Prothomalo:
2025-06-21@13:19:44 GMT

পুকুরের জলে স্মৃতির ছায়া

Published: 21st, June 2025 GMT

আমার শৈশব কেটেছে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার একটি ছোট গ্রামে, নাম ফতেপুর। সেই গ্রামের স্মৃতিতে আজও ভেসে ওঠে শতবর্ষী বটগাছের ছায়া, তার পাশে নোনা ধরা পুরোনো মন্দির, শিমুলগাছের নিচে ফুটে থাকা ভাঁটফুলের মৃদু গন্ধ, ধান কাটা শেষ হওয়ার পর বিকেলের ম্লান আলোয় খোলা মাঠের নীরবতা, সন্ধ্যায় ঝোপের ধারে ঝুলতে থাকা জোনাকির আলো আর দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝির ডাক—সব মিলিয়ে এক স্বপ্নজালের মতো শৈশব।

আমাদের বাড়ির দরজার ঠিক সামনে ছিল ডালিমগাছের ছায়া, তারপর খানিকটা কাঁচা পথ পেরিয়ে ডুমুরগাছ। আর সেই গাছের ঠিক পরেই পুকুরঘাট—শৈশবের অলৌকিক জলছবি।

আমাদের বাড়িতে তখন ১২ থেকে ১৪টি পরিবার থাকত। বাড়িটা যেমন বড়, পুকুরটাও তেমনি বড়। পুকুরের এক পাশে শ্মশান, সেখানে দুটি মন্দির—একটা পুরোনো, অশ্বত্থগাছে একেবারে ঢেকে গেছে। সেখানে কারা শায়িত, কেউ জানে না, জিজ্ঞেস করলে রহস্যময় সব উত্তর পেতাম। আরেকটা মন্দিরে আমার দাদু আর ঠাকুমার সমাধি। এই মন্দির ছাড়া পুকুরটার বাকি তিন পাশের তিনটি গাছের কথা মনে আছে। দক্ষিণে একা দাঁড়িয়ে থাকা নিমগাছ, যার ছায়ায় বসে শিখেছি কোনো কিছু না ভেবে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে। বড়বেলায় বনফুলের ‘নিমগাছ’ গল্প পড়ার পর সেই গাছটার কথা মনে হয়েছিল। উত্তর পাশে ছিল কদমগাছ, বর্ষায় যেটা কদম ফুলে ভরে যেত—মনে হতো যেন পুকুরটা নোলক পরে আছে। আর পশ্চিম পাশে ছিল প্রিয় ডুমুরগাছ, সেখানেই ছিল পুকুরঘাট। ওই গাছটায় হালকা চেষ্টায় ওঠা যেত, তারপর গাছ থেকে সোজা ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে। সেকি আনন্দ! যেন পৃথিবীটা জল দিয়ে তৈরি। আমরা হাসতে হাসতে জলে ভেসে থাকতাম। আলো হয়ে, হাওয়া হয়ে, আনন্দ হয়ে।

বর্ষায় আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমার পর সেই মেঘের ছায়া পুকুরের জলে পড়লে মনে হতো কোনো অজানা পাখির কালচে রঙের নীল ডিম। এরপর বৃষ্টি নামলে পুকুরজুড়ে শুরু হতো জলের ওপর জলবিন্দুর নৃত্য। স্কুল থেকে ফেরার পথে বুকের ওপর বই–খাতা চেপে গাছের নিচে ভিজতে ভিজতে শুনতাম রিমঝিম, রিমঝিম, রিমঝিম।

আমাদের বাড়ির পুকুরটা ছিল বারোয়ারি—এ পুকুরটার নির্জনতা ছিল না। নির্জনতা ছিল আমার মামাবাড়ির পুকুরে। মামাদের গ্রামের নামটি খুব সুন্দর, যাত্রাসিদ্ধি। মামার বাড়িতে শুধু দুটি পরিবার থাকত, ভিড় হতো না খুব একটা। স্নানের সময়টা ছাড়া বাকি সময়টা জলরঙে আঁকা শান্ত এক নিরিবিলি পুকুরের ছবি হয়ে ঝুলে থাকত। এ পুকুরটা ছিল ছিমছাম, মাঝারি গোছের। চারপাশে আম, কাঁঠাল, সুপারি আর একদিকে একটা হেলে পড়া তালগাছ। পাড়ের ধারে নরম ঘাস, জলে গাছের গভীর ছায়া টলটল করত। এই পুকুরপাড়ে বসে দেখছি গাছ থেকে পাতা খসে পড়া আর উড়তে থাকা তিনটি ফড়িংয়ের হঠাৎ করে রোদ্দুরে মিশে যাওয়া!

এ পুকুরটা ছিল মাছে ভর্তি। পুকুরের মাঝবরাবর জাল লাগানো থাকত। সেই জাল সাদা জুঁই ফুলের মতো ভরে থাকত চাপিলা মাছে। মাঝেমধ্যে কলাগাছ কেটে ভেলা বানিয়ে মাছ ধরা হতো। তারপর মাছ কেটে দুই পরিবারের মধ্যে ভাগ করে দুপুরের চুলার আগুনে সেই মাছ রান্না হতো। গোটা প্রক্রিয়াটা সিনেমা দেখার চেয়ে কম আকর্ষণীয় ছিল না।

আমার জীবনের তৃতীয় পুকুরটি বাকি দুটির মতো কাব্যিক নয়। পুকুরটা মফস্‌সল শহরের চারদিকের দালানকোঠার মধ্যে কোনো রকম নাক উঁচু করে বেঁচে ছিল। এ পুকুরটা ফেনী পিটিআই স্কুলের পেছনে ছিল বলে এর নাম ছিল পিটিআই পুকুর। এখানে গাছের ছায়া নেই, পুকুরের অর্ধেকজুড়ে কচুরিপানা। কলেজে পড়ার সময়, গরম বিকেলে খেলা শেষে এই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে শীতলতা পেয়েছি। ফুটবল খেলার পর জলে নামা ছিল আমাদের রঙিন উৎসব—বন্ধুদের সঙ্গে সে সময়গুলো ছিল দুরন্ত  কৈশোরবেলার সেরা উপহার।

এখন গ্রামে, শহরে রোজ একটু একটু করে সব পুকুর দোকান আর ফ্ল্যাটের পেটে ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর ছেলেবেলার যে অনন্ত ছায়া, তা মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমে। বয়স যত বাড়ছে, এই সব ইকিরমিকির ছেলেবেলা তত বেশি ঝাপটা মারছে হররোজ। আমের গন্ধ, কল্কে ফুলের মধু আর প্রিয় পুকুরঘাট কানের কাছে প্রায়ই ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, মনে আছে আমাদের কথা?

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: মন দ র আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

পুকুরের জলে স্মৃতির ছায়া

আমার শৈশব কেটেছে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার একটি ছোট গ্রামে, নাম ফতেপুর। সেই গ্রামের স্মৃতিতে আজও ভেসে ওঠে শতবর্ষী বটগাছের ছায়া, তার পাশে নোনা ধরা পুরোনো মন্দির, শিমুলগাছের নিচে ফুটে থাকা ভাঁটফুলের মৃদু গন্ধ, ধান কাটা শেষ হওয়ার পর বিকেলের ম্লান আলোয় খোলা মাঠের নীরবতা, সন্ধ্যায় ঝোপের ধারে ঝুলতে থাকা জোনাকির আলো আর দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝির ডাক—সব মিলিয়ে এক স্বপ্নজালের মতো শৈশব।

আমাদের বাড়ির দরজার ঠিক সামনে ছিল ডালিমগাছের ছায়া, তারপর খানিকটা কাঁচা পথ পেরিয়ে ডুমুরগাছ। আর সেই গাছের ঠিক পরেই পুকুরঘাট—শৈশবের অলৌকিক জলছবি।

আমাদের বাড়িতে তখন ১২ থেকে ১৪টি পরিবার থাকত। বাড়িটা যেমন বড়, পুকুরটাও তেমনি বড়। পুকুরের এক পাশে শ্মশান, সেখানে দুটি মন্দির—একটা পুরোনো, অশ্বত্থগাছে একেবারে ঢেকে গেছে। সেখানে কারা শায়িত, কেউ জানে না, জিজ্ঞেস করলে রহস্যময় সব উত্তর পেতাম। আরেকটা মন্দিরে আমার দাদু আর ঠাকুমার সমাধি। এই মন্দির ছাড়া পুকুরটার বাকি তিন পাশের তিনটি গাছের কথা মনে আছে। দক্ষিণে একা দাঁড়িয়ে থাকা নিমগাছ, যার ছায়ায় বসে শিখেছি কোনো কিছু না ভেবে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে। বড়বেলায় বনফুলের ‘নিমগাছ’ গল্প পড়ার পর সেই গাছটার কথা মনে হয়েছিল। উত্তর পাশে ছিল কদমগাছ, বর্ষায় যেটা কদম ফুলে ভরে যেত—মনে হতো যেন পুকুরটা নোলক পরে আছে। আর পশ্চিম পাশে ছিল প্রিয় ডুমুরগাছ, সেখানেই ছিল পুকুরঘাট। ওই গাছটায় হালকা চেষ্টায় ওঠা যেত, তারপর গাছ থেকে সোজা ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে। সেকি আনন্দ! যেন পৃথিবীটা জল দিয়ে তৈরি। আমরা হাসতে হাসতে জলে ভেসে থাকতাম। আলো হয়ে, হাওয়া হয়ে, আনন্দ হয়ে।

বর্ষায় আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমার পর সেই মেঘের ছায়া পুকুরের জলে পড়লে মনে হতো কোনো অজানা পাখির কালচে রঙের নীল ডিম। এরপর বৃষ্টি নামলে পুকুরজুড়ে শুরু হতো জলের ওপর জলবিন্দুর নৃত্য। স্কুল থেকে ফেরার পথে বুকের ওপর বই–খাতা চেপে গাছের নিচে ভিজতে ভিজতে শুনতাম রিমঝিম, রিমঝিম, রিমঝিম।

আমাদের বাড়ির পুকুরটা ছিল বারোয়ারি—এ পুকুরটার নির্জনতা ছিল না। নির্জনতা ছিল আমার মামাবাড়ির পুকুরে। মামাদের গ্রামের নামটি খুব সুন্দর, যাত্রাসিদ্ধি। মামার বাড়িতে শুধু দুটি পরিবার থাকত, ভিড় হতো না খুব একটা। স্নানের সময়টা ছাড়া বাকি সময়টা জলরঙে আঁকা শান্ত এক নিরিবিলি পুকুরের ছবি হয়ে ঝুলে থাকত। এ পুকুরটা ছিল ছিমছাম, মাঝারি গোছের। চারপাশে আম, কাঁঠাল, সুপারি আর একদিকে একটা হেলে পড়া তালগাছ। পাড়ের ধারে নরম ঘাস, জলে গাছের গভীর ছায়া টলটল করত। এই পুকুরপাড়ে বসে দেখছি গাছ থেকে পাতা খসে পড়া আর উড়তে থাকা তিনটি ফড়িংয়ের হঠাৎ করে রোদ্দুরে মিশে যাওয়া!

এ পুকুরটা ছিল মাছে ভর্তি। পুকুরের মাঝবরাবর জাল লাগানো থাকত। সেই জাল সাদা জুঁই ফুলের মতো ভরে থাকত চাপিলা মাছে। মাঝেমধ্যে কলাগাছ কেটে ভেলা বানিয়ে মাছ ধরা হতো। তারপর মাছ কেটে দুই পরিবারের মধ্যে ভাগ করে দুপুরের চুলার আগুনে সেই মাছ রান্না হতো। গোটা প্রক্রিয়াটা সিনেমা দেখার চেয়ে কম আকর্ষণীয় ছিল না।

আমার জীবনের তৃতীয় পুকুরটি বাকি দুটির মতো কাব্যিক নয়। পুকুরটা মফস্‌সল শহরের চারদিকের দালানকোঠার মধ্যে কোনো রকম নাক উঁচু করে বেঁচে ছিল। এ পুকুরটা ফেনী পিটিআই স্কুলের পেছনে ছিল বলে এর নাম ছিল পিটিআই পুকুর। এখানে গাছের ছায়া নেই, পুকুরের অর্ধেকজুড়ে কচুরিপানা। কলেজে পড়ার সময়, গরম বিকেলে খেলা শেষে এই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে শীতলতা পেয়েছি। ফুটবল খেলার পর জলে নামা ছিল আমাদের রঙিন উৎসব—বন্ধুদের সঙ্গে সে সময়গুলো ছিল দুরন্ত  কৈশোরবেলার সেরা উপহার।

এখন গ্রামে, শহরে রোজ একটু একটু করে সব পুকুর দোকান আর ফ্ল্যাটের পেটে ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর ছেলেবেলার যে অনন্ত ছায়া, তা মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমে। বয়স যত বাড়ছে, এই সব ইকিরমিকির ছেলেবেলা তত বেশি ঝাপটা মারছে হররোজ। আমের গন্ধ, কল্কে ফুলের মধু আর প্রিয় পুকুরঘাট কানের কাছে প্রায়ই ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, মনে আছে আমাদের কথা?

সম্পর্কিত নিবন্ধ