শিবব্রত বর্মণের শোধ উপন্যাসটির কাহিনিতে যা আছে, তা ইতিহাস আর উপন্যাসের দ্বৈততার সবচেয়ে ভালো সংশ্লেষিত রূপ হিসেবে জারি থাকবে বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণ প্রসঙ্গে। যে উপন্যাসের মূল বিষয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গৌরবময় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অধিকৃত বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল এবং এই অঞ্চলের কিছু মানুষকে নিয়ে। বিষয়টিকে এমন এক ‘নন-ভায়োলেন্স’ পদ্ধতিতে তিনি নিয়ে এলেন উপন্যাসে, যা ইতিহাস আর উপন্যাসের এক দারুণ সমন্বিত রূপ হয়ে উঠল।
উপন্যাসটিতে একদম শেষে কেবল কিছু ‘সহিংসতার মতো’ বিষয় এসে ধরা দিয়েছে। বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক কিংবা সাহিত্যিক বয়ানে এই বিষয় লক্ষ করা যায়: পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর যুদ্ধ। কিন্তু এই উপন্যাসে সে বিষয় নিয়ে আলাপ বেশ কমই হয়েছে। বরং এই উপন্যাসে এই প্রথাগত বয়ানের বাইরে গিয়ে একটি এলিট শ্রেণির রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাই প্রাধান্য পেয়েছে।
শোধ পড়ে শেষ করার পর একজন প্রকৃত পাঠক বলতে বাধ্য হবেন, ‘দুর্দান্ত একটা উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম!’ ইতিহাস যে এভাবে কথাসাহিত্য হতে পারে, তা ঔপন্যাসিক ‘দাবা’ গল্পে আমাদের একটু জানান দিয়েছিলেন, কবছর আগে। সেটা এবার পুরোপুরি করে দেখালেন এই উপন্যাসে। কারণ, সুরাইয়া গল্পগ্রন্থের ‘দাবা’ গল্প যেখানে শুরু হয়েছিল, শোধ উপন্যাস সেইখানে প্রায় শেষ হয়েছে।
এই উপন্যাসটির প্লট এগিয়েছে দাবা খেলার সঙ্গে। উপন্যাসের সূচনা হয়েছে নিম্নোক্ত বাক্য দিয়ে, ‘দাবা এক হিংস্র খেলা। যে বোঝে সে জানে’। এই বাক্য দিয়ে শুরু হওয়ার ভেতর এক নতুন গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেছে দুজন দাবাড়ু। সঙ্গে এগিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: আফসান চৌধুরী আর ফিরোজ বেগের ভেতর চলমান দাবার লড়াই পরবর্তী সময়ে এই জনযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে একই বিন্দুতে। ঔপন্যাসিক দৈশিক আর বৈদেশিক রাজনীতির নানা ঘটনাকেও একত্র করেছেন দাবার চালের সঙ্গে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আরও হলো, আফসান চৌধুরী দাবা খেলার বিষয়টি একান্তই নিজ থেকে শিখেছে। অপর দিকে ফিরোজ বেগ দাবা খেলা শিখেছে একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির ভেতর দিয়ে। আর এই বিষয়টি ঔপন্যাসিক পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে মিলিয়েছেন। অর্থাৎ আফসান চৌধুরী যেমন দাবা খেলেছে একজন প্রশিক্ষিত ও পদকধারী ব্যক্তির বিপরীতে, ঠিক একইভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁরাও কোনো রাষ্ট্রীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কোনো প্রশিক্ষিত বাহিনী হিসেবে কাজ করেননি। কিন্তু তারপরও ফিরোজ বেগ দাবা খেলায় মার খেয়েছে আফসান চৌধুরীর কাছে। আর মুক্তিযুদ্ধে দারুণভাবে মার খেয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, এই অনিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বললে গেরিলাদের কাছে। এসব বিষয় আবার, মানে গেরিলাযুদ্ধ সম্পর্কে আফসান চৌধুরীর পড়ালেখাও ছিল। কারণ, ক্লজভিটাস পড়ার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল বলেই ঔপন্যাসিক জানাচ্ছেন উপন্যাসে।
এই উপন্যাসের একটি ঐতিহাসিক সত্য ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত টর্চার সেলের অনুষঙ্গ। এ বিষয়ে জাহানারা ইমাম আমাদের জানিয়েছেন তাঁর একাত্তরের দিনগুলি শীর্ষক স্মৃতিকথায়। কিন্তু বিষয় তার চেয়ে আরও একটু এগিয়ে। এই উপন্যাসে আফসান চৌধুরী যা করেনি, তার জন্য ফিরোজ বেগের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এমন সৈনিকদের দিয়ে তাকে টর্চার সেলে নিয়ে যায়। সেখান থেকে মুক্তিও পাবে বলে জানায় ফিরোজ বেগ, যদি আফসান চৌধুরী দাবা খেলায় তার কাছে হারতে রাজি থাকে। কিন্তু উপন্যাসের শেষে এসে দৃশ্যমান হয়, যে চালে ফিরোজ বেগ তাকে পাকিস্তান আর্মির হাতে তুলে দিয়েছিল, ঠিক সেই চালেই আফসান চৌধুরী আবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বেশ ভালোমতোই ভড়কে দিয়েছে। এই দুটি প্রধান কাহিনি ছাড়া, এই কম পরিসরের উপন্যাসে, ষাট-সত্তরের দশকের উঠতি ঢাকার নানা বিষয় গ্রন্থিত হয়েছে, যা সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
সব ছাড়া, এই উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর থ্রিলারধর্মিতা। একটা টান টান উত্তেজনা পাঠক সব সময়ই নিজের উপলব্ধিতে অনুধাবন করতে পারবেন। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত বহু ক্লিশে উপন্যাসের চেয়ে এই উপন্যাস বেশখানিক ভিন্নতা আনতে পারবে। ঔপন্যাসিক দারুণ এক ভাষিক বয়ান-নির্মাণের মাধ্যমে উল্লেখিত প্রায় সবকিছুকে নির্মাণ করেছেন, বেশ সংহতভাবেই যা পাঠককে এই উপন্যাস একবসায় পাঠ করতে বাধ্যই করবে।
শোধ
শিবব্রত বর্মন
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৫; প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী; ৮৮ পৃষ্ঠা;
দাম: ২৭৫ টাকা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আফস ন চ ধ র উপন য স র ঔপন য স ক
এছাড়াও পড়ুন:
শিক্ষক রায়হান অভিযুক্ত হলেও নাম নেই অস্ত্র ব্যবসায়ীর
সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শ্রেণিকক্ষে গত বছরের ৪ মার্চ শিক্ষার্থীকে গুলির একটি মামলায় গত ৩১ জানুয়ারি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে ডিবি। এতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীকে গুলি করা কলেজের কমিউনিটি মেডিসিনের প্রাক্তন শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে অভিযোগপত্রে নাম নেই যার কাছ থেকে ডা. রায়হান অস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন সেই এস এস আল হোসাইন ওরফে সোহাগের। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার নওদাপাড়ার সোহাগের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র-বিস্ফোরক ও নাশকতার একাধিক মামলা আছে।
গত বছরের ৪ মার্চ ব্যাগভর্তি অস্ত্র-গুলি নিয়ে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ভয় দেখান শিক্ষক রায়হান। তার দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করায় তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত আমিন তমালকে লক্ষ্য করে শিক্ষক রায়হান গুলি করেন। শিক্ষার্থী তমাল বাম উরুতে গুলিবিদ্ধ হলেও বর্তমানে সুস্থ। ওই ঘটনায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ব্যাগভর্তি অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন শিক্ষক রায়হান। তাঁর ব্যাগে লাইসেন্সবিহীন দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি জাপানি সামুরাই, ১০টি বার্মিজ ছুরি ও ৭৮ রাউন্ড তাজা গুলি পাওয়া যায়। ডা. রায়হানের বিরুদ্ধে সে সময় আহত শিক্ষার্থী তমালের বাবা বগুড়ার আবদুল্লাহ আল আমিন হত্যাচেষ্টা ও ডিবি পুলিশ বিস্ফোরক আইনে মামলা করেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার হন রায়হান। যদিও পরবর্তী সময়ে জামিন নিয়ে রায়হান এখন পলাতক। ঘটনার পর থেকে উধাও অস্ত্র ব্যবসায়ী সোহাগও।
পুলিশ সূত্র জানায়, ডা. রায়হান সিরাজগঞ্জ আদালতে স্বীকারোক্তি ও জবানবন্দি দেন। তিনি জানান, সোহাগের কাছ থেকেই সব অস্ত্র কিনেছেন। এরপর অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে সোহাগ ও রায়হানের বিরুদ্ধে মামলা করেন সিরাজগঞ্জ ডিবি পুলিশের সাবেক এসআই ওয়াদুত আলী। অভিযোগ উঠেছে, অভিযোগপত্র থেকে সোহাগের নাম বাদ দিয়েছেন ডিবির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা এসআই নাজমুল ইসলাম ও ইউনিট ওসি ইকরামুল হোসাইন। ডিবির তদন্ত ও দাখিলকৃত অভিযোগপত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তাঁর বাবা।
সিরাজগঞ্জ ডিবির এসআই নাজমুল হক নতুন তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করলেও তিনি এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তাঁর ইউনিটপ্রধান বর্তমান ওসি ইকরামুল হোসাইন আজ ২৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার কাছে থেকে পুলিশ পদক নিতে ঢাকায় রয়েছেন। তিনি ফোনে দাবি করেন, ডা. রায়হান আদালতে ১৬৪ ধারায় বিচারকের সামনে সোহাগের নাম বললেও তাঁর বাবা বা গ্রামের নাম জানাতে পারেননি। মামলার বাদী এজাহারে যে সোহাগের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করেন, তিনি এতে জড়িত নন। বিএনপি করার কারণে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়রানি করতেই আগের সরকারের সময় সাবেক এসপি ও ওসি সোহাগকে জড়িয়েছেন। শিক্ষক রায়হান যে সময় অস্ত্রগুলো কিনেছিলেন, তার আগে থেকেই সোহাগ ঢাকা ও ভারতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইমিগ্রেশন ও হাসপাতাল সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
এ বিষয়ে সাবেক এসপি আরিফুল ইসলামের বক্তব্য পাওয়া না গেলেও মামলার বাদী ডিবির সাবেক এসআই ওয়াদুত আলী বলেন, শিক্ষক রায়হানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে সোহাগের কথোপকথন ও লেনদেনের বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায়। তাই এজাহারে সোহাগের নাম ও মোবাইল নম্বর উল্লেখ করা হয়।
সমকালের অনুসন্ধানেও সাবেক এসআই ওয়াদুত আলীর এজাহার অনুযায়ী সোহাগের ফোন নম্বরের কল ডিটেইল এবং এনআইডি নম্বর সংগ্রহ করা হয়। সেখানে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা সোহাগেরই তথ্য ও ছবি পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে অজ্ঞাত স্থান থেকে শিক্ষক রায়হান শরীফ গতকাল ফোনে বলেন, ‘আমি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। ডিবির চার্জশিটের বিষয়টি জানি না।’
মামলার সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ইব্রাহিম হোসেন বলেন, চার্জশিট থেকে সোহাগকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি আত্মঘাতী ও তদন্তের নীতিমালার বাইরে।
জানা গেছে, ভেড়ামারার স্বেচ্ছসেবক দলের সদস্য সচিব কথিত অস্ত্র ব্যবসায়ী সোহাগ। গতকাল তিনি ফোনে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র, খুন ও নাশকতা মামলাগুলো রাজনৈতিক। আমি অস্ত্র ব্যবসায়ী নই। রাজনৈতিক এক নেতার বিরুদ্ধে মামলা করায় আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।
রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা স্বাধীন হলেও পুলিশ সুপার, সার্কেল অফিসার ও সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ওসি সুপারভাইজরি অথারিটি। বিষয়টি খতিয়ে দেখব।