শিয়াল, গুইসাপ, বেজি, মেছো বাঘগুলো যাবে কোথায়
Published: 21st, June 2025 GMT
‘বাড়ির পাশে বেতের আড়া
হাল জুইড়াছে ছোট্ট দ্যাওরা রে।’
গ্রামমাত্রই আড়া বা জঙ্গল থাকবে। এই জঙ্গলে গুইসাপ, বেজি, বাগডাশ থেকে শুরু করে কচ্ছপ পর্যন্ত থাকত। ছিল এজমালি সম্পত্তির মতো। কেউ মারা গেছে? বাঁশ ওখান থেকে কেটে আনো। কবিরাজের ওষুধ আর কারিগরের বেতও মিলত এখানেই। যে গাছ কেউ রোপণ করত না, সেই শেওড়া, হিজল, ছাতিম, এমনকি সুমিষ্ট কাঁটাভরা পাইনালেরও ঠাঁই মিলত সেখানে। শিশুরা পাখির বাসা খুঁজত। ছিল অপার কল্পনার উৎস।
এই জঙ্গলগুলোকে একপ্রকার মিয়াওয়াকি ফরেস্টও বলা যেতে পারে। বাড়ির পাশের এই বেতের আড়া বা জঙ্গলগুলোই ছিল গাছগাছড়া ও ফসলের পরাগায়ণ ও অঙ্কুরোদ্গমের বেলায় মৌমাছি, কীটপতঙ্গ ও পাখির আবাস। জঙ্গলের মাটি ঝুরঝুরে হওয়ায় ভূগর্ভে পানি প্রবেশ সহজ করে। এই জঙ্গলগুলোই গাঁয়ের বাতাস ঠিক রাখে।
মেছো বাঘ ও বনবিড়াল—উভয়েই তৃণভূমি, জলাভূমি, নদীর ধারে, বনাঞ্চলে থাকে। গায়ে যাদের কালো দাগ, এরা মেছো বাঘ আর গায়ের রং ধূসর বাদামি ও কান লম্বা যাদের, এইগুলো বনবিড়াল। মেছো বাঘ পানিতে মাছ ধরে খায় আর বন বিড়াল ইঁদুর ও ছোট পাখি খায়। বিপন্ন প্রাণী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত এরা। এ ছাড়া ধূসর নেকড়ে, ডোরাকাটা হায়েনা, নীলগাই, গাউর বা বনগরুও ছিল উত্তরবঙ্গের জঙ্গলগুলোতে। সেগুলো কোথায় হারাল?
বন মানে শুধু গাছ নয়, সেখানে পাখি আছে, পোকা আছে, আত্মা আছে, গান আছে। এটা হাওয়াই দ্বীপের আদিবাসীদের বিশ্বাস। আমাদেরও তো।
২০০ থেকে ৫০০ একর জায়গাজুড়ে মিয়াওয়াকি ফরেস্ট গড়ে তোলা গেলে বিলুপ্তপ্রায় অনেক প্রাণী প্রকৃতিতে ফিরে আসবেদুই.ভারতের আসামের মাজুলি দ্বীপ। নাম মোলাই বন। জাদব পায়েং ১৯৭৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে গাছ লাগানো শুরু করেন। তাঁকে ভারতের ফরেস্ট ম্যান বলে ডাকা হয়। একা তিনি বনটি গড়ে তুলেছেন। আজ সেখানে ১ হাজার ৩৬০ একর জমিতে ঘন বন বিস্তৃত। সেখানে বেঙ্গল টাইগার, হাতি, হরিণ, পাখি, খরগোশ, শিয়াল প্রভৃতি প্রাণী বসবাস করছে। ভারতের উত্তর প্রদেশেও ২০১২ শুভেন্দু শর্মা নামের এক ব্যক্তি ছোট ছোট জমিতে প্রাকৃতিক মিয়াওয়াকি বন তৈরি করেছেন। তার সংস্থা ‘এফরেস্ট’ বিভিন্ন দেশে ব্যক্তিগত বন গড়ে তোলায় সাহায্য করে এখন।
ব্রাজিলের জোসে লুটজ নিজের জমিতে বিশাল বন তৈরি করে প্রতিবেশীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁর ৫০ একরের বনে বহু বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী আবার এসেছে। এবার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে তোলা বনগুলোর কথা বলি।
ক. চীন—গ্রেট গ্রিন ওয়াল, আয়তন প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০০ কিলোমিটার চওড়া একটি অঞ্চলজুড়ে। উদ্দেশ্য, গোবি মরুভূমির বিস্তার ঠেকানো। চীনা হরিণ, খরগোশ, পাখি, শিয়াল, সাপ প্রজাতি উল্লেখযোগ্য। খ. ভারত—আরণ্যক বন, পশ্চিমবঙ্গ, ১ হাজার ২০০ হেক্টর। সীতাবাড়ি সামাজিক বন, রাজস্থান, প্রায় ৫০০ হেক্টর। উদ্দেশ্য, জ্বালানি কাঠ, পশুখাদ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ। বনরুই, শিয়াল, বনবিড়াল, বিভিন্ন পাখি ও সরীসৃপ এখানকার প্রধান প্রাণী। গ. সৌদি আরব—মরুভূমিতে কৃত্রিম বন, রিয়াদ–সংলগ্ন এলাকায় সবুজায়নের প্রকল্প। আয়তন ছোট ছোট অঞ্চল মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমি। মরুভূমির খরগোশ, স্যান্ড ক্যাট, সাপ ও মরু পাখিই প্রধান।
তিন.জাপানের বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ আকিরা মিয়াওয়াকি। তিনিই মিয়াওয়াকি ধারণার প্রবক্তা। এ পদ্ধতিতে ছোট ছোট জায়গায় অল্প সময়ে বয়স্ক বনের আদল তৈরি করা যায়। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে মাত্র ৩০ বর্গফুটের মধ্যেও বন তৈরি করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে লাগানো গাছ সাধারণ বনের গাছের চেয়ে ১০ গুণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। বছরে অন্তত এক মিটার বাড়ে। ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে গভীর বন তৈরি করা সম্ভব। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য সাধারণ বন থেকে এই বন ৩০ গুণ বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। এ ধারণা কাজে লাগিয়ে নেদারল্যান্ডস ও ভারত তাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ গড়ে তুলে সুফল পাচ্ছে।
সম্প্রতি মিরসরাই উপজেলায় একটি মিয়াওয়াকি ফরেস্ট গড়ে তোলায় পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন প্রাকৃতিক কৃষিকেন্দ্রের উদ্যোক্তা ও পরিচালক দেলোয়ার জাহান। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমে মাটি প্রস্তুত করেছি। সে মাটিতে জৈব সার হিসেবে গাছের গুঁড়ি, খড় ও পচা লতাপাতা ব্যবহার করা হয়েছে। আলাদা জায়গায় মাটি প্রস্তুত করে সেই মাটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিচ থেকে ওপরে কিছুটা ঢালু করে বিছানো হয়েছে। তারপর সেখানে দুই বর্গফুট জায়গার চার কোনায় চারটি করে গাছ লাগানো হয়েছে। এখানে ৪ হাজার ৪০০ বর্গফুট জায়গায় আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা ১২০ প্রজাতির গাছ ও লতাগুল্ম লাগিয়েছি। তুলসী থেকে কদম, বাঁশ থেকে বেত—সব ধরনের প্রজাতির সম্মিলন ঘটানো হয়েছে এই বনে। ১৩ মাস বয়সী গাছগুলোর কোনো কোনোটির উচ্চতা ১৭ ফুট পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। বলতে পারি, মিয়াওয়াকি ফরেস্ট তৈরির চেষ্টায় সফল হয়েছি আমরা।’
চার.ধারণা করা যায়, ২০০ থেকে ৫০০ একর জায়গাজুড়ে মিয়াওয়াকি ফরেস্ট গড়ে তোলা গেলে বিলুপ্তপ্রায় অনেক প্রাণী প্রকৃতিতে ফিরে আসবে। শুরুতে খাসজমি চিহ্নিত করতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় এটুকু জমি অনায়াসে সংগ্রহ করা সম্ভব। তথ্য সংগ্রহ থেকে বন গড়ে তোলা পর্যন্ত জেলা প্রশাসন, স্থানীয় ভূমি অফিস ও বন বিভাগের সমন্বয়ে কাজটি হবে।
বাংলাদেশে কৃষি–প্রতিবেশ বা বাস্তুসংস্থান এলাকা ৩০ প্রকারের। অঞ্চলভেদে ফসলের বিন্যাস ও চাষের ধরনও ৩০ প্রকার। ২৩০টি নদী হিসেবে বাংলাদেশকে ১৭টি পানি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। একেকটি পানি অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান, কৃষি–সংস্কৃতি একেক রকম। এ অনুসারে কোন ধরনের গাছপালা সেখানে টিকবে এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, তা বোঝা যাবে আশপাশে কোন বৃক্ষগুলো আপনা–আপনি বেড়ে উঠেছে সেগুলো দেখে। সে অনুসারে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। তবে কথিত সামাজিক বনায়নের নামে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি এবং শালবনে ভিন্ন বৃক্ষরোপণ করা যাবে না। আর এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে স্থানীয় তরুণসমাজ, পরিবেশপ্রেমী মানুষ ও শিক্ষার্থীদের।
● নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কৃত্রিম হীরা তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা
গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে হীরা তৈরি করেছেন চীনের সেন্টার ফর হাই-প্রেশার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অ্যাডভান্সড রিসার্চের বিজ্ঞানীরা। উল্কাপিণ্ডে থাকা বিভিন্ন উপাদান সফলভাবে কাজে লাগিয়ে ষড়্ভুজাকার হীরা তৈরি করেছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, কৃত্রিমভাবে তৈরি হীরাটি প্রকৃতিতে পাওয়া যেকোনো বস্তুর চেয়ে শক্ত। বৈজ্ঞানিক সাময়িকী নেচারে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
গবেষণার তথ্যমতে, বিজ্ঞানীরা উচ্চ তাপমাত্রা, উচ্চ চাপ ও আধা হাইড্রোস্ট্যাটিক পরিস্থিতিতে উল্কাপিণ্ডে থাকা গ্রাফাইটকে ষড়্ভুজাকার হীরাতে রূপান্তর করেছেন। এই স্ফটিক কাঠামো প্রচলিত প্রাকৃতিক হীরার চেয়ে শক্ত বলে মনে করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক হীরা শক্ত হলেও কিছুটা দুর্বলতা থাকে। তবে ষড়্ভুজাকার হীরা বা লন্সডেলাইট আরও শক্তিশালী পারমাণবিক বিন্যাস নিয়ে গঠিত।
বিজ্ঞানী ইয়াং লিউশিয়াং বলেন, এই পদ্ধতির মাধ্যমে হীরা তৈরিতে দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জের সমাধান করা হয়েছে। ভবিষ্যতের উপাদান উদ্ভাবনের জন্য একটি পদ্ধতিগত ভিত্তি স্থাপন করেছি আমরা। অপর বিজ্ঞানী হো-কোয়াং মাও এই অর্জনকে পরবর্তী প্রজন্মের অতি কঠিন উপকরণ ও উন্নত ইলেকট্রনিক যন্ত্র বিকাশের জন্য একটি নতুন পথ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি জানান, কাঁচামাল হিসেবে অতি বিশুদ্ধ, অপরিষ্কার–মুক্ত প্রাকৃতিক গ্রাফাইট ষড়্ভুজাকার হীরার নমুনা তৈরিতে সহায়তা করেছে। পুরো প্রক্রিয়া সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
১০০ মাইক্রন স্কেলে পরীক্ষাগারে ষড়্ভুজাকার হীরা তৈরি করা হয়েছে। উল্কাপিণ্ডে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া এই বিরল হীরা তৈরির মাধ্যমে অতি কঠিন পদার্থের সন্ধানে এগিয়ে গেলেন চীনের বিজ্ঞানীরা। নতুন এই প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে পরীক্ষাগারে নতুন পদার্থ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সূত্র: এনডিটিভি