করপোরেট করের বোঝা কতটা বইতে পারবে ছোট প্রতিষ্ঠান
Published: 20th, June 2025 GMT
ব্যবসা করলে কর দিতে হবে– এটা সবাই জানে। কিন্তু ব্যবসায় যদি লোকসান হয়? বাংলাদেশে ব্যবসা মানেই কর। লাভ হোক বা লোকসান, সরকার কর আদায় করবে– এই বাস্তবতা নিয়ে দেশে ব্যবসা করতে হয়। ছোট-বড়, নতুন-পুরোনো সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই এই নিয়ম কার্যকর। তবে সাম্প্রতিক বাজেটে প্রস্তাবিত কর কাঠামো বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য কঠিন বাস্তবতা তৈরি করেছে। ব্যবসার আয় নেই, তবু কর দিতে হবে– এমন এক অযৌক্তিক কাঠামোর মুখোমুখি হচ্ছেন তারা।
অথচ সরকার যেমন বলছে, কর আদায় না হলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিপরীতে ব্যবসায়ীরাও বলছে, ব্যবসা টিকলেই কেবল কর দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ টিকে থাকার শর্তে কর আদায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে ব্যবসার শুরুতেই একটি কোম্পানিকে যে করের ফাঁদে পড়তে হয়, তা অনেক সময়েই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
লোকসান হলেও কর
বাংলাদেশে যৌথ মূলধনি বা কোম্পানি কাঠামোয় ব্যবসা পরিচালনা করলে কর দিতে হবে– এটা প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, লাভ না হলেও ব্যবসায়িক লেনদেন বা ‘টার্নওভার’ এর ওপর একটি নির্ধারিত হারে কর দিতে হয়, যা ‘টার্নওভার ট্যাক্স’ বা লেনদেন কর নামে পরিচিত।
এটি আসলে কর নয়, একটি নির্দিষ্ট হারভিত্তিক বাধ্যতামূলক কর্তন। ১৯৮২ সালে তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ অধ্যাদেশ জারি করে প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর ‘টার্নওভ্যার ট্যাক্স’ বা লেনদেন কর নামে ন্যূনতম করপোরেট ট্যাক্সের এই বোঝা চাপিয়েছিল। নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরার পরও কোনো সরকারই সহজ এই কর আদায়ের পথ থেকে সরে আসেনি। এমনকি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারে দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের এই সংস্কারে কোনো আগ্রহ দেখাল না।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অর্থ উপদেষ্টা ড.
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত
এই কর কাঠামোতে সবচেয়ে বিপাকে পড়ছেন নতুন ব্যবসা শুরু করা উদ্যোক্তারা এবং এসএমই খাতের কোম্পানিগুলো। একটি নতুন ব্যবসা সাধারণত প্রথম কয়েক বছর লোকসানে থাকে। তখন তার মূল লক্ষ্য থাকে বাজার ধরার চেষ্টা এবং ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা। কিন্তু শুরুতেই যদি লোকসানের ওপর কর দিতে হয়, তাহলে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধরুন, একটি ই-কমার্স কোম্পানি ‘ওয়াই লিমিটেড’-এর বার্ষিক বিক্রি ৩০ কোটি টাকা। প্রচার-প্রচারণা, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও কর্মী ব্যয় মেটাতে গিয়ে তারা বছরে ২ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এরপরও তাদের কর দিতে হবে ৩০ লাখ টাকা, কারণ ১ শতাংশ টার্নওভার কর বাধ্যতামূলক। এই কর দিতে গিয়ে তাদের নগদ প্রবাহে চাপ পড়বে এবং তা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণে বাধা সৃষ্টি করবে।
আরেকটি বাস্তব উদাহরণ হলো, একটি টেক্সটাইল এসএমই ‘মুন টেক্স’ যার বার্ষিক টার্নওভার ১০ কোটি টাকা। তাদের প্রকৃত লাভ ১০ লাখ টাকা হলেও নতুন কর কাঠামোয় তাদের কর দিতে হবে ১০ লাখ টাকা– অর্থাৎ সম্পূর্ণ লাভটাই চলে যাচ্ছে কর বাবদ।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতিমালা হলো, কর আরোপ হবে মুনাফার ওপর, লেনদেন মূল্যের ওপর নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামসহ প্রায় সব দেশেই এই নীতিই মানা হয়। বাংলাদেশে সেই নীতি উপেক্ষিত হওয়ায় বিশ্লেষকরা একে ‘শাস্তিমূলক কর ব্যবস্থা’ বলছেন। কারণ কোম্পানি যখন ব্যবসার প্রতিটি ধাপে–কাঁচামাল আমদানি, পণ্য উৎপাদন, পরিবহন, বিক্রয়–সবক্ষেত্রে ভ্যাট, শুল্ক, উৎসে করের মাধ্যমে সরকারকে কর দিচ্ছে, তখন লোকসানে থাকার পরও অতিরিক্ত একটি কর আরোপ সংবেদনশীল নয়।
ব্যবসা কতটা টিকে থাকে
বাংলাদেশের যৌথ মূলধনি কোম্পানিগুলোর নিবন্ধক (আরজেএসসি) অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। কিন্তু পেশাদার নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইসিএবি বলছে, গত বছর নিরীক্ষা হয়েছে মাত্র ৫৮ হাজার কোম্পানির। এর মানে বাকিরা হয় ব্যবসা করছে না, অথবা কর নীতির চাপে কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।
ব্যবসার প্রাথমিক ধাপে টিকে থাকার লড়াইয়ে এই কর কাঠামো বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যারা বড় কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে, তাদের সংখ্যাই বেশি। অথচ দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীর বেশির ভাগেরই যাত্রা শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে।
সরকার বলছে, রাজস্ব আদায়ের হার আশানুরূপ না হওয়ায় বাধ্য হয়েই কর হার বাড়াতে হচ্ছে। কর ফাঁকি রোধ ও বৈষম্য দূর করতে এ সম্পর্কিত বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি যদি বছরে মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশ নগদে করে, তাহলে তার ২৫ শতাংশ করযোগ্য আয় ধরে নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এখনও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত নয়। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের জন্য ব্যাংকিং লেনদেন বাধ্যতামূলক করেনি। ফলে বাস্তবতা উপেক্ষা করে কৃত্রিম করযোগ্য আয় নির্ধারণ করাটা যুক্তিসংগত নয়।
পুঞ্জীভূত মুনাফার ওপর কর: বিনিয়োগে বাধা
আগের বছর মুনাফার ৭০ শতাংশ পুঞ্জীভূত মুনাফা বা রিটেইন্ড আর্নিংসে যোগ করলে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত কর দিতে হতো। এবার বলা হয়েছে, চলতি বছরের আয়ের ৭০ শতাংশ রিটেইন করলেও অতিরিক্ত কর দিতে হবে। অথচ বাংলাদেশের অধিকাংশ কোম্পানি পারিবারিক মালিকানাধীন। তারা লভ্যাংশ না দিয়ে পুঁজি হিসেবে মুনাফা পুনঃবিনিয়োগ করে। এই কর বাধ্যবাধকতা তাদের বিস্তারে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
আজকে টিকলেই আগামীকাল রাজস্ব
বাংলাদেশে রাজস্ব বাড়ানো জরুরি, কিন্তু তা যেন টিকে থাকা ব্যবসাকে হত্যা করে না হয়। যে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান আজ একটি দোকান, সেটাই কাল হতে পারে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। কর কাঠামো হওয়া উচিত এমন– যা ব্যবসাকে টিকতে সাহায্য করে, ধ্বংস করে না। সময় এসেছে কর কাঠামোতে বড় ধরনের সংস্কার আনার।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ট র নওভ র কর ক ঠ ম ব যবস র ব স তবত ব যবস য় ত ম লক কর দ ত ল নদ ন র ওপর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
পদ্মাপাড়ের আহত জারুল ও পাখিরা
পদ্মাপাড়ের শক্তিশালী বাতাস সঞ্চয় করে ডানা ঝাপটানো পাখিরা হারিয়ে যায় দূরে। হয়তো সে সময়টা খুব ভোরে, যখন পারাবারের ফেরিকর্মী খসরু পানকৌড়ি, মাছরাঙা পাখিদের মতোই টুপ করে বারবার জলে ডুব দিয়ে গোসল করে তার সাবানের ফেনাসমেত শরীরটা নিয়ে। যে সাবানের সাদা ফেনা সরিয়ে ফেললে তার কালো কষ্টিপাথরের মতো শরীরটা বের হয়ে যায়, যার ভেজা চেকপ্রিন্টের লুঙ্গি নিতম্ব ঊরুতে লেপটে থাকলেও তা তার দেখা সিনেমার নায়িকাদের মতো যৌন কামনার বদলে উদ্রেক করে বিরক্তির, গা শিরশির করা ঘৃণার। এ সময় প্রতিদিন ভোরে ছন্দার মাকেও দেখা যায় এক পাশে এসে বাসনকোসন মেজে নিয়ে যেতে। খসরু যতবার ডুব দেয়, ঠিক সেই বরাবর ততবারই ছন্দার মা একদলা থুতু পানিতে ফেলে, যাতে তা খসরুর গোসলকে অসম্পূর্ণই রেখে দেয়। একই সঙ্গেই সাবানের ফেনা মেখে ফরসা হতে বাধা দেয়, নিতম্ব ঊরু সব সময় অবহেলিত হয়েই পড়ে থাকে। কোনো পাখি হয়তো নদীপাড়েরই উঁচু একটা ঢিবির ওপর রাখা বাঁশে গোসল শেষ করে উঠে এদিক-ওদিক তাকায়, পাশেই কিছু উলঙ্গ শিশুও কাদা নিয়ে খেলা শেষে গোসল করতে ঝুপঝাপ লাপ দেয় পাড়ের অল্প পানিতে। কোনো পাখি হয়তো গভীর রাতে ফেরিঘাটের এই ব্যস্ততা, সারি সারি বাস, ট্রাক আর আলো-অন্ধকার ভেদ করে কালো গভীর পানিতে ছুটে চলা ফেরি চুপচাপ দেখে যায়; যেখানটায় ‘ফেরি ক্যামেলিয়া’ নামফলক লেখা দেখা যায়, ঠিক সেখানটায় বসে।
ভরদুপুরে এমনই একটা পাখি আহত হয়ে পড়ে থাকে নদীপাড়ের উত্তপ্ত সাদা বালুতে। দলছুট হয়ে উড়তে না পারায় পাখি হতবিহ্বল হয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। বাকি পাখিরা উড়ে চলে পাল্লা দিয়ে ফেরির সাথে আর নিচে চাকায় ঘুরতে থাকা স্রোতের সাথে। সে সময় হয়তো বগুড়া থেকে বরিশালগামী নবীনবরণ বাসটাও ফেরিতে নদী পার হয়। বাস থেকে হন্তদন্ত হয়ে সাদা পাঞ্জাবি–পায়জামা পরে ইসহাক ব্যাপারীকে নামতে দেখা যায়। দূর থেকে দেখলে যে কেউ হয়তো বলবে ফেরির এক পাশে যে শৌচাগার আছে, ঠিকঠাক দরজার খিল দেওয়া ছাড়া, ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার আর গন্ধময়, ব্যাপারীর হয়তো সেখানে যাওয়ার জন্যই এত তাড়াহুড়ো। কিন্তু শৌচাগার ছাড়িয়েও সে সামনে এগোয় আশপাশে না তাকিয়ে। নাহ, শুধু একবার তাকায় যেখানে চানাচুর দিয়ে মসলা, তেল, পেঁয়াজ, ধনেপাতাকুচি মুড়িতে মেশানো হয় এক ইচ্ছাকৃত উচ্চ শব্দে, সর্বনিম্ন দশ টাকার এই মুড়ি মাখার ঘ্রাণ ব্যাপারীকে তাকাতে বাধ্য করে। মুড়িমাখাওয়ালা আর তার চারপাশের ভিড় সব অগ্রাহ্য করে একটা মাইক্রোবাস আর একটা ট্রাকের মাঝখানের অল্প ফাঁকের ভেতর দিয়ে শুকনো শরীরটা ঢুকিয়ে দেয় অল্পতেই পার হওয়ার জন্য। সে সবকিছু ফেলে প্রায় দৌড়ে হাটে। খাড়া লোহার সিঁড়ির হাতল ধরে পৌঁছে যায় তিনতলায়।
খসরু তিনতলায় ব্যস্ত সবাইকে খাবারদাবার ও ভাত দেওয়ায়। তিনতলায় এক পাশে তার চিপস, প্যাকেটের ভাজাপোড়া, চা–কফির দোকান। ফ্রিজটা আপাতত নষ্ট, নাহয় সেখানে আইসক্রিম থাকে। তারই আশপাশে দুটি টেবিল আর কিছু বেঞ্চ পেতে রাখা সবার ভাত খাওয়ার আর বসার জন্য। এক কোণে তার রান্না করার ছোট রুম। এখান থেকে বের হয়েই উঁচু বেঞ্চে সে গামলা ভরে ভাত, মাছ-মাংস, তরকারি, ডাল রাখে। সে একা সব দিক সামাল দিয়ে উঠতে না পারায় এখান থেকে সবাই যে যার মতো নিয়ে খায়। মাঝেমধ্যে খসরু এসে তদারকি করে, কেউ তাকে ওতে পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। বিশেষত যেসব বাস–ট্রাকের ড্রাইভার, সুপারভাইজাররা নিয়মিত আসে। তার আজকের মেন্যু লালশাকভাজি, বেগুনভাজি, নদীর মাছ ভুনা আর পাতলা ডাল। ডাল সবার জন্য ফ্রি। শাপলা বাসের ড্রাইভার লালশাকের গামলা থেকে অর্ধেক শাক একাই খেয়ে ফেলে, আবার যাওয়ার সময় টাকা না দিয়েই মুহূর্তেই তিনতলা থেকে উধাও হয়ে যায়। খসরুর এখন সময় নেই তার পিছু নেওয়ার কিন্তু সে ধরবেই, এমনই সিদ্ধান্ত তার। সবকিছু শেষ হয়ে গেলে সে বাকিদের ডিমভাজি আর ডাল দেয়। এমন সময়-ই ব্যাপারী সেখানে এসে উপস্থিত হয়। ব্যাপারীকে খুব তাড়াহুড়ো করে বলতে শোনা যায়—“তত্তোরি দ্যাওসেন, দেরি হইয়্যা যাইতাসে তো।’ অল্পক্ষণ পরে মেলামাইনের জোড়া প্লেটের ওপর ভাত, ডাল, ডিমভাজি আর পাতলা শরীরটা নিয়ে ছুটতে দেখা যায় নিচে, বাসের ভেতরে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে সে ওপরে না খেয়ে এত ছোটাছুটির কারণ কী? কারণ সেখানে তার ছেলে আবদুর রহমান আর স্ত্রী অপেক্ষায়। ছেলেকে খাইয়ে সে আবার ছুটে চলে ফেরির তিনতলায় প্লেট-গ্লাস ফেরত দেওয়ার জন্য। তাকে একটা গ্লাসও চেয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে খসরুর কাছ থেকে; কারণ আবদুর রহমান গ্লাস ছাড়া শুধু বোতলে মুখ দিয়ে পানি খেতে পারে না।
২.নদীর পাড়ে আহত পাখিটা সূর্যের উত্তাপে গরম হওয়া বালুতে ফুটতে থাকে। মনে হয় কে যেন শরীর থেকে একটা একটা করে নরম পালক টেনে খুলে ফেলছে। বিস্ফারিত কমলা কালো চোখের মণি নিয়ে ওপরের আকাশের দিকে তাকায়, সেখানের সূর্যের আলো তার চোখে ধাঁধার সৃষ্টি করে। সূর্য আর তার মাঝখানে রংধনুর মতো একটা রাস্তা দেখা যায়। সব শক্তি সঞ্চয় করে সে ওড়ে। হায়, এক হাত সামনে যেতেই সে আবার বালুর ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে। ইসহাক ব্যাপারী এবার তিনতলা থেকে দ্রুত নেমে আসে দোতলায় নামাজ পড়ার জায়গায়। নামাজের ভেতর কণ্ঠনালি, জিহ্বায় জোর দিয়ে পড়া ‘ইয়া কানা’বুদু ওয়া ইয়া কানাস্তাইন’ মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়, মিলিয়ে যায় নদীপাড়ের সুবিস্তৃত হাওয়ায়, সাদা চিকচিক বালুতে। তাতে বাইরের আর্দ্রতা কিছু না কমলেও ব্যাপারীর ভেতর পুরোটা দ্রবীভূত হয়ে যায়। সে প্রস্তুতি নেয় সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু বলার, দীর্ঘ কোনো মোনাজাত ধরার।
৩.আহত পাখির দৃষ্টি কয়েক হাত দূরের আকন্দগাছের ঝোপের দিকে। তার চোখে ঝাপসা ধরা দেয় হালকা ময়লা বেগুনিরঙা আকন্দ ফুলের থোকাগুলো, মনে হয় এই দিনের আলোয়ও অসংখ্য তারা ফুটে আছে। যেভাবেই হোক ঝোপের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে ছায়া মিলবে। পাখি তাকায় ঝোপের দিকে একবার, বিপরীত দিক থেকে রক্তের গন্ধ পেয়ে ছুটে আসা লাল পিঁপড়ার সারির দিকে একবার আর আকাশের স্বচ্ছ কাচরঙা রোদের দিকে। সে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে পড়ে গন্তব্য নিয়ে।
ওদিকে নবীনবরণ বাসের যাত্রীরা সবাই উঠে পড়েছে। বাসের সুপারভাইজার মাথা গুনছে, সবাই ঠিকঠাক উঠল কি না। বাসের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ফেরি থেকে ডাঙায় এপারে ওঠার জন্য তৈরি। ইসহাক ব্যাপারীর বউ আকলিমা পাশে অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, নাক–মুখ বোরকায় ঢাকা আকলিমার ক্ষীণকণ্ঠ সর্বশক্তি দিয়ে বলছে—‘এই যে শুনছেননি ডেরাইভার সাব, আমাগো বাবুর আব্বা তো এক্ষনো আইসা পৌঁছায় নাই যে। হ্যায় নামাজ পড়বার গ্যাছে তো কইল। হে কই গ্যাছে, খুঁইজ্যা আনেন যে।’ সামনের সিটের দাঁড়ানো পায়জামা-পাঞ্জাবি টুপি পরা বারো-তেরো বছর বয়সী ছেলেটাও এ মুহূর্তে হাতের শসা খাওয়া বন্ধ রেখে একবার আকলিমার দিকে আরেকবার দরজার দিকে, ড্রাইভারের দিকে তাকায়। বিটলবণসহ শসার রস বেয়ে তার পাঞ্জাবির দুই হাতা ভিজিয়ে ফেলে, সেদিকে নজর দেওয়ার সময় এ মুহূর্তে না। ফেরির তৃতীয় তলায় সে সময় খসরু একটা বড় গামলায় ডাল, ডিমভাজি আর পোড়া শুকনা মরিচ নিয়ে ভাত খেতে বসে যায়। ঠিক দরজায় ঠাসা সুন্দর ঊরু বের করা লাস্যময়ী নায়িকার ছবির মুখোমুখি হয়ে। সারা দিনের এই একমুহূর্ত সময় পাওয়ার জন্য সে ছটফট করে। এ সময় সে ভাত খায় আর নায়িকার সঙ্গে একান্তে কথা বলে সুখ–দুঃখের, কোন কাস্টমার তার সঙ্গে কী ব্যবহার করল। সবশেষে প্রতিদিন এই আলাপ শেষ হয় এক কষ্ট নিয়ে। নায়িকাকে সে বলে—‘বুঝলানি আমি এই খসরু এত মাইনষেরে রান্না কইরা খাইওইলাম শুধু বাদ থাকলা আমার পেয়ারের লোক তুমি। আমার হাতের ইলিশ মাছ ভাজা শুকনা মরিচ পোড়া দিয়া আর কচি ডাঁটা চিংড়ির ঝোল খাইলে তুমি আমারে সারাডা জীবন মনে রাকতা গো, ভুলবার পারতা না, হ্যাভি টেস।’ সে গোগ্রাসে ভাত মুখে দিয়ে আবার বলতে থাকে—‘সারাডা দিন শুটিংয়ে থাহো, কী যে খাও, সবার রান্দন তো বালা না, কাছত থাকলে যত্ন–আত্তি কত্তামনি। তহন শুধু তুমার রান্দনই রানতাম গো নাইকা ।’ বলেই সে লজ্জা পেয়ে হাসে, আশপাশে কেউ দেখে ফেলল কি না খেয়াল করে। ফেরির দোতলায় সে সময় নামাজের মোনাজাতে ক্রন্দনরত ইসহাক বলছে বিড়বিড় করে—‘ইয়া আল্লাহ, আমার কথা শোনো গো আল্লাহ, কবুল কইর্যা লও সে, আমার পোলাডারে তুমি লইয়া যাইও না গো আল্লাহ। ও আল্লাহ, সারা জাহানের মালিক তুমি মায়ের কোলডা খালি কইরো না। আমি হ্যার মায়েরে কী দিয়া বুঝ দিমু গো আল্লাহ? হ্যায় তো জানে বড় হওনের লগে লগে পোলা ঠিক হইয়্যা যাইব। পোলাতো আরও রোগে পড়তাছে, হ্যার মা’য় তো সন্দেহ করতাসে আমারে। মায়ের মন তো!! আমি যেন হ্যার লগে মিছা কতা না কই। ও মাবুদ, আমি কেমনে কমু পোলার মায়েরে এই ডাউন সিনডোমের পোলার হায়াত আছে আর কয়ডা বছর মাত্র।’
৪.আকাশে হঠাৎ ছায়া নেমে আসে। কোত্থেকে মেঘের গর্জন শোনা যায়, বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির পানি পড়ে। নদীপাড়ের অরিন গার্মেন্টস আরবিঅ্যান্ডবি ব্রিকফিল্ডের ছাইরঙা ধোঁয়া তখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে ঊর্ধ্বমুখী। আহত পাখি তার ঠোঁট হাঁ করে, বৃষ্টির পানির স্বাদ নেয় তার পিপাসার্ত জিহ্বায়। তার চোখ, শরীর ভেজে, আহত ডানার রক্ত ধুয়ে যায়। খসরু সে সময় তিনতলায় হাঁড়ি–পাতিল ধোয়ার কাজে ব্যস্ত, চুলায় তার রাতের ভাত টগবগ করে ফুটতে থাকে। সে উদাস দৃষ্টিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখে নাকি অন্য কিছু ভাবে, সেটা বলা মুশকিল। ইসহাক ব্যাপারীর এ মুহূর্তে চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি নেমে আসে। যা এতক্ষণ ধরে বহু চেষ্টায়ও কেন জানি আসেনি। সে বলতে থাকে—‘ইয়া মাবুদ, মাবুদ রে, রাহমানুর রাহিম তুমি তো তোমার বান্দারে খালি হাতে ফেরত দাও না। আমারেও দিয়ো না। প্রয়োজন হইলে আমারে লইয়্যা যাও গো আল্লাহ, তার বিনিময়ে আমার পোলাডার জীবনডা ভিক্ষা দাও, যেমন কইর্যা ফেরত দিসিলা বাদশার পোলারে (এ সময় সে বাসা থেকে মনে করে আসা বাদশাহ বাবর আর তাঁর পুত্র হুমায়ুনের নাম বহুকষ্ট করেও মনে করতে পারে না )। ব্যাপারী আবার শুরু করে—‘আল্লাহ তুমি তো পানির ওপর থাকন অবস্থায় তোমার অসহায় বান্দার দোয়া কবুল করো। আমার চোখের সামনে আমার আবদুর রহমানরে নিয়ো না আল্লাহ।’ ব্যাপারীর সময়জ্ঞান লোপ পায়, তার হুঁশ থাকে না মোনাজাতে কতটা সময় পেরিয়ে যায়। নিচে ফেরিঘাটে এসে পৌঁছায়। হঠাৎ করে নেমে আসা বৃষ্টিতে পুরো ফেরি পিচ্ছিল কাদাময় হয়ে যায়। যারা এতক্ষণ কোনো বাস ছাড়াই শুধু নদী পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা ছিল, তারা তাদের বস্তা বেডিং, বাচ্চা ছেলের মেয়েদের হাত ধরে পার হয় গাড়িগুলো পাড়ে ওঠার আগেই। আশপাশের ছোট ছোট মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মালবাহী ট্রাক ছোটে ধীরে ধীরে। পেছনে যাত্রীসহ নবীনবরণ বাসের ড্রাইভার গাড়ি ধীরগতিতে এগিয়ে নেয় সিরিয়াল অনুযায়ী ফেরি থেকে পাড়ে ওঠার। ব্যাপারীর বউয়ের চিৎকার, কান্নাকাটিতে আশপাশের দু–একজন সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় ব্যাপার কী জানতে। এ সময় ব্যাপারীর অসুস্থ প্রতিবন্ধী ছেলেরও ঠোঁটের দুপাশে লালা গড়িয়ে পড়ে, চোখের মণি বিস্ফারিত করে সর্বশক্তি দিয়ে সে বহুকষ্টে উচ্চারণ করে—‘আব...বা...আআআ...আব...বা...আআআ।’
অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।ই–মেইল: [email protected]