প্রতিদিন রাতে আমি ওকে চুমু দিতাম, যেন এটাই শেষবার
Published: 7th, April 2025 GMT
এই গল্প আজকের নয়। গল্পটি শুরু হয়েছিল ঠিক এক বছর আগে—১৯ মার্চ ২০২৪ সালে। এটি ছিল যুদ্ধ, ভয়, ক্ষুধা, মৃত্যু, বাস্তুচ্যুতি আর ধ্বংসের এক বছর। এটি ছিল এমন একটি বছর, যেখানে প্রতিটি কোণে মৃত্যু ওত পেতে ছিল। আমি নিজ চোখে মৃত্যু দেখেছি। আমি যে বেঁচে আছি, তা তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, যখন চরম আতঙ্কের মধ্যে আমার প্রসববেদনা শুরু হলো। একটি ক্ষেপণাস্ত্র আমাদের বাড়ির একদম পাশেই আঘাত হেনেছিল। বিস্ফোরণের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল, আর ধাতব টুকরাগুলো উড়ে আসতে লাগল। বাতাস ধোঁয়া আর রক্তের গন্ধে ভরে গিয়েছিল।
আমি নিশ্চিত ছিলাম, সব শেষ। কিন্তু নিজের জন্য ভয় পাইনি। ভয় পেয়েছিলাম আমার সেই অনাগত শিশুর জন্য, যে এখনো সূর্যের আলোও দেখেনি। আমরা কি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাব—আমি, আমার অনাগত সন্তান আর আমার স্বামী?
আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি, চিৎকার করে উঠেছিলাম, ‘আমরা পুড়ে যাচ্ছি! আমরা পুড়ে যাচ্ছি!’ আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম আনন্দ, উষ্ণতা আর উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে আমার সন্তানকে পৃথিবীতে স্বাগত জানাব। কিন্তু তার বদলে সে জন্ম নিল গুলি আর আগুনে ঝলসানো আকাশের নিচে। যতই প্রসবের দিন ঘনিয়ে আসছিল, আমি প্রার্থনা করছিলাম যেন সে শান্তিতে জন্ম নেয়। আমি মরিয়া হয়ে একটা যুদ্ধবিরতির আশায় ছিলাম। কিন্তু ভাগ্য ছিল নিষ্ঠুর।
আমার সন্তান হয়ে গেল আরেকটি যুদ্ধশিশু—যে শিশু জন্মের পরপরই বিস্ফোরণের শব্দে ঢাকা পড়ে গেল, যার ঘর আর দোলনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো, আর যার জীবন শুরু হওয়ার আগেই কেড়ে নেওয়া হলো। আমরা ছিলাম একা—এক জ্বলন্ত পৃথিবীর মাঝে নিঃসঙ্গ।
ইসরায়েলের যুদ্ধ যখন ফিলিস্তিনের এই ছোট্ট ভূখণ্ডকে তছনছ করে চলেছিল, তখন আমার ছিল না কোনো আশ্রয়, ছিল না কোনো স্বস্তি, ছিল না কোনো সহায়তার হাত। আমার একমাত্র শক্তি ছিল আমার গর্ভের সন্তানের ছোট ছোট নড়াচড়া। আমার ভেতরে তার প্রতিটি স্পন্দন যেন একটা ফিসফিসানি ছিল। ছিল একটা প্রতিশ্রুতি—আমরা টিকে থাকব। মৃত্যু আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছিল। কিন্তু কোনোভাবে আমরা টিকে গিয়েছিলাম। আমরা বেঁচে ছিলাম ঘর ছাড়ার পর। ফাঁকা রাস্তাগুলো পেরিয়ে যেখানে বাতাসও যেন শোক বয়ে আনছিল, সে পথে আমরা গুটি গুটি পায়ে হাঁটছিলাম।
আমরা বেঁচে ছিলাম যুদ্ধের নিষ্ঠুর হাত যখন আমাকে আমার পরিবার থেকে ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা বেঁচে ছিলাম প্রিয়জনদের হারানোর পরও বুকের ভেতর সেই ভারী শোক বয়ে নিয়ে। যখন শত্রুরা আমার ঘরটাকে উড়িয়ে দিল, তখন আমি সাত মাসের গর্ভবতী। আমি তখন নিজেকে সেই কথাগুলোই বললাম, যা আল্লাহ মরিয়ম (আ.
তারপর, প্রসবব্যথা শুরু হলো।
প্রতি তরঙ্গে যখন ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছিল, আমি কেবল দয়া আর শক্তির জন্য দোয়া করছিলাম। মুহূর্তটি আনন্দ আর ভালোবাসার হওয়ার কথা ছিল। সে মুহূর্তে কোনো একজনের আমার হাত ধরে সাহস দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে আমি ছিলাম ঘোর অন্ধকারের মধ্যে, মৃত্যুর ছায়ায় ঘেরা এক ভয়াবহ পথে। বিস্ফোরণের শব্দ যেন আমার প্রতিটি প্রসববেদনার সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। আমি আল্লাহর কাছে কাতর হয়ে দোয়া করছিলাম, যেন আমি নিরাপদে আমার সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে পারি, আর তাকে নিজের হাতে একবার হলেও ধরতে পারি। এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই আমার সন্তানের প্রথম কান্না আমাদের অবিনশ্বর শক্তির প্রমাণ হয়ে উঠল।
সেই রাত ছিল প্রচণ্ড ঠান্ডা। বৃষ্টিতে ভিজে থাকা এক রাত। কিন্তু আকাশ ছিল আগুনের মতো জ্বলন্ত। যুদ্ধবিমানগুলো গর্জন করছিল। আর মিসাইলের আলো অন্ধকার চিরে শহরটাকে এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের রূপ দিচ্ছিল। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নিথর সন্তানের দেহ আঁকড়ে ধরে রাখা মায়েদের পাশে আমার মতো নারীরা সন্তান জন্ম দিচ্ছিল। আমি তখনো আমার বাচ্চাটির মুখে চুমু খেতে পারিনি।
অবশেষে সকাল এল। আমার পরিবারও এসে পৌঁছাল। এত দিন পর প্রথমবার মনে হলো, আমার দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন। কিন্তু শান্তি ছিল তেমনই এক স্বপ্ন, যা আমরা বাস্তবে আর দেখিনি। বোমার শব্দ আমার আনন্দের চেয়ে বেশি জোরে বাজছিল। তবু সেদিন আমি এক সিদ্ধান্ত নিলাম: আমার সন্তান ও আমি বেঁচে থাকব। যা কিছু আসবে, তার সঙ্গে লড়াই করব।
কিন্তু লড়াই তো সবে শুরু হয়েছিল। আমি ওকে কী খাওয়াব? একসময় ফাঁকা হয়ে যাওয়া বাজার আবার হঠাৎ করেই ভরে উঠল। কিন্তু সবকিছুর দাম এমন ছিল যে তা কেনা অসম্ভব হয়ে উঠল। মাংস, মাছ, ফল—সবই এক অজানা বিলাসিতা হয়ে গেল। আর কাপড়? বাচ্চাটির কোনো নতুন পোশাক ছিল না। কেবল যুদ্ধের মধ্যে জন্ম নেওয়া অন্য শিশুদের পুরোনো কাপড়েই তাকে ঢেকে রাখছিলাম।
আমার সন্তান জন্ম নিয়েছে এক শরণার্থী হয়ে, এক গৃহহীন শিশু হিসেবে—আমাদের মতোই। আমরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে বেড়াচ্ছিলাম আর আমাদের পেছনে ছিল কেবল মৃত্যু।
যুদ্ধ লম্বা হতে থাকল। সে তখনো এতটাই ছোট যে গ্রীষ্ম আর শীতের পার্থক্য বোঝার বয়সও তার হয়নি। কিন্তু কষ্ট? সেটা সে খুব ভালো করেই বুঝতে শিখেছিল। গরম এমন ছিল যে সহ্য করাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। সে সব সময় ঘেমে থাকত আর কাঁদতে কাঁদতে একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
ইসরায়েল গজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছেউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জন ম ন আম দ র আম র প আম র স র জন য করছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
লবণ শ্রমিকদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়
“প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে কাজ করি। লবণ তুলি, বস্তা ভরি। কিন্তু যে মজুরি পাই, তা দিয়ে এক বেলার চাল-ডালও কেনা যায় না। লবণ চাষের কাজ করলেও আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়।”
এ কথা কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার তাবলেরচর এলাকার লবণ শ্রমিক জাহেদ আলমের। হাজারো লবণ শ্রমিক দিনভর কড়া রোদে ঘাম ঝরালেও মিলছে না ন্যায্য মজুরি। নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন জাহেদ আলমের মতো শত শত লবণ শ্রমিক।
উত্তর ধুরুংয়ের লবণ চাষি রশীদ আহমদ বলেন, “এবার সাড়ে ৫ কানি জমিতে লবণ চাষ করেছি। এই বছর আবহাওয়া ভালো ছিল, উৎপাদনও হয়েছে। কিন্তু দাম পড়ে যাওয়ায় আমরা লোকসানে যাচ্ছি। প্রতিমণ লবণের উৎপাদন খরচ পড়ে ৩৫০ টাকার মতো, অথচ বিক্রি হচ্ছে ১৮০-১৮৫ টাকায়। এই লোকসান শ্রমিকদের মজুরিতেও প্রভাব পড়েছে।”
তিনি জানান, মজুরি দিতে না পারায় একদিকে শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে চাষিরাও হতাশ হয়ে পড়ছেন।
আরমান হোসেন নামে আরেক শ্রমিক বলেন, “লবণের কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। লবণের দাম কম পেলেই চাষিরা আমাদের পারিশ্রমিকের ওপর লোকসান চাপিয়ে দেয়। এতে আমরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হই। এই অনিয়ম দূর হোক।”
চাষিরা বলছেন, একদিকে জমির ইজারা, পলিথিন, লবণ পরিবহন, শ্রমিক মজুরি-সব খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে বাজারে সিন্ডিকেট করে দাম নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতি মণ লবণে তারা ১৭০ টাকার মতো লোকসান গুণছেন। এই লোকসানের কারণে লবণ শ্রমিকরাও দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।
লেমশীখালীর চাষি বেলাল উদ্দিন আকাশ বলেন, ‘‘গত বছর এই সময় প্রতি মণ লবণ বিক্রি করেছি ৪৫০ টাকায়। এখন পাই ১৮৫ টাকা। এতে শ্রমিকের মজুরি দিতেও আমরা হিমশিম খাচ্ছি।”
চাষি আবুল বশর ও সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘সিন্ডিকেট করেই দাম নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে লবণ উৎপাদন কমে যায়। পরে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করার সুযোগ তৈরি হয়। অথচ এতে মাঠের হাজারো শ্রমিকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ছে।”
মহেশখালী লবণ চাষি ঐক্য সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘‘মজুরি না পেয়ে অনেক শ্রমিক লবণের মাঠ ছাড়ছেন। এইভাবে চলতে থাকলে শ্রমিক সংকট হবে।”
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, “চাষিদের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে উৎপাদনে অনীহা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে শ্রমিকদেরও চাহিদা কমে যাচ্ছে। বাজারে দাম কমে যাওয়ার পেছনের কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলার সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় প্রায় ৬৮ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব অঞ্চলে উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ। মৌসুম শেষে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন, যা দেশের বার্ষিক চাহিদার সমান।