ইসলামে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসাসেবার গুরুত্ব
Published: 2nd, May 2025 GMT
মানুষ দেহ ও আত্মার সমন্বয়। আল্লাহর হুকুম ও নবীজি (সা.)–এর সুন্নত অনুশীলনে আত্মা পরিপুষ্ট হয়। দেহ পরিশুদ্ধ হয় হালাল ও পবিত্র রিজিক গ্রহণে এবং সুস্থ থাকে পরিমিত খাদ্য-পথ্য ও সঠিক চিকিৎসা গ্রহণে। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা ভূমি হতে উৎপন্ন হালাল ও পবিত্র রিজিক আহার করো আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৬৮)
আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তার জন্য রিজিক প্রস্তুত করে রেখেছেন এবং অসুস্থ হলে চিকিৎসারও ব্যবস্থা দিয়েছেন। কোরআনে কারিমে রয়েছে, ‘তিনি ক্ষুধায় অন্ন দেন এবং ভয়ে নিরাপত্তা বিধান করেন।’ (সুরা কুরাইশ, আয়াত: ৪)
হজরত ইব্রাহিম (আ.
ইসলাম স্বাস্থ্যসচেতনতা ও চিকিৎসার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে। রাসুল (সা.) অসুস্থ রোগীদের খোঁজখবর নিতেন এবং সুস্থতার জন্য দোয়া করতেন। বহু সাহাবি চিকিৎসাসেবা দিতেন। নবীপত্নী উম্মুল মুমিনিনদের কেউ কেউ যেমন হজরত আয়েশা (রা.) ও হজরত উম্মে সালমা (রা.) চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। যুদ্ধ অভিযানে নবীজি (সা.)–এর নির্দেশনায় মুসলিম কাফেলায় চিকিৎসক দল থাকত। সে চিকিৎসক ও সেবক দলের অন্যতম ছিলেন খাজরাজ বংশের আসলাম গোত্রের এক মহীয়সী নারী হজরত রুফায়দা আসলামি আনসারি (রা.)। তিনি ছিলেন চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শী। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা, বিনা মূল্যে অসুস্থদের সেবাই ছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য। তিনি সারা জীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন, যেখানেই প্রয়োজন ছুটে গেছেন; দুর্বল ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন; যুদ্ধের ময়দানে আহত ব্যক্তিদের সেবা, তৃষ্ণার্তকে পানি পান করানো তাঁর অন্যতম বিশেষ কাজ ছিল। (তারিখুত তবারি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ৫৮৬; আলইস্তিআব, পৃষ্ঠা: ৩৩৪০; উসদুল গাবাহ, পৃষ্ঠা: ৬৯২৫; আলইসাবাহ, পৃষ্ঠা: ১১১৮১)
মাহমুদ বিন লাবিদ (রা.) বলেন, খন্দকের যুদ্ধে যখন সাআদ বিন মুয়াজ (রা.) আহত হলেন, তখন রাসুলে কারিম (সা.) বললেন, ‘তোমরা তাকে রুফায়দার তাঁবুতে নিয়ে যাও।’ বর্ণনাকারী বলেন, রুফায়দা (রা.) হলেন এমন এক নারী, যিনি আহত ব্যক্তিদের সেবা করতেন। এরপর রাসুলে কারিম (সা.) সকাল-সন্ধ্যা তাঁর খবর নিতেন। (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস: ১১২৯)
খাইমাতু রুফায়দা (রুফায়দার তাঁবু) মানুষের কাছে এক প্রসিদ্ধ নাম ছিল, আহত ব্যক্তিদের সেবায় আস্থা ও নির্ভরতার কেন্দ্র ছিল। মুআয (রা.) আহত হলে নবীজি (সা.) তাঁকে রুফায়দার তাঁবুতে পাঠিয়ে দিলেন।
রুফায়দা (রা.)–এর মতো আরও অনেক নারী সাহাবি জিহাদের কঠিন মুহূর্তেও আহত ব্যক্তিদের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। বিশেষত আসলাম গোত্রেরই আরেক নারী হলেন উম্মে সিনান আসলামি (রা.)। নবীজি (সা.)–এর কাছে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন; আহত ব্যক্তিদের ঘায়ে মলম, পিপাসার্তের মুখে পানি—এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য। নবীজি (সা.) অনুমতি দিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর বরকত নিয়ে যাও। তোমার কওমের আরও অনেক নারী আছে, আমি যাদের অনুমতি দিয়েছি, তুমি চাইলে তাদের সঙ্গে থাকতে পারো।’ (আত তাবাকাতুল কুবরা, ইবনে সাআদ, পৃষ্ঠা: ৪২৪৪)
রুফায়দা (রা.) দিন-রাত এক করে নিজেকে মানবসেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তেও সেবা বন্ধ থাকেনি। মানুষ ছুটে আসত তাঁর তাঁবুতে। তাই ঐতিহাসিকেরা ‘খাইমাতু রুফাইদা’কে ইতিহাসের প্রথম ‘মুসতাশফা’ বা চিকিৎসালয় আখ্যা দিয়েছেন।
যুদ্ধ ছাড়া সাধারণ সময়েও মানুষের কাছে রুফায়দা (রা.)–এর তাঁবু ছিল বাতিঘর, অসুস্থ মানুষের আস্থার ঠিকানা। মুখে মুখে তাই ছড়িয়ে গিয়েছিল ‘খাইমাতু রুফাইদা’র নাম। এর স্মরণে প্রতিবছর বাহরাইন সরকার ‘রুফায়দা স্বর্ণপদক’ প্রদান করে।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
দোয়ার ফজিলত ও আদব
দোয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ আহ্বান করা বা প্রার্থনা করা। পরিভাষায় দোয়া হলো কল্যাণ ও উপকার লাভের উদ্দেশ্যে এবং ক্ষতি ও অপকার রোধে মহান আল্লাহকে ডাকা এবং তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।
প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘দোয়াই ইবাদত।’ (বুখারি ও মুসলিম) ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কিছু চায় না, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন।’ (তিরমিজি: ৩৩৭৩)
আল–কোরআনের বর্ণনা, ‘আর তোমাদের রব বলেন, “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।”’ (সুরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ৬০)
মুমিনের পরিচয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের পার্শ্বদেশ শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। কেউ জানে না তার কৃতকর্মের জন্য তাদের কী কী চোখজুড়ানো প্রতিদান লুকায়িত আছে।’ (সুরা-৩২ সাজদা, আয়াত: ১৬-১৭)
‘আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে, (তখন বলে দিন যে) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে, আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই। কাজেই তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ইমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৬)
দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত হলো হালাল উপার্জন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎকাজ করো; তোমরা যা করো, সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা-২৩ মুমিনুন, আয়াত: ৫১)দোয়া ও আমল কবুল হওয়ার মূল শর্ত হলো ইখলাস। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। অতএব, তাঁকে ডাকো খাঁটি ইবাদতের মাধ্যমে।’ (সুরা-৪০ মুমিন, আয়াত: ৬৬)
দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত হলো হালাল উপার্জন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎ কাজ করো; তোমরা যা করো, সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা-২৩ মুমিনুন, আয়াত: ৫১) ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পাক পবিত্র বস্তুসামগ্রী আহার করো, যেগুলো আমি তোমাদের রিজিক হিসেবে দান করেছি।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৭৩)
নবীজি (সা.) বলেন, ‘উষ্কখুষ্ক ধুলায় ধূসরিত অবস্থায় দীর্ঘ সফরকারী একজন যে স্বীয় দুই হাত আকাশের দিকে প্রসারিত করে বলে, “হে প্রভু! হে প্রভু!” অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং সে হারাম দ্বারা লালিত, তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?’ (মুসলিম: ১৬৮৬)
নির্জনে নীরবে বিনয়ের সঙ্গে দোয়া করা উত্তম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাকো কাকুতি মিনতি করে এবং সংগোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৫)। ‘পৃথিবীকে কুসংস্কারমুক্ত ও ঠিক করার পর তাতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না। তাকে আহ্বান করো ভয় ও আশাসহকারে। নিশ্চয় আল্লাহর করুণা সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৫-৫৬)
দোয়ার আদব হলো দৃঢ়সংকল্প ও আকুতির সঙ্গে দোয়া করা, দোয়া কবুলে প্রবল আশাবাদী হওয়া।
হজরত জাকারিয়া (আ.) তাঁর দোয়ায় বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনার কাছে দোয়া করে আমি কখনো ব্যর্থ হইনি।’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ৪) হজরত ইব্রাহিম (আ.) বলেন, ‘আশা করি, আমার প্রতিপালকের নিকট দোয়া করে আমি বিফল হব না।’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ৪৮)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]