বেলুচিস্তানে সশস্ত্র আন্দোলন কারা, কেন উসকে দিচ্ছে
Published: 24th, July 2025 GMT
ভূরাজনীতির মঞ্চে ছায়া আর নীরবতা দিন দিন প্রধান বিষয় হয়ে উঠছে। এ প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে চলমান সশস্ত্র লড়াই প্রক্সি যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিকে সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে সামনে নিয়ে আসছে। ১৫ জুলাই ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রায়ান বারলেটিক নতুন এক বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন। তাঁর অভিযোগ হলো ওয়াশিংটন সম্ভবত নীরবে বেলুচ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা দিচ্ছে। নির্দিষ্ট করে চীনা প্রকৌশলী ও পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করতে এ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
যদিও তাঁর এই দাবির সত্যতা নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক রয়েছে। তার পরও তথ্য–প্রমাণ থেকে এই বাস্তবতা দৃশ্যমান হচ্ছে যে বেলুচ সশস্ত্র সংগ্রাম এখন আর নিখাদ অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম নেই। এটি এখন দুই পরাশক্তির কৌশলগত টানাপোড়েনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে বেলুচিস্তানে অন্তত এক ডজন সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় ৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুজন পদস্থ কর্মকর্তাও রয়েছেন।
আরও পড়ুনবেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি কারা, তাদের জন্ম কীভাবে?১৬ মার্চ ২০২৫বেলুচিস্তান দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ভিন্নমত ও বিদ্রোহের একটি কেন্দ্র। এখন এটি বৃহত্তর বৈশ্বিক সংঘাতের একটি বিভেদক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বেলুচিস্তান ইরান ও আফগানিস্তানের সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ গোয়াদার বন্দর এখানে রয়েছে।, বেলুচিস্তান চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি ভারকেন্দ্র।
গোয়াদার বন্দরের সঙ্গে সংযুক্তির কারণে বেইজিংয়ের পক্ষে মালাক্কা প্রণালি এড়িয়ে বাণিজ্য করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা ওয়াশিংটন ও এর মিত্রদের কৌশলগত হিসাবনিকাশকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, চীনা স্বার্থ লক্ষ্য করে ঘটানো প্রতিটি হামলা শুধু অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের প্রতিফলন নয়, এটা বৈশ্বিক উদ্বেগেরও প্রতিধ্বনি।
যদিও বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যোগসূত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু পরিস্থিতিগত বাস্তবতা বলছে, এটাকে অস্বীকার করা কঠিন।
ইউএস পিস ইনস্টিটিউট, ফরেন পলিসি ও রেডিও ফ্রি ইউরোপের মতো সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে তড়িঘড়ি করে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র এখন বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) ও তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)-সহ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে। এ ধরনের মার্কিন সামরিক সরঞ্জামের বিস্তার (এমনকি তা অনিচ্ছাকৃত হোক না কেন) এ অঞ্চলে (বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে) সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত বাস্তবতা হিসেবে কাজ করেছে।
ভারতের ভূমিকা এখানকার সমীকরণকে আরও জটিল করে তুলেছে। চীন-পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা নিয়ে শঙ্কিত নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের অভিযোগ হলো, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অর্থ জোগাচ্ছে ভারত। তালেবান এখন ক্ষমতায় এবং আঞ্চলিক জোটগুলোর পুনর্গঠন চলছে—এই প্রেক্ষাপটে কে বা কারা বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মিকে সহায়তা করে চলেছে, সেই প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে।বালুচ বিদ্রোহ, জিহাদি আন্দোলন নয়। সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ, গণতান্ত্রিক অধিকার, জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের মতো পরিভাষা ব্যবহার করার কারণে বেলুচ বিদ্রোহ খুব স্বাচ্ছন্দ্যে পশ্চিমা উদারপন্থী মূল্যবোধের সঙ্গে মিলে যায়। এ আদর্শগত সাযুজ্যের কারণে বালুচদের প্রবাসী সংগঠনগুলো ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসে প্রভাব তৈরির সুযোগ পাচ্ছে। তারা প্রকাশ্যেই মার্কিন কংগ্রেসের হস্তক্ষেপ এবং পাকিস্তানের বিদ্রোহ দমন নীতির উপর বৈশ্বিক নজরদারির দাবি তুলছেন।
যদিও এ ধরনের প্রকাশ্য তদবির গোপন পৃষ্ঠপোষকতার সমান নয়; কিন্তু এখান থেকে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যে বেলুচ লিবারেশন আর্মি সম্প্রতি চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে আত্মঘাতী হামলার দায় স্বীকার করেছে, তাদের নিয়েই পশ্চিমা রাজধানীগুলিতে আলোচনা চলছে, বিবৃতি আসছে।
আরও পড়ুনপাকিস্তান থেকে বেলুচিস্তানকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করছে ভয়ংকর ডেথ স্কোয়াড১০ আগস্ট ২০২৩২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র বেলুচ লিবারেশন আর্মিকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করলেও সেটি অনেকটাই আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ। সংগঠনটির আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গঠন, অর্থ সংগ্রহ ও প্রচারণা—এ সব কর্মকাণ্ড রোধে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বিমুখী নীতি নতুন নয়। লাতিন আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য—প্রকাশ্যে কূটনৈতিক অবস্থান নিলেও, গোপনে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অস্থিরতা সৃষ্টির কাজে সহায়তা দিয়েছে, এই ইতিহাস যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের।
উদাহরণ হিসেবে সিরিয়ার কথা বলা যায়। সেখানে জিহাদি সহিংসতার বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রকাশ্য নিন্দা জানালেও আসাদবিরোধী এই শক্তিগুলোকে গোপনে সমর্থন জানিয়ে গেছে। বিদ্রোহে বিপর্যস্ত বেলুচিস্তানে কৌশলগত যুক্তি খুব একটি ভিন্ন নয়। বেলুচ বিদ্রোহীরা চীনের অবকাঠামোগত বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সেবা করে।
ইরানের ক্ষেত্রেও সেই একই যুক্তি খাটে। ইরানে জাতিগত বালুচ অধ্যুষিত অঞ্চল সিস্তান ও বেলুচিস্তান বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। তেহরান বারবার করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে তারা ‘জায়েশ আল-আদল’ নামের সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠীকে মদদ দিচ্ছে। এই গোষ্ঠী ইরানের নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর হামলার জন্য দায়ী। এ অভিযোগ সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, সীমান্ত অঞ্চলে স্থায়ী অস্থিরতা ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব খর্ব করতে চাওয়া শক্তিগুলোর পক্ষেই যায়।
আরও পড়ুনবেলুচিস্তান কি আরেক বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ভারতের ভূমিকা এখানকার সমীকরণকে আরও জটিল করে তুলেছে। চীন-পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা নিয়ে শঙ্কিত নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের অভিযোগ হলো, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অর্থ জোগাচ্ছে ভারত। তালেবান এখন ক্ষমতায় এবং আঞ্চলিক জোটগুলোর পুনর্গঠন চলছে—এই প্রেক্ষাপটে কে বা কারা বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মিকে সহায়তা করে চলেছে, সেই প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে।
এসব বাস্তবতায় পাকিস্তানের নীরব প্রতিক্রিয়া অনেক কথায় বলে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ও পাকিস্তানে কর্মরত চীনা নাগরিকদের ওপর একের পর এক হামলা হওয়া সত্ত্বেও ইসলামাবাদ কখনোই এই বিদ্রোহের সম্ভাব্য অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাম উচ্চারণ করেনি। এর বদলে পাকিস্তান মূলত ভারতের দিকে অভিযোগের তির ছোড়ে কিংবা ‘শত্রু দেশের গোয়েন্দা সংস্থা’র কাজ বলে বিবৃতি দেয়। এই কূটনৈতিক সংযমের পেছনে যুক্তি আছে।
পাকিস্তানের অর্থনীতি খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। দেশটিকে বারবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে এবং পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে পাকিস্তানের পক্ষে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাতে জড়ানো কঠিন।
রহিম নাসার পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র প রক শ য ব স তবত সশস ত র ক শলগত র জন ত
এছাড়াও পড়ুন:
সবচেয়ে নিরাপদ পথ হলো কৌশলগত নিরপেক্ষতা বজায় রাখা
প্রথম আলো:
জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আপনি এর আগে জাতীয় নিরাপত্তা সমন্বয় সংস্থা গঠনের কথা বলেছিলেন। বর্তমান বাস্তবতায় সেটা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে কি?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: এটা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তার কারণ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতিমালার ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পরিষ্কারভাবে নীতিমালাগুলো প্রণয়ন করা হয়নি। যেকোনো দেশের জন্য এই নীতিমালাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখন পর্যন্ত আমাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কিটেকচার বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি। সে কারণে আমাদের সক্ষমতাগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমন্বয়ের কাজটি অনেক ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটির সঙ্গে শুধু সশস্ত্র বাহিনী জড়িত থাকে না। বর্তমান বিশ্বে এ জায়গায় সমগ্র সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা থাকে। সে জন্য রাষ্ট্রীয় সব ধরনের সক্ষমতা একই ছাতার নিচে সমন্বয় করার জন্য যে ধরনের অবকাঠামো দরকার, সেটা খুব শিগগির আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এ জায়গায় এখন পর্যন্ত অনেক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য একক কোনো বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়া কতটা বাস্তবসম্মত হবে? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থানটা কী হওয়া উচিত?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: বাংলাদেশ একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অবস্থানে অবস্থান করে। বিশেষ করে আমরা বঙ্গোপসাগরের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত দেশ। বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগরীয় দেশও। এ কারণে বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে এবং উঁচু স্থানে চলে গেছে। বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রণয়ন করা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কারণে ভারত মহাসাগর কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
চীনের প্রণীত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেও (বিআরআই) দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন করিডরের মাধ্যমে তারা অনেক ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। কাজেই দুটি পরাশক্তিরই একই মহাসাগরের ওপর যে কড়া দৃষ্টি বা স্বার্থ জড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে আমাদের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিটা একটু স্পর্শকাতর হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটা হচ্ছে, আমরা যাতে সব ক্ষেত্রে একটা নিরপেক্ষতা বজায় রাখি।
আমরা যাতে কোনো একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে বা কোনো চুক্তির সঙ্গে এককভাবে জড়িয়ে না পড়ি। আমাদের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে আমরা সবার সঙ্গে কাজ করতে চাই এবং একইভাবে আমাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চাই। আমরা এককভাবে কারও সঙ্গে সংযুক্ত হলে আমরা অন্য পক্ষের নেতিবাচক দৃষ্টিতে চলে আসতে পারি। সেখানে আমাদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে পারে। কাজেই আমাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ পথ হবে কৌশলগত নিরপেক্ষতা ও কৌশলগত স্বনির্ভরতা বজায় রাখা।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধে ভারসাম্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ঝুঁকে পড়েছে। রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই আরাকান আর্মির হাতে। রোহিঙ্গাদের কারণে আরাকানের সঙ্গে আমাদের বড় স্বার্থ রয়েছে। রাজ্যটিতে চীন ও ভারতের স্বার্থটাও বড়। আবার মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বার্মা অ্যাক্ট পাস করেছে। সব মিলিয়ে মিয়ানমার ও রাখাইন ঘিরে একটা জটিল ভূরাজনৈতিক সমীকরণ বিরাজ করছে। এই বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে? বাংলাদেশের সামনে পথটাই–বা কী?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: আমাদের দুটি পথে এগোতে হবে। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আছে, তাদের আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। আবার আমাদের প্রতিবেশী রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে চলে গেছে। তবে আরাকান আর্মি কোনো রাষ্ট্রীয় সত্তা নয়, তারা একটি অরাষ্ট্রীয় সত্তা। রাষ্ট্র হিসেবে আমরা তাদের সঙ্গে সরাসরি আলাপ-আলোচনা করতে পারি না। তবে অন্যান্য চ্যানেলে আরাকান আর্মির সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপনের একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে কূটনীতির চেয়ে কৌশলগত মারপ্যাঁচ কাজে লাগাতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্মুখপথে আমাদের কূটনীতি পরিচালিত হবে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাক চ্যানেলে কূটনীতি পরিচালিত করতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে তাদের দক্ষতা প্রমাণের এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা দুই পক্ষের সঙ্গেই আমাদের কার্যকর একটা সম্পর্ক বজায় রেখে এগোতে হবে। তবে কোনোভাবেই এমন কিছু করা যাবে না, যেটা মিয়ানমার সরকারের স্বার্থের সম্পূর্ণ বিপরীতে চলে যায়।
রাখাইন পরিস্থিতি রোহিঙ্গা সংকটে নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। নতুন করে রোহিঙ্গা এসেছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সহায়তা কমেছে। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজ জন্মভূমিতে ফেরানোর বিষয়টা কতটা জটিল হলো?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: পরিস্থিতিটা জটিল হয়ে উঠছে আরও বেশি কারণে যে রোহিঙ্গারা মানবিক যে একটা পরিস্থিতির ভেতরে ছিল, সেটা থেকে এটা উত্তরণ করে এটা একটা নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় রূপান্তরিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভেতরে অনেকে বিভিন্ন ধরনের বেআইনি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। যেমন তাদের অনেকে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। এখান থেকে বিভিন্ন দেশে মানব পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাস্ত্র আসছে, সেগুলো বিভিন্ন দেশে চোরাচালান হচ্ছে। কাজেই এটা শুধু আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে না; বরং বলা চলে, আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর একটা বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছে।
এ ছাড়া এই অঞ্চলে যে ধরনের উগ্র মতবাদের সৃষ্টি হচ্ছে, সেটার প্রভাবও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পড়তে শুরু করেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন যেমন আরসা বা আরএসও ইতিমধ্যে রাখাইনের ভেতরে গিয়ে বিভিন্ন সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এখন রাখাইনের ওপর আরাকান আর্মির যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ আছে, তাতে তাদের সমর্থন ছাড়া রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই তাদের জন্মভূমিতে ফেরত যেতে পারবে না।
আরসা, আরএসওর মতো সংগঠনগুলোর তৎপরতার কারণে আরাকান আর্মির রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে খুবই নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে। এখন আমরা যদি ধরেও নিই মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে রাজি হয়, কিন্তু দেখা যাবে যে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের রাস্তাগুলো খুলে দেবে না। কাজেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ভবিষ্যৎটা খুবই অনিশ্চিত।
অদূর ভবিষ্যতে তারা সেখানে ফেরত যাবে বলে মনে করি না। কাজেই এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আমরা কীভাবে এখানে রাখব, সেটা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। কেননা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা উদ্বেগজনকভাবে কমে যাচ্ছে। প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা এখানে আগে থেকেই বাস করছিল। গত ১৮ মাসে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে এসেছে। প্রতিবছর রোহিঙ্গা শিবিরে ৪০-৫০ হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে। কাজেই রোহিঙ্গা সমস্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কয়েকজন তরুণের বিরুদ্ধে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। বৈশ্বিক ও আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে এ ঘটনা আমাদের জন্য কতটা ঝুঁকি তৈরি করল?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: মালয়েশিয়ায় উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে আমাদের তরুণদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা আমাদের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। আমাদের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে আসছে। মালয়েশিয়া আমাদের বড় শ্রমবাজার। মালয়েশিয়ায় উগ্রবাদী তরুণেরা যে সমস্যাটা সৃষ্টি করেছে, সেটা শুধু মালয়েশিয়ার ভেতরে সীমিত নয়। তারা সেখান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মধ্যপ্রাচ্যে আইএসআইএসের কাছে পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিল। কাজেই এখানে একটা আন্তর্জাতিক মাত্রাও যোগ হয়েছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশেও এ ধরনের উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর যোগাযোগ থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। কাজেই শুধু মালয়েশিয়ায় একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, এভাবে দেখা ঠিক হবে না। বাংলাদেশে তারা কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে কিংবা কাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে, সেটা আমাদের খুব গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।
আমাদের আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতিটা একেবারে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ৫ আগস্টের পর পুলিশ সঠিকভাবে কাজ করছে না। উগ্র মতবাদ ও জঙ্গি মতবাদ দমনের জন্য পুলিশের বেশ কিছু বিশেষায়িত ইউনিট তৈরি করা হয়েছিল। সেই ইউনিটগুলো বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে। এসব ইউনিটের যে সক্ষমতা সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেটা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে নজর দেওয়া ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের সক্ষমতাটা একেবারে নেই বললেই চলে। কাজেই উগ্রবাদের কারণে আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো কিন্তু আমরা সঠিকভাবে যাচাই করতে পারছি না। এদিকে আমাদের খুব দ্রুত দৃষ্টি দিতে হবে।
মালয়েশিয়ায় যারা জেলে আছে বা যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে, আমরা যদি খুব বলিষ্ঠ এবং পরিষ্কার ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নিই, তাহলে মালয়েশিয়া নয়, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য অনেক দেশে আমাদের শ্রমবাজারের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ব্যাপারে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খুবই আশু কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম চোখে পড়েনি। যে গুরুত্ব দিয়ে এই সমস্যাটা তাদের সামাল দেওয়া উচিত ছিল, সেটা তারা করেনি। এই দুর্বলতার সমস্যাটাকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।
প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি করে শুল্ক কমাতে পারলেও বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণ কী বলে মনে করেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ–অর্থনৈতিক সমস্যাট। শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল। পরে আলাপ-আলোচনার জন্য তারা এই সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছিল। সে ক্ষেত্রে এই সময়কে কাজে লাগিয়ে অনেক দেশ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। যেমন ভিয়েতনাম আলোচনার মাধ্যমে তাদের ওপর আরোপিত শুল্ক ২০ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। আমরা জানতে পারছি, ভারতও প্রায় ২০ শতাংশ বা তার নিচে শুল্ক নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কার্যকর আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা সময়টাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির চেষ্টা সঠিক ব্যক্তির দ্বারা করা হয়নি। যেমন ওয়াশিংটনে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা উপস্থিত থেকে আলোচনাটা পরিচালনা করছিলেন। এটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ। এটি কোনোভাবেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাজ নয়।
এখানে আরেকটি বড় ঘাটতির জায়গা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যাঁরা রপ্তানি করেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হয়নি, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ত করাও হয়নি। কাজেই যে আলাপ-আলোচনাটি হয়েছে, সেটা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, সেটা আমরা জানি না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে চিঠিটা দিয়েছেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে পূর্বঘোষিত ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে শুল্ক ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। এখন আমাদের যদি ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হয়, আর আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো যদি আমাদের চেয়ে কম শুল্ক দেয়, তাহলে কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে আমরা অনেকখানি পিছিয়ে পড়ব। এতে আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পে যে চাপ তৈরি হবে, তাতে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। সেই বাজারে রপ্তানি যদি বিঘ্নিত হয়, তার স্পিল-ওভার প্রভাব ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারসহ অন্যখানেও পড়বে। আমরা এরই মধ্যে শুনতে পাচ্ছি, ইউরোপের কিছু কিছু ক্রেতা বলতে শুরু করেছেন, তাঁরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে দর-কষাকষি করতে চান। এটা আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। কেননা আমরা রপ্তানির ক্ষেত্রে এককভাবে তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ৩৫ শতাংশ শুল্কের কারণে অর্থনীতির ওপর যে ঝুঁকি আসবে, সেটা মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জন্য খুবই কঠিন হবে।
এ রকম ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে যে দর-কষাকষির বিষয়টাকে যে ধরনের গুরুত্ব দেওয়া দরকার, যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল, সেটা করা হয়নি। এখানে উচিত ছিল ট্রেড লবিস্ট নিয়োগ করা। ভিয়েতনামসহ আরও কিছু দেশ খুবই দক্ষ ট্রেড লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। বাংলাদেশ সে রকম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রথমে দায়সারাভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে, শেষ মুহূর্তে নেগোসিয়েশন করতে গেছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তো নেগোসিয়েশন হয় না। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অপর পক্ষ যখন জানে যে আমরা খুব নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছি, তারা তো আমাদের কাছ থেকে যতটুকু পারে, ততটুকু নেওয়ার চেষ্টা করবেই।
প্রথম আলো:আপনাকে ধন্যবাদ।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ।