প্রকৃত অর্থেই ওই নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন: পুলিশ
Published: 29th, June 2025 GMT
ধারের টাকার খোঁজ নিতে এসে খালি বাড়ি পেয়ে কুমিল্লার মুরাদনগরে ফজর আলী নামের এক ব্যক্তি ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী নারী (২৫) ও তাঁর স্বজনদের। ওই নারী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ফজরের টাকাপয়সা নিয়ে ঝামেলা আছে। গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে ফজর বাড়িতে গিয়ে ঘরের দরজা খুলতে বলেন। তিনি খুলতে না চাইলে ফজর টিনের ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে তাঁকে ধর্ষণ করেন।
ভুক্তভোগী নারী প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণের বিষয়টি টের পেয়ে আশপাশ থেকে লোকজন এসে ফজর আলীকে পেটাতে থাকেন। এ সময় তাঁকে বিবস্ত্র অবস্থায় মারধর করা হয়। পুলিশ যে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে, তাঁরাই তাঁকে মারধর করেছেন। তাঁদের লোকজনই সেই ভিডিও ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আরও পড়ুনমুরাদনগরে দরজা ভেঙে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ, থানায় মামলা১৮ ঘণ্টা আগেসনাতন ধর্মাবলম্বী ওই নারীর বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চার হাজার টাকা সুদের বিনিময়ে এক মাসের জন্য তাঁরা ফজর আলীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নেন। কয়েক দিন আগে ওই টাকা ফেরত দেওয়ার সময় ছিল; কিন্তু তাঁরা টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। ফজরের কাছে আরও কয়েক দিন সময় চান; কিন্তু তিনি তা না দিয়ে হুমকি দিতে থাকেন। বৃহস্পতিবার রাতে সেই টাকার সূত্র ধরে বাড়িতে এসে তাঁর বোনকে ধর্ষণ করেন ফজর।
ভুক্তভোগীর ভাই বলেন, ঘটনার সময় বাড়িতে তাঁদের মা–বাবা ছিলেন না। তাঁরা সাপ্তাহিক একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তিনি (ভাই) নিজে পাশের উপজেলা তিতাসে ছিলেন। সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। বাড়িতে তাঁর বোন, বোনের ছোট দুই ছেলেমেয়ে ছিল। তারা ঘুমিয়ে ছিল।
বোনের বিবস্ত্র অবস্থার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে ওই নারীর ভাইয়ের ভাষ্য, ভাই শাহ পরানের সঙ্গে ফজর আলীর বিরোধ আছে। সেই বিরোধের জের ধরে শাহ পরানই ঘটনার সময় তাঁদের বাড়িতে লোকজন পাঠান। তাঁরাই তাঁর বোনকে বিবস্ত্র অবস্থায় মারধর করে সেই ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মুরাদনগর সার্কেল) এ কে এম কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার পর থেকেই অনেকেই বিষয়টি পরকীয়া বলে প্রচার করছেন। তবে আমাদের প্রাথমিক তদন্তে এমন কোনো তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রকৃত অর্থেই ওই নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ভিকটিমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছি, তিনি সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের ঘটনায় আরও কেউ জড়িত আছেন কি না, সেটিও আমরা তদন্ত করে দেখছি।’
ওই নারীর একজন প্রতিবেশীর ভাষ্য, বৃহস্পতিবার রাতে ওই বাড়িতে অনেক শব্দ হচ্ছিল। তিনি ভয়ে দৌড়ে গিয়ে লোকজন ডেকে আনেন। লোকজন গিয়ে দেখেন, দরজা ভাঙা। পরে তাঁরা ওই নারীকে উদ্ধার করেন। এ সময় কিছু লোক ওই নারীকে মারধর এবং ওই অবস্থায় ভিডিও করেন। পরে যখন সবাই বুঝতে পারেন ওই নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, তখন সবাই ফজর আলীকে পেটাতে থাকেন।
দুই মামলা ও গ্রেপ্তার ৫ফজর আলীকে আসামি করে গত শুক্রবার মুরাদনগর থানায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন ওই নারী। এ ছাড়া আজ রোববার তিনি পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে আরেকটি মামলা করেন। ওই মামলায় চারজনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
আরও পড়ুনমুরাদনগরে দরজা ভেঙে নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে প্রধান আসামিসহ গ্রেপ্তার ৫১০ ঘণ্টা আগেওসি জানান, ফজর আলীকে (৩৮) আজ ভোর পাঁচটার দিকে ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনায় সময় বেধড়ক পিটিয়ে তাঁর হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন কুমিল্লা জেলা পুলিশ হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া ভুক্তভোগীকে বিবস্ত্র অবস্থায় নির্যাতন করে ৫১ সেকেন্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই চারজন হলেন মোহাম্মদ আলী ওরফে সুমন, রমজান আলী, মো.
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন বলেন, ফজর আলীকে পেটানোর পর তাঁর পরিবারের লোকজন ও স্বজনেরা তাঁকে কুমিল্লা শহরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। মামলা হওয়ার খবর শোনার পর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান। পরে পুলিশ তাঁকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য আবদুর রব প্রথম আলোকে বলেন, ফজর আলী এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারি। তিনি এলাকায় জুয়ার আসর বসিয়ে অনেক পরিবারকে নিঃস্ব করেছেন। ১৫ বছর ধরে ফজর নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিতেন, ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি নিজেকে বিএনপির লোক বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। তবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কোনো কমিটিতে তাঁর পদ নেই।
আতঙ্কের ছাপ চোখেমুখেমুরাদনগর উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদীর পারে ওই নারীর বাবার বাড়ি। তাঁর বাবা নদীতে মাছ ধরে পরিবারের ভরণপোষণ করেন। ঘটনার পর থেকে পুরো পরিবার উদ্বেগ আর আতঙ্কে আছে। নির্যাতিত নারীর চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। তিনি এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। তবে এটাও বলেন, তাঁর প্রবাসী স্বামী কোনো ঝামেলা চান না। তিনি মামলা তুলে নিতে বলছেন। অন্য কেউ তাঁকে মামলা তুলে নিতে বলছেন না।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর প রথম আল ক ম র দনগর ওই ন র র অবস থ য় ন র পর র আল ক পর ব র ম রধর ল কজন ঘটন র ঘটন য়
এছাড়াও পড়ুন:
মুরাদনগরে দুই সন্তানসহ নারী হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার আতঙ্ক, হয়রানি বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কড়ইবাড়ি গ্রামে দুই সন্তানসহ নারীকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানি বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন গ্রামের নারীরা। গ্রেপ্তার আতঙ্কে এক মাসের বেশি সময় ধরে কড়ইবাড়ি গ্রাম পুরুষশূন্য বলে দাবি করেছেন মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শতাধিক নারী। এ সময় তাঁরা দুই সন্তানসহ নারী হত্যাকে ‘গণপিটুনি’ ও নিহত রোকসানা বেগম ওরফে রুবিকে ‘মাদক সম্রাজ্ঞী’ বলে দাবি করেছেন।
সোমবার সকালে কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়কের কড়ইবাড়ি এলাকায় এই মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন গ্রামের নারীরা। তাঁদের অভিযোগ, গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনাকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিদের নামে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। ঘটনায় জড়িত না হলেও তাঁদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের হয়রানি করা হচ্ছে। এর আগে ৫ আগস্ট একই দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন গ্রামের নারীরা।
গত ৩ জুলাই সকালে উপজেলার কড়ইবাড়ি গ্রামে মব সৃষ্টি করে একই পরিবারের তিনজনকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা ঘটে। তাঁরা হলেন কড়ইবাড়ি গ্রামের খলিলুর রহমানের স্ত্রী রোকসানা বেগম ওরফে রুবি (৫৩), তাঁর ছেলে রাসেল মিয়া (৩৫) ও মেয়ে তাসপিয়া আক্তার (২৯)। পরদিন ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২০–২৫ জনকে আসামি করে উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানায় মামলা করেন রোকসানা বেগমের বড় মেয়ে রিক্তা আক্তার। মামলার প্রধান আসামি আকুবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ। এর মধ্যে যৌথ বাহিনীর অভিযানে মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের এক মাস আট দিন পার হলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ।
মানববন্ধনে অংশ নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দা সায়েরা বানু বলেন, ‘ঘটনার পর থেকেই একটি পক্ষ এখানে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে। গ্রামের পুরুষেরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে ফিরছেন না। এতে পুরো গ্রাম এখন নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। ঘটনার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরীহ গ্রামবাসীকে হয়রানি করছে। আমরা এই অবস্থার অবসান চাই। নিরীহ মানুষের হয়রানি বন্ধ হোক।’
কড়ইবাড়ি গ্রামের রুমা বেগম বলেন, ‘এক মাসের বেশি সময় ধরে পুরুষেরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন। এতে অর্থকষ্টে পড়েছি আমরা। শিশুসন্তানদের নিয়ে অনেকটাই মানবেতর জীবন যাপন করছি। আমরা চাই প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হোক। নিরপরাধ মানুষেরা গ্রামে ফিরে আসুক। আমাদের প্রতিটি দিনই এখন আতঙ্কে কাটে।’
গ্রামবাসীর নিরাপত্তাহীনতা প্রসঙ্গে বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের মামলাটি বর্তমানে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করছে। এলাকায় শান্তি–শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রতি রাতেই কড়ইবাড়ি এলাকাসহ আশপাশের গ্রামে পুলিশের চারটি টহল দল কাজ করছে। এ ছাড়া নিরপরাধ কোনো মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি। আমরা পুলিশের পোশাক পরেই ডিউটিতে বের হই। তবে সাদাপোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য কোনো সংস্থার লোকজন আসেন কি না, সেটি আমার জানা নেই।’
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) নয়ন কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘নিরীহ একজন মানুষকেও হয়রানি করা হয়নি। আমরা শুরু থেকেই মামলাটি নিয়ে সতর্ক। গ্রামবাসীর আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। যাঁরা এ ঘটনায় জড়িত নন, তাঁরা গ্রামে ফিরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করুন। ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’