আমার বয়স এখন নব্বইয়ের কিছুটা বেশি। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বয়স ছিল চল্লিশের কাছাকাছি। আমাদের বাড়ি সিলেট শহরের দরগাহ মহল্লা এলাকায়। ১৯৭১ সালে আমরা সপরিবার বাড়িতেই ছিলাম। শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর দরগাহের ঠিক কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর বিভিন্ন মারফতে প্রায়ই কানে আসত। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম। কখন কী হয়, এই আতঙ্ক সব সময় কাজ করত। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া শিশুদের বাসার বাইরে বেরোতে দিতাম না।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পবিত্র রমজান মাস আসে। রমজান শুরু হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া গুলি দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আমাদের পাশের বাসার একজন শহীদ হন। চোখেমুখে আতঙ্ক আর ভয় নিয়ে গুলিতে নিহত সেই প্রতিবেশীর মরদেহ আমরা দেখেও এসেছি। এ ঘটনা ঘটার পর মহল্লায় আতঙ্ক আরও ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ে সবাই দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ করে রাখতেন। প্রতিবেশীদের একে অপরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কম হতে থাকে। আমরাও সব সময় বাড়ির গেট বন্ধ করে রাখতাম।

এমন পরিস্থিতিতে রমজান মাস আসে। সব কটি রোজাই রেখেছি। তবে আগের বছরগুলোতে যেমন ঈদের জন্য উচ্ছ্বাস ছিল, সেই আনন্দ মুক্তিযুদ্ধের বছর উধাও। কেবল আমাদেরই নয়, মহল্লার বাসিন্দা যাঁরা ছিলেন, সবারই একই অবস্থা ছিল। অন্যান্য বছর যেমন আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে ইফতারি করতে যেতাম, সেবার আর সেটা হয়নি। ভয় আর অনিশ্চিত জীবনের আশঙ্কায় পুরো রমজান মাস কাটে।

আরও পড়ুনপাকিস্তানি এক সেনা ডেকে বলেছিল, ‘ঈদ মোবারক নেহি বোলগে?’ ২ ঘণ্টা আগে

ঈদের দিনটিও মনে আনন্দের পরিবর্তে ভয় ছিল। অন্যান্য বছরের মতো ঈদের দিন ঘরে ভালোমন্দ রান্না করতে পারিনি। ঈদের জন্য সেমাইসহ কোনো কিছুই কেনা হয়নি। বাচ্চাদের জন্য কেনা হয়নি নতুন কাপড়। পুরোনো কাপড় পরেই ছেলেরা ঈদের নামাজে যায়। আমার স্বামী মুফতি এ এম জালাল উদ্দিন চার ছেলেকে নিয়ে দরগাহ মসজিদে ঈদের জামাতে অংশ নেন। ছোট ছেলের বয়স এক বছর থাকায় সে ঘরেই ছিল। সেবার খুব বেশি মুসল্লির জমায়েত জামাতে হয়নি বলে আমার স্বামী ঘরে এসে জানিয়েছিলেন। নামাজ শেষে মানুষজন কোনো রকমে কোলাকুলি সেরে তাড়াহুড়া করে বাসায় ফেরেন। এ ছাড়া মানুষজনও চিরায়ত রীতি অনুযায়ী একে অন্যের বাড়িতে ঈদের দাওয়াত খেতে খুব একটা যাননি। কেউ কেউ যে ভয় উপেক্ষা করে যাননি, তা-ও আবার নয়। তবে মূলত ওই সময় ঈদ ছিল নিরানন্দের।

শহর ছিল থমথমে আর নির্জন। তাই স্বামী-সন্তানেরা যখন ঈদের জামাতে যায়, তখন বড্ড দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তারা যেন ভালোয় ভালোয় বাসায় ফেরে, আল্লাহর কাছে সেই প্রার্থনা করি। তারা বাসায় ফিরলে ভাত-তরকারি খেতে দিই। ঈদের দিনেও বিশেষ কোনো খাবার সন্তানদের মুখে দিতে পারছি না—এ জন্য মনের ভেতরে চাপা একটা কষ্ট ছিল। তবে পরক্ষণেই ভাবি, দেশের এই দুঃসময়ে পরিবারের সবাই সুস্থভাবে বেঁচে আছি, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে!

অনুলিখন: সুমনকুমার দাশ, সিলেট

আরও পড়ুনপ্রথম প্রতিরোধে তিনি বাজালেন পাগলা ঘণ্টা২৫ মার্চ ২০২১.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ঈদ র দ ন ঈদ র জ রমজ ন

এছাড়াও পড়ুন:

৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই সনদ না হলে অবরোধের হুঁশিয়ারি আপ বাংলাদেশের

জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারির দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস (আপ) বাংলাদেশ। আজ শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে গণজমায়েত থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। দাবি পূরণ না হলে ৬ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে অবরোধ কর্মসূচি পালনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি।

‘৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদের দাবি’ শীর্ষক গণজমায়েতে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আপ বাংলাদেশের নেতা–কর্মীরা। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পার হলেও জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারি না হওয়াকে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন তাঁরা।

আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, ‘আমরা একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। কিন্তু আহতদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। আমরা দেখেছি, যারা জুলাইয়ের নেতৃত্বে ছিল, জুলাইয়ের পরে তাদের পকেট ভারী হয়েছে। আমি বলতে চাই, আপনাদের এই পকেটের হিসাব দিতে হবে।’

অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে আলী আহসান বলেন, ‘আপনারা জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে পারবেন কি পারবেন না, তা জানান; না পারলে আমরা আছি। যারা জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম, বাংলাদেশের (সেই) ২০ কোটি জনগণ জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করবে।’

আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক বলেন, ‘৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে যদি জুলাই ঘোষণাপত্র না হয়, তাহলে ৬ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে অবরোধ শুরু হবে। এ সরকারের কোনো হুমকি আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।’

গণজমায়েতে অংশ নিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বলেন, আপ বাংলাদেশের নেতারা এখনো কোনো প্রটোকল ছাড়া রাস্তাঘাটে হাঁটেন। কিন্তু তাঁরা যেদিন প্রটোকল নিতে শুরু করবেন, সেদিন থেকে তাঁদের বিরুদ্ধেও তিনি কথা বলা শুরু করবেন।

জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারির আহ্বান জানিয়ে শরীফ ওসমান বলেন, এখন পর্যন্ত বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় জুলাই শহীদেরা রাষ্ট্রদ্রোহী। তাঁদেরকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আজকের মধ্যে সরকার দিনক্ষণ না জানালে আগামী ৩ তারিখ (আগস্ট) ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে কফিন মিছিল নিয়ে সচিবালয় অবরোধ করা হবে।

বিগত এক বছর থেকে একটি দুর্বল সরকার দেশ চালাচ্ছে উল্লেখ করে আপ বাংলাদেশের সদস্যসচিব আরেফিন মোহাম্মদ বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে ঘোষণাপত্রের জন্য আমাদের আবারও গণজমায়েত করতে হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে?’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এ বি জুবায়ের বলেন, ‘আমরা যে মৌলিক সংস্কার চেয়েছিলাম, এখনো তার কিছুই হয়নি। এখনো শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত হয়নি। আমি উপদেষ্টাদের উদ্দেশে বলতে চাই, অবিলম্বে জুলাই সনদ ঘোষণা করুন। আপনাদের কাছে আমাদের চাওয়া–পাওয়া খুব বেশি নেই।’

গণজমায়েতে র‌্যাপ গান পরিবেশন করেন আপ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্য আহনাফ তাহমিদ। স্বাগত বক্তব্য দেন জুলাই শহীদ ওসমান পাটোয়ারীর বাবা আবদুর রহমান। গণজমায়েতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন আপ বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী রাফে সালমান রিফাত, প্রধান সংগঠক নাঈম আহমেদ, মুখপাত্র শাহরিন সুলতানা প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ