শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য শিল্পাঞ্চলে হাসপাতাল স্থাপন ও ‘শ্রমিক স্বাস্থ্য কার্ড’ চালুর সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া স্বল্পমূল্যে আবাসন নিশ্চিতে ‘শ্রমিক আবাসন তহবিল’ গঠনের পাশাপাশি স্বল্পসুদে গৃহঋণ ও আবাসন ভর্তুকির জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে কমিশন।

রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) ও বাইরের শ্রমিকদের জন্য একক শ্রম আইন প্রণয়নের কথাও বলা হয়েছে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। কমিশন বলেছে, ইপিজেডের জন্য যদি আলাদা শ্রম আইন করতেও হয়, তবে সেটি যেন সাধারণ শ্রম আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদের নেতৃত্বাধীন শ্রম সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় ১৮ সদস্যের শ্রম সংস্কার কমিশন। ‘শ্রম জগতের রূপান্তর-রূপরেখা: শ্রমিক অধিকার, সুসমন্বিত শিল্প সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মোট ২৫টি সুপারিশ রয়েছে।

শ্রম সংস্কার কমিশন বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের মজুরি তিন বছর পরপর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণ, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মজুরি না দিলে ক্ষতিপূরণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য আপৎকালীন তহবিল, ট্রেড ইউনিয়ন করার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস, স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেছে।

শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও আবাসনসুবিধা

শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতাল স্থাপন এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসা, সঠিক পরামর্শ ও সেবা নিশ্চিতের সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমিকের প্রয়োজন বিবেচনায় হাসপাতালে বিনা মূল্যে সন্ধ্যাকালীন সেবা থাকতে হবে। শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য শ্রমিক স্বাস্থ্য কার্ড চালু করতে হবে, যা তাঁদের স্বাস্থ্যতথ্য ও প্রাপ্য সুবিধাদি গ্রহণে সাহায্য করবে; পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টা টোল ফ্রি টেলিমেডিসিন সেবা দিতে হবে, যাতে শ্রমিকেরা যেকোনো সময় স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরামর্শ নিতে পারেন। এ ছাড়া শ্রমিকেরা যাতে কম খরচে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন, সে জন্য সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যবিমা চালু করার সুপারিশ করেছে কমিশন।

আমরা কোনো অবাস্তব সুপারিশ করিনি। সব শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করেছে কমিশন। শুরুতে কোন কাজগুলো বাস্তবায়ন করা যায় এবং কোন মন্ত্রণালয় কীভাবে সেগুলো করতে পারে, তার একটি রূপরেখা আমরা দেবসৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ, শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান

স্বল্পমূল্যে আবাসন নিশ্চিতে ‘শ্রমিক আবাসন তহবিল’ গঠনের পাশাপাশি স্বল্পসুদে গৃহঋণ ও আবাসন ভর্তুকির জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে। কমিশন বলছে, শ্রমিকদের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বল্পসুদে গৃহঋণের সুবিধা চালু করা দরকার; পাশাপাশি শ্রমিকের আবাসন নিশ্চিতে শিল্পমালিককে উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেওয়ার জন্য একটি নীতিমালা করতে হবে। এ ছাড়া ‘শ্রমিক আবাসন নীতি’ করে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে শিল্পাঞ্চল ও শ্রমঘন এলাকায় সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা দরকার।

সব কর্মস্থল বা অঞ্চলভিত্তিক শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে-কেয়ারের ব্যবস্থা চালু করতে আইন সংশোধনের সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারখানা বা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ডে-কেয়ারের পাশাপাশি শিল্পাঞ্চল ও শ্রমিকের বসবাসের এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে কমিউনিটি-ভিত্তিক ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করতে হবে। ডে-কেয়ার পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান, স্থানীয় সরকার ও সমবায় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি সমন্বিত কাঠামো তৈরিরও প্রস্তাব করা হয়েছে।

শিশুশ্রম নিরসনে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে কর্মে নিয়োজিত হওয়ার বয়স ১৬ বছরে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর–তরুণদের এমন কাজে নিয়োগের সুযোগ থাকা উচিত, যা তাদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে শ্রম মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

ক্ষতিপূরণের শর্ত শিথিল

বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এটি অপ্রতুল উল্লেখ করে ক্ষতিপূরণের হার বৃদ্ধি করে সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে কমিশন। এ ছাড়া মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণের জন্য দুই বছরের চাকরির শর্ত বাতিল করে এক বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। চাকরি থেকে বরখাস্তের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার বিধান বাতিল শ্রমিকের পূর্ববর্তী চাকরির ভিত্তিতে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ বা গ্র্যাচুইটি ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিতেরও প্রস্তাব করা হয়। কমিশন বলেছে, শ্রমিকের চাকরি যেভাবেই শেষ হোক না কেন, সবার জন্য গ্র্যাচুইটি বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আইনি নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেকোনো শিল্প খাত, বিশেষায়িত শ্রম অঞ্চল, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং কাজের ধরন–নির্বিশেষে সব শ্রমিকের জন্য সমানভাবে শ্রম আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে বিদ্যমান শ্রম আইনের ব্যাপক সংস্কার অথবা নতুন ও সমন্বিত এক বা একাধিক শ্রম আইন প্রণয়ন করতে হবে। শ্রম আইনের সবক্ষেত্রে ‘মালিক’ শব্দের পরিবর্তে ‘নিয়োগকারী’ শব্দটি ব্যবহার করতে হবে।

রাইড শেয়ার করা চালকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে শ্রম অধিকার, ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে কমিশন। একই সঙ্গে রাইড শেয়ারিংয়ে কোম্পানিগুলোর কমিশনের হার যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা, বিশেষ মজুরি কাঠামো নির্ধারণ, শ্রমিকদের অ্যাকাউন্ট স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে।

এসব সুপারিশের বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা কোনো অবাস্তব সুপারিশ করিনি। সব শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করেছে কমিশন।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুরুতে কোন কাজগুলো বাস্তবায়ন করা যায় এবং কোন মন্ত্রণালয় কীভাবে সেগুলো করতে পারে, তার একটি রূপরেখা আমরা দেব। সেই রূপরেখায় বর্তমান সরকার কী কী বাস্তবায়ন করতে পারে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র স প র শ কর ছ ন শ চ ত কর র র জন য ন সমন ব ত লক ষ য র পর খ সরক র তহব ল

এছাড়াও পড়ুন:

৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই সনদ না হলে অবরোধের হুঁশিয়ারি আপ বাংলাদেশের

জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারির দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস (আপ) বাংলাদেশ। আজ শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে গণজমায়েত থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। দাবি পূরণ না হলে ৬ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে অবরোধ কর্মসূচি পালনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি।

‘৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদের দাবি’ শীর্ষক গণজমায়েতে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আপ বাংলাদেশের নেতা–কর্মীরা। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পার হলেও জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারি না হওয়াকে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন তাঁরা।

আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, ‘আমরা একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। কিন্তু আহতদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। আমরা দেখেছি, যারা জুলাইয়ের নেতৃত্বে ছিল, জুলাইয়ের পরে তাদের পকেট ভারী হয়েছে। আমি বলতে চাই, আপনাদের এই পকেটের হিসাব দিতে হবে।’

অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে আলী আহসান বলেন, ‘আপনারা জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে পারবেন কি পারবেন না, তা জানান; না পারলে আমরা আছি। যারা জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম, বাংলাদেশের (সেই) ২০ কোটি জনগণ জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করবে।’

আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক বলেন, ‘৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে যদি জুলাই ঘোষণাপত্র না হয়, তাহলে ৬ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে অবরোধ শুরু হবে। এ সরকারের কোনো হুমকি আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।’

গণজমায়েতে অংশ নিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বলেন, আপ বাংলাদেশের নেতারা এখনো কোনো প্রটোকল ছাড়া রাস্তাঘাটে হাঁটেন। কিন্তু তাঁরা যেদিন প্রটোকল নিতে শুরু করবেন, সেদিন থেকে তাঁদের বিরুদ্ধেও তিনি কথা বলা শুরু করবেন।

জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারির আহ্বান জানিয়ে শরীফ ওসমান বলেন, এখন পর্যন্ত বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় জুলাই শহীদেরা রাষ্ট্রদ্রোহী। তাঁদেরকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আজকের মধ্যে সরকার দিনক্ষণ না জানালে আগামী ৩ তারিখ (আগস্ট) ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে কফিন মিছিল নিয়ে সচিবালয় অবরোধ করা হবে।

বিগত এক বছর থেকে একটি দুর্বল সরকার দেশ চালাচ্ছে উল্লেখ করে আপ বাংলাদেশের সদস্যসচিব আরেফিন মোহাম্মদ বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে ঘোষণাপত্রের জন্য আমাদের আবারও গণজমায়েত করতে হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে?’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এ বি জুবায়ের বলেন, ‘আমরা যে মৌলিক সংস্কার চেয়েছিলাম, এখনো তার কিছুই হয়নি। এখনো শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত হয়নি। আমি উপদেষ্টাদের উদ্দেশে বলতে চাই, অবিলম্বে জুলাই সনদ ঘোষণা করুন। আপনাদের কাছে আমাদের চাওয়া–পাওয়া খুব বেশি নেই।’

গণজমায়েতে র‌্যাপ গান পরিবেশন করেন আপ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্য আহনাফ তাহমিদ। স্বাগত বক্তব্য দেন জুলাই শহীদ ওসমান পাটোয়ারীর বাবা আবদুর রহমান। গণজমায়েতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন আপ বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী রাফে সালমান রিফাত, প্রধান সংগঠক নাঈম আহমেদ, মুখপাত্র শাহরিন সুলতানা প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ