ছয় দফা থেকে এক দফার আন্দোলন চলছে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট)। সেখানে উপাচার্যের অপসারণ চান শিক্ষার্থীরা। বুধবার এ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন তারা।
কুয়েটে এ পরিস্থিতির সূচনা হয় দুই মাস আগে। ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। সেখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জের ধরেই এমন হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলার সময় আমরা দেখেছি, রামদা হাতে থাকা যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। সেই হামলায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হলেও প্রশাসন এক প্রকার নীরবই ছিল।
পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনিক ভবনসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। প্রশাসন অবশ্য সিন্ডিকেটের বৈঠক করে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। একই সঙ্গে খানজাহান আলী থানায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে। ২৫ ফেব্রুয়ারি কুয়েট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
এরই মধ্যে বিস্ময়করভাবে, ঘটনার প্রায় দুই মাস পর ১০ এপ্রিল কুয়েটের ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন খুলনার এক ব্যক্তি। অভিযুক্ত প্রায় সবাই ১৮ ফেব্রুয়ারিতে হামলার শিকার হয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কুয়েট প্রশাসনের প্ররোচনায় এ মামলা করা হয়েছে। তাদের দাবি, প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া বাইরের কোনো ব্যক্তির পক্ষে এতজন শিক্ষার্থীর নাম-পরিচয় জানা সম্ভব নয়। আরও আশ্চর্যের বিষয়, ১৪ এপ্রিল সোমবার কুয়েটের সিন্ডিকেট সভায় যে ৩৭ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়, তারাও মার খাওয়া শিক্ষার্থী। আন্দোলনকারী একজন শিক্ষার্থী সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘কোপ খাইলাম, গুলি খাইলাম, মামলা খাইলাম আবার বহিষ্কারও খাইলাম।’
২৫ ফেব্রুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া কুয়েট প্রশাসন এমনকি ঈদের পরও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এদিকে ৭ এপ্রিল ‘কুয়েট ১৯’ পেজ থেকে শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন– তারা সবাই ১৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে উঠবেন। ঈদের দীর্ঘ ছুটির পর যেখানে ৮-৯ এপ্রিল সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছিল, সেখানে কুয়েট প্রশাসন ৮ এপ্রিল বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার বিষয়টি ছাত্রছাত্রীদের জানায়। প্রশাসন এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। মোবাইল ফোনে অভিভাবকদের বার্তা দিয়ে জানায়– কুয়েট এখনও খোলেনি; তারা যেন তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে না পাঠায়। শুধু তাই নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার একই দিনে কেএমপি কমিশনারকে চিঠি দিয়ে ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েনের আহ্বান জানান। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ ছিল, ১৫ এপ্রিল থেকে দাপ্তরিক কার্যক্রম খোলা হবে। তারপরই আমরা দেখলাম, ১০ এপ্রিল কুয়েট শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হলো।
প্রশাসন ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক হল বন্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি; হলের ওয়াইফাই, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়, যাতে শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই হলে থাকতে না পারেন। কিন্তু এর মধ্যে হামলার দুই মাস পার হলেও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের বিচার কিংবা তাদের চিহ্নিত করে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়নি। ক্যাম্পাসের পরিবেশ রক্ষা ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য যে সময়ে হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি ছিল, সে সময় বরং দেখা গেল কুয়েট প্রশাসন সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা বহিষ্কারাদেশ ও মামলা প্রত্যাহার, হল খুলে দেওয়াসহ ছয়টি দাবি জানান। তারা ১৩ এপ্রিল কুয়েটে এলেও হল খুলে দেওয়া হয়নি। দুই দিন তারা প্রশাসনিক ভবনের সামনে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটান। দাবি পূরণ না হওয়ায় ১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে প্রতিটি বিভাগের সামনে গিয়ে হ্যান্ডমাইকে হল খুলে দেওয়ার আহ্বান জানান। এর পরও সাড়া না পেয়ে ছাত্ররা খানজাহান আলী, ড.
স্বাভাবিকভাবেই কুয়েটের আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়টির মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। কুয়েটের ৩৭ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার ও ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনায় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) প্রশাসনের ভূমিকা সত্যিই হতাশাজনক। বিশ্ববিদ্যালয়টি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করেছে; ভালো কথা। তাদের এ সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীরাও মেনে নিয়েছে। বস্তুত, সেখানকার সাধারণ শিক্ষার্থীরাও চায় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক। এই দাবির বিপরীতে দাঁড়িয়ে যখন ছাত্রদলের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, তখন কুয়েট প্রশাসনের উচিত ছিল শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে হামলাকারীদের বিচার করা। অথচ যে ঘটনাপ্রবাহ আমরা দেখছি, সেখানে প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ এবং সে কারণেই কুয়েট উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হওয়ার মানে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন হুমকিতে পড়া। বিশেষ করে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর সব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন স্বস্তির পরিবেশ ফিরে এসেছে; হলগুলো যখন লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে এসেছে; যখন ক্যাম্পাসে পুরোদমে পড়াশোনা হওয়ার কথা, তখন দুই মাস যাবৎ কীভাবে কুয়েট বন্ধ থাকে! উপাচার্য ও কুয়েট প্রশাসনকে অবশ্যই এ জন্য জবাবদিহি করতে হবে। ছাত্রদের বহিষ্কারাদেশ ও মামলা উভয়ই অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার জরুরি। এমন উপাচার্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ছ ত র র জন ত উপ চ র য র
এছাড়াও পড়ুন:
বিগ-বির মাধ্যমে জাপানের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী বাংলাদেশ
এক দশক আগে বঙ্গোপসাগর ঘিরে বাংলাদেশের জন্য বিগ-বি নামে পরিচিত বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট গ্রহণ করেছিল জাপান। বঙ্গোপসাগরীয় শিল্প প্রবৃদ্ধির ওই উদ্যোগে রয়েছে মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ প্রকল্প আর আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার বিকাশ। মে মাসের শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জাপান সফরে বিগ–বির মাধ্যমে সহযোগিতা জোরদারের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। তাঁর জাপান সফরের আগে টোকিওতে ১৫ মে অনুষ্ঠেয় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকেও বিষয়টিতে প্রাধান্য দেবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠকের প্রস্তুতি হিসেবে বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে জাপানের আলোচনায় কোন কোন বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার থাকবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
১৫ মে টোকিওতে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে জসীম উদ্দিন বাংলাদেশের এবং জাপানের জ্যেষ্ঠ উপমন্ত্রী আকাহোরি তাকেশি তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে কোন কোন বিষয়গুলো ১৫ মের আলোচনায় প্রাধান্য পেতে পাবে, তা নিয়ে মতামত নেওয়া হয়। পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফরসহ সচিব পর্যায়ের সফর নিয়ে আলোচনা হয়।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিগ–বিতে সহযোগিতা জোরদারের পাশাপাশি ব্যবসা, বিনিয়োগ, নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ খাতভিত্তিক সহযোগিতা জোরদারের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নানা বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন সফর নিয়ে আলোচনা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, টোকিওতে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকটি দুই ভাগে বিভক্ত থাকবে। প্রথম ভাগে থাকবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা বিষয়। আর দ্বিতীয় ভাগে থাকবে আঞ্চলিক ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি।
আঞ্চলিক বিষয়াদিতে জাপানের বিগ–বি নিয়ে আলোচনা হবে। এ সময় ঢাকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের বাস্তবতা তুলে ধরা হবে। সেই সঙ্গে এ প্রকল্প সামনে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টিও বলা হবে। পরে ভারত যদি এর সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, তবে তার ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হবে।
বিগ–বির সঙ্গে ২০২৩ সালে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলকে যুক্ত করে জাপান। কিন্তু ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে চরম টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক। এমন এক প্রেক্ষাপটে বিগ–বিকে বিশেষ করে সংযুক্তিকে বাংলাদেশের পরিমণ্ডলে নেওয়ার পরিকল্পনায় আপাতত একটা ধাক্কা এসেছে। এ নিয়ে জাপান নানাভাবে নিজেদের অস্বস্তির বিষয়টি বাংলাদেশকে জানিয়েছে। বিগ–বি জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের অগ্রাধিকার প্রস্তাব হওয়ায় এটিতে বিশেষ গুরুত্ব আছে টোকিওর। তাই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আগ্রহী জাপান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং প্রধান উপদেষ্টার টোকিও সফরে জাপান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিবিড় করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কাছ থেকে সমরাস্ত্র বিক্রির ওপর কয়েক বছর ধরে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে জাপান।
বাংলাদেশকে ২০২৩ সালে জাপানের সরকারি নিরাপত্তা সহায়তায় (ওএসএ) যুক্ত করা হয়েছে। মূলত জাপান নিজের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে এই কাঠামো তৈরি করেছে। ওএসএর মাধ্যমে জাপান বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও গভীর করার এবং ওই দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা দিয়ে থাকে। ওএসএর মাধ্যমে জাপান একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে ঋণের পরিবর্তে অনুদান দিয়ে থাকে।