নারীদের পা তুলনামূলকভাবে স্থূল হওয়ার পেছনে কিছু বৈজ্ঞানিক ও শারীরবৃত্তীয় কারণ আছে। নিচে সহজ ভাষায় সেগুলো ব্যাখ্যা করা হলো।

হরমোনজনিত পার্থক্য

ইস্ট্রোজেন নামক একটি হরমোন আছে, যা সাধারণত নারীদের দেহে পাওয়া যায়। এই হরমোন শরীরে, বিশেষ করে ঊরু, নিতম্ব ও পায়ে চর্বি জমাতে সাহায্য করে। এই ফ্যাট নারীকে প্রজননের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ও সুরক্ষা দেয়। গর্ভধারণের সময়ে শরীরের এসব অংশে চর্বি দরকার পড়ে।

চর্বির বণ্টন

ছেলেদের শরীরে চর্বি সাধারণত পেটের চারপাশে জমে, যা অভ্যন্তরীণ অঙ্গের আশপাশে থাকে। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে চর্বি জমে ত্বকের নিচে, বিশেষ করে ঊরু ও পায়ে। এ জন্য তাঁদের পা দেখতে তুলনামূলক স্থূল লাগে।

বংশগত প্রভাব

অনেক ক্ষেত্রে বংশগত কারণেও মেয়েদের নির্দিষ্ট অংশে বেশি ফ্যাট জমে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় নারীদের ক্ষেত্রে ঊরুতে ফ্যাট জমার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

শরীরের গঠনগত পার্থক্য

নারীদের হাড় ও পেশির গঠন ছেলেদের চেয়ে আলাদা। নারীদের পেলভিস চওড়া থাকে। যে কারণে পা ও নিতম্বকে দেখায় প্রশস্ত। তাঁদের পেশি তুলনামূলকভাবে ছেলেদের মতো শক্ত না হওয়ায় ফ্যাট বেশি লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া বডি টাইপ বলেও একটি কথা আছে। একেক নারীর বডি টাইপ একেক রকম, সে অনুযায়ী একেকজনের কোমর হয় প্রশস্ত আর কাঁধ সরু, আবার অনেকের কাঁধ চওড়া ও কোমর হয় সরু।

আরও পড়ুন‘মোটা হয়ে যাচ্ছ’—আপনাকে কেউ এ কথা বললে যে উত্তর দেবেন০৬ জুন ২০২৩মাতৃত্বকালীন পরিবর্তন

গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে পায়ে ও নিতম্বে অতিরিক্ত ফ্যাট জমে। অনেক সময় সন্তান প্রসবের পরেও এগুলো কমে না। কেউ কেউ আবার মা হওয়ার পর পায়ের চর্বি নিয়ে খুব একটা সচেতন থাকেন না। ফলে পা তুলনামূলক স্থূল দেখায়।

পায়ে ফ্যাট বা চর্বি থাকা স্বাস্থ্যগত দিক থেকে খারাপ নয়; বরং এটি প্রাকৃতিক ও প্রজননে সহায়ক একধরনের বৈশিষ্ট্য। তবে অতিরিক্ত ফ্যাট জমে গেলে স্থূলতা বা হরমোনাল সমস্যা তৈরি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সঠিক ডায়েট ও ব্যায়াম গুরুত্বপূর্ণ।

ফওজিয়া আহমেদ, পুষ্টিবিদ, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল, ঢাকা

আরও পড়ুন৩০ মিনিট হাঁটা, নাকি ১০ মিনিট দৌড়—কোনটা বেশি ভালো২২ জুন ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হরম ন

এছাড়াও পড়ুন:

চিনিকল বন্ধ রেখে বিদেশি বিনিয়োগ খোঁজা আর কতদিন

২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভোর। দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ চিনিকলের গেস্টহাউসে ঘুম ভাঙল কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে। পাশেই অফিসার্স ক্লাব, ২০২০ সালে চিনিকল বন্ধের ঘোষণার পর যে ক্লাব চার বছর নিঃশব্দে তালাবদ্ধ ছিল। ক্লাবের পুরোনো ভবনের প্রবেশপথে গজিয়ে ওঠা আগাছা কেটে ফেলা হয়েছে। জীর্ণ দেয়াল-মেঝে ধুয়ে করা হয়েছে ঝকঝকে।

উদ্বোধনের আনন্দে চিনিকলের কিছু কর্মী আয়োজন করেছেন পিঠা উৎসব, যেখানে আমরাও আমন্ত্রিত। আশপাশের কৃষক পরিবার আর কর্মীদের স্ত্রী-সন্তানেরা একে একে ট্রেতে সাজানো পিঠা নিয়ে প্রবেশ করলেন। মুহূর্তেই হলরুম ভরে উঠল হাসি, গল্প আর মানুষের উষ্ণতায়। পাঁচ বছর পর স্যাঁতসেঁতে ভবনটি ফিরে পেল প্রাণ, আর মানুষের চোখেমুখে ঝলমলিয়ে উঠল পুরোনো দিনের স্মৃতি।

২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় হাসিনা সরকার হঠাৎ দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টিতে আখমাড়াই বন্ধের ঘোষণা দেয়, খেতে তখন দণ্ডায়মান আখ, কাটার অপেক্ষায় ছিল। সেই বন্ধ হওয়া মিলগুলোর একটি ছিল সেতাবগঞ্জ চিনিকল। আকস্মিক এ সিদ্ধান্তে কর্মী ও কৃষকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামলেন, তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনরাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল কেন রাষ্ট্রকেই চালাতে হবে১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

চিনিকলগুলো লোকসানের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয় এই শিল্পের ধরনের কারণে। এ কারণে এটি ঐতিহাসিকভাবে কৌশলগত খাত হিসেবে বিবেচিত হয়।

বিদেশি কোম্পানিকে এই রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি দিলে অনেক সময় অপব্যবহার করার ঝুঁকি থাকে। তখন ভুল সিদ্ধান্তের দায় এসে পড়ে জনগণের ঘাড়ে।

যখন সামান্য বিনিয়োগ ও দেশি দক্ষ জনবল ব্যবহারেই কর্মসংস্থান তৈরি ও অর্থনীতির ভিত গড়া যায়, তখন সরকারের উচিত অতিসত্বর বিনিয়োগ করা।

থমথমে পরিস্থিতিতে আশপাশের হোটেল, দোকান, ছোট ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। সবার মুখে তখন একটাই প্রশ্ন—কীভাবে হঠাৎ এ সিদ্ধান্ত নিল হাসিনা সরকার? শোক ও ক্ষোভে কৃষকেরা রাস্তায় আখ পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানান। জমে থাকা এ ক্ষোভই যেন পরবর্তী সময়ে গণ–অভ্যুত্থানের সময় বাষ্প হয়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল।

অভ্যুত্থানের পর চিনিকল আবার চালুকরণ টাস্কফোর্সের সুপারিশে প্রধান উপদেষ্টা আখমাড়াই স্থগিতাদেশ তুলে নেন। জীবিকা হারানো মানুষগুলো নতুন করে আশাবাদী হন—আবার খুলবে মিল, আবার ফিরবে কর্মসংস্থান। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দেরি করে হলেও আখ চাষ শুরু হয়। আখ রোপণ উদ্বোধন দেখতে যাই শ্যামপুর আর সেতাবগঞ্জে।

এরপর চিনিকলগুলো চালু করতে নতুন বিনিয়োগের প্রস্তুতির সময়, টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী করপোরেশন অর্থ বিভাগে সেতাবগঞ্জ ও শ্যামপুর চিনিকলের জন্য তিন বছরের বাজেট প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন রোপণ মৌসুম শুরু হওয়ার ঠিক আগে জানা গেল, অর্থ বিভাগ বাজেট অনুমোদন করেনি। অথচ আট-নয় মাস আগেও মিলগেটে লিফলেট দিয়ে কৃষকদের আখ চাষে উৎসাহিত করা হয়েছিল। টাস্কফোর্সকেও জানানো হয়নি, কেন সরকার হঠাৎ অর্থছাড় থেকে সরে এল।

আগের মতোই কারণ জানা গেল পত্রিকার শিরোনামে, ‘গত ৫ বছরে ৫০০ কোটি টাকা লোকসান করেছে চিনিকলগুলো।’ পুরোনো লোকসানের একই অজুহাত আবারও হাজির করা হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাস্তবতা কি সত্যিই এত সরল?

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আসা–যাওয়া

নানা তরফ থেকে জানা যাচ্ছে, বিদেশি কোম্পানি সুটেক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে সরকারের আলোচনা চলছে। থাই কোম্পানি সুটেককে জাপান ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন প্রাথমিকভাবে ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির (সভরেন গ্যারান্টি) শর্তে।

এর আগে অনেক ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে, একেকবার একেক বিনিয়োগকারী এসে ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মধ্যে থাইল্যান্ড, জাপান, ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক দেশের বিনিয়োগকারীরা এসেছিল। কিন্তু প্রতিবারই রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি চাওয়ায় শেষ পর্যন্ত কোনো বিনিয়োগ হয়নি। প্রশ্ন হলো, সরকার যদি মনে করে বিদেশি বিনিয়োগ এলেই চিনিকলগুলো লাভ করা শুরু করবে, তাহলে কেন সেই বিনিয়োগকারীরা রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি চায়?

বিগত সরকার বিদেশি বিনিয়োগের আশায় চিনিকলগুলো শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল, কিন্তু গত পাঁচ বছরে কোনো বিনিয়োগ তো আসেইনি; বরং কৃষকেরা ভোগান্তিতে পড়েছেন, সম্ভাবনাময় একটা শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও অনেক কর্মসংস্থান বিলুপ্ত হয়েছে। এ বছর আবার অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশি বিনিয়োগের আশায় একই পথে হাঁটছে। অথচ এত দিনে তো জেনে যাওয়ার কথা, কেন রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি ঝুঁকিপূর্ণ, কেন আগের সরকার গ্যারান্টি দেয়নি?

আরও পড়ুনপাটকল, উচ্ছেদ এবং সচল কর্মসংস্থান নষ্টের উন্নয়ন২৮ নভেম্বর ২০২০চিনিশিল্পে লোকসানের ঝুঁকি ও রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি

এত দিনে জানা হয়ে গেছে যে চিনিকলগুলো লোকসানের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয় এই শিল্পের ধরনের কারণে। এ কারণে এটি ঐতিহাসিকভাবে কৌশলগত খাত হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, এর সঙ্গে দেশের আখচাষিদের জীবিকা ও খাদ্যনিরাপত্তা জড়িত। এ ছাড়া এখান থেকে উৎপাদিত উপজাত থেকে বিদ্যুৎ, সার, অ্যালকোহল, জীবাণুনাশক ও স্যানিটাইজার উৎপাদন করা যায়।

এই খাত লাভজনক হয় যদি সমন্বিত পরিকল্পনা করে উপজাত থেকে বহুমুখী পণ্য, অন্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন করা যায় এবং রিফাইনারি ও ডিস্টিলারি চালু করা যায়। এরপরও চিনিশিল্প লাভজনক না–ও হতে পারে, যদি কৃষকদের যথেষ্ট বীজ ও সার দিয়ে প্রণোদনা দেওয়া না হয়, কৃষকদের কাছে গিয়ে আখ সরবরাহে উৎসাহিত করা না হয়, সময়মতো আখ মিলে না আনা হয়, সমন্বয়হীনতা থাকে ও চিনির বাজারদর পরিবর্তিত হয়।

লোকসানের ঝুঁকি রয়েছে বলেই যেকোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী এলেই ঋণ নিতে গেলে ব্যাংকগুলো রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি চায়। সরকারের দিক থেকে এ ধরনের গ্যারান্টি দেওয়া প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, বিদেশি কোম্পানিকে এই রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি দিলে অনেক সময় অপব্যবহার করার ঝুঁকি থাকে। তখন ভুল সিদ্ধান্তের দায় এসে পড়ে জনগণের ঘাড়ে।

রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি সরকার সাধারণত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে দিয়ে থাকে, বিশেষ করে তখনই এটা দেওয়া হয়, যখন লোকসানের ঝুঁকি থাকে, খাদ্য, জ্বালানি ও কর্মসংস্থানের নিরাপত্তার কারণে শিল্প চালু করা প্রয়োজন হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি স্থানীয় ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি বা বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, তারা লোকসান দেখিয়ে, খরচ বাড়িয়ে সরকারকে ঋণ পরিশোধে বাধ্য করার সুযোগ পায়।

আরও পড়ুনরাষ্ট্রায়ত্ত কল বন্ধ রেখে ডেকে আনা চিনিসংকট১৫ নভেম্বর ২০২২‘ট্রেডগ্যাপ’ বনাম রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি

রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো দ্য পাবলিক করপোরেশনস অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৬ অনুযায়ী, সরকার নির্ধারিত দামে চিনি বিক্রি করে। দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে কম হলে আইন অনুযায়ী সরকারকে পার্থক্য (ট্রেডগ্যাপ) পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু বহু বছর ধরে সরকার এ ভর্তুকি না দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ দিচ্ছে। ফলে কিছু চিনিকলে ঋণ পরিশোধের খরচ গড়ে উৎপাদন খরচের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে লোকসান দেখিয়েই সরকার ছয়টি চিনিকল বন্ধ করেছে।

চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন দাবি করে, সরকার যদি নিয়মিত ট্রেডগ্যাপ পরিশোধ করত, তবে ঋণের ভারে জর্জরিত হতো না ও লোকসানও কমত। ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত অপরিশোধিত ট্রেডগ্যাপ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৩০ দশমিক ১৮ কোটি টাকা। অথচ ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত ভ্যাট, শুল্ক ও কর বাবদ গড়ে ৪ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে দিয়েছে। শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে করপোরেশন সরকারকে দিয়েছে ১৪৮ কোটি টাকা, যা প্রাপ্য অর্থের (৪২৯ কোটি টাকা) এক-তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ সরকার চিনিকল থেকে আয় করছে, কিন্তু প্রাপ্য অর্থ না দিয়ে করপোরেশনকে ঋণগ্রস্ত করছে।

বিদেশি ব্যাংককে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি দিলে ঝুঁকি বেশি। যদি সুটেক ও করপোরেশনের যৌথ প্রকল্প লোকসানে পড়ে, ঋণ পরিশোধের বোঝা জনগণের ঘাড়ে পড়বে, কিন্তু লাভ হলে অংশ যাবে বিদেশি কোম্পানির কাছে। এতে রাজস্ব ঘাটতি বাড়বে, স্থানীয় কৃষক-শ্রমিক-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সিদ্ধান্ত থেকে বাদ পড়বেন এবং খাদ্যশিল্পে বিদেশি নিয়ন্ত্রণ তৈরি হয়ে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।

‘ট্রেডগ্যাপ’ টাকায় মেটাতে হয় আর বিদেশি ঋণের সুদ দিতে হয় ডলারে, যা রিজার্ভে চাপ ফেলে, ডলারের দাম বাড়লে খরচও বাড়ে। প্রকল্প দেরি বা খরচ বাড়লে সরকার লোকসান চলাকালীন ঋণ শোধে বাধ্য। বিদেশি কোম্পানি ইচ্ছাকৃত অপচয়, বেশি দামে যন্ত্রপাতি কেনা বা ব্যয়বহুল ঠিকাদার নিয়োগ করে লোকসান দেখিয়ে সরকারের কাছে অর্থ চাইতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই লোকসান রাজস্ব থেকে মেটাতে হয়। তফাত শুধু ট্রেডগ্যাপের অর্থ যায় করপোরেশনে আর গ্যারান্টির সুদের অর্থ যায় বিদেশি ব্যাংকে।

আরও পড়ুনচিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থার তুঘলকি কাণ্ড১৯ আগস্ট ২০২৩বিদেশি বিনিয়োগ, নাকি প্রকল্প পরিকল্পনায় সমস্যা

অনেক সময় বিদেশি বিনিয়োগে নির্মিত প্রকল্পের সমস্যা নিয়ে বিরোধিতা করলে তা অনেকের কাছে ‘বিদেশ বিরোধিতার’ সমার্থক মনে হতে পারে। কারণ, প্রকল্পের ধরন, ফিজিবিলিটি, দীর্ঘমেয়াদি আর্থসামাজিক প্রভাব বোঝার ধৈর্য তাদের থাকে না। অনেকে সহজভাবে এ বিরোধিতাকে ‘বিদেশ ভীতি’র সঙ্গে তুলনা করেন।

সুটেক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রস্তাবে ১৫টি এলাকার ১৫টি চিনিকল বন্ধ করে মাত্র ৪টি এলাকায় ৪টি চিনিকল করার কথা বলা হয়েছে। ২০২০ সালে ছয়টি চিনিকল বন্ধের সময় বলা হয়েছিল, বন্ধ মিলসংলগ্ন আখ চালু মিলগুলোতে যাবে, সমস্যা হবে না। কিন্তু দেখা গেল, কৃষকেরা দূরে আখ সরবরাহে আগ্রহী নন। আনা-নেওয়ার খরচ, মিলগেটে দীর্ঘ লাইন তাঁদের আখ চাষ নিরুৎসাহিত করে। আখ শুকিয়ে গেলে সুক্রোজ ও চিনি আহরণের হার কমে।

যাঁদের চিনিকল বিষয়ে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা জানেন, আখ উৎপাদন এলাকা থেকে মিল দূরে হলে আখ পাওয়া যায় না। যা সবাই বোঝেন, তা বিনিয়োগ বোর্ড কেন বোঝে না?

যেকোনো প্রকল্প পরিকল্পনার আগে মাঠপর্যায়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে সমস্যা বুঝতে হয়, বিশেষ করে তা যদি হয় কৃষি–সম্পর্কিত। কবে বিদেশি বিনিয়োগের ফিজিবিলিটি স্টাডি হবে, কবে বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাতিল হবে—এ জন্য তো চিনিকল বন্ধ করে কৃষকদের বঞ্চিত করার দরকার নেই।

পাঁচ বছর ধরে এত ফিজিবিলিটি স্টাডি হওয়ার পরও সেগুলো কেন বাস্তবায়িত হলো না, এ বিষয়ে প্রথমে বিনিয়োগ বোর্ডকে ভালোমতো অনুধাবন করতে হবে। কয়েক দিন পরপর একেক বিনিয়োগকারী নিয়ে এসে, জমি মাপা, চিনিকল দেখানো, ফিজিবিলিটি স্টাডির মধ্যে আর কত দিন ঘুরপাক খাবে বিনিয়োগ বোর্ড?

আরও পড়ুনচিনিকল ও ‘হাতি বিত্তান্ত’০৩ ডিসেম্বর ২০২০শেষ কথা

পাঁচ বছর প্রায় হলো চিনিকলগুলো বন্ধ। সরকার ধরে নিচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগ এলেই লাভ হবে আর ঝুঁকি দেখে ব্যাংকগুলো রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি চাচ্ছে—এই দুটো পরস্পরবিরোধী বার্তা দেয়। লাভজনক যদি হয়ই, ঋণের জন্য রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি কেন দরকার? তাহলে ট্রেডগ্যাপ পরিশোধ আর সরকারের ঋণ পরিশোধে তেমন পার্থক্য থাকে না। সরকার দীর্ঘদিন ট্রেডগ্যাপের অর্থ পরিশোধ না করে চিনিকলগুলোর উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে, অথচ দায়ী করা হচ্ছে শুধুই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে।

অব্যবস্থাপনা আছে বটে, কিন্তু ৮০ বছরের পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, যথেষ্ট বিনিয়োগ না করে, মাঠপর্যায়ে কর্মী নিয়োগ না করে, আখ সরবরাহ নিশ্চিত না করে লাভের আশা করা অবাস্তব চিন্তা। সরকার হাজার কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ করছে অপচয়মূলক প্রকল্পে, কিন্তু জনস্বার্থ–সম্পর্কিত কোনো খাতে বিনিয়োগের প্রসঙ্গ এলে অর্থ থাকে না।

যখন সামান্য বিনিয়োগ ও দেশি দক্ষ জনবল ব্যবহারেই কর্মসংস্থান তৈরি ও অর্থনীতির ভিত গড়া যায়, তখন বিদেশি ঋণে জর্জরিত সরকারের উচিত অতিসত্বর অর্থ বিনিয়োগ করা। বিদেশি বিনিয়োগের মুলা ঝুলিয়ে রেখে আর কত দিন কৃষকদের বঞ্চিত করা হবে?

টাস্কফোর্স ছয়টি চিনিকলের মধ্যে সেতাবগঞ্জ ও শ্যামপুরে এ বছর আখ রোপণের জন্য মাত্র ১১ দশমিক ৮৩ কোটি ও আগামী দুই বছর আরও প্রায় ১০৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। পাশাপাশি পরে আরও দুটি করে চিনিকল খোলার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল।

হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয়ের তুলনায় এ অর্থ তুচ্ছ। কিন্তু কৃষকের স্বার্থ এলে সরকারের কাছে এ সামান্য অর্থও থাকে না। এ থেকে স্পষ্ট যে সেতাবগঞ্জ ও শ্যামপুরের সেই আশাবাদী কৃষকদের আখ রোপণ উৎসবের কথা ও পরের হতাশার কথা, উপদেষ্টা বা সরকারি কর্তাব্যক্তিরা হয়তো কোনো দিনই জানবেন না।

ড. মোশাহিদা সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

* মতামত লেখকের নিজস্ব

( ১৭ আগস্ট ২০২৫ ছাপা কাগজে এ লেখাটি ‘চিনিকল বন্ধ রেখে বিদেশি বিনিয়োগ খুঁজতে হবে কেন’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে)

সম্পর্কিত নিবন্ধ