দুই ধারে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, যার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে কুলাউড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নে জনগুরুত্বপূর্ণ শ্রীপুর-বনগাঁও সড়ক। দৃশ্যত পুরোপুরি গ্রামীণ সড়ক মনে হলেও উপজেলা সদরের সঙ্গে একাধিক ইউনিয়নের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম সড়কটি। অথচ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই সড়কটি সংস্কারের অভাবে পরিণত হয়েছে ভোগান্তিতে।
শ্রীপুর-বনগাঁও সড়কজুড়েই রয়েছে দুর্ভোগের নানা আয়োজন। বিশেষ করে সদর প্রান্ত থেকে এর ৫০০ মিটার অংশে চলাচল করা খুবই কষ্টসাধ্য।
গত ২৩ বছরে এই এলাকার জনপ্রতিনিধিত্বে এসেছেন অনেকেই। তবে কারোরই নজরে আসেনি সড়কটি। স্থানীয়দের অভিযোগ, সংসদ সদস্য বা চেয়ারম্যান– কোনো পর্যায় থেকেই বেহাল এই সড়ক মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া হলে এই দুরবস্থা হতো না। সে ক্ষেত্রে সড়কের মেরামত ব্যয় এবং মানুষের দুর্ভোগ– দুটিই কম হতো।
অতীতে একাধিকবার শ্রীপুর-বনগাঁও সড়ক সংস্কারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দরজায় কড়া নেড়েছেন স্থানীয়রা। সম্প্রতি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে
রাস্তাটি সংস্কারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা প্রকৌশলী বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল আজিজ চৌধুরী।
জানা যায়, কুলাউড়া সদর ইউনিয়নের লস্করপুর-লক্ষ্মীপুর সড়ক থেকে পূর্বমুখী শ্রীপুর-বনগাঁও সড়ক। ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে সিলেট বিভাগ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে এই সড়কের ৫০০ মিটার অংশ বিসি পেভম্যান্ট দ্বারা উন্নয়ন করা হয়। ওই সময় এক কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন হওয়ার কথা থাকলেও বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫০০ মিটারের কাজের জন্য। বাকি রাস্তা বিভিন্ন মেয়াদে ইটসলিং করা হলেও তা টেকেনি।
দীর্ঘদিন ধরে রাস্তাটি সংস্কার না করায় বর্তমানে সেটি খানাখন্দে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে কোনোভাবে চলা গেলেও বর্ষায় এই সড়ক ধরে যাতায়াত করা খুবই কঠিন। ওই সড়ক দিয়ে শাহ সুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় ৪ থেকে ৫টি গ্রামের লোকজনের চলাচল। এই অংশ থেকে সৈয়দপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগী আনা-নেওয়ার একমাত্র পথও এই সড়কটি। সড়কের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা যায়, জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে পিচের ঢালাই। অনেক স্থানে বেরিয়ে এসেছে নিচের মাটি। আর পুরো সড়কই খানাখন্দে ভরা। যান চলাচলে সমস্যায় পড়তে হয় চালকদের। এভাবেই ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন এসব গ্রামের মানুষ।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল আজিজ চৌধুরী, মোমিন চৌধুরী ও খালেদ খান বলেন, এলাকার লোকজন চরম কষ্টে আছেন। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন রোগীরা। ২৩ বছরে কেউ একটি সড়ক সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেনি। সারাদেশে উন্নয়নের এত গল্প। এলাকার রাস্তায় তো তা সত্য বলে মনে হচ্ছে না।
কুলাউড়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম বলেন, জনগুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি চলাচলের অনুপযোগী হওয়ায় প্রতিদিন বিরূপ মন্তব্য করছেন স্থানীয়রা। দায়িত্বশীলরা সময়মতো সংস্কারের উদ্যোগ নেননি। এতে মানুষের কষ্ট বেড়েই চলেছে। স্থানীয়দের স্বার্থে সড়কটির সংস্কার কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে
দ্রুতই আলোচনা করবেন বলে জানান স্থানীয়
এই জনপ্রতিনিধি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) উপজেলা প্রকৌশলী তারেক বিন ইসলাম জানান, শ্রীপুর-বনগাঁও সড়কসহ কুলাউড়ায় অনেক রাস্তায় সংস্কার কাজ করা খুবই জরুরি। তারমধ্যে সদর ইউনিয়নের শ্রীপুর-বনগাঁও সড়কটি অন্যতম। এই রাস্তাটি দ্রুত সংস্কারের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পাওয়া মাত্র প্রক্রিয়া শুরু হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সড়ক ৫০০ ম ট র ও সড়ক উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
আজও আঁধার কাটেনি কোচদের
বন্যহাতি ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে কোচ সম্প্রদায়। তাদের কেউ কেউ দিনমজুরি, বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ, বাঁশ দিয়ে ডোল, ধারাই ও চাটাই তৈরি করে বিক্রি করে থাকেন। আবার কেউ নিজেদের লাগানো কাসাবা খেয়ে বেঁচে থাকেন। অভাব-অনটনে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করলেও তাদের দিকে বিশেষ নজর নেই কারও। অবহেলিত এ আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক পরিবারের বসবাস নালিতাবাড়ী উপজেলার খলচান্দা গ্রামে। সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩০০।
বারমারী বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে খলচান্দা গ্রামে যেতে হয়। প্রায় ১০০ গজ উত্তরে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। স্বাধীনতার আগে মাত্র চার ঘর কোচ এই গ্রামে বাস করত। এর পর বংশবৃদ্ধি এবং ১৯৭৬ সালে চৌকিদার টিলা গ্রামে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন ও পরে ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প করায় আন্ধারুপাড়া গ্রাম থেকে বেশ কিছু পরিবার এখানে এসে বসতি গড়ে। এই গ্রামের বর্তমান পরিবার সংখ্যা প্রায় ৫২ ঘর। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ এ গ্রামে যেতে চান না। টিলায় ঘেরা গ্রামে দিনদিন জনসংখ্যা বাড়লেও তাদের ভাগ্যের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বাসিন্দারা জানান, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা চেল্লাখালী নদী দিয়ে এক সময় ভারত থেকে ভেসে আসত অসংখ্য বড় মূল্যবান গাছ। সে গাছ নদী থেকে তুলে এনে বিক্রি করে এবং পাহাড়ের সমতল জমিতে ধান চাষ করে ভালোই চলত খলচন্দা গ্রামের কোচদের সংসার। এসব দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি। তাদের মূল পেশা কৃষিকাজ হলেও পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ায় জমি সংকট এবং কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই সেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিনমজুর, কেউবা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নানা পেশায় যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঘরে বসে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকেই।
গ্রামটিতে কোনো পাকা সড়ক নেই। যাতায়াতের সড়কটি বেহাল। শুষ্ক মৌসুমে সড়ক ধুলোময় হয়ে থাকে। বর্ষায় চলাচল সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে যায়। এ ছাড়া গ্রামে একটি মাত্র প্রাকপ্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এই গ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষার হার নাজুক। স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও একই। কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পায় না কোচ পরিবারগুলো। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তিন কিলোমিটার দূরে বারোমারি খ্রিষ্টান পল্লীর দাতব্য হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়। মুমূর্ষু রোগীকে ডাক্তার দেখাতে বা চিকিৎসা নিতে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলা সদরে অথবা ৪০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদর হাসপাতালে যেতে হয়। স্বাধীনতার এত বছর পরও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছায়নি খলচান্দা গ্রামে। আজও আঁধার কাটেনি কোচদের– এমনটিই বলছেন স্থানীয়রা।
খলচান্দা গ্রামের মায়াদেবী কোচ বলেন, ‘আমগর সড়কটা দিয়ে শান্তি মতো যাওন যায় না। আধা মাইল দূর থাইকা দুই বেলা পানি আইনা চলি। এতে আমগর বিরাট কষ্ট অয়। মেঘ (বৃষ্টি) অইলে সড়কা দিয়া হাঁটন যায় না। সরকার যদি আমগরে গ্রামে বেশ কয়ডা টিউবওয়েলের ব্যবস্থা কইরা দিত, বিরাট উপকার অইত।’
বৃদ্ধ রুক্কিনী কোচ জানান, তাঁর বাবার বাড়ি পাশের সমেশ্চুরা গ্রামে। দেশ স্বাধীনের আগে এই গ্রামে বিয়ে হয় তাঁর। এক সময় পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা ছিল। পাহাড় থেকে মরা কাঠ সংগ্রহ আর গাছ থেকে বিভিন্ন ফল পেড়ে খেতেন তারা। অনেক পশুপাখিও ছিল, কিন্তু এখন এই পাহাড়ে আর আগের মতো গাছও নেই, তাদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
গ্রামের রমেশ কোচ ও পরমেশ্বর কোচের ভাষ্য, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের গ্রামের মাত্র তিনজন কোচ সরকারি চাকরি পেয়েছেন। এর মধ্যে বিজিবিতে কর্মরত একজন অনেক আগে মারা গেছেন। অভাব-অনটন আর যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় এই গ্রামের কোচ উপজাতিরা শিক্ষায় এগোতে পারছেন না।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, মাঝে মধ্যেই বন্যহাতি হানা দেয় এই গ্রামে। গাছের কাঁঠাল ও ক্ষেতের ধান পাকার মৌসুমে বন্যহাতির পাল খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। এ সময় হাতির পাল কাঁঠাল, ক্ষেতের ধান খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে দেয়। বাড়িঘরও ভেঙে তছনছ করে ফেলে। তখন এই অসহায় কোচদের টিন পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে, ডাকচিৎকার ও হৈহুল্লোড় করে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। তাদের ভালো-মন্দের খবর কেউ রাখে না। জনপ্রতিনিধিরা শুধু নির্বাচনের সময় ভোট চাইতে আসেন। তাদের পদচারণায় কোচপল্লী তখন মুখর হলেও নির্বাচনের পর তাদের খবর রাখে না কেউ।
স্থানীয় চেয়ারম্যান হাজী জামাল উদ্দিন বলেন, খলচান্দার কোচপাড়া যাওয়ার রাস্তাটার জন্যই অনেক পিছিয়ে আছে কোচ সম্প্রদায়ের লোকগুলো। বিশেষ করে অনিরাপদ রাস্তার জন্য শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তারা। রাস্তা ও স্কুলের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।