কাজে কচ্ছপগতি, জনতার দুর্ভোগ বাড়ে লাফিয়ে
Published: 27th, June 2025 GMT
পায়ের নিচে পিচ নয়, থিকথিকে কাদা। চারপাশে দুর্গন্ধ। সামনে গর্ত। হাঁটতে গেলে জুতা আটকে যায়। প্রতিবার চাকার ঘূর্ণিতে কাঁপে রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা। কোথাও বড় গর্ত, কোথাও জলজট। যানবাহন মাঝপথে থেমে যায়। অন্তঃসত্ত্বা নারী থেকে রোগীবাহী গাড়ি– কেউই স্বস্তিতে নেই। স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে সব বয়সী মানুষকে পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় ভোগান্তি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর-গোকর্ণ-পূর্বভাগ-মাধবপুর সড়কের এই চিত্র প্রতিদিনের।
৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের তিন কিলোমিটার নির্মাণেই সময় লেগেছে প্রায় দুই বছর। অথচ কাজের মেয়াদ শেষ হয়েছে আরও আগে। স্থানীয় লোকজনের চোখে, সড়কটি ফুটিয়ে তুলেছে বছরের পর বছর ধরে চলা অব্যবস্থাপনার চিত্র।
নাসিরনগর উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্র জানায়, ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নাসিরনগর-মাধবপুর আঞ্চলিক সড়কের ৯ কিলোমিটার অংশ সংস্কারের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর। এর খরচ ধরা হয় ১৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাসান এন্টারপ্রাইজ পায় কাজটি। আগের সড়কটি ছিল ১২ ফুট। কার্যাদেশে সেটি ২২ ফুটে উন্নীত করার কথা। এর মধ্যে ১৬ ফুট ৫ ইঞ্চি হবে পিচঢালাই, পাশে তিন ফুট করে সোল্ডার। এক বছর ছয় মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। যে সময়সীমা শেষ হয়েছে ২০২৫ সালের ২৮ মে। ইতোমধ্যে প্রায় ৭ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তারা এখন কাজের সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
এই সড়ক নির্মাণ কাজের ধীরগতিতে ক্ষুব্ধ আশপাশের লোকজন। তারা জানায়, সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তাটি কাদায় ঢেকে যায়। হেঁটে চলাও এখন বিপজ্জনক। এই রাস্তাটি শুধু ভোগান্তির নয়, তাতে ঘটছে প্রতিনিয়িত দুর্ঘটনাও। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু-নারী, বৃদ্ধসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন।
সরেজমিন বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার দেখা যায়, নাসিরনগর থেকে ফুলপুর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার অংশে কাজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা অসম্পূর্ণ। কোথাও চওড়া ১৬ ফুট, কোথাও ১৮ ফুট। অথচ কাজ হওয়ার কথা ২২ ফুট।
গোকর্ণ ইউনিয়নের নূরপুর থেকে পূর্বভাগের ভুবন পর্যন্ত অংশে পিচ উঠে গেছে। গর্ত হয়েছে অনেক জায়গায়। কোথাও পানি জমে আছে, কোথাও কাদায় আটকে যানবাহন। ভুবন এলাকায় বুধবার একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার উল্টে পড়ে ছিল। পাশে হাঁটু পর্যন্ত কাদা। সেখান দিয়ে জুতা খুলে হাঁটছিলেন ষাটোর্ধ্ব হায়দার আলী। তিনি বলেন, ‘কোমরের চিকিৎসা করে বাড়িতে ফিরেছিলাম দুই দিন আগে। পরের দিন এই রাস্তা দিয়ে বাজারে যেতে গিয়ে এমন ঝাঁকুনি খেলাম, আবার ঢাকায় যাচ্ছি চিকিৎসা নিতে।’
বৃহস্পতিবার জেঠাগ্রামের পাশে রাস্তায় বসে ছিলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক জুয়েল মিয়া। তাঁর অটোরিকশাটির সামনে চাকা ভেঙে গেছে। চোখে পানি নিয়ে তিনি বললেন, ‘এমন রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো মানে মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা। আমার গাড়িতেই দুইজন নারী সন্তান প্রসব করেছেন। আজ সেই গাড়িটাই উল্টে গেল। চালানো বন্ধ করলে খাওয়ার কী হবে?’
ভুবন বাজারের কাছাকাছি পাওয়া যায় ইমরান হোসেনকে। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলেন, ‘ছেলেকে স্কুলে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তা এত খারাপ, কোনো গাড়িই আসতেছে না।’
কাছাকাছি এলাকার দুর্জয় ও আশিক পড়ছে সপ্তম শ্রেণিতে। তারা যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে, তখন থেকেই সড়কের এই অবস্থা দেখে আসছে। তারা জানায়, আগে আরেকটু ভালো ছিল, এখন খুবই ভয়াবহ অবস্থা।
গোকর্ণ ইউনিয়নের বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন বলেন, নির্বাচনের আগে সবাই প্রতিশ্রুতি দেয়, পরে আর খোঁজ রাখে না। দু’জন এমপি বদলাল, কিন্তু রাস্তাটার অবস্থা বদলায়নি।
পল্লীবিদ্যুৎ সমিতিতে লাইনম্যান হিসেবে কর্মরত আলামিন শান্ত বলেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে আমাদের দিনে ১০ বার করে যাতায়াত করতে হয়। সপ্তাহে এক-দুইবার দুর্ঘটনায় পড়ি। এই রাস্তার জন্য মাঝেমধ্যে মনে হয়, চাকরি ছেড়ে চলে যাই।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের দাবি, সড়কের দুই পাশের গাছ কাটতে বন বিভাগ সময় নিয়েছে দেড় বছর। এ ছাড়া সড়ক প্রশস্ত করতে গিয়ে অনেকে জায়গা ছাড়তে রাজি হয়নি। এজন্যই দীর্ঘ সময় লেগেছে। উপজেলা বন বিভাগের কর্মকর্তা মো.
নিয়মমতোই কাজ হচ্ছে বলে দাবি করেন হাসান এন্টারপ্রাইজের খায়রুল হাসান। তিনি বলেন, কিছু স্থানে লোকজন জায়গা দিতে রাজি হচ্ছেন না বলে সমস্যা হচ্ছে। সড়কের যেটুকু কাজ করেছেন, এর দুই পাশে মাটির সোল্ডারের কাজ পরে করা হবে।
উপজেলা প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম মৃধা বলেন, নাসিরনগর-মাধবপুর সড়কের ৯ কিলোমিটার অংশে সংস্কার হচ্ছে। ২২ ফুট চওড়া করার বদলে কম করার অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন। একই রকম আশ্বাস দেন ইউএনও শাহিনা নাসরিনও।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন স রনগর এই র স ত সড়ক র
এছাড়াও পড়ুন:
জাহাঙ্গীরনগরের সামিয়া ইসলামের তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কেন অক্সফোর্ডকেই বেছে নিলেন
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সামিয়া ইসলাম। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক ছিল, তবে কখনো কোচিং বা প্রাইভেটের ওপর নির্ভর করেননি। বাবার হাত ধরেই তৈরি হয়েছে তাঁর শিক্ষাভিত্তি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে এবার তিনি যাচ্ছেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ডে। পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে পাঁচ বছরের পিএইচডি প্রোগ্রামে পড়বেন সেখানে।
ঢাবি থেকে জাবি, সেখান থেকে অক্সফোর্ড
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন সামিয়া ইসলাম। কিন্তু তাঁর মনে ছিল অর্থনীতি নিয়ে পড়ার স্বপ্ন। তাই এক বছর পর ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। শুরু থেকেই ইচ্ছা ছিল বিশ্বের প্রথম সারির কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার। স্নাতকোত্তরের ফলাফল হাতে পাওয়ার আগেই তৈরি করতে শুরু করেছিলেন নিজের প্রোফাইল। অক্সফোর্ড ছাড়াও ইয়েল, ওয়ারউইক ও ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডাক দিয়েছিল। তবে তত্ত্বীয় অর্থনীতিতে বিশেষ আগ্রহ ও গবেষণার পরিবেশ বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত অক্সফোর্ডকেই বেছে নেন।
পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি
শুরু থেকেই নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে এগিয়েছেন সামিয়া ইসলাম। স্নাতকে ৩.৯২ ও স্নাতকোত্তরে ৩.৯১ সিজিপিএ অর্জন করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি খুব পড়ুয়া শিক্ষার্থী ছিলাম না। পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়তাম। তবে ক্লাস কখনো মিস করিনি। নিয়মিত মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করাই আমাকে ভালো ফল করতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে।’
একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি যুক্ত গবেষণা কার্যক্রমেও। ইন্টার্নশিপ করেছেন, ভাষাগত পরীক্ষা (আইএলটিএস এবং জিআরই) প্রস্তুতিও নিয়েছেন আগেভাগেই। সব মিলিয়ে আবেদনপ্রক্রিয়ায় শেষ মুহূর্তে কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি তাঁকে।
আরও পড়ুনপ্রাথমিকে ছুটি কমিয়ে ৬০ দিন হচ্ছে: মহাপরিচালক নূর মো. শামসুজ্জামান২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫গবেষণা ও সহশিক্ষা কার্যক্রম
গবেষণার ক্ষেত্রেও এগিয়ে ছিলেন সামিয়া ইসলাম। ইতিমধ্যে তাঁর একটি গবেষণাপত্র ও কনফারেন্স পেপার প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে। এ ছাড়া সানেমে ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। পড়াশোনার বাইরে সক্রিয় ছিলেন সহশিক্ষা কার্যক্রমেও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির (জিইউডিএস) সহসাধারণ সম্পাদক এবং বিভাগীয় ছাত্র সংসদের শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মতে, এসব কার্যক্রম ব্যক্তিগত দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, পাশাপাশি নতুন সুযোগ তৈরি করে।
আরও পড়ুনকেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা মূল্যে অনলাইন কোর্স, নেই বয়সের সীমা২২ ঘণ্টা আগেপরিবারের প্রেরণা
শৈশব থেকেই কোচিং-প্রাইভেটের বদলে বাবার কাছে পড়াশোনা করেছেন সামিয়া ইসলাম। বাবাকেই তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা মনে করেন। সামিয়া বলেন, ‘বাবা আমাকে সব সময় নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাহাঙ্গীরনগরে আসার ব্যাপারে প্রথমে তাঁর আপত্তি ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার সিদ্ধান্তকেই সম্মান করেছেন। এতে আমি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি।’
নিজ বিভাগের শিক্ষকদের সহায়তাও সামিয়ার কাছে বিশেষ প্রাপ্তি। সামিয়া বলেন, ‘আমার শিক্ষকেরা পড়াশোনা ও গবেষণার প্রতিটি ধাপে পাশে থেকেছেন। তাদের সহযোগিতা না পেলে এত দূর আসা কঠিন হতো।’
আরও পড়ুনবেসরকারি স্কুল-কলেজে কর্মচারী নিয়োগে ক্ষমতা হারাল পরিচালনা পর্ষদ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫তরুণদের জন্য শিক্ষা
বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য সামিয়ার অভিজ্ঞতা একটি পথনির্দেশের মতো। তিনি মনে করেন, আগে ঠিক করতে হবে কোনো বিষয়ে পড়তে চান, তারপর সেই অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ ও প্রস্তুতি নিতে হবে। একাডেমিক ফল ভালো হলে সুযোগ অনেক বেড়ে যায়, তবে গবেষণা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমেও যুক্ত থাকা জরুরি। আবেদনপ্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এসওপি–স্টেটমেন্ট অব পারপোজ, যা মনোযোগ দিয়ে লিখতে হবে। আর ভাষাগত পরীক্ষাগুলো আগেভাগেই দিয়ে রাখা উচিত, নয়তো শেষ মুহূর্তের তাড়াহুড়োতে সমস্যা হতে পারে।
আরও পড়ুনজুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা: শিক্ষার্থীদের জন্য ১০টি বিশেষ পরামর্শ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ভবিষ্যৎ লক্ষ্য
সামিয়া ইসলাম এখনো চূড়ান্তভাবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণ করেননি। তবে তিনি অর্থনীতির জগতে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে চান। স্বপ্ন দেখেন একজন সফল অর্থনীতিবিদ হওয়ার। পরিকল্পনা, অধ্যবসায় ও পরিবারের সমর্থনে সামিয়ার এ অর্জন অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে নতুন প্রজন্মের অনেক তরুণ-তরুণীর কাছে।