায়ের পাশে থাকবে। কিন্তু দলিলের কালি শুকানোর আগেই মাকে উঠিয়ে দেওয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মায়ের চোখের জল তখন ছিল মূল্যহীন; সম্পদের নেশাই ছিল মূল।
অন্যদিকে দীর্ঘদিনের ‘বিশ্বস্ত’ বন্ধু ব্যবসার আড়ালে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে রাতের অন্ধকারে। এসব গল্প আজ প্রতিটি নগর-পল্লীর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্পর্কের পবিত্রতা আজ যেন লোভ ও মুনাফার কাছে নতজানু।
বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা কোনো দাগের মতো নয়, যা সময়ের সঙ্গে মুছে যায়। বরং এটি মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। একজনের আঘাত শুধু তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; ছড়িয়ে পড়ে সমাজজুড়ে। গড়ে ওঠে এক অবিশ্বাসের দেয়াল, যেখানে একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সম্পর্কের উষ্ণতা ক্রমে ঠান্ডা হতে হতে বরফে পরিণত হয়, যা গলাতে লাগে যুগের পর যুগ।
ভোগবাদী সভ্যতা মানুষকে করে তুলেছে আত্মকেন্দ্রিক। মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার সংকট এবং তাৎক্ষণিক লাভের মোহে সম্পর্কও আজ মুনাফার মাপে মাপা হয়। বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, প্রেম– সবকিছু যেন পরিণত হয়েছে একেকটি চুক্তিতে। ‘কে কতটা কাজে লাগবে’– এই প্রশ্নই আজ সম্পর্কের মানদণ্ড। তবে সব আলো নিভে যায়নি। অন্ধকার যত গভীর হোক, এক টুকরো মোমবাতি গোটা ঘর আলোকিত করতে পারে। এই সংকটময় সময়ে আমাদের প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক হতে হবে। কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবেগের তাড়নায় নয়, বিবেকের আলোয় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষাকে মজবুত করতে হবে। শিশুর মনে শৈশব থেকেই সততা, বিশ্বস্ততা ও মানবিকতার বীজ বপন করতে হবে। পরিবারই হচ্ছে ব্যক্তিত্ব গঠনের মূল কেন্দ্র। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে সমাজে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠা পায়। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। তবু এই অন্ধকারে কিছু আলোকবর্তিকা রয়েছেন, যারা এখনও বিশ্বাসের মানদণ্ডে অবিচল। যাদের জীবন শুধু নিজের জন্য নয়, অপরের কল্যাণে নিবেদিত। সংকটে পাশে দাঁড়ানো, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিলানো– এটাই তাদের ধর্ম। এরা প্রমাণ করে– বিশ্বাস এখনও বিলুপ্ত হয়নি পুরোপুরি। শুধু খুঁজে নিতে জানতে হবে।
পরিশেষে, চিনি ও লবণের বাহ্যিক সাদার ভ্রম নয়, আসল স্বাদ বোঝার সক্ষমতা অর্জন করাই আজ সময়ের দাবি। মানুষকে তার কার্যকলাপের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে; বাহ্যিক মোহের ফাঁদে পা না দিয়ে। অন্ধবিশ্বাস নয়– সচেতন, বিবেকবান বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে তুলতে হবে সম্পর্কের ভিত।
মুহাম্মদ ইমাদুল হক প্রিন্স: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়