বর্তমান করব্যবস্থায় আয়কর প্রদানের ক্ষেত্রে কর রেয়াত এবং ন্যূনতম করব্যবস্থা একে অপরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আয়কর আইনে কর রেয়াতের মাধ্যমে একজন সাধারণ ব্যক্তি করদাতার করের বোঝা হ্রাস করার উপায় থাকলেও অন্যায়ভাবে ন্যূনতম কর আরোপের কারণে নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের করদাতা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কর রেয়াত এবং ন্যূনতম কর; উভয়ই নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষ এবং উচ্চ আয়ের মানুষের সঙ্গে কর প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করছে। কর প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যক্তির আয়ের ওপর নির্ভর করে কর প্রয়োগ করা উচিত, যাতে করে কর প্রদানের ক্ষেত্রে করদাতাদের মধ্যে কোনো অসম সুবিধা না থাকে। এ জন্য কর রেয়াত এবং ন্যূনতম কর উভয়ই বাতিল করা উচিত।
কর রেয়াত বাতিল করতে হবে কেনআয়কর হিসাব করে দেখা যায়, ঢাকা উত্তর বা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বাসকারী একজন বেসরকারি চাকরিজীবী করদাতার বছরে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা থেকে ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন খাতে আয় হলে করদায় আসে ৫ হাজার টাকা।
যাঁদের আয় ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বা তার বেশি, তাঁরা কর রেয়াত-সুবিধা সম্পূর্ণ ভোগ করে করদায় লাঘব করতে পারেন। বিপরীতে যাঁদের আয় এই সীমার নিচে তাঁরা কর রেয়াত-সুবিধা ভোগ করতে ব্যর্থ হন। এবং এর অন্যতম কারণ হলো অন্যায্য ন্যূনতম করব্যবস্থা।
এখানে কর রেয়াত বাদ দেওয়া হলে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ উঠবে। এক.
যেহেতু আয়ের ওপর ভিত্তি করে কর প্রদান করতে হবে, তাই আয়ের পরিমাণ যত বাড়তে থাকবে, করের পরিমাণও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকবে। এ জন্য নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের করদাতার জন্য কর ধাপ অনুযায়ী করহারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে।
বর্তমানে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করযোগ্য আয় অতিক্রম করার পর প্রথম ১ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ কর প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে এই ধাপটা বৃদ্ধি করে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত করা করা হলে নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের করদাতার করের পরিমাণ কিছুটা কম থাকবে। এর সঙ্গে ট্যাক্স অফসেট ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে করের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে থাকবে।
ন্যূনতম কর বাতিল করে ট্যাক্স অফসেট চালু করুনন্যূনতম করের আওতা ব্যাপক। একজন সাধারণ গৃহিণী প্রতি মাসে অল্প অল্প করে সঞ্চয় করেও যদি সঞ্চয়পত্র কেনেন বা ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন, তাহলে সেখান থেকে যে মুনাফা প্রদান করা হয়, তা থেকে উৎসে ১০ শতাংশ কর কর্তন করা হয়। এই কর তিনি আর ফেরত পান না। এভাবে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যায়ভাবে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছ থেকে করের নামে টাকা কেড়ে নিচ্ছে।
তাই ন্যূনতম করব্যবস্থা বাতিল হলে একদিকে যাঁরা আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাইরে আছেন, তাঁরাও যেমন বাধ্যতামূলক আয়কর প্রদান থেকে মুক্ত হবেন, আবার তেমনি যাঁরা রিটার্ন দাখিল করেন, তাঁদের কর প্রদানের ক্ষেত্রেও আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য আসবে।
তবে কর রেয়াত-সুবিধা বাতিল হলে যাঁদের করযোগ্য আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করবে, তাঁরা সবাই যেহেতু তাঁদের আয় অনুপাতে কর প্রদান করবেন, তাই নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের করদাতাদের জন্য ট্যাক্স অফসেট ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
এই ট্যাক্স অফসেট সুবিধা পাবেন দুই শ্রেণির করদাতা। এক. যাঁরা নিম্ন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের করদাতা তাঁরা আয় অনুপাতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ট্যাক্স অফসেট পাবেন, যা তাঁদের মোট করদায় থেকে বাদ যাবে। দুই. যাঁরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বাস করবেন, তাঁরাও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ট্যাক্স অফসেট পাবেন। এই কর-সুবিধা অস্ট্রেলিয়ায় করদাতাদের জন্য রয়েছে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কর প্রদানের ক্ষেত্রে সমতা আসলেও কর রেয়াত বাদ দিলে করদাতার সঞ্চয়ের কী হবে?
সর্বজনীন পেনশন তহবিল বাধ্যতামূলক করুনবাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু হয়েছে। এটাকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশে খুবই অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানে ভবিষ্যৎ তহবিল আছে যেখানে চাকরিজীবী এবং চাকরিদাতা উভয়ে চাঁদা প্রদান করে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এই সুবিধা নেই। তাই দীর্ঘ সময় চাকরি করলেও অবসরে যাওয়ার সময় তাঁরা শূন্য হাতে বাড়ি ফেরেন।
যেসব প্রতিষ্ঠানে ভবিষ্যৎ তহবিল আছে, সেখানে সর্বনিম্ন ছয় মাস বা এক বছর চাকরি না করলে চাকরিদাতার অংশ চাকরিজীবী পান না। শুধু চাকরিজীবী যেটুকু চাঁদা দিয়েছেন, ওইটুকুই পান। এবং এই অংশটুকু পরিমাণে নগণ্য হওয়ায় অনেক সময় দেখা যায় খরচ হয়ে যায়।
অস্ট্রেলিয়ায় বর্তমানে মোট বেতনের ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুপারঅ্যানুয়েশন ফান্ডে বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করতে হয়। ১ জুলাই ২০২৫ থেকে এই হার ১২ শতাংশে উন্নীত হবে।
যখনই কেউ কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে যান, তখন তাঁকে তিনটি তথ্য প্রদান করতে হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, ট্যাক্স ফাইল নম্বর (যেটা বাংলাদেশে কর শনাক্তকরণ নম্বর হিসেবে পরিচিত) এবং সুপার ফান্ডের নম্বর। একজন ব্যক্তি যেমন যেকোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন, ঠিক তেমনি অসংখ্য সুপার কোম্পানি আছে, যেখানে সুপার অ্যাকাউন্ট খোলা যায়।
কোনো চাকরিজীবী যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে এক দিনও কাজ করেন, তাহলে তাঁর ব্যাংকে যে বেতন দেওয়া হয়, তার ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুপার অ্যাকাউন্টে প্রদান করা হয়। এবং এই সুপার ফান্ডে যে ডলার জমা হচ্ছে, তা অবসরে যাওয়ার আগে উত্তোলন করা যায় না। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় ৬৭ বছর হলো পেনশনের জন্য নির্ধারিত বয়স এবং এই বয়সের আগে এই ফান্ড থেকে ডলার উত্তোলন করা যায় না। চাইলে এক সুপার ফান্ড কোম্পানি থেকে জমা করা অর্থ অন্য সুপার ফান্ড কোম্পানিতে নেওয়া যাবে, কিন্তু উত্তোলন করা যাবে পেনশনের বয়স হলে।
এই ব্যবস্থার ফলে যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের দীর্ঘ সময় ধরে ডলার জমতে থাকে এবং অবসরে যাওয়ার পর তাঁরা ভালো একটা অঙ্ক পান, যা দিয়ে শেষ বয়সে চলতে পারেন।
বাংলাদেশেও যদি মোট বেতনের একটা অংশ এভাবে জমতে থাকে তাহলে অবসরে যাওয়ার পর শেষ বয়সে আর্থিক দুর্দশার মধ্যে পড়তে হবে না।
তাই কর রেয়াত না থাকলেও বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে না। বরং যাঁদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করার প্রয়োজন নেই, তাঁদেরও মোট আয়ের একটা অংশ পেনশন ফান্ডে জমতে থাকবে।
জসীম উদ্দিন রাসেল অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট
[email protected]
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ট য ক স অফস ট করব যবস থ অ য ক উন ট ব ত ল কর র পর ম ণ চ কর জ ব কর র য় ত ব ধ যত ম ব যবস থ করদ ত র দ র আয় র জন য কর র প কর প র করদ য় প নশন
এছাড়াও পড়ুন:
একজন সরকারি চাকরিজীবী কীভাবে আয়করের হিসাব করবেন
সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের প্রতিবছর আয় ও ব্যয়ের খবর জানিয়ে আয়কর রিটার্ন দিতে হয়। দশম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক। কারণ, রিটার্ন না দিলে বেতন–ভাতা পাওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়।
এমন সরকারি কর্মকর্তারা কীভাবে আয় ও কর হিসাব করবেন, এর একটি উদাহরণ দেওয়া হলো। প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আয়ের হিসাব দিতে হয়। চলতি মাসের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আয়কর রিটার্ন দেওয়ার সময়সীমা নির্ধারিত আছে।
জাহিদ কবির একজন সরকারি কর্মচারী। ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আগের এক বছরের আয়–ব্যয়ের হিসাব করতে হবে।
জাহিদ কবিরের আয় হলো মাসিক মূল বেতন ২৬ হাজার টাকা; ২৬ হাজার টাকা করে দুটি উৎসব বোনাস ৫২ হাজার টাকা, চিকিৎসার ভাতা ১ হাজার ৫০০ টাকা, শিক্ষাসহায়ক ভাতা ৫০০ টাকা ও বাংলা নববর্ষ ভাতা ৪ হাজার ৪০০ টাকা। এ ছাড়া তিনি রাজধানীর বেইলি রোডের সরকারি বাসায় থাকেন।
এ ছাড়া ভবিষ্য তহবিলে জাহিদ কবির প্রতি মাসে ৩ হাজার ২০০ টাকা জমা রাখেন। হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে পাওয়া প্রত্যয়নপত্রে দেখা যায় যে ৩০ জুন ২০২৫ তারিখে ভবিষ্য তহবিলে অর্জিত সুদের পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ৫০০ টাকা। কল্যাণ তহবিল ও গোষ্ঠী বিমা তহবিলে চাঁদা প্রদান বাবদ প্রতি মাসে বেতন থেকে কর্তন ছিল যথাক্রমে ১৫০ ও ১০০ টাকা।
করযোগ্য আয় কত২০২৫–২৬ করবর্ষে জাহিদ কবিরের মোট আয় হলো বেতন খাতে মূল বেতন ৩ লাখ ১২ হাজার টাকা (২৬ হাজার টাকার ১২ মাসের মূল বেতন) ও উৎসব বোনাস ৫২ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।
জাহিদ কবির চিকিৎসার ভাতা, শিক্ষাসহায়ক ভাতা ও বাংলা নববর্ষ ভাতা পেয়েছেন তা তাঁর জন্য প্রযোজ্য চাকরি (ব্যাংক, বিমা ও ফাইন্যান্স কোম্পানি) (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০১৫–এর অন্তর্ভুক্ত। ফলে এসব ভাতার জন্য তাঁকে আয়কর প্রদান করতে হবে না।
কত কর হবে
কর দায় গণনার হিসাব অনুসারে, প্রথম ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত করহার শূন্য অর্থাৎ কোনো কর দিতে হবে না। তাই জাহিদ কবিরের ১৪ হাজার টাকার ওপর কর বসবে। এই ১
বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত কত
জাহিদ কবির ভবিষ্য তহবিলে প্রতি মাসে ৩ হাজার ২০০ টাকা করে চাঁদা দিয়েছেন। সারা বছরে দিয়েছেন ৩৮ হাজার ৪০০ টাকা। কল্যাণ তহবিলে প্রতি মাসে ১৫০ টাকা করে পুরো বছরে দিয়েছেন ১ হাজার ৮০০ টাকা। গোষ্ঠী বিমা তহবিলে প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে পুরো বছরে দিয়েছেন ১ হাজার ২০০ টাকা। সব মিলিয়ে জাহিদ কবির বিনিয়োগ করেছেন ৪১ হাজার ৪০০ টাকা।
বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত নেওয়ার নিয়ম হলো মোট আয়ের দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ; মোট অনুমোদনযোগ্য বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ কিংবা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা—এই তিনটির মধ্যে যেটি কম হবে, তাই রেয়াতের পরিমাণ।
জাহিদ কবিরের মোট আয়ের (৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা) দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ হলো ১০ হাজার ৯২০ টাকা; মোট অনুমোদনযোগ্য হলো (৪১ হাজার ৪০০ টাকার ১৫ শতাংশ) ৬ হাজার ২১০ টাকা। বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত নেওয়ার সর্বোচ্চ সীমা ১০ লাখ টাকা। এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে কম হলো ৬ হাজার ২১০ টাকা। এটিই হলো জাহিদ কবিরের প্রাপ্য কর রেয়াতের পরিমাণ।
কর রেয়াত পাবেন কিযেহেতু জাহিদ কবিরের মোট আয়ের ওপর প্রযোজ্য কর ৭০০ টাকা এবং আইনানুগ রেয়াতের পরিমাণ ৬ হাজার ২১০ টাকা। এই ক্ষেত্রে করদাতা কোনো প্রকার কর রেয়াত প্রাপ্য হবেন না। কর রেয়াতের পরিমাণ কখনোই কর দায়ের বেশি হবে না। সেই ক্ষেত্রে জাহিদ কবিরের করের পরিমাণ ৭০০ টাকা।
কিন্তু আয়কর আইন অনুসারে, জাহিদ কবিরকে দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। কারণ, করদাতার অবস্থান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় হলে ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা, অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায় হলে ন্যূনতম চার হাজার টাকা ও সিটি করপোরেশন ব্যতীত অন্যান্য এলাকায় হলে তিন হাজার টাকা দিতে হবে।৪ হাজার টাকার ওপর কর বসবে। হিসাবটি এমন, করের হিসাবের প্রথম স্তরে ১ লাখ টাকার হিসাবে ৫ শতাংশ হারে ৭০০ টাকা কর প্রযোজ্য হবে।