আমার শৈশব কেটেছে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার একটি ছোট গ্রামে, নাম ফতেপুর। সেই গ্রামের স্মৃতিতে আজও ভেসে ওঠে শতবর্ষী বটগাছের ছায়া, তার পাশে নোনা ধরা পুরোনো মন্দির, শিমুলগাছের নিচে ফুটে থাকা ভাঁটফুলের মৃদু গন্ধ, ধান কাটা শেষ হওয়ার পর বিকেলের ম্লান আলোয় খোলা মাঠের নীরবতা, সন্ধ্যায় ঝোপের ধারে ঝুলতে থাকা জোনাকির আলো আর দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝির ডাক—সব মিলিয়ে এক স্বপ্নজালের মতো শৈশব।
আমাদের বাড়ির দরজার ঠিক সামনে ছিল ডালিমগাছের ছায়া, তারপর খানিকটা কাঁচা পথ পেরিয়ে ডুমুরগাছ। আর সেই গাছের ঠিক পরেই পুকুরঘাট—শৈশবের অলৌকিক জলছবি।
আমাদের বাড়িতে তখন ১২ থেকে ১৪টি পরিবার থাকত। বাড়িটা যেমন বড়, পুকুরটাও তেমনি বড়। পুকুরের এক পাশে শ্মশান, সেখানে দুটি মন্দির—একটা পুরোনো, অশ্বত্থগাছে একেবারে ঢেকে গেছে। সেখানে কারা শায়িত, কেউ জানে না, জিজ্ঞেস করলে রহস্যময় সব উত্তর পেতাম। আরেকটা মন্দিরে আমার দাদু আর ঠাকুমার সমাধি। এই মন্দির ছাড়া পুকুরটার বাকি তিন পাশের তিনটি গাছের কথা মনে আছে। দক্ষিণে একা দাঁড়িয়ে থাকা নিমগাছ, যার ছায়ায় বসে শিখেছি কোনো কিছু না ভেবে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে। বড়বেলায় বনফুলের ‘নিমগাছ’ গল্প পড়ার পর সেই গাছটার কথা মনে হয়েছিল। উত্তর পাশে ছিল কদমগাছ, বর্ষায় যেটা কদম ফুলে ভরে যেত—মনে হতো যেন পুকুরটা নোলক পরে আছে। আর পশ্চিম পাশে ছিল প্রিয় ডুমুরগাছ, সেখানেই ছিল পুকুরঘাট। ওই গাছটায় হালকা চেষ্টায় ওঠা যেত, তারপর গাছ থেকে সোজা ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে। সেকি আনন্দ! যেন পৃথিবীটা জল দিয়ে তৈরি। আমরা হাসতে হাসতে জলে ভেসে থাকতাম। আলো হয়ে, হাওয়া হয়ে, আনন্দ হয়ে।
বর্ষায় আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমার পর সেই মেঘের ছায়া পুকুরের জলে পড়লে মনে হতো কোনো অজানা পাখির কালচে রঙের নীল ডিম। এরপর বৃষ্টি নামলে পুকুরজুড়ে শুরু হতো জলের ওপর জলবিন্দুর নৃত্য। স্কুল থেকে ফেরার পথে বুকের ওপর বই–খাতা চেপে গাছের নিচে ভিজতে ভিজতে শুনতাম রিমঝিম, রিমঝিম, রিমঝিম।
আমাদের বাড়ির পুকুরটা ছিল বারোয়ারি—এ পুকুরটার নির্জনতা ছিল না। নির্জনতা ছিল আমার মামাবাড়ির পুকুরে। মামাদের গ্রামের নামটি খুব সুন্দর, যাত্রাসিদ্ধি। মামার বাড়িতে শুধু দুটি পরিবার থাকত, ভিড় হতো না খুব একটা। স্নানের সময়টা ছাড়া বাকি সময়টা জলরঙে আঁকা শান্ত এক নিরিবিলি পুকুরের ছবি হয়ে ঝুলে থাকত। এ পুকুরটা ছিল ছিমছাম, মাঝারি গোছের। চারপাশে আম, কাঁঠাল, সুপারি আর একদিকে একটা হেলে পড়া তালগাছ। পাড়ের ধারে নরম ঘাস, জলে গাছের গভীর ছায়া টলটল করত। এই পুকুরপাড়ে বসে দেখছি গাছ থেকে পাতা খসে পড়া আর উড়তে থাকা তিনটি ফড়িংয়ের হঠাৎ করে রোদ্দুরে মিশে যাওয়া!
এ পুকুরটা ছিল মাছে ভর্তি। পুকুরের মাঝবরাবর জাল লাগানো থাকত। সেই জাল সাদা জুঁই ফুলের মতো ভরে থাকত চাপিলা মাছে। মাঝেমধ্যে কলাগাছ কেটে ভেলা বানিয়ে মাছ ধরা হতো। তারপর মাছ কেটে দুই পরিবারের মধ্যে ভাগ করে দুপুরের চুলার আগুনে সেই মাছ রান্না হতো। গোটা প্রক্রিয়াটা সিনেমা দেখার চেয়ে কম আকর্ষণীয় ছিল না।
আমার জীবনের তৃতীয় পুকুরটি বাকি দুটির মতো কাব্যিক নয়। পুকুরটা মফস্সল শহরের চারদিকের দালানকোঠার মধ্যে কোনো রকম নাক উঁচু করে বেঁচে ছিল। এ পুকুরটা ফেনী পিটিআই স্কুলের পেছনে ছিল বলে এর নাম ছিল পিটিআই পুকুর। এখানে গাছের ছায়া নেই, পুকুরের অর্ধেকজুড়ে কচুরিপানা। কলেজে পড়ার সময়, গরম বিকেলে খেলা শেষে এই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে শীতলতা পেয়েছি। ফুটবল খেলার পর জলে নামা ছিল আমাদের রঙিন উৎসব—বন্ধুদের সঙ্গে সে সময়গুলো ছিল দুরন্ত কৈশোরবেলার সেরা উপহার।
এখন গ্রামে, শহরে রোজ একটু একটু করে সব পুকুর দোকান আর ফ্ল্যাটের পেটে ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর ছেলেবেলার যে অনন্ত ছায়া, তা মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমে। বয়স যত বাড়ছে, এই সব ইকিরমিকির ছেলেবেলা তত বেশি ঝাপটা মারছে হররোজ। আমের গন্ধ, কল্কে ফুলের মধু আর প্রিয় পুকুরঘাট কানের কাছে প্রায়ই ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, মনে আছে আমাদের কথা?
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘একশটা টেস্টই যেন শেষ না হয়’
যে ক্ষণটার জন্য অপেক্ষা ছিল, যে সময়টার জন্য প্রতীক্ষা ছিল তার খুব কাছাকাছি ক্রিকেটাঙ্গন। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম যিনি টেস্ট ক্রিকেটের তিন অঙ্কে পৌঁছতে যাচ্ছেন। ১৯ নভেম্বর ঢাকায় আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্ট। এই টেস্টেই শততম টেস্টে মাইলফলক স্পর্শ করবেন মুশফিকুর।
সময় তাই যত ঘনিয়ে আসছে ততই মুশফিকুরকে ঘিরে বাড়ছে উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা ও রোমাঞ্চ। যা ছুঁয়ে যাচ্ছেন মুশফিকুরের কোচদেরও। যাদের সঙ্গে ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন, তাদের সবার চাওয়া মাইলফলক ছোঁয়া এই সময়টা তিনি উপভোগ করুক প্রাণ খুলে। নিজের আনন্দে খেলুক। শুধু তা-ই নয়, একশ টেস্টেই যেন থমকে না যায় মুশফিকুর ব্যাট। অন্তত এক-দুই বছর তাকে টেস্ট অঙ্গনে দেখতে চান প্রত্যেকে।
আরো পড়ুন:
মুশফিকুরের শততম টেস্ট নিয়ে আশরাফুলের উচ্ছ্বাস
লর্ডসে প্রথম, মিরপুরে শততম টেস্ট মুশফিকুর
সোহেল ইসলাম
কোচ, বিসিবির গেম ডেভেলাপমেন্ট বিভাগ
‘‘আমাদের দেশে যারা টেস্ট খেলে তাদের টেস্টের সংখ্যা কম। এটা যদি ইংল্যান্ড হইতো বা অস্ট্রেলিয়াতে হতো বা ভারতেরও হতো, ওর যতদিন ধরে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার, এতদিনে দেড়শ টেস্ট খেলে ফেলতো। সেই হিসাবে ইদানিং আমাদের একটু টেস্ট সংখ্যা বেড়েছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের কারণে। আগে তো অনেক কম হইতো। সেখান থেকে একশটা টেস্ট খেলা মানে বিশাল কিছু।’’
‘‘ওর সফরটা দেখেন আপনি। শুধু একশ টেস্ট বলবেন…ও কতদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে। এমন না যে অযথাই খেলছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কিন্তু আপনার পারফর্ম করে খেলতে হয়। আপনি পারফর্ম ছাড়া থাকলে আপনাকে কিন্তু খেলাবে না।’’
‘‘মুশফিকুরকে তার পারফরম্যান্সটা ধরে রাখতে হয়েছে। আমাদের দেশের প্রথম একজন যে একশ টেস্ট খেলতে যাচ্ছে। এজন্য ও নিজেকে প্রস্তুত রেখেছে। ওই ক্ষুধাটা তার ছিল। ওই জেদটা তার ছিল। আমি আশা করব, যদি দলের চাহিদা থাকে এবং তারও খেলার ইচ্ছা তাহলে যেন আরো খেলা চালিয়ে যায়। আরো বেশিদিন মাঠে থাকে। মানে একশটা টেস্ট যেন শেষ না হয়।’’
মিজানুর রহমান বাবুল
কোচ, বিসিবির গেম ডেভেলাপমেন্ট বিভাগ
‘‘মুশফিকুরকে শুভকামনা। একজন পারফেক্ট ব্যাটসম্যান। একজন পারফেক্ট স্পোর্টসম্যান। যাকে আপনি অনুসরণ করলে, যাকে আপনি মেনে চললে, আদর্শ ভাবলে ক্যারিয়ারে উন্নতি করতে পারবেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট যেভাবে চলে, যে ধাঁচে এগিয়ে যায় সেখানে একজনের ক্যারিয়ার শীর্ষ পর্যায়ে ২০ বছর টিকে থাকা মুশকিল। মুশফিকুর প্রমাণ করেছে যদি আপনার নিবেদন থাকে, ভালো করার ইচ্ছা থাকে তাহলে আপনি পারবেন।’’
‘‘ব্যাটসম্যান মুশফিকুর সব সময়ই বাংলাদেশ দলের সেরা। মিডল অর্ডারে লম্বা সময় বাংলাদেশকে সার্ভ করেছে। দেখুন তাকে চ্যালেঞ্জ করে কেউ তাকে রিপ্লেস করতে পারেনি। পারফর্ম করেই সে টিকে আছে এবং খেলে যাচ্ছে। আমি চাই সে সেই ধারাবাহিকতাই ধরে রাখুক। এখনো ফিট আছে। অন্যদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করছে। খেলার প্রতি ভালোবাসা না থাকলে এটা হয় না।’’
‘‘শততম টেস্টটায় সেঞ্চুরি লাগবেই, এমনটাই নয়। হলে ভালো। না হলেও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। থামলে হবে না। ওর অভিজ্ঞতাটা এই দলের প্রয়োজন এখন। যতদিন খেলতে মন চায় খেলুক। ও তো পারফর্ম না করে আর খেলবে না। তরুণ একজন ক্রিকেটার যদি তার ডেডিকেশন সম্পর্কে জানতে পারে সেটাই হবে বড় পাওয়া।’’
ঢাকা/ইয়াসিন