‘বাড়ির পাশে বেতের আড়া

হাল জুইড়াছে ছোট্ট দ্যাওরা রে।’

গ্রামমাত্রই আড়া বা জঙ্গল থাকবে। এই জঙ্গলে গুইসাপ, বেজি, বাগডাশ থেকে শুরু করে কচ্ছপ পর্যন্ত থাকত। ছিল এজমালি সম্পত্তির মতো। কেউ মারা গেছে? বাঁশ ওখান থেকে কেটে আনো। কবিরাজের ওষুধ আর কারিগরের বেতও মিলত এখানেই। যে গাছ কেউ রোপণ করত না, সেই শেওড়া, হিজল, ছাতিম, এমনকি সুমিষ্ট কাঁটাভরা পাইনালেরও ঠাঁই মিলত সেখানে। শিশুরা পাখির বাসা খুঁজত। ছিল অপার কল্পনার উৎস।

এই জঙ্গলগুলোকে একপ্রকার মিয়াওয়াকি ফরেস্টও বলা যেতে পারে। বাড়ির পাশের এই বেতের আড়া বা জঙ্গলগুলোই ছিল গাছগাছড়া ও ফসলের পরাগায়ণ ও অঙ্কুরোদ্‌গমের বেলায় মৌমাছি, কীটপতঙ্গ ও পাখির আবাস। জঙ্গলের মাটি ঝুরঝুরে হওয়ায় ভূগর্ভে পানি প্রবেশ সহজ করে। এই জঙ্গলগুলোই গাঁয়ের বাতাস ঠিক রাখে।

মেছো বাঘ ও বনবিড়াল—উভয়েই তৃণভূমি, জলাভূমি, নদীর ধারে, বনাঞ্চলে থাকে। গায়ে যাদের কালো দাগ, এরা মেছো বাঘ আর গায়ের রং ধূসর বাদামি ও কান লম্বা যাদের, এইগুলো বনবিড়াল। মেছো বাঘ পানিতে মাছ ধরে খায় আর বন বিড়াল ইঁদুর ও ছোট পাখি খায়। বিপন্ন প্রাণী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত এরা। এ ছাড়া ধূসর নেকড়ে, ডোরাকাটা হায়েনা, নীলগাই, গাউর বা বনগরুও ছিল উত্তরবঙ্গের জঙ্গলগুলোতে। সেগুলো কোথায় হারাল?

বন মানে শুধু গাছ নয়, সেখানে পাখি আছে, পোকা আছে, আত্মা আছে, গান আছে। এটা হাওয়াই দ্বীপের আদিবাসীদের বিশ্বাস। আমাদেরও তো।

২০০ থেকে ৫০০ একর জায়গাজুড়ে মিয়াওয়াকি ফরেস্ট গড়ে তোলা গেলে বিলুপ্তপ্রায় অনেক প্রাণী প্রকৃতিতে ফিরে আসবেদুই.

ভারতের আসামের মাজুলি দ্বীপ। নাম মোলাই বন। জাদব পায়েং ১৯৭৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে গাছ লাগানো শুরু করেন। তাঁকে ভারতের ফরেস্ট ম্যান বলে ডাকা হয়। একা তিনি বনটি গড়ে তুলেছেন। আজ সেখানে ১ হাজার ৩৬০ একর জমিতে ঘন বন বিস্তৃত। সেখানে বেঙ্গল টাইগার, হাতি, হরিণ, পাখি, খরগোশ, শিয়াল প্রভৃতি প্রাণী বসবাস করছে। ভারতের উত্তর প্রদেশেও ২০১২ শুভেন্দু শর্মা নামের এক ব্যক্তি ছোট ছোট জমিতে প্রাকৃতিক মিয়াওয়াকি বন তৈরি করেছেন। তার সংস্থা ‘এফরেস্ট’ বিভিন্ন দেশে ব্যক্তিগত বন গড়ে তোলায় সাহায্য করে এখন।

ব্রাজিলের জোসে লুটজ নিজের জমিতে বিশাল বন তৈরি করে প্রতিবেশীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁর ৫০ একরের বনে বহু বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী আবার এসেছে। এবার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে তোলা বনগুলোর কথা বলি। 

ক. চীন—গ্রেট গ্রিন ওয়াল, আয়তন প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০০ কিলোমিটার চওড়া একটি অঞ্চলজুড়ে। উদ্দেশ্য, গোবি মরুভূমির বিস্তার ঠেকানো। চীনা হরিণ, খরগোশ, পাখি, শিয়াল, সাপ প্রজাতি উল্লেখযোগ্য। খ. ভারত—আরণ্যক বন, পশ্চিমবঙ্গ, ১ হাজার ২০০ হেক্টর। সীতাবাড়ি সামাজিক বন, রাজস্থান, প্রায় ৫০০ হেক্টর। উদ্দেশ্য, জ্বালানি কাঠ, পশুখাদ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ। বনরুই, শিয়াল, বনবিড়াল, বিভিন্ন পাখি ও সরীসৃপ এখানকার প্রধান প্রাণী। গ. সৌদি আরব—মরুভূমিতে কৃত্রিম বন, রিয়াদ–সংলগ্ন এলাকায় সবুজায়নের প্রকল্প। আয়তন ছোট ছোট অঞ্চল মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমি। মরুভূমির খরগোশ, স্যান্ড ক্যাট, সাপ ও মরু পাখিই প্রধান।

তিন.

জাপানের বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ আকিরা মিয়াওয়াকি। তিনিই মিয়াওয়াকি ধারণার প্রবক্তা। এ পদ্ধতিতে ছোট ছোট জায়গায় অল্প সময়ে বয়স্ক বনের আদল তৈরি করা যায়। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে মাত্র ৩০ বর্গফুটের মধ্যেও বন তৈরি করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে লাগানো গাছ সাধারণ বনের গাছের চেয়ে ১০ গুণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। বছরে অন্তত এক মিটার বাড়ে। ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে গভীর বন তৈরি করা সম্ভব। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য সাধারণ বন থেকে এই বন ৩০ গুণ বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। এ ধারণা কাজে লাগিয়ে নেদারল্যান্ডস ও ভারত তাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ গড়ে তুলে সুফল পাচ্ছে।

সম্প্রতি মিরসরাই উপজেলায় একটি মিয়াওয়াকি ফরেস্ট গড়ে তোলায় পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন প্রাকৃতিক কৃষিকেন্দ্রের উদ্যোক্তা ও পরিচালক দেলোয়ার জাহান। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমে মাটি প্রস্তুত করেছি। সে মাটিতে জৈব সার হিসেবে গাছের গুঁড়ি, খড় ও পচা লতাপাতা ব্যবহার করা হয়েছে। আলাদা জায়গায় মাটি প্রস্তুত করে সেই মাটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিচ থেকে ওপরে কিছুটা ঢালু করে বিছানো হয়েছে। তারপর সেখানে দুই বর্গফুট জায়গার চার কোনায় চারটি করে গাছ লাগানো হয়েছে। এখানে ৪ হাজার ৪০০ বর্গফুট জায়গায় আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা ১২০ প্রজাতির গাছ ও লতাগুল্ম লাগিয়েছি। তুলসী থেকে কদম, বাঁশ থেকে বেত—সব ধরনের প্রজাতির সম্মিলন ঘটানো হয়েছে এই বনে। ১৩ মাস বয়সী গাছগুলোর কোনো কোনোটির উচ্চতা ১৭ ফুট পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। বলতে পারি, মিয়াওয়াকি ফরেস্ট তৈরির চেষ্টায় সফল হয়েছি আমরা।’

চার.

ধারণা করা যায়, ২০০ থেকে ৫০০ একর জায়গাজুড়ে মিয়াওয়াকি ফরেস্ট গড়ে তোলা গেলে বিলুপ্তপ্রায় অনেক প্রাণী প্রকৃতিতে ফিরে আসবে। শুরুতে খাসজমি চিহ্নিত করতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় এটুকু জমি অনায়াসে সংগ্রহ করা সম্ভব। তথ্য সংগ্রহ থেকে বন গড়ে তোলা পর্যন্ত জেলা প্রশাসন, স্থানীয় ভূমি অফিস ও বন বিভাগের সমন্বয়ে কাজটি হবে।

 বাংলাদেশে কৃষি–প্রতিবেশ বা বাস্তুসংস্থান এলাকা ৩০ প্রকারের। অঞ্চলভেদে ফসলের বিন্যাস ও চাষের ধরনও ৩০ প্রকার। ২৩০টি নদী হিসেবে বাংলাদেশকে ১৭টি পানি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। একেকটি পানি অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান, কৃষি–সংস্কৃতি একেক রকম। এ অনুসারে কোন ধরনের গাছপালা সেখানে টিকবে এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, তা বোঝা যাবে আশপাশে কোন বৃক্ষগুলো আপনা–আপনি বেড়ে উঠেছে সেগুলো দেখে। সে অনুসারে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। তবে কথিত সামাজিক বনায়নের নামে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি এবং শালবনে ভিন্ন বৃক্ষরোপণ করা যাবে না। আর এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে স্থানীয় তরুণসমাজ, পরিবেশপ্রেমী মানুষ ও শিক্ষার্থীদের।

নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ফর স ট বন ত র

এছাড়াও পড়ুন:

ফায়ারফক্সে আসছে এআই উইন্ডো

কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তা বা এআইকেন্দ্রিক ব্রাউজারের বাজার দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতার মধ্যেই ফায়ারফক্সে নতুন এআই উইন্ডো নামের বিশেষ সুবিধা যুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে মজিলা। সুবিধাটির মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা ওয়েবসাইট ব্রাউজ করার সময় প্রয়োজন অনুসারে একটি সমন্বিত এআই সহকারীর সাহায্য নিতে পারবেন। পুরো প্রক্রিয়াই থাকবে ব্যবহারকারীর নিয়ন্ত্রণে।

এক ব্লগ বার্তায় মজিলা জানায়, এআই উইন্ডো ব্রাউজিংয়ে ক্ষেত্রে এআই নির্দেশনা ও ব্যক্তিগত সহায়তার সুবিধা দেবে। সুবিধাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় থাকবে না। আগ্রহী ব্যবহারকারীরা চাইলে নিজে থেকেই চালু করবেন। যেকোনো সময় বন্ধ করা যাবে। এআইনির্ভর এই সুবিধা ওপেন সোর্স প্রযুক্তির ভিত্তিতে তৈরি করা হচ্ছে।

ফিচারটি পরীক্ষামূলক সংস্করণ কিছু ব্যবহারকারীর কাছে উপলব্ধ হয়েছে। মজিলা জানিয়েছে, যে কেউ চাইলে আগের মতোই ফায়ারফক্স ব্যবহার করে নিজের পছন্দমতো কাস্টমাইজড অভিজ্ঞতা পাবেন। আরও বেশি গোপনীয়তা চাইলে প্রাইভেট উইন্ডো ব্যবহার করতে পারবেন। এআই উইন্ডো ব্রাউজিংকে আরও ব্যক্তিগত উপায়ে ব্যবহারের সুযোগ দেবে।

এআই চালিত ব্রাউজারের ব্যবহার বাড়তে থাকায় বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি এখন সার্চবারের জায়গায় চ্যাটবট যুক্ত করা বা সম্পূর্ণ এআইনির্ভর ব্রাউজার তৈরিতে মনোযোগ দিচ্ছে। ওপেনএআইয়ের চ্যাটজিপিটি অ্যাটলাস বা পারপ্লেক্সিটির কমেট পুরোপুরি এআই এজেন্টকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়েছে।

ভবিষ্যতে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলনির্ভর ব্রাউজারের বড় সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিযোগিতার মধ্যেও ভিন্ন অবস্থান তৈরি করতে চেষ্টা করছে মজিলা। তারা বলছে, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ব্যবহারকারীর স্বাধীনতা—এই তিন নীতি সামনে রেখে ব্রাউজিং অভিজ্ঞতা দেওয়া হচ্ছে। ওয়েবকে সবার জন্য উন্মুক্ত, মুক্ত ও নিরাপদ রাখতে চায় মজিলা। মজিলার ভাষ্য অনুযায়ী, ফায়ারফক্সে কোনো একক ইকোসিস্টেমে ব্যবহারকারীকে আটকে রাখা হবে না। এআই ব্যবহারের ওপর কোনো বাধ্যবাধকতাও থাকবে না। কখন, কীভাবে বা আদৌ এটি ব্যবহার করবেন কি না, এমন সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ব্যবহারকারীর।

এ বছরের জুনে ফায়ারফক্সের অ্যাড্রেসবারে থাকা ইউনিফায়েড সার্চ সুবিধায় সরাসরি পারপ্লেক্সিটি এআইয়ের মাধ্যমে অনুসন্ধানের অপশন যুক্ত করে মজিলা। নতুন এআই উইন্ডো ফিচার যুক্ত হলে ব্রাউজিং অভিজ্ঞতা আরও বহুমাত্রিক হয়ে উঠবে বলে মনে করছে সংস্থাটি।

সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

সম্পর্কিত নিবন্ধ