শিল্পের শহর কি ফিরে পাবে হারানো গৌরব
Published: 26th, April 2025 GMT
খুলনার নাম উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত সারি সারি শিল্পকারখানা, শ্রমিকের কর্মব্যস্ত মুখ আর অর্থনীতির গতিময় চাকা। পাটকলের সাইরেন, নিউজপ্রিন্ট মিলের অবিরাম ঘূর্ণি আর ছোট-বড় কারখানার অবিরাম কোলাহলের মধ্যেই ছিল খুলনার পরিচয়। এ শহর শুধু ইট-পাথরের সমষ্টি ছিল না; ছিল উন্নত জীবনের সন্ধানে আসা স্বপ্নবাজ মানুষের ঠিকানা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আশায় বুক বেঁধে এখানে আসত। খুলনা হয়ে উঠেছিল তাদের আশ্রয়, তাদের জীবিকার উৎস।
আবুল কালাম সামসুদ্দিন তাঁর শহর খুলনার আদি-পর্ব বইয়ে খুলনাকে স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ১৮৭৫–৭৬ সালের দিকে বিভিন্ন দিক দিয়ে সুন্দরবনের গুরুত্ব ও ভূমিকা সরকারের কাছে অনুভূত হতে থাকে। বাংলার গভর্নর রিচার্ড টেম্পল সুন্দরবনের অবস্থা সরেজমিনে তদন্ত করে অনুভব করেন, সুদূর যশোর বা ২৪ পরগনা থেকে সুন্দরবন অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা খুব দুরূহ। এর আগেও এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের রাজস্ব ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে সুন্দরবন বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র জেলা গঠনের চিন্তাভাবনা চলছিল। অন্যদিকে দক্ষিণবঙ্গের ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাতায়াতের দ্রুততার জন্য রেলপথ সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব কারণে সুন্দরবন এলাকার শাসনকার্যের সুবিধার্থে ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিল যশোর জেলার খুলনা ও বাগেরহাট মহকুমা এবং ২৪ পরগনা জেলা থেকে সাতক্ষীরা মহকুমাকে পৃথক করে খুলনাকে স্বতন্ত্র জেলায় পরিণত করা হয়।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই খুলনাকে সারা দেশ চিনেছে তার শিল্পের ঐশ্বর্যে। আশির দশকেও এই শহরের কারখানা ঘিরে ছিল হাজারো মানুষের ব্যস্ততা। ১১৩ একরের খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিল আকার ও শ্রমিকসংখ্যার দিক দিয়ে ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাটকল। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠার পর ৭০ বছর এই পাটকল বহু শ্রমিকের জীবিকা জুগিয়েছে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে বন্ধের সময় এখানে প্রায় ৯ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। ক্রিসেন্ট মিলের প্রধান ফটকের পাশে টাইলসের বেদি—যেন এক নীরব স্মৃতিস্তম্ভ। ধুলার পুরু আস্তরণ জানান দিচ্ছে, কতকাল এখানে কোনো পদচিহ্ন পড়েনি, বসেনি কোনো ক্লান্ত শ্রমিক। একসময়ের কর্মচাঞ্চল্যমুখর আঙিনা এখন খাঁ খাঁ করে, স্তব্ধতার অচেনা সুর যেন বিষণ্ন গান গায়।
শুধু ক্রিসেন্ট নয়, খুলনার অনেক পাটকলই এখন বন্ধ। শুধু পাটকল কেন, আরও অনেক কারখানায় উৎপাদন নেই। সব মিলিয়ে শিল্পের শহর খুলনার কারখানায় কারখানায় এখন নীরবতা, নিস্তব্ধতা। বন্ধ দরজার ওপারে স্তব্ধ হয়ে আছে একসময়ের কর্মমুখর প্রাঙ্গণ।
১৯৮৬ সালে বদলি শ্রমিক হিসেবে ক্রিসেন্টের আঙিনায় পা রেখেছিলেন রতন কুমার মণ্ডল। গত বসন্তে একদিন মিলের ভেতর দাঁড়িয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে রতন বলেন, ‘ক্রিসেন্টের বিশাল প্রান্তরে মাইকের সুরে ফুটবলের উন্মাদনা ছিল যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। কারখানার ভেতরেই সবকিছু—যেন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ জগৎ। আজ সেই চেনা ছবি উধাও, খাঁ খাঁ করছে চারপাশ, কথা বলারও যেন কেউ নেই।’
খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিল আকার ও শ্রমিকসংখ্যার দিক দিয়ে ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাটকল.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’
পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে।
যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে।
রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”
তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।
শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’
ঢাকা/শহিদুল/এস