Prothomalo:
2025-08-13@18:18:46 GMT

হলোট

Published: 13th, August 2025 GMT

তুফাজ্জল মিয়া খেতের আল ভেঙে উপুড় হয়ে আশপাশে তাকায়। কেউ নেই...এই তটস্থ মাছ ধরা মানুষ হিসেবে নিজস্ব কৌশলগত কারণে সে চায় না কেউ দেখে ফেলুক এখানে তার দোয়ার পাতা হয়েছে। তাতে মাছ চুরি যাওয়ার ভয় আছে, থাকে দোয়ারটাই চুরি হওয়ার শঙ্কা। অবশ্য দোয়ার সরানো হলে সেই ফাঁকে অন্য কারও দোয়ার বসিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এমন বর্ষা মৌসুমে তুফাজ্জল নিজেই যেন জলজ প্রাণীতে পরিণত হয় মাছ বা ব্যাঙের মতো। মানুষ আর পানির অদ্ভুত সখ্য যে না দেখছে, সে বুঝবে না।

পানিপোকার মতো খেত থেকে অন্য খেতে, এক বিল থেকে অন্য বিলে ঘুরে বেড়ায়, আর তার সদাসতর্ক শিকারি চোখ তাকে সতর্ক করে। কাঁধে সব সময় দু–একটা দোয়ার তো থাকেই, উপযুক্ত জায়গা পেলেই হাতের কোদালে জায়গাটা একটু খোঁড়াখুঁড়ি করে দোয়ার পাতার উপযোগী করে তোলে। আলগোছে দোয়ার পেতে ওপরে খেতের জলাজঙ্গল, শালুকপাতা, পানা দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দেয়, যাতে সহসা কারও চোখে না পড়ে যে এখানে আদৌ মাছ ধরার কোনো ফাঁদ পাতা আছে। সাধারণত দোয়ার পাতা হয় এমন জায়গায়, যেখানে বিস্তৃত জায়গার পানি একটা স্রোত হয়ে নামতে থাকে। তেমনই এক জায়গা এই কালভার্টপাড়ের কড়ইতলা।

এখানে মানুষের আনাগোনা কম। ছোট্ট একটা চোরা স্রোত আছে। রাস্তার ওপাশ থেকে ছোট্ট কালভার্ট হয়ে নেমে এসেছে। দৃশ্যত শুকনা খেত। মানুষ ভাবতেই পারে না এখানে মাছ থাকতে পারে। ঝুম বৃষ্টি মাথায় করে তুফাজ্জল গভীর রাতে ছাতা মাথায়, মুখে ছোট একটা টর্চ কামড়ে মাঝারি সাইজের এই দোয়ার পেতে গিয়েছিল, তা–ও উল্টো করে।

মাছ ধরার কৌশলটা একটু অদ্ভুত। স্রোতের মধ্যে উল্টো করে দোয়ার পাতা, মাথা থেকে স্রোত নেমে যাওয়ার পথ করে দিতে হয়। সেটা গিয়ে শেষ হবে বেশি পানির খেতে। বেশি পানির মাছ এসে পড়বে ওই ড্রেনে। স্রোত ঠেলে আসা মাছেদের স্বভাব। স্বভাবতই ঝাঁক এসে হাজির হবে দোয়ারের সামনে, একটু দোদুল্যমান থাকবে, তারপর ফুড়ুৎ করে ঢুকে যাবে দোয়ারের মুখে পাতা ফাঁদের পেটের মধ্যে। হঠাৎ আটকে গিয়ে বেরোনোর জন্য ছটফট শুরু করবে। সদ্য ঢোকা মাছের ছটফটানির সঙ্গে আটকা পড়া আগের মাছগুলোও ছটফট শুরু করবে।

তুফাজ্জল দোয়ারটার দিকে ঝুঁকে পড়ে চারপাশ লক্ষ করার ফাঁকে ভেতরের অবস্থা বোঝার জন্য কান খাড়া করে। শুনতে চেষ্টা করে মাছদের ছটফটানি এবং সঙ্গে সঙ্গে পরিমাপ করার চেষ্টা করে কী পরিমাণ মাছ তাতে ধরা পড়ছে বা পড়েছে। তাতে কতটুকু আনন্দিত হওয়া যায়, আর করা যায় কতটা আশঙ্কা।

আশঙ্কাটা সাপের। মাছ মারা মানুষের জীবনে এই একটা উৎপাত। সংকটও বলা যায়। সারা রাত ধরে যে মাছ ঢুকল, ভোররাতে দেখা গেল সাত-আটটা সাপ ঢুকে সব সাবাড় করে ফেলেছে। তখন মেজাজ খিঁচড়ে যায়। ফলে সাপগুলোকে সাধারণত মারা হয় খুব নির্মমভাবে। তুফাজ্জল সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, সে সাপ মারার পক্ষে না। কখনো সে সাপ মারবে না, কিছুটা বকাঝকা করে ছেড়ে দেবে।

তুফাজ্জলের কথায়, সাপ যেইটা খাইছে সেইটা ওরই রিজিক। আমারটা হেয় খায় নাই। তারটাই হেয় খাইছে। বিষ নাই, আল্লার সৃষ্টি একটা প্রাণী রে আমি হুদাই ক্যান মারতে যামু। আমার ভালা লাগে না। মন সায় দেয় না।

কালভার্টপাড়ের কড়ইতলায় দোয়ারের কাছে কান পেতে ধরে তুফাজ্জলের মনে বর্ষার বিলের মতো আনন্দ উথলে ওঠে—যেখানে শাপলারা আলতো বাতাসে বৃষ্টির ছাঁট নিয়ে দোল খাচ্ছে, একটা আরেকটাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে, পানকৌড়ি ডুবে বেড়াচ্ছে। মাছ ধরা পড়েছে! বেশ ভালো মাছ! দোয়ারের পেট মাছে মাছে ভর্তি। বৃষ্টির এই ভোরে কোথাও কেউ নেই। সে কালো ছাতার কাঠের বাঁটটা কাঁধে গাল দিয়ে চেপে ধরে নিশ্চিন্ত মনে দোয়ারের ওপরের পানাপাতা সরায়। দুই ধার ধরে পানিতে নাড়া দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করে শূন্যে তুলে ধরে।

দোয়ারের ভেতরে মাছগুলো কিলবিল শুরু করে। পেছন দিকের দুয়ারটা খুলে দিয়ে খালুইয়ে উপুড় করে দেয়। শাঁই করে শূন্যে একটা গোঁত্তা মেরে খালুই মাছে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। খালুইয়ের ওপর তুফাজ্জল দোয়ার ঝাঁকায়। ভেতরের আনাচে–কানাচে আটকে থাকা দু–একটা দাড়িকানা, পুঁটি আর গুতুম টুপটুপ করে এসে পড়ে হোতকাপেটু খালুইয়ের গলা পর্যন্ত ভরে ওঠা মাছের সঙ্গে মিশে যায়।

পুরোটা সময় তুফাজ্জলের মুখের কোথাও কোনো অভিব্যক্তির রেখা ফুটে ওঠে না। তবে গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, ভরা বিলে গোঁত্তা মারা বোয়ালের মতো একটা আনন্দ তার চোখে খেলা করে।

২.

তুফাজ্জল মিয়া গ্রামের খেতমজুর মানুষ। মানুষের খেতে কাজমাজ করে উপার্জন করা তার পেশা। কিন্তু বৃষ্টির দিন এলে তার আর অন্য কোনো খেয়াল থাকে না। অবশ্য বর্ষা মৌসুমে খেতের কোনো কাজও থাকে না। আক্ষরিক অর্থেই সে শয়নে-স্বপনে মাছ দেখে দেখে, নিজেও যেন মাছ হয়ে যায়। পানি ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার হাত-পা সাদা হয়ে যায়। আঙুলের ফাঁকে সাদা ঘা। মেয়ে জিগাগাছের গোটা এনে দেয়। বউ শিল-পাটায় বেঁটে দিয়ে দেয় আঙুলের ফাঁকে। কিন্তু কিচ্ছুতে কিচ্ছুটি হয় না। হবেই–বা কীভাবে? রাতদিন যদি একটা মানুষ পানিতে কাটায়, তার ঘা ভালো হবে কীভাবে?

তুফাজ্জলের অত কিছু ভাবার সময় নেই। আজ রাতে সে যাবে জাগিরাচালা থেকে অনেক দূরে, মাছ শিকারে। এলাকার ভাষায় যাকে বলা হয়—হলোটে। সে একা যাবে না। জলাজঙ্গল ভেঙে অত দূরে একা যাওয়া যায় না। তা–ও আবার মাছ ধরতে। মাছের নেশায় পাওয়া একদল মানুষ তৈরি হয়ে আছে। মধুপুর জঙ্গলের দূরতম ভেতরকার সেই বিলে আজ তারা হলোটে যাবে। তুফাজ্জল তাদের একজন।

সন্ধ্যা থেকে তুমুল বৃষ্টি। আকাশ ভেঙে চরাচর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তুফাজ্জল চার ব্যাটারির স্টিলের ভারী টর্চ, খালুই, কাস্তে, লন্ঠন, বিড়ি, মেস একটা বাজারের ব্যাগে ঠিকঠাক করে ভরে রাখে। খেয়েদেয়ে ব্যাগটার জিনিসপত্তর আরেকবার চেক দিয়ে সন্ধ্যারাতেই শুয়ে পড়ে। মচমচে পুঁটি মাছ ভাজা আর মাষকলাই ডাল...অমৃত! কুড়মুড় করে কামড় দিয়ে মুচমুচ করে মুখময় ছড়িয়ে যায় কালচে করে ভাজা পুঁটি মাছের স্বাদ। ধনেপাতা দেওয়া ডাল মাখানো গরম ভাত মুখকে কেমন বিহ্বল করে দেয়—ঠোঁটের কষ দিয়ে সেই স্বাদকে ফ্রড়ড়ড় করে টেনে তাড়িয়ে তাড়িয়ে স্বাদ উপভোগ করে খাবার শেষ করে তুফাজ্জল।

টিনের চালে ঝুপঝুপ বৃষ্টি পড়ছে। ঘরে চেরাগ জ্বলছে। চেরাগের আলোয় গলা ছেড়ে ছড়া মুখস্থ করার চেষ্টা করার মধ্যেই তুফজ্জলের মেয়ে মরিয়ম কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েকে ঠিকমতো শুইয়ে দিয়ে হাওয়াও শুয়ে পড়ে। তুফাজ্জল আর মেয়ের মাঝখান দিয়ে।

মেয়েটা খাইল না? তুফাজ্জল জিজ্ঞেস করে।

দুপুরকার খাবার খাইছে বৈকালে। ডাকলাম, খাব না। আফনের মাইয়্যার যা ঘুম।

হুম, সব আমার মাইয়্যার দুষ। তর কোনো দুষই নাই রে। তুই খাওয়াইতে পারলি না, তা কবি না।

আফনে ত খালি আমার দুষটাই দেকবেন।

তর পুঁটি মাছ ভাজা দুনিয়ার সেরা।

পাম দিলেন?

আরে না। সত্যি।

কত অইল?

তিন হাজার দুই শ পুচ্চল্লিশ।

আর কত?

পাঁচ হাজার পুরা করণ লাগব। তয়লে না টগবগা একটা বাছুর কিনন যাব।

আরে হয়া যাব দেখিস। আজকা হলোটেই তো পাঁচ শ টেকার মাছ মারমু, দেখ না খালি।

সত্যি! হাওয়া যেন একটু বেশি কৌতূহলী হয়ে পড়ে। কৌতূহলের চোটে সে তুফাজ্জলের প্রায় বুকের ওপর ওঠে বসে।

কী রে ঢেমনি! কিসটা কী?

কিছু না, বলে হাওয়া তুফাজ্জলের গলায় কামড়ে ধরে। যেন সে পেতনি, তুফাজ্জলের সব রক্ত শুষে খাবে। তুফাজ্জল দক্ষ মাছশিকারির মতো হাওয়ার ঊরু চেপে ধরে উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠে, বোয়াল রে, বোয়াল!

পাশে ঘুমিয়ে থাকা মেয়ে মরিয়ম নড়েচড়ে ওঠে।

হাওয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে, রয়াসয়া। মাইয়া ঘুমায়।

৩.

গভীর রাত। তুফাজ্জল হুড়মুড় করে ওঠে বসে। তুফাজ্জলের নাড়া খেয়ে হাওয়াও।

কী হইল?

আইছে ওরা। ডাকতাছে। তুফাজ্জল দ্রুত হাতে জিনিসপত্র ভরা প্লাস্টিকের বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘরের দুয়ার খোলে। বাইরে এসে ডাক দেয়, কই তরা?

কেউ কোনো উত্তর দেয় না। আবার ডাক দেয়। এবারও কোনো উত্তর আসে না। কেবল টিনের চালে একটানা ঝমঝম বৃষ্টি পড়া ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই।

তুফাজ্জল এবার গলা ছেড়ে ডাক দেয়, কালু! কই তরা?

এবারও কোনো উত্তর আসে না। তয়লে আমারে ডাকল কে রে, হাওয়া। আমি নিজ কানে হুনলাম, আমার নাম ধইরা ডাকল।

কেরা হইতে পারে? কুপির আলোতে হাওয়ার মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেরা হইবার পারে? তয়লে কী...

কী? তুফাজ্জল হাসে, মাইছা ভূত! হাহাহাহা।

হাসেন ক্যান আফনে? হাওয়া বিস্ময়ে ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে।

আরে দল বাঁইধা যামু। দলের আগে-পাছে ওরা আহে না। দলরে ডরায় ওই সব। আহে একলা কাউরে পাইলে।

তুফাজ্জলের ব্যাখ্যা শুনেও হাওয়ার দুশ্চিন্তা যায় না। না, আফনে আজকা যায়েন না। আমার ক্যান জানি ভালা লাগতাছে না।

আরে কী কস! গরু কিনবি না? মাইয়া বড় হইতাছে, বিয়া দেওন লাগব না? টেকা পাবি কই? আর এত মানুষ একলগে গেলে কিছুই হইব না রে। ওই সবেরও তো ডরভয় আছে, তাই না?

এবার সত্যি সত্যি দরজার বাইরে থেকে ডাক পড়ে তুফাজ্জলের নামে। তুফাজ্জল কোনো কথা না বলে ব্যাগ হাতে বের হয়ে যায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হাওয়াকে একলা ঘরে ফেলে।

৪.

হলোটের দলটা যত বড় হওয়ার কথা ছিল, তত বড় হয়নি। চারজনের দল। দশ-বারোজনের জায়গায় এসেছে মোটে চারজন। চারটা ছাতা ঠোকাঠুটি করে প্রবল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্যাক-কাদার মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। দুই দিকে অন্ধকার বন।

কালু, মুজাম্মেইল্যা আইল না?

একে তো বৃষ্টির রাইত, তার মইধ্যে বউর ওম—ওই কি হেই বেডামানুষ কইতে চাস যে এই রাইতে ঘর ছাইড়া ওয়ে হলোটে যাইব।

কালুর কথা শুনে সবাই একযোগে হেসে ওঠে। সম্মিলিত হাসির ধ্বনি বনভূমিতে প্রতিধ্বনি তুলে বৃষ্টিময় অন্ধকারকে আরও প্রগাঢ় করে তোলে। চারটা ছাতা ঠোকাঠুকি করে এগিয়ে যায়। যেন এদের আলাদা করে কোনো অস্তিত্ব নেই—এতটা লেগে লেগে চলে তারা। অথচ বিলে যখন নামবে, আর মাছের নেশা তাদের পেয়ে বসবে, কে কোন দিকে চলে যাবে, তার কোনো খোঁজই থাকবে না।

কেউ লোভে পইড়া বেশি পানিতে যাবি না। মজনু খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্য তিনজন তার বয়ান আর এগোতে দেয় না। হাসিতে ফেটে পড়ে। এ হাসি স্বতঃস্ফূর্ত না চেষ্টাকৃত, সে বিবেচনায় না গেলেও তারা হাসে, কারণ তাদের হাসতে হয়। এ যেন হাসি নয়, সাহস; অমঙ্গল তাড়ানো কোনো মন্ত্র।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, পায়ে লাল মাটির জট নিয়ে চারজনের ছোট্ট দল এসে দাঁড়ায় বিলের পাড়ে। আশপাশে সাত-আট গাঁওসমান এলাকাজুড়ে কোনো বাড়ি নেই। বনের মধ্যকার এই বিলের পাড় দিয়ে তৈরি হওয়া ধানি জমিতে মানুষ কেবল আসে আবাদের মৌসুমে। ফসল চাষ করে নিয়ে চলে যায়। এর বাইরে এদিকটায় সাধারণত মানুষের তেমন আনাগোনা নেই। এখন তো আরও না। পানিতে বিল ভরে খেতগুলোও থইথই করছে। কেউ এলে দল বেঁধে আসে, তা–ও ওই মাছ ধরতে। তথাপি এমন রাতে বৃষ্টি মাথায় করে বনের মধ্যে এসে মাছ শিকার করার মতো পাগলও যে খুব বেশি আছে, তা–ও না। কে আসবে? বৃষ্টি আর কাদার সাগর ভেঙে বনজঙ্গল পাড়ি দিয়ে এই বিলে!

তুফাজ্জল তো আবাদের সময়ও আসে না এদিকে। নিজের কোনো খেত নেই। অন্যের জমিতে খেটে খাওয়া মানুষ সে। আশপাশের জমিতেই যদি কাজ হয়ে যায়, তাহলে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে কে আসে? ফলে তুফাজ্জলের এদিকে আসা পড়ে না। তার আজকের এ আগমন দুর্লভ ঘটনাই বটে যে একটা চারজনের দলে সে, মানে তুফজ্জল আলীও আছে। বড় কথা হচ্ছে, সে দল বেঁধে মাছ মারতে ভালোবাসে না। কিন্তু আজকের তাল ভিন্ন। এখানে অন্য রকম একটা হিসাব আছে। তার টাকার দরকার, দরকার অনেক মাছেরও। সেই তাড়না এই বৃষ্টির রাতে তাকে বনের মধ্যকার এই বিলে এনে ফেলেছে। সঙ্গে হলোটের মাছের নেশা তো আছেই।

তুফাজ্জল ছাতাটার অগ্রভাগ বিলের ধারে গেঁথে দাঁড় করিয়ে তার ওপর ব্যাগটা রেখে লন্ঠনটা জ্বালিয়ে দেয়। অর্থাৎ তার যাত্রাটা এখান থেকে শুরু, আবার এখানে এসে থামবে। কত কত যাত্রাই তো এভাবে সুপরিকল্পিতভাবে শুরু হয়, সব যাত্রাই কি আর পরিকল্পনামাফিক এগাোয়? এগোয় না এবং ইচ্ছেমতো শেষও হয় না। কারণ, যাত্রার নিজস্ব একটা গতি আছে; শুরু হলে তা নিজের মতো এগিয়ে এবং নিজের মতো করে শেষ হতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

খালুইটা কোমরে নাইলন সুতা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে তুফাজ্জল পানিতে নেমে যায়। ডান হাতে কাস্তে, বাঁ হাতে টর্চটা জ্বালিয়ে তার অভিব্যক্তিহীন মুখটা কঠিন করে বিলের মধ্যে এগোতে থাকে। পানিতে যতটা কম শব্দ করা যায়, যত কম ঢেউ ওঠে ততই ভালো—এভাবে সন্তর্পণে এগিয়ে যাওয়ার নাম হলোট। তার মতো সূক্ষ্মভাবে এ কাজ আর কেউ পারে না। সে এমনভাবে পা ফেলবে পানিও তা টের পাবে না। এক হাতে তার কাস্তে উদ্ধত, অপর হাতে টর্চ ধরা; চোখ তীব্র চৌকস হয়ে টর্চের আলো যেখানে পড়েছে, সেখানটা ভেদ করে মাটির কাছে পৌঁছে যেতে চায়।

‘ছপ্’ একটা শব্দ। ডোরাকাটা পুরুষ্টু টাকি মাছটার কানকোর কাছে গিয়ে কাস্তের কোপটা লাগে। মাছটা একটা ঘাই মেরে মাটিতে গোঁত্তা খেয়ে পানির ওপর ভেসে ওঠে। লুফে নিয়ে খালুইয়ের হোতকাপেটে চালান করে দেয়। এভাবে একের পর এক মাছ শিকার চলতে থাকে তুফাজ্জলের।

একসময় মনে হয় কিছুটা সামনে একটা মাছ খুব খলবল করছে। এগিয়ে যায়। কিন্তু কিছু দেখতে পাওয়া যায় না। মনে হয় আরেকটু সামনে হচ্ছে খলবল শব্দটা। টর্চ ধরে। দেখা যায় খুব পানি ছিটছে তুফাজ্জল যেখানটায় দাঁড়িয়ে তার থেকে আরও কিছুটা সামনে। সে সেদিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সে যতই সামনে যাচ্ছে, ততই পানির ছিটা বেড়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে পানির গভীরতা তার কাছা দেওয়া ঊরুর কাছে চলে আসে। সংবিৎ ফিরে পেয়ে সে আশপাশে তাকায়। দেখে অনেক দূরে দূরে ছড়ানো তিনটা আলোর বৃত্ত—কোনোটা থির হয়ে আছে, কোনোটাবা অস্থির হয়ে উঠছে।

এবার সে খলবলটা একপাশে শুনতে পায়। একবার ভাবে থাক, অত লোভ ভালো না। পরক্ষণে সে নিজের লোভকে সামলাতে ব্যর্থ হয়। বাঁ দিকের ওই শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে যায়। টর্চের আলোয় ছলকে ওঠে মাছের বড়সড় একটা সাদা পেট। ত্বরিত গতিতে তার কাস্তে ধরা হাত সেদিকে এগিয়ে যায়, যেন স্বয়ংক্রিয়। যেতে যেতে তার মনে হতে থাকে এটা হয়তো ঠিক হচ্ছে না। মনে হয়, মাছটার সাদা পেটের ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে ধূসর কাছির মতো কিছু একটা—গায়ে তার বাদামি ছোপ।

ততক্ষণে তুফাজ্জলের দেরি হয়ে গেছে। তার মাসল মেমোরির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে দেরি করে ফেলেছে তার মস্তিষ্কজাত বিবেচনা। মাছটাকে পেঁচিয়ে রাখা সাপটা কাস্তে এগিয়ে আসতে দেখে আত্মরক্ষার তাগিদে সর্পীয় প্রাচীন ঐতিহ্য মোতাবেক তুফাজ্জলের কবজিতে ছোবল বসিয়ে দেয় এবং মাছটাকে নিজের কবজা থেকে ছেড়ে আক্রমণাত্মক হাত পেঁচিয়ে ধরে।

তুফাজ্জলের গগনবিদারী চিৎকারে বনের মধ্যকার জলে টইটম্বুর বিল হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেই জমাট বরফে রূপ নেয়। সেখানে লেগে থাকে কষ্টে কুঁকড়ে যাওয়া কিছু ককানি আর পানিতে তৈরি হওয়া কতক ছপছপ পদশব্দ।

৫.

বাড়ির ওঠানে একটা খাটিয়া সাদা কাপড়ে ঢাকা। সাদার রাজ্যে ঢাকা পড়েছে মাছ শিকারে দক্ষ দুটি হাত। শুধু মুখটুকু বের করে রাখা। নাকে তুলা। এলাকার লোক ভেঙে পড়েছে তুফাজ্জলের মুখটা একটাবার দেখার জন্য। তাদের কৌতূহল একজন মেছোভূতে পাওয়া মানুষের মুখ মৃত্যুর পর দেখতে কেমন হয়! তারা মৃতের মুখের আনাচ-কানাচ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। হয়তো তারা খুঁজে পেতে চেষ্টা করে এমন কিছু, যা সাধারণ মৃতের মুখের থেকে আলাদা কিছু হবে; হয়তো অনেকটা ভৌতিক ধরনের কিছু। কারণ, দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ হলোটে যায়, আর শতভাগ মানুষের সেই অভিজ্ঞতা আছে। হয়তো নিশ্চিত হতে চায়, হলোটে গিয়ে যদি তারা মারা যায়, তাহলে তাদের মুখ দেখতে কেমন হতে পারে।

ঘরের মেঝেতে পড়ে চিৎকার করে কাঁদছে হাওয়া। মেয়েটা মাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, যেন সে ভয় পাচ্ছে বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

হাওয়ার আহাজারিতে কেবল একটি কথা বারবার ঘুরেফিরে আসছে, আমি না করলাম, তুমি হুনলা না! আমি না করলাম, তুমি হুনলা না গো!

এলাকার মান্যজন আকিল মুন্সি, যিনি মাঝেসাঝে হলোটে যান, তিনি নিজের কৌতূহল ধরে রাখতে পারলেন না। সহসা জিজ্ঞেস করে বসলেন, সত্যি তুমি শুনছ, মরিয়মের মাও?

নিজ কানে হুনছি, হেরে ডাকতাছে। হেয়সহ আমি বাইরায়া দেহি কেউ নাই। খাঁ খাঁ! বিষ্টি ছাড়া কেউ নাই। আমি তহনই কইলাম তুমি আজকা যায়ো নাগো হলোটে, হেয় হুনল না; তুমি হুনলা না, তুমি হুনলা না গো!

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত ফ জ জল দ ত ফ জ জল র জ জল র ম ক র কর ক ত হল আশপ শ চ রজন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

হলোট

তুফাজ্জল মিয়া খেতের আল ভেঙে উপুড় হয়ে আশপাশে তাকায়। কেউ নেই...এই তটস্থ মাছ ধরা মানুষ হিসেবে নিজস্ব কৌশলগত কারণে সে চায় না কেউ দেখে ফেলুক এখানে তার দোয়ার পাতা হয়েছে। তাতে মাছ চুরি যাওয়ার ভয় আছে, থাকে দোয়ারটাই চুরি হওয়ার শঙ্কা। অবশ্য দোয়ার সরানো হলে সেই ফাঁকে অন্য কারও দোয়ার বসিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এমন বর্ষা মৌসুমে তুফাজ্জল নিজেই যেন জলজ প্রাণীতে পরিণত হয় মাছ বা ব্যাঙের মতো। মানুষ আর পানির অদ্ভুত সখ্য যে না দেখছে, সে বুঝবে না।

পানিপোকার মতো খেত থেকে অন্য খেতে, এক বিল থেকে অন্য বিলে ঘুরে বেড়ায়, আর তার সদাসতর্ক শিকারি চোখ তাকে সতর্ক করে। কাঁধে সব সময় দু–একটা দোয়ার তো থাকেই, উপযুক্ত জায়গা পেলেই হাতের কোদালে জায়গাটা একটু খোঁড়াখুঁড়ি করে দোয়ার পাতার উপযোগী করে তোলে। আলগোছে দোয়ার পেতে ওপরে খেতের জলাজঙ্গল, শালুকপাতা, পানা দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দেয়, যাতে সহসা কারও চোখে না পড়ে যে এখানে আদৌ মাছ ধরার কোনো ফাঁদ পাতা আছে। সাধারণত দোয়ার পাতা হয় এমন জায়গায়, যেখানে বিস্তৃত জায়গার পানি একটা স্রোত হয়ে নামতে থাকে। তেমনই এক জায়গা এই কালভার্টপাড়ের কড়ইতলা।

এখানে মানুষের আনাগোনা কম। ছোট্ট একটা চোরা স্রোত আছে। রাস্তার ওপাশ থেকে ছোট্ট কালভার্ট হয়ে নেমে এসেছে। দৃশ্যত শুকনা খেত। মানুষ ভাবতেই পারে না এখানে মাছ থাকতে পারে। ঝুম বৃষ্টি মাথায় করে তুফাজ্জল গভীর রাতে ছাতা মাথায়, মুখে ছোট একটা টর্চ কামড়ে মাঝারি সাইজের এই দোয়ার পেতে গিয়েছিল, তা–ও উল্টো করে।

মাছ ধরার কৌশলটা একটু অদ্ভুত। স্রোতের মধ্যে উল্টো করে দোয়ার পাতা, মাথা থেকে স্রোত নেমে যাওয়ার পথ করে দিতে হয়। সেটা গিয়ে শেষ হবে বেশি পানির খেতে। বেশি পানির মাছ এসে পড়বে ওই ড্রেনে। স্রোত ঠেলে আসা মাছেদের স্বভাব। স্বভাবতই ঝাঁক এসে হাজির হবে দোয়ারের সামনে, একটু দোদুল্যমান থাকবে, তারপর ফুড়ুৎ করে ঢুকে যাবে দোয়ারের মুখে পাতা ফাঁদের পেটের মধ্যে। হঠাৎ আটকে গিয়ে বেরোনোর জন্য ছটফট শুরু করবে। সদ্য ঢোকা মাছের ছটফটানির সঙ্গে আটকা পড়া আগের মাছগুলোও ছটফট শুরু করবে।

তুফাজ্জল দোয়ারটার দিকে ঝুঁকে পড়ে চারপাশ লক্ষ করার ফাঁকে ভেতরের অবস্থা বোঝার জন্য কান খাড়া করে। শুনতে চেষ্টা করে মাছদের ছটফটানি এবং সঙ্গে সঙ্গে পরিমাপ করার চেষ্টা করে কী পরিমাণ মাছ তাতে ধরা পড়ছে বা পড়েছে। তাতে কতটুকু আনন্দিত হওয়া যায়, আর করা যায় কতটা আশঙ্কা।

আশঙ্কাটা সাপের। মাছ মারা মানুষের জীবনে এই একটা উৎপাত। সংকটও বলা যায়। সারা রাত ধরে যে মাছ ঢুকল, ভোররাতে দেখা গেল সাত-আটটা সাপ ঢুকে সব সাবাড় করে ফেলেছে। তখন মেজাজ খিঁচড়ে যায়। ফলে সাপগুলোকে সাধারণত মারা হয় খুব নির্মমভাবে। তুফাজ্জল সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, সে সাপ মারার পক্ষে না। কখনো সে সাপ মারবে না, কিছুটা বকাঝকা করে ছেড়ে দেবে।

তুফাজ্জলের কথায়, সাপ যেইটা খাইছে সেইটা ওরই রিজিক। আমারটা হেয় খায় নাই। তারটাই হেয় খাইছে। বিষ নাই, আল্লার সৃষ্টি একটা প্রাণী রে আমি হুদাই ক্যান মারতে যামু। আমার ভালা লাগে না। মন সায় দেয় না।

কালভার্টপাড়ের কড়ইতলায় দোয়ারের কাছে কান পেতে ধরে তুফাজ্জলের মনে বর্ষার বিলের মতো আনন্দ উথলে ওঠে—যেখানে শাপলারা আলতো বাতাসে বৃষ্টির ছাঁট নিয়ে দোল খাচ্ছে, একটা আরেকটাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে, পানকৌড়ি ডুবে বেড়াচ্ছে। মাছ ধরা পড়েছে! বেশ ভালো মাছ! দোয়ারের পেট মাছে মাছে ভর্তি। বৃষ্টির এই ভোরে কোথাও কেউ নেই। সে কালো ছাতার কাঠের বাঁটটা কাঁধে গাল দিয়ে চেপে ধরে নিশ্চিন্ত মনে দোয়ারের ওপরের পানাপাতা সরায়। দুই ধার ধরে পানিতে নাড়া দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করে শূন্যে তুলে ধরে।

দোয়ারের ভেতরে মাছগুলো কিলবিল শুরু করে। পেছন দিকের দুয়ারটা খুলে দিয়ে খালুইয়ে উপুড় করে দেয়। শাঁই করে শূন্যে একটা গোঁত্তা মেরে খালুই মাছে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। খালুইয়ের ওপর তুফাজ্জল দোয়ার ঝাঁকায়। ভেতরের আনাচে–কানাচে আটকে থাকা দু–একটা দাড়িকানা, পুঁটি আর গুতুম টুপটুপ করে এসে পড়ে হোতকাপেটু খালুইয়ের গলা পর্যন্ত ভরে ওঠা মাছের সঙ্গে মিশে যায়।

পুরোটা সময় তুফাজ্জলের মুখের কোথাও কোনো অভিব্যক্তির রেখা ফুটে ওঠে না। তবে গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, ভরা বিলে গোঁত্তা মারা বোয়ালের মতো একটা আনন্দ তার চোখে খেলা করে।

২.

তুফাজ্জল মিয়া গ্রামের খেতমজুর মানুষ। মানুষের খেতে কাজমাজ করে উপার্জন করা তার পেশা। কিন্তু বৃষ্টির দিন এলে তার আর অন্য কোনো খেয়াল থাকে না। অবশ্য বর্ষা মৌসুমে খেতের কোনো কাজও থাকে না। আক্ষরিক অর্থেই সে শয়নে-স্বপনে মাছ দেখে দেখে, নিজেও যেন মাছ হয়ে যায়। পানি ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার হাত-পা সাদা হয়ে যায়। আঙুলের ফাঁকে সাদা ঘা। মেয়ে জিগাগাছের গোটা এনে দেয়। বউ শিল-পাটায় বেঁটে দিয়ে দেয় আঙুলের ফাঁকে। কিন্তু কিচ্ছুতে কিচ্ছুটি হয় না। হবেই–বা কীভাবে? রাতদিন যদি একটা মানুষ পানিতে কাটায়, তার ঘা ভালো হবে কীভাবে?

তুফাজ্জলের অত কিছু ভাবার সময় নেই। আজ রাতে সে যাবে জাগিরাচালা থেকে অনেক দূরে, মাছ শিকারে। এলাকার ভাষায় যাকে বলা হয়—হলোটে। সে একা যাবে না। জলাজঙ্গল ভেঙে অত দূরে একা যাওয়া যায় না। তা–ও আবার মাছ ধরতে। মাছের নেশায় পাওয়া একদল মানুষ তৈরি হয়ে আছে। মধুপুর জঙ্গলের দূরতম ভেতরকার সেই বিলে আজ তারা হলোটে যাবে। তুফাজ্জল তাদের একজন।

সন্ধ্যা থেকে তুমুল বৃষ্টি। আকাশ ভেঙে চরাচর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তুফাজ্জল চার ব্যাটারির স্টিলের ভারী টর্চ, খালুই, কাস্তে, লন্ঠন, বিড়ি, মেস একটা বাজারের ব্যাগে ঠিকঠাক করে ভরে রাখে। খেয়েদেয়ে ব্যাগটার জিনিসপত্তর আরেকবার চেক দিয়ে সন্ধ্যারাতেই শুয়ে পড়ে। মচমচে পুঁটি মাছ ভাজা আর মাষকলাই ডাল...অমৃত! কুড়মুড় করে কামড় দিয়ে মুচমুচ করে মুখময় ছড়িয়ে যায় কালচে করে ভাজা পুঁটি মাছের স্বাদ। ধনেপাতা দেওয়া ডাল মাখানো গরম ভাত মুখকে কেমন বিহ্বল করে দেয়—ঠোঁটের কষ দিয়ে সেই স্বাদকে ফ্রড়ড়ড় করে টেনে তাড়িয়ে তাড়িয়ে স্বাদ উপভোগ করে খাবার শেষ করে তুফাজ্জল।

টিনের চালে ঝুপঝুপ বৃষ্টি পড়ছে। ঘরে চেরাগ জ্বলছে। চেরাগের আলোয় গলা ছেড়ে ছড়া মুখস্থ করার চেষ্টা করার মধ্যেই তুফজ্জলের মেয়ে মরিয়ম কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েকে ঠিকমতো শুইয়ে দিয়ে হাওয়াও শুয়ে পড়ে। তুফাজ্জল আর মেয়ের মাঝখান দিয়ে।

মেয়েটা খাইল না? তুফাজ্জল জিজ্ঞেস করে।

দুপুরকার খাবার খাইছে বৈকালে। ডাকলাম, খাব না। আফনের মাইয়্যার যা ঘুম।

হুম, সব আমার মাইয়্যার দুষ। তর কোনো দুষই নাই রে। তুই খাওয়াইতে পারলি না, তা কবি না।

আফনে ত খালি আমার দুষটাই দেকবেন।

তর পুঁটি মাছ ভাজা দুনিয়ার সেরা।

পাম দিলেন?

আরে না। সত্যি।

কত অইল?

তিন হাজার দুই শ পুচ্চল্লিশ।

আর কত?

পাঁচ হাজার পুরা করণ লাগব। তয়লে না টগবগা একটা বাছুর কিনন যাব।

আরে হয়া যাব দেখিস। আজকা হলোটেই তো পাঁচ শ টেকার মাছ মারমু, দেখ না খালি।

সত্যি! হাওয়া যেন একটু বেশি কৌতূহলী হয়ে পড়ে। কৌতূহলের চোটে সে তুফাজ্জলের প্রায় বুকের ওপর ওঠে বসে।

কী রে ঢেমনি! কিসটা কী?

কিছু না, বলে হাওয়া তুফাজ্জলের গলায় কামড়ে ধরে। যেন সে পেতনি, তুফাজ্জলের সব রক্ত শুষে খাবে। তুফাজ্জল দক্ষ মাছশিকারির মতো হাওয়ার ঊরু চেপে ধরে উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠে, বোয়াল রে, বোয়াল!

পাশে ঘুমিয়ে থাকা মেয়ে মরিয়ম নড়েচড়ে ওঠে।

হাওয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে, রয়াসয়া। মাইয়া ঘুমায়।

৩.

গভীর রাত। তুফাজ্জল হুড়মুড় করে ওঠে বসে। তুফাজ্জলের নাড়া খেয়ে হাওয়াও।

কী হইল?

আইছে ওরা। ডাকতাছে। তুফাজ্জল দ্রুত হাতে জিনিসপত্র ভরা প্লাস্টিকের বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘরের দুয়ার খোলে। বাইরে এসে ডাক দেয়, কই তরা?

কেউ কোনো উত্তর দেয় না। আবার ডাক দেয়। এবারও কোনো উত্তর আসে না। কেবল টিনের চালে একটানা ঝমঝম বৃষ্টি পড়া ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই।

তুফাজ্জল এবার গলা ছেড়ে ডাক দেয়, কালু! কই তরা?

এবারও কোনো উত্তর আসে না। তয়লে আমারে ডাকল কে রে, হাওয়া। আমি নিজ কানে হুনলাম, আমার নাম ধইরা ডাকল।

কেরা হইতে পারে? কুপির আলোতে হাওয়ার মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেরা হইবার পারে? তয়লে কী...

কী? তুফাজ্জল হাসে, মাইছা ভূত! হাহাহাহা।

হাসেন ক্যান আফনে? হাওয়া বিস্ময়ে ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে।

আরে দল বাঁইধা যামু। দলের আগে-পাছে ওরা আহে না। দলরে ডরায় ওই সব। আহে একলা কাউরে পাইলে।

তুফাজ্জলের ব্যাখ্যা শুনেও হাওয়ার দুশ্চিন্তা যায় না। না, আফনে আজকা যায়েন না। আমার ক্যান জানি ভালা লাগতাছে না।

আরে কী কস! গরু কিনবি না? মাইয়া বড় হইতাছে, বিয়া দেওন লাগব না? টেকা পাবি কই? আর এত মানুষ একলগে গেলে কিছুই হইব না রে। ওই সবেরও তো ডরভয় আছে, তাই না?

এবার সত্যি সত্যি দরজার বাইরে থেকে ডাক পড়ে তুফাজ্জলের নামে। তুফাজ্জল কোনো কথা না বলে ব্যাগ হাতে বের হয়ে যায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হাওয়াকে একলা ঘরে ফেলে।

৪.

হলোটের দলটা যত বড় হওয়ার কথা ছিল, তত বড় হয়নি। চারজনের দল। দশ-বারোজনের জায়গায় এসেছে মোটে চারজন। চারটা ছাতা ঠোকাঠুটি করে প্রবল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্যাক-কাদার মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। দুই দিকে অন্ধকার বন।

কালু, মুজাম্মেইল্যা আইল না?

একে তো বৃষ্টির রাইত, তার মইধ্যে বউর ওম—ওই কি হেই বেডামানুষ কইতে চাস যে এই রাইতে ঘর ছাইড়া ওয়ে হলোটে যাইব।

কালুর কথা শুনে সবাই একযোগে হেসে ওঠে। সম্মিলিত হাসির ধ্বনি বনভূমিতে প্রতিধ্বনি তুলে বৃষ্টিময় অন্ধকারকে আরও প্রগাঢ় করে তোলে। চারটা ছাতা ঠোকাঠুকি করে এগিয়ে যায়। যেন এদের আলাদা করে কোনো অস্তিত্ব নেই—এতটা লেগে লেগে চলে তারা। অথচ বিলে যখন নামবে, আর মাছের নেশা তাদের পেয়ে বসবে, কে কোন দিকে চলে যাবে, তার কোনো খোঁজই থাকবে না।

কেউ লোভে পইড়া বেশি পানিতে যাবি না। মজনু খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্য তিনজন তার বয়ান আর এগোতে দেয় না। হাসিতে ফেটে পড়ে। এ হাসি স্বতঃস্ফূর্ত না চেষ্টাকৃত, সে বিবেচনায় না গেলেও তারা হাসে, কারণ তাদের হাসতে হয়। এ যেন হাসি নয়, সাহস; অমঙ্গল তাড়ানো কোনো মন্ত্র।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, পায়ে লাল মাটির জট নিয়ে চারজনের ছোট্ট দল এসে দাঁড়ায় বিলের পাড়ে। আশপাশে সাত-আট গাঁওসমান এলাকাজুড়ে কোনো বাড়ি নেই। বনের মধ্যকার এই বিলের পাড় দিয়ে তৈরি হওয়া ধানি জমিতে মানুষ কেবল আসে আবাদের মৌসুমে। ফসল চাষ করে নিয়ে চলে যায়। এর বাইরে এদিকটায় সাধারণত মানুষের তেমন আনাগোনা নেই। এখন তো আরও না। পানিতে বিল ভরে খেতগুলোও থইথই করছে। কেউ এলে দল বেঁধে আসে, তা–ও ওই মাছ ধরতে। তথাপি এমন রাতে বৃষ্টি মাথায় করে বনের মধ্যে এসে মাছ শিকার করার মতো পাগলও যে খুব বেশি আছে, তা–ও না। কে আসবে? বৃষ্টি আর কাদার সাগর ভেঙে বনজঙ্গল পাড়ি দিয়ে এই বিলে!

তুফাজ্জল তো আবাদের সময়ও আসে না এদিকে। নিজের কোনো খেত নেই। অন্যের জমিতে খেটে খাওয়া মানুষ সে। আশপাশের জমিতেই যদি কাজ হয়ে যায়, তাহলে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে কে আসে? ফলে তুফাজ্জলের এদিকে আসা পড়ে না। তার আজকের এ আগমন দুর্লভ ঘটনাই বটে যে একটা চারজনের দলে সে, মানে তুফজ্জল আলীও আছে। বড় কথা হচ্ছে, সে দল বেঁধে মাছ মারতে ভালোবাসে না। কিন্তু আজকের তাল ভিন্ন। এখানে অন্য রকম একটা হিসাব আছে। তার টাকার দরকার, দরকার অনেক মাছেরও। সেই তাড়না এই বৃষ্টির রাতে তাকে বনের মধ্যকার এই বিলে এনে ফেলেছে। সঙ্গে হলোটের মাছের নেশা তো আছেই।

তুফাজ্জল ছাতাটার অগ্রভাগ বিলের ধারে গেঁথে দাঁড় করিয়ে তার ওপর ব্যাগটা রেখে লন্ঠনটা জ্বালিয়ে দেয়। অর্থাৎ তার যাত্রাটা এখান থেকে শুরু, আবার এখানে এসে থামবে। কত কত যাত্রাই তো এভাবে সুপরিকল্পিতভাবে শুরু হয়, সব যাত্রাই কি আর পরিকল্পনামাফিক এগাোয়? এগোয় না এবং ইচ্ছেমতো শেষও হয় না। কারণ, যাত্রার নিজস্ব একটা গতি আছে; শুরু হলে তা নিজের মতো এগিয়ে এবং নিজের মতো করে শেষ হতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

খালুইটা কোমরে নাইলন সুতা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে তুফাজ্জল পানিতে নেমে যায়। ডান হাতে কাস্তে, বাঁ হাতে টর্চটা জ্বালিয়ে তার অভিব্যক্তিহীন মুখটা কঠিন করে বিলের মধ্যে এগোতে থাকে। পানিতে যতটা কম শব্দ করা যায়, যত কম ঢেউ ওঠে ততই ভালো—এভাবে সন্তর্পণে এগিয়ে যাওয়ার নাম হলোট। তার মতো সূক্ষ্মভাবে এ কাজ আর কেউ পারে না। সে এমনভাবে পা ফেলবে পানিও তা টের পাবে না। এক হাতে তার কাস্তে উদ্ধত, অপর হাতে টর্চ ধরা; চোখ তীব্র চৌকস হয়ে টর্চের আলো যেখানে পড়েছে, সেখানটা ভেদ করে মাটির কাছে পৌঁছে যেতে চায়।

‘ছপ্’ একটা শব্দ। ডোরাকাটা পুরুষ্টু টাকি মাছটার কানকোর কাছে গিয়ে কাস্তের কোপটা লাগে। মাছটা একটা ঘাই মেরে মাটিতে গোঁত্তা খেয়ে পানির ওপর ভেসে ওঠে। লুফে নিয়ে খালুইয়ের হোতকাপেটে চালান করে দেয়। এভাবে একের পর এক মাছ শিকার চলতে থাকে তুফাজ্জলের।

একসময় মনে হয় কিছুটা সামনে একটা মাছ খুব খলবল করছে। এগিয়ে যায়। কিন্তু কিছু দেখতে পাওয়া যায় না। মনে হয় আরেকটু সামনে হচ্ছে খলবল শব্দটা। টর্চ ধরে। দেখা যায় খুব পানি ছিটছে তুফাজ্জল যেখানটায় দাঁড়িয়ে তার থেকে আরও কিছুটা সামনে। সে সেদিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সে যতই সামনে যাচ্ছে, ততই পানির ছিটা বেড়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে পানির গভীরতা তার কাছা দেওয়া ঊরুর কাছে চলে আসে। সংবিৎ ফিরে পেয়ে সে আশপাশে তাকায়। দেখে অনেক দূরে দূরে ছড়ানো তিনটা আলোর বৃত্ত—কোনোটা থির হয়ে আছে, কোনোটাবা অস্থির হয়ে উঠছে।

এবার সে খলবলটা একপাশে শুনতে পায়। একবার ভাবে থাক, অত লোভ ভালো না। পরক্ষণে সে নিজের লোভকে সামলাতে ব্যর্থ হয়। বাঁ দিকের ওই শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে যায়। টর্চের আলোয় ছলকে ওঠে মাছের বড়সড় একটা সাদা পেট। ত্বরিত গতিতে তার কাস্তে ধরা হাত সেদিকে এগিয়ে যায়, যেন স্বয়ংক্রিয়। যেতে যেতে তার মনে হতে থাকে এটা হয়তো ঠিক হচ্ছে না। মনে হয়, মাছটার সাদা পেটের ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে ধূসর কাছির মতো কিছু একটা—গায়ে তার বাদামি ছোপ।

ততক্ষণে তুফাজ্জলের দেরি হয়ে গেছে। তার মাসল মেমোরির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে দেরি করে ফেলেছে তার মস্তিষ্কজাত বিবেচনা। মাছটাকে পেঁচিয়ে রাখা সাপটা কাস্তে এগিয়ে আসতে দেখে আত্মরক্ষার তাগিদে সর্পীয় প্রাচীন ঐতিহ্য মোতাবেক তুফাজ্জলের কবজিতে ছোবল বসিয়ে দেয় এবং মাছটাকে নিজের কবজা থেকে ছেড়ে আক্রমণাত্মক হাত পেঁচিয়ে ধরে।

তুফাজ্জলের গগনবিদারী চিৎকারে বনের মধ্যকার জলে টইটম্বুর বিল হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেই জমাট বরফে রূপ নেয়। সেখানে লেগে থাকে কষ্টে কুঁকড়ে যাওয়া কিছু ককানি আর পানিতে তৈরি হওয়া কতক ছপছপ পদশব্দ।

৫.

বাড়ির ওঠানে একটা খাটিয়া সাদা কাপড়ে ঢাকা। সাদার রাজ্যে ঢাকা পড়েছে মাছ শিকারে দক্ষ দুটি হাত। শুধু মুখটুকু বের করে রাখা। নাকে তুলা। এলাকার লোক ভেঙে পড়েছে তুফাজ্জলের মুখটা একটাবার দেখার জন্য। তাদের কৌতূহল একজন মেছোভূতে পাওয়া মানুষের মুখ মৃত্যুর পর দেখতে কেমন হয়! তারা মৃতের মুখের আনাচ-কানাচ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। হয়তো তারা খুঁজে পেতে চেষ্টা করে এমন কিছু, যা সাধারণ মৃতের মুখের থেকে আলাদা কিছু হবে; হয়তো অনেকটা ভৌতিক ধরনের কিছু। কারণ, দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ হলোটে যায়, আর শতভাগ মানুষের সেই অভিজ্ঞতা আছে। হয়তো নিশ্চিত হতে চায়, হলোটে গিয়ে যদি তারা মারা যায়, তাহলে তাদের মুখ দেখতে কেমন হতে পারে।

ঘরের মেঝেতে পড়ে চিৎকার করে কাঁদছে হাওয়া। মেয়েটা মাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, যেন সে ভয় পাচ্ছে বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

হাওয়ার আহাজারিতে কেবল একটি কথা বারবার ঘুরেফিরে আসছে, আমি না করলাম, তুমি হুনলা না! আমি না করলাম, তুমি হুনলা না গো!

এলাকার মান্যজন আকিল মুন্সি, যিনি মাঝেসাঝে হলোটে যান, তিনি নিজের কৌতূহল ধরে রাখতে পারলেন না। সহসা জিজ্ঞেস করে বসলেন, সত্যি তুমি শুনছ, মরিয়মের মাও?

নিজ কানে হুনছি, হেরে ডাকতাছে। হেয়সহ আমি বাইরায়া দেহি কেউ নাই। খাঁ খাঁ! বিষ্টি ছাড়া কেউ নাই। আমি তহনই কইলাম তুমি আজকা যায়ো নাগো হলোটে, হেয় হুনল না; তুমি হুনলা না, তুমি হুনলা না গো!

সম্পর্কিত নিবন্ধ