অধ্যাপক আহমদ শামসুল ইসলাম আর নেই
Published: 14th, April 2025 GMT
দেশে টিস্যু কালচার ও বায়োটেকনোলজি গবেষণার পথিকৃৎ ও বাংলাদেশি বায়োটেকনোলজিস্টদের সংগঠন জিএনওবিবির প্রতিষ্ঠাতা মডারেটর অধ্যাপক আহমদ শামসুল ইসলাম আর নেই। আজ সোমবার সকালে ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। আহমদ শামসুল ইসলামের মেয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অধ্যাপক জেবা ইসলাম সিরাজ জানিয়েছেন, তাঁর বয়স হয়েছিল ১০০ বছর।
অধ্যাপক আহমদ শামসুল ইসলাম ১৯২৪ সালের ৬ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক, রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট (বিজ্ঞান বিভাগ), প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা থেকে ১৯৪৫ সালে বোটানিতে অনার্স এবং ১৯৪৭ সালে এমএসসি সম্পন্ন করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিলের আর্থিক সহায়তায় যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানিতে (সাইটোজেনেটিকস) পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বীজবিহীন স্ট্রবেরি নিয়ে তাঁর অনন্য গবেষণার জন্য একই বছর কারি মেমোরিয়াল পুরস্কার লাভ করেন।
অধ্যাপক আহমদ শামসুল ইসলাম চার দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পাকিস্তানের সিন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়, তানজানিয়া, নাইরোবির দার-এ-সালাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়িয়েছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে সর্বপ্রথম ‘প্ল্যান্ট টিস্যু কালচার ও জেনেটিকস ল্যাবরেটরি’ স্থাপন করেন, যা দেশে এ ক্ষেত্রে গবেষণার সূত্রপাত করে। লিখেছেন বেশ কিছু পাঠ্যপুস্তক।
শিক্ষা ও গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে কৃষিতে রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক, ১৯৮৬ সালে শিক্ষায় একুশে পদক পেয়েছেন অধ্যাপক আহমদ শামসুল ইসলাম।
আহমদ শামসুল ইসলামের মেয়ে অধ্যাপক জেবা ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বড় ছেলে অধ্যাপক ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ছোট ছেলে খালিদ ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
আজ বাদ জোহর গুলশান আজাদ মসজিদে মরহুমের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন কর ন
এছাড়াও পড়ুন:
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বনাম আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার দেশটির উচ্চশিক্ষার ওপর যে পরিকল্পিতভাবে খড়্গহস্ত হয়েছে, তার কারণ দেশজুড়ে ক্যাম্পাসগুলোয় ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ। তবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সেই তোপ দাগতে গিয়ে বেশ প্রতিবন্ধকতারও সম্মুখীন হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ফলে ফেডারেল সরকারের সঙ্গে চাপান-উতোর লেগে গেছে হার্ভার্ডের।
গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ‘ঠান্ডা যুদ্ধে’র জল বহুদূর গড়িয়ে যাওয়ার পর অবশেষে হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক অ্যালান এম গার্বার ১৪ এপ্রিল যে প্রকাশ্য চিঠির মাধ্যমে সরকারি কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, তা হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তার স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে এক ঐতিহাসিক দলিল।
অবশ্য গার্বারের চিঠির আগেই অনেকেই বলেছিলেন, হার্ভার্ড যদি বুদ্ধিবৃত্তি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় নেতৃত্ব দিতে পারে, তাহলে সরকার খড়্গহস্ত হওয়ার পদক্ষেপ থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। হার্ভার্ডের সিংহভাগ শিক্ষক, বহু শিক্ষার্থী ও প্রাক্তন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী গার্বারের পক্ষে কথা বলেছেন। নামটি হার্ভার্ড বলেই সরকারও কিছুটা চাপে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতায় সরকারের হস্তক্ষেপ
চাপান-উতোর চরমে পৌঁছায় মূলত ফেডারেল সরকারের সাধারণ সেবা প্রশাসন (জেনারেল সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন), স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস) এবং শিক্ষা বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন) যৌথ টাস্কফোর্সের কর্তৃত্ববাদী এক চিঠির পর।
১১ এপ্রিলের এ চিঠিতে টাস্কফোর্স হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষকে ১০টি দাবি আমলে নিতে বলে। এগুলোর মধ্যে আছে: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও নেতৃত্বের ব্যবস্থায় সংস্কার, মাস্ক নিষিদ্ধকরণ, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গীয় বিবেচনা বন্ধ করে সরাসরি মেধার প্রাধান্য, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া সংস্কার, যেসব বিষয় ও পাঠ্য অ্যান্টিসেমিটিজমের বিরুদ্ধে, সেগুলো রদ করা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে এ সংস্কারগুলো ২০২৫ সালের আগস্টের মধ্যে শুরু করতে হবে এবং অন্তত ২০২৮ সাল পর্যন্ত চলমান রাখতে হবে।
এ ছাড়া সবচেয়ে কঠোরভাবে বলা হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ডাইভার্সিটি, ইকুইটি ও ইনক্লুশন’ (ডিইআই) ভিত্তিক সব প্রোগ্রাম বা বিভাগ বন্ধ করতে হবে। আর শেষ দাবি হিসেবে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই উচ্চশিক্ষা অধ্যাদেশের ১১৭ ধারা মেনে সব অর্থনৈতিক উৎস ও বৈদেশিক অর্থায়নের তথ্য ফেডারেল সরকারকে জানাতে হবে এবং এ–সংক্রান্ত তদন্তে সরকারকে সহায়তা করতে হবে। অভিবাসনসংক্রান্ত সব বিষয় দেশীয় নিরাপত্তা বিভাগকে অবহিত করার পাশাপাশি স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ ভিজিটর ইনফরমেশন সিস্টেমের (সেভিস)সব শর্ত পূরণ করতে হবে।
১৪ এপ্রিল হার্ভার্ড তার অবস্থান জানানোর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল চুক্তি ও অনুদানের মধ্য থেকে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল তহবিল স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। শুধু তা–ই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির করছাড়ের সুবিধা বাতিল করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তি করতে না দেওয়ার ব্যাপারেও হুমকি দেয়।
স্বভাবতই টাস্কফোর্সের এমন বক্তব্যকে বিশ্বজুড়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানসাধনা ও চিন্তার স্বাধীনতায় সরকারি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সমালোচনাও হচ্ছে। গার্বারও সম্ভবত ভাবতে পারেননি, এই কর্তৃত্ববাদিতার বিরুদ্ধে জনভাষ্য দিয়ে এত বিশাল সমর্থন তিনি অর্জন করবেন। সর্বশেষ খবর হলো, ১৮ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফেডারেল আদালতে তহবিল স্থগিতের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। চলমান সরকারি কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে হার্ভার্ডই সরকারি নির্দেশনা প্রত্যাখ্যান ও মামলা করার নজির স্থাপন করেছে।
হার্ভার্ড প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক চিঠি
সরকারের উচ্চশিক্ষাবিরোধী নীতির সমালোচনা করে হার্ভার্ড প্রেসিডেন্ট ‘আমেরিকান উচ্চশিক্ষার অঙ্গীকার’ শীর্ষক চিঠিতে অনেক বিষয়েই খোলামেলা আলোচনা করেছেন। সরকারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীদারত্বের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে তিনি শুরুতেই বলেছেন, ‘বিগত কয়েক সপ্তাহে ফেডারেল সরকার ক্যাম্পাসে অ্যান্টিসেমিটিজমের (ইহুদিবিদ্বেষ) অভিযোগে হার্ভার্ডসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারত্ব বাতিলের হুমকি দিয়েছে, অথচ এগুলো আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফলপ্রসূ ও লাভজনক অংশীদারত্ব।’
অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনা লালনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে হার্ভার্ড গত ১৫ মাসে অ্যান্টিসেমিটিজম রোধে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে বিষয়েও আলোকপাত করেছেন হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্টের। সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার, আইনের ব্যত্যয় ঘটানো, হার্ভার্ডের পাঠদান ও শিখনপ্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ এবং কার্যপ্রণালির ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে এসব অর্জন করা যাবে না।’
অ্যালান এম গার্বার লিখেছেন, ‘এটা পরিষ্কার যে অ্যান্টিসেমিটিজিম রোধে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক ও গঠনমূলক উপায়ে কাজ করার কোনো অভিপ্রায় আসলে (সরকারের) নেই। যদিওবা সরকারের প্রস্তাবিত কিছু দাবি অ্যান্টিসেমিটিজম রোধের উদ্দেশ্যে বলা, কিন্তু অধিকাংশই হার্ভার্ডের “বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ” সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার পাঁয়তারা।’
এই সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব হার্ভার্ড মানবে না বলে গার্বার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমরা প্রশাসনকে আমাদের আইনি পরামর্শকের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছি, আমরা তাদের প্রস্তাবিত চুক্তি মানব না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাধীনতা সমর্পণ করবে না কিংবা সাংবিধানিক অধিকার বিসর্জন দেবে না।’
ফেডারেল সরকারের অধিকারের সীমানা উল্লেখ করে অধ্যাপক গার্বার লিখেছেন, ‘প্রশাসনিক এই নির্দেশাবলি ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারবহির্ভূত। এসব হার্ভার্ডের প্রথম সংশোধনীতে প্রদত্ত অধিকারের বরখেলাপ এবং টাইটেল ছয় অনুযায়ী সরকারি ক্ষমতার সংবিধিবদ্ধের সীমা অতিক্রম। এই দাবিগুলো জ্ঞানের সাধনা, সৃজন ও প্রচারের জন্য নিবেদিত একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে হার্ভার্ডের মূল্যবোধের জন্য হুমকিস্বরূপ।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো ছাড় না দেওয়ার অঙ্গীকার করে হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্টের খুব সহজ করে বলেছেন, ‘ক্ষমতায় যে দলই থাকুক না কেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী পড়াতে পারবে, কাকে ভর্তি করতে পারবে, কাকে নিয়োগ দিতে পারবে, অধ্যয়ন ও অনুসন্ধানের কোন ক্ষেত্রগুলো অনুসরণ করতে পারবে, তা কোনো সরকারই নির্ধারণ করে দিতে পারে না।’
গার্বার চিঠিটি শেষ করেছেন এই বলে, ‘চিন্তা ও অনুসন্ধানের স্বাধীনতার পাশাপাশি একে শ্রদ্ধা ও রক্ষা করতে দীর্ঘদিনের সরকারি প্রতিশ্রুতি নানামাত্রিক মুক্ত সমাজ এবং আরও স্বাস্থ্যময় ও উন্নত মানবজীবন গড়তে সারা বিশ্বেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিশ্চয়তা দিয়ে এসেছে। আমরা সবাই সেই স্বাধীনতা রক্ষার অংশীদার। সব সময়ের মতোই এবারও আমরা এই দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাব যে দুঃসাহসিক ও শৃঙ্খলমুক্ত সত্যানুসরণই মানবজাতিকে স্বাধীন করে তোলে। আমাদের দেশ ও জগতের প্রতি আমেরিকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থায়ী অঙ্গীকারকে আমরা বিশ্বাসের সঙ্গে লালন করব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনগত দায়িত্ব হলো মুক্তচিন্তার পরিবেশকে সুনিশ্চিত করা। গার্বারের চিঠির প্রতিটি বাক্য ও বাক্যগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাও যেন সেই প্রতিশ্রুতিই পুনর্ব্যক্ত করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও আমাদের অতীত
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ আমল থেকেই বহুবিধ লড়াই হয়েছে এবং কখনো কখনো খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সরকারের বিপক্ষে কথা বলেছেন। ভাইসরয় লর্ড কার্জনের সময়ে প্রণীত ‘ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯০৪’-কে সরকারি নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখা হয়েছিল এবং এর বিরুদ্ধে তুমুল জনসমালোচনা ও জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল।
এর আরও পরে সরকারের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে নেতৃত্ব দেন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি। তৎকালীন মাত্র আড়াই লাখ টাকার অর্থ বরাদ্দকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতায় সরকার হস্তক্ষেপ করায় ১৯২২ সালের ২ ডিসেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনেটে সভাপতির ভাষণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।
স্যার আশুতোষ মুখার্জি বলেছিলেন, ‘আমার শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকতে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবমাননার কোনো কাজে অংশগ্রহণ করব না। এ বিশ্ববিদ্যালয় দাস উৎপাদনের কারখানা হবে না। আমরা সত্যচিন্তা করতে চাই। আমরা স্বাধীনতার শিক্ষা দিতে চাই। আমরা উঠতি প্রজন্মকে উচ্চ ও নৈতিক মানোন্নয়নের চিন্তাভাবনায় অনুপ্রাণিত করব। আমরা সরকারি সচিবালয়ের অংশ হব না...আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্যদের অনুরোধ জানাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। বাংলার সরকারকে ভুলে যান, ভারত সরকারকে ভুলে যান। আপনাদের আলমা মাতের প্রকৃত সন্তান হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর হিসেবে আপনাদের দায়িত্ব পালন করুন। স্বাধীনতা প্রথম, স্বাধীনতা দ্বিতীয়, স্বাধীনতা সর্বদা—এ ছাড়া অন্যকিছু আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না।’
পাকিস্তান আমলে স্বৈরাচার আইয়ুব খানের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন উপাচার্য সরকারের চাপিয়ে দেওয়া নানা নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন; এরশাদের সময়েও তা–ই হয়েছিল। এমনকি সরকারি নীতির বিরোধিতা করে কেউ কেউ পদত্যাগও করেছিলেন।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে চারবারের মধ্যে তিনবার সেরা তিনে ছিলেন। দ্বিতীয়বার সর্বোচ্চ ভোট পেলে তাঁকে উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সরকারি চাপে নতিস্বীকার করবেন না বলে এরশাদ আমলে সেই পদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।
দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশেও সরকার বা রাষ্ট্রের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো আত্মমর্যাদাবোধ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তি বা শিক্ষকদের একদা ছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাকে তো রাষ্ট্রবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ এবং উপনিবেশবিরোধী বিদ্যায়তনিক ইতিহাসের জায়গা থেকেই পাঠ করা যায়। কিন্তু আমাদের উল্টোরথে যাত্রার উদাহরণও বহু।
আমাদের হাল দশা ও ‘আবু জুনায়েদগণ’
হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি কর্তৃত্বের সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশে খোদ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনই সরকারি খবরদারিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। সেখানে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা তো অচিন্তনীয়। আশ্চর্যই বটে, বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখনো তাদের সিলেবাস ইউজিসির অনুমোদন নিয়ে চূড়ান্ত করতে হয়! বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণবিধিতে চিন্তা ও বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতার কথা লেখা থাকলেও অন্যত্র লেখা থাকে যে সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির বিরুদ্ধে এমন কিছু বলা যাবে না, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে।
কয়েক দিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৮টি বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দিয়ে কলা, মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানভুক্ত বিষয় বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা সেই চিঠির সঙ্গে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ‘নতুন বন্দোবস্তে’ কুয়েটের অব্যাহতিপ্রাপ্ত উপাচার্যের যে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবিরোধী অবস্থান, তা বলে দেয় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও তাদের উপাচার্যদের খাসলত বিগত রেজিমেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। গত ১৫ বছরে উচ্চশিক্ষা ধ্বংসে এই বিশ্ববিদ্যালয় ও উপাচার্যদের কর্মকাণ্ডের কথা ভাবলে আমাদের লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ হতে হয়। আমল বদলালেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আমলাতন্ত্র বদলায়নি।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসনের অলংকার পরাতে জন্ম নেয় ‘বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩’। কিন্তু সেই অধিকার কাজে লাগানোর চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন ও ক্ষমতালিপ্সু শিক্ষকেরা বিভিন্ন সরকারের পদলেহন করে সেই অধ্যাদেশেরই উল্টো মর্যাদাহানি করেছেন।
১৯৯৫ সালে প্রকাশিত আহমদ ছফার লোকপ্রিয় উপন্যাস গাভী বিত্তান্ত সেসব উপাচার্যেরই গল্পের সারবত্তা আমাদের সামনে হাজির করে। একটি গাভির জীবনকে ভিত্তি করে রচিত রম্যরসাত্মক উপন্যাস হলেও এখানে ছফা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থা, শিক্ষকদের হালহকিকত ও সর্বোপরি একজন উপাচার্যের বিদ্যায়তনিক অযোগ্যতার দৃশ্য চিত্রায়িত করেছেন।
এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ক্ষমতার স্বাদ পেতে ও ক্ষমতাবানের পূজারি হওয়ার কী আপ্রাণ চেষ্টা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা করে থাকেন! তাঁরা প্রত্যেকেই একেকজন সম্ভাবনাময় মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ (ওই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র ও বাংলাদেশের ‘শ্রেষ্ঠ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্টের অবস্থান বিবেচনা করলে বাংলাদেশে এমন উপাচার্যের সন্ধান সম্ভবত শুধু স্বপ্নেই কল্পনা করা যাবে! আইনি অধিকার থাকার পরও স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাষ্ট্র ও সরকারের দাসত্ব থেকে যে মুক্ত করতে পারিনি। এর অন্যতম কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে থাকা ‘আবু জুনায়েদগণ’, যারা ভীষণ রকম সরকারভীরু ও সরকারপ্রেমি। এর ফলে জ্ঞান সৃজন ও মুক্তচিন্তা লালনের প্রশ্নে সরকারি ‘হুকুমতের’ বাইরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার তাৎপর্যকে আজও আমরা উপলব্ধিই করতে পারিনি।
ড. সৌমিত জয়দ্বীপ সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়