সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রে জন্ম নিয়েছে মহাবিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত কেটো কচ্ছপ বা কাইট্টা কচ্ছপের ৬৫টি ছানা। গতকাল সোমবার সকালে কেন্দ্রের পুকুরপাড়ের স্যান্ডবিচে রাখা ডিম ফুটে ছানাগুলো বের হতে শুরু করে। সেগুলো তুলে রাখা হয় কচ্ছপ লালনপালন কেন্দ্রের সংরক্ষণ প্যানে। 
এই কচ্ছপের বৈজ্ঞানিক নাম বাটাগুর বাসকা। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তপশিল-১ অনুযায়ী এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
করমজল বন্যপ্রাণী ও প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ 
কবির বলেন, পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ প্রজাতির কচ্ছপ আছে। এর মধ্যে এই অঞ্চলে এক সময় পাওয়া যেত প্রায় ২৬টি প্রজাতি। বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ আর দেখা যাচ্ছিল না। এ কারণে ২০০০ সাল 
থেকে গবেষকরা ধারণা করেন, পৃথিবীতে 
এ প্রজাতির অস্তিত্ব নেই। বিষয়টি নিশ্চিত হতে ২০০৮ সালে তারা প্রকৃতিতে বাটাগুর বাসকা খুঁজতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে নোয়াখালী ও বরিশালের বিভিন্ন জলাশয়ে চারটি পুরুষ ও চারটি স্ত্রী বাটাগুর বাসকা পাওয়া যায়।
প্রজননের জন্য আটটি কেটো কচ্ছপ নেওয়া হয় গাজীপুরের ভাওয়াল গড়ে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা সেগুলো নিবিড়ভাবে লালনপালন ও প্রজননের চেষ্টা করেন। সেখানে ভালো সাড়া মেলেনি। ২০১৪ সালে ওই কচ্ছপগুলো এবং তাদের জন্ম দেওয়া ৯৪টি ছানা করমজলে আনা হয়। 
করমজলে বাটাগুর বাসকা গবেষণায় বাংলাদেশ বন বিভাগের সঙ্গে যোগ দেয় প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন এবং অস্ট্রিয়ার জু ভিয়েনার গবেষক দল ও যুক্তরাষ্ট্রের টার্টল সারভাইভাল অ্যালায়েন্স। ২০১৭ সাল থেকে এখানে ডিম দিতে শুরু করে কচ্ছপগুলো। বর্তমানে এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৮৭টি কচ্ছপ আছে।
হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনটি কচ্ছপ ৮২টি ডিম দেয়। সেগুলো সংগ্রহ করে পুকুরপাড়ের স্যান্ডবিচে রাখা হয়। নিবিড় পরিচর্যার পর সোমবার সকালে ডিম থেকে ফুটে বের হতে শুরু করে ৬৫টি ছানা। এগুলো প্যানে রেখে লালনপালনের পর বড় পুকুরে ছাড়া হবে। এ পর্যন্ত করমজলে ৫২১টি ডিম থেকে ৪৭৫টি বাচ্চা ফোটানো গেছে।

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

যমুনার ধারে দেখা পাখিটি

সুন্দর এই লালঘাড় পেঙ্গা পাখি বাংলাদেশের অল্প কিছু জায়গায় বিস্তৃত। এ পাখি মূলত দেশের পূর্বাঞ্চলীয় বনগুলোতে; বিশেষ করে সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন বনে, শেরপুরের গারো পাহাড় ও মধুপুরের জাতীয় উদ্যানে পাওয়া যায়।

গত নভেম্বরে টাঙ্গাইলে যমুনা রেলসেতুর পূর্ব প্রান্তে নলখাগড়ার ঝোপ এলাকায় পাখি জরিপকাজে বন্য প্রাণী–বিশেষজ্ঞ ডক্টর রশিদসহ কয়েকজন অংশ নিয়েছিলাম। সকালে ক্যামেরা নিয়ে বের হয়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখছিলাম ও ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ দূর থেকে দেখতে পেলাম, শালিকের মতো একটি পাখি। এই কম দেখা যাওয়া পাখিটির দেহ লালচে বাদামি এবং মুখ কালো এবং গলার পাশের দিকটায় লাল দাগ দেখতে পেলাম। পাখিটি শালিকও না, আবার বুলবুলিও না।

চেনার জন্য তাই ছুটে গেলাম পাখিটির কাছাকাছি, ততক্ষণে সঙ্গে আরও দুটি পাখি যোগ দিল। আমার হাতে থাকা জুম লেন্সের ক্যামেরা দিয়ে তাড়াতাড়ি কয়েকটি ছবি তুলে পর্যবেক্ষণ করলাম এবং বুঝতে পারলাম, এ তিনটি পাখি হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার ঝোপঝাড়ে মাঝেমধে৵ পাওয়া যায়, এমন একটি পাখি। যেটির ইংরেজি নাম Rufous-necked Laughing Thrush; বাংলা নাম লালঘাড় পেঙ্গা, বৈজ্ঞানিক নাম Garrulax ruficollis। অবাক হলাম কিছুটা; কারণ, এ পাখিটি মূলত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল (সিলেট) ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম) পাহাড়ি বনগুলোর ঝোপে পাওয়া যায়। তবে উত্তর-মধ্যাঞ্চলে বেশ কমই আগে দেখা গেছে। মধুপুরে আমি একবার দেখেছি। এই পাখিগুলোর কালচে ধূসর মাথা; কপাল, গাল, গলা ও বুক কালো; ঘাড়ে লালচে পট্টি। চোখ বাদামি, চঞ্চু কালচে বাদামি, পা কালচে বাদামি এবং তলপেট ও লেজের তলায় লাল। ই-বার্ডের তথ্যানুযায়ী, পৃথিবীতে প্রায় ৬৬ প্রজাতির পেঙ্গা পাওয়া যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশে পাওয়া যায় চার প্রজাতির পেঙ্গা। যেমন ধলাঝুঁটি পেঙ্গা, ছোট মালাপেঙ্গা, বড় মালাপেঙ্গা ও লালঘাড় পেঙ্গা।

তিন থেকে পাঁচটি পেঙ্গা পাখি একত্রে দলবদ্ধ অবস্থায় মূলত বেশি পাওয়া যায়। এরা পতঙ্গভুক ও গায়ক পাখি। মাটিতে শুকনা পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পোকামাকড় খুঁজে খুঁজে খেয়ে থাকে। তাই ফসলের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এই প্রজাতির পাখি কীটপতঙ্গ খেয়ে খাদ্যশৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। প্রাণী ভক্ষণের মাধ্যমে এক প্রাণী থেকে খাদ্যশক্তি অন্য প্রাণীতে স্থানান্তরে সহায়তা করে। ফলে এরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করে।

মার্চ মাস থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে পেঙ্গা পাখি প্রজনন করে থাকে। শুকনা ঘাস ও লতাপাতা দিয়ে কাপ আকৃতির বাসা তৈরি করে। তিন থেকে চারটি ডিম পাড়ে। পুরুষ ও স্ত্রী পাখি পালাক্রমে ডিমে তা দেয়। যদিও এরা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাখি; নদীর ধারের কাশবন, জঙ্গল অথবা নলখাগড়া থাকে, এমন বাসস্থান এ পাখির খুবই পছন্দ। তাই এ ধরনের বাসস্থানগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি। নির্জন এলাকায় বসবাস করতে এরা পছন্দ করে।

পেঙ্গা পাখির বাসস্থান এখন হুমকির সম্মুখীন। এই প্রজাতির পাখির জন্য বাসা বানানোর নিরাপদ স্থান বা বাসা তৈরির জন্য উপযুক্ত গাছের এখন খুবই অভাব। সহজে ও নির্বিঘ্নে প্রজনন করতে পারছে না বলে দিন দিন এ পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এদের বাসস্থান সংরক্ষণ ও বাসা বানানোর জন্য পছন্দের গাছ লাগানো এখন খুবই জরুরি। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে পতঙ্গভুক এ প্রজাতির পাখি আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যাবে।

মোহাম্মদ ফিরোজ জামান, অধ্যাপক ও প্রাণী-গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • করমজলে বাটাগুর বাসকা কচ্ছপের ৬৫ বাচ্চার জন্ম
  • প্রজনন মৌসুমে হালদায় মরে ভেসে উঠল মা কাতলা মাছ
  • যমুনার ধারে দেখা পাখিটি
  • সৌন্দর্যের সন্ধানে সুন্দরবনের গহিনে : শেষ পর্ব