ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত জুনে স্বীকার করেছিলেন, তাঁর দেশ হামাসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে গাজার পপুলার ফোর্সেস মিলিশিয়াকে অস্ত্র ও সমর্থন দিচ্ছে।

টুইটারে পোস্ট করা একটি ছোট ভিডিওতে নেতানিয়াহু বলেন, ‘এতে কী সমস্যা? এটা শুধু ইসরায়েলি সেনাদের জীবন রক্ষায় কাজে লাগছে।’

যদিও পপুলার ফোর্সেস বলতে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি নেতানিয়াহু। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল এই মিলিশিয়া ও তাদের নেতা ইয়াসির আবু শাবাবকে সমর্থন করছে, যেন গাজায় জাতিগত নির্মূল অভিযানের পেছনে একটি ফিলিস্তিনি চেহারা দেখিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করা যায়।

৩১ বছর বয়সী আবু শাবাব গাজার তারাবিন বেদুইন গোত্রের একজন সদস্য। তাঁর নাম গাজা যুদ্ধের আগে তেমন একটা শোনা যায়নি। মাদকসংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে ২০১৫ সাল থেকে তিনি কারাবন্দী ছিলেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজায় আক্রমণ শুরু করলে যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি কারাগার থেকে পালিয়ে যান।

মিসরের সিনাই অঞ্চল হয়ে গাজায় মাদক পাচার করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, আইএসআইএলের (আইএসআইএস) সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠী গাজায় মাদক পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করে। অনেকের বিশ্বাস, আইএসআইএলের সঙ্গে আবু শাবাবের সম্পর্ক রয়েছে।

কিন্তু আবু শাবাবের আইএসআইএল–সংশ্লিষ্টতার বিষয়কে ইসরায়েল আমলে নেয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল বরং তাঁকে গাজায় জাতিগত নির্মূল পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে ব্যবহার করছে।

আবু শাবাবের উত্থান

প্রায় ১০০ যোদ্ধা নিয়ে পপুলার ফোর্সেস নামে একটি মিলিশিয়া গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন আবু শাবাব। ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ভিজিটিং ফেলো মুহাম্মদ শেহাদা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়েই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়েছিলেন আবু শাবাব।

মিসরের সিনাই অঞ্চল হয়ে গাজায় মাদক পাচার করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, আইএসআইএলের (আইএসআইএস) সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠী গাজায় মাদক পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করে। অনেকের বিশ্বাস, আইএসআইএলের সঙ্গে আবু শাবাবের সম্পর্ক রয়েছে।

তা সত্ত্বেও বিভিন্ন ভাষায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবু শাবাবের উপস্থিতি সরব ও সংগঠিত। সম্প্রতি তিনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। সেখানে দাবি করেছেন, গাজার ফিলিস্তিনিরা আর হামাসকে চান না।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সম্ভবত গাজার বাইরে আবু শাবাবকে ঘষেমেজে তৈরি করে সংবাদমাধ্যমের সামনে পরিশীলিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

শেহাদা বলেন, ‘গত এক দশকে সমাজের সঙ্গে আবু শাবাবের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি পরিচিত কেউ ছিলেন না। তিনি মূলত অন্যদের সামনে উপস্থাপন করা একজন মুখপাত্র।’

‘এক মাস পর (গত বছর জুলাই) তাঁর গ্যাং প্রকাশ্যে আসে এবং গাজায় প্রবেশ করা খাদ্য ও ত্রাণসহায়তার বিপুল অংশ পরিকল্পিতভাবে লুট করা প্রধান গ্যাংয়ে পরিণত হয়।মুহাম্মদ শেহাদা, ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ভিজিটিং ফেলো

নিজের গোত্র তারাবিন পর্যন্ত গাজায় আবু শাবাবের আজকের ভূমিকা সমর্থন করে না। এটি প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে আবু শাবাবকে পরিত্যাগ ও ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ ধরনের প্রকাশ্য বিবৃতি দেওয়ার ঘটনা খুব বিরল।

গাজার দক্ষিণের শহর রাফায় ইসরায়েলের আক্রমণের পর গত বছরের মে মাসের শেষ দিক থেকে আবু শাবাবের নাম ছড়াতে শুরু করে।

শেহাদা বলেন, ‘এক মাস পর আবু শাবাবের গ্যাং প্রকাশ্যে আসে এবং গাজায় প্রবেশ করা খাদ্য ও ত্রাণসহায়তার বিপুল অংশ পরিকল্পিতভাবে লুট করা প্রধান গ্যাংয়ে পরিণত হয়।’

জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজায় প্রবেশ করা প্রতি ১০ ট্রাকের মধ্যে প্রায় ৯টিই লুট করা হয়েছে।

শুরুতে ইসরায়েল এ লুটের জন্য হামাসকে দায়ী করেছিল। কিন্তু মানবিক সহায়তাদানকারী সংস্থাগুলো সে দাবি খণ্ডন করে। এমনকি ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের দাবির পক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।

আন্তর্জাতিক সহায়তাকর্মীরা বলেছেন, পরিকল্পিতভাবে ত্রাণ লুটের পেছনে রয়েছেন আবু শাবাব ও তাঁর দল।

বরং আন্তর্জাতিক সহায়তাকর্মীরা বলেছেন, পরিকল্পিতভাবে ত্রাণ লুটের পেছনে রয়েছেন আবু শাবাব ও তাঁর দল।

ওয়াশিংটন পোস্টের হাতে পাওয়া জাতিসংঘের একটি অভ্যন্তরীণ নথিতে আবু শাবাবকে গাজায় ‘পরিকল্পিত ও ব্যাপক লুটপাটের পেছনে প্রধান ও সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি’ হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এ বছরের শুরুর দিকে গাজায় যে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি হয়েছিল সে সময়ে আবু শাবাব নিখোঁজ হন। মার্চে ইসরায়েল একতরফাভাবে ওই যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেয়। মে মাসের মাঝামাঝি আবার প্রকাশ্যে আসেন আবু শাবাব। বিশেষ করে ওই সময়ে তীব্র আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরায়েল যখন গাজায় সামান্য পরিমাণ ত্রাণ ঢুকতে দেওয়া শুরু করে।

শেহাদা বলেন, ‘আক্ষরিক অর্থে (যেদিন থেকে ত্রাণ প্রবেশ শুরু হয়) ঠিক সেদিনই আবু শাবার হঠাৎ আবার প্রকাশ্যে আসেন। তিনি ইসরায়েলের অনাহারে রাখার অভিযানের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। একই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলকে এ ব্যাপারে (ত্রাণ লুটপাট) পুরোপুরি দায়মুক্তির সুযোগ দিচ্ছেন এবং ইসরায়েল অন্য কাউকে দিয়ে সহজে নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছে।’

জাতিগত নির্মূল অভিযানে সহায়তা করা এক ফিলিস্তিনি মুখ

বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে তাঁদের জন্য নির্ধারিত ত্রাণ লুট করাই নয়, বরং আবু শাবাব ও তাঁর মিলিশিয়া দল গাজায় ইসরায়েলের জাতিগত নির্মূল অভিযানের বিস্তৃত পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও অবদান রাখছে।

ইসরায়েল বর্তমানে আবু শাবাবের সঙ্গে সম্পর্কিত মিলিশিয়া দলগুলোকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। দেশটি আশা করছে, মিলিশিয়া দলগুলো ব্যবহার করে তারা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এলাকা আরও বাড়াবে এবং ওই মিলিশিয়া সেসব এলাকা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে।তারিক কেনি শাওয়া, মার্কিন নীতি ফেলো

চলতি বছর আবু শাবাব ও তাঁর দল এ ভূমিকা পালনে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
আল-শাবাকা নামে একটি ফিলিস্তিনি নীতি নেটওয়ার্কের মার্কিন নীতি ফেলো তারিক কেনি শাওয়া বলেন, ‘ইসরায়েল বর্তমানে আবু শাবাবের সঙ্গে সম্পর্কিত মিলিশিয়া দলগুলো শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। দেশটি আশা করছে, তাদের ব্যবহার করে তারা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এলাকা আরও বাড়াবে এবং ওই মিলিশিয়ারাই সেসব এলাকা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। এভাবে ইসরায়েল নিজেদের ওপর থেকে এলাকা দখলে রাখার বোঝা কমাতে চায় এবং একই সঙ্গে জাতিগত নির্মূল অভিযান সহজতর করতে চায়।’

গত মাসের শুরুতে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাত্জ ছয় লাখ ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণ গাজায় একটি অস্থায়ী শিবিরে সরে যাওয়ার এক পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। তিনি ওই পরিকল্পনাকে ‘স্বেচ্ছায় অভিবাসন’ বলে উল্লেখ করেন।

কাৎজের এ পরিকল্পনা সে সময়ে ইসরায়েলি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। বিভিন্ন মানবিক সংগঠন থেকেও ওই পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।

আবু শাবাবের মিলিশিয়া দল দক্ষিণ গাজায় এমন সব স্থাপনা তৈরি করছে, যেগুলো বিশ্লেষকেরা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বলে উল্লেখ করছেন। ক্যাম্পগুলো তৈরির লক্ষ্য সেখানে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেওয়া এবং সেখান থেকে পাঁচ লাখের বেশি মানুষকে তৃতীয় কোনো দেশে স্থানান্তর করা।

মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের ফেলো ওমর রাহমান বলেন, ‘এসব ক্যাম্প তৈরির উদ্দেশ্য হলো, ফিলিস্তিনিদের সেখানে রাখা; যতক্ষণ না ফিলিস্তিনিদের গাজার বাইরে পাঠানোর সুযোগ আসে। সেটা হতে পারে মিসর বা কোনো তৃতীয় দেশ।’

ফিলিস্তিনিদের ছোট ছোট শিবিরে ঠাসাঠাসি করে রাখা এবং পরে সীমান্ত পার করে মিসরে পাঠানোর পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিকভাবে গুরুতর প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

এরই মধ্যে মিসর ফিলিস্তিনিদের সে দেশে স্থানান্তরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।

শেহাদা আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইসরায়েল বুঝতে পেরেছে, যদি (ইসরায়েলি বাহিনী) রাফায় একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প পরিচালনা করে, সেটা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই তারা তাদের এ অভিযানে এমন একটি মুখ বেছে নেবে যিনি একজন ফিলিস্তিনি, ফিলিস্তিনিদের মতো পোশাক পরবেন, ফিলিস্তিনি পতাকা বহন করবেন ও আরবি ভাষায় কথা বলবেন।’

গত মাসের শুরুতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাত্জ ৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণ গাজায় একটি অস্থায়ী শিবিরে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।

এসব তৎপরতার পাশাপাশি আবু শাবাব ফেসবুকে দুটি অত্যন্ত কার্যকর প্রচারণা চালাচ্ছেন। এ প্রচারণা দীর্ঘ যুদ্ধে হতাশ গাজার বাসিন্দাদের তাঁর শিবিরে আশ্রয় নিতে প্রলুব্ধ করতে পারে। বিশেষ করে ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনিদের সেখানে জোর করে ঠেলে পাঠাতে শুরু করে।

কেনি শাওয়া বলেন, আবু শাবাবের মিলিশিয়ারা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় ছোট ছোট কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প চালাচ্ছেন এবং সেগুলো মানুষের জন্য ‘নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ হিসেবে প্রচার করছেন, যেখানে তাঁরা সহায়তা পেতে ও তাঁবু স্থাপন করতে পারেন।

আরও পড়ুনগাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরায়েলের হামলায় ৭০ জনের বেশি নিহত৩১ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনগাজায় একটি প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে: জাতিসংঘ১২ আগস্ট ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ইসর য় ল ব ইসর য় ল র প রক শ য দ র মত ল ট কর প রব শ শ ব বক য় একট

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় জাতিগত নির্মূল অভিযানে ইসরায়েল কি উপজাতীয় যোদ্ধাদের ব্যবহার করছে

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত জুনে স্বীকার করেছিলেন, তাঁর দেশ হামাসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে গাজার পপুলার ফোর্সেস মিলিশিয়াকে অস্ত্র ও সমর্থন দিচ্ছে।

টুইটারে পোস্ট করা একটি ছোট ভিডিওতে নেতানিয়াহু বলেন, ‘এতে কী সমস্যা? এটা শুধু ইসরায়েলি সেনাদের জীবন রক্ষায় কাজে লাগছে।’

যদিও পপুলার ফোর্সেস বলতে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি নেতানিয়াহু। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল এই মিলিশিয়া ও তাদের নেতা ইয়াসির আবু শাবাবকে সমর্থন করছে, যেন গাজায় জাতিগত নির্মূল অভিযানের পেছনে একটি ফিলিস্তিনি চেহারা দেখিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করা যায়।

৩১ বছর বয়সী আবু শাবাব গাজার তারাবিন বেদুইন গোত্রের একজন সদস্য। তাঁর নাম গাজা যুদ্ধের আগে তেমন একটা শোনা যায়নি। মাদকসংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে ২০১৫ সাল থেকে তিনি কারাবন্দী ছিলেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজায় আক্রমণ শুরু করলে যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তিনি কারাগার থেকে পালিয়ে যান।

মিসরের সিনাই অঞ্চল হয়ে গাজায় মাদক পাচার করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, আইএসআইএলের (আইএসআইএস) সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠী গাজায় মাদক পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করে। অনেকের বিশ্বাস, আইএসআইএলের সঙ্গে আবু শাবাবের সম্পর্ক রয়েছে।

কিন্তু আবু শাবাবের আইএসআইএল–সংশ্লিষ্টতার বিষয়কে ইসরায়েল আমলে নেয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল বরং তাঁকে গাজায় জাতিগত নির্মূল পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে ব্যবহার করছে।

আবু শাবাবের উত্থান

প্রায় ১০০ যোদ্ধা নিয়ে পপুলার ফোর্সেস নামে একটি মিলিশিয়া গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন আবু শাবাব। ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ভিজিটিং ফেলো মুহাম্মদ শেহাদা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়েই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়েছিলেন আবু শাবাব।

মিসরের সিনাই অঞ্চল হয়ে গাজায় মাদক পাচার করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, আইএসআইএলের (আইএসআইএস) সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠী গাজায় মাদক পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করে। অনেকের বিশ্বাস, আইএসআইএলের সঙ্গে আবু শাবাবের সম্পর্ক রয়েছে।

তা সত্ত্বেও বিভিন্ন ভাষায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবু শাবাবের উপস্থিতি সরব ও সংগঠিত। সম্প্রতি তিনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। সেখানে দাবি করেছেন, গাজার ফিলিস্তিনিরা আর হামাসকে চান না।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সম্ভবত গাজার বাইরে আবু শাবাবকে ঘষেমেজে তৈরি করে সংবাদমাধ্যমের সামনে পরিশীলিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

শেহাদা বলেন, ‘গত এক দশকে সমাজের সঙ্গে আবু শাবাবের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি পরিচিত কেউ ছিলেন না। তিনি মূলত অন্যদের সামনে উপস্থাপন করা একজন মুখপাত্র।’

‘এক মাস পর (গত বছর জুলাই) তাঁর গ্যাং প্রকাশ্যে আসে এবং গাজায় প্রবেশ করা খাদ্য ও ত্রাণসহায়তার বিপুল অংশ পরিকল্পিতভাবে লুট করা প্রধান গ্যাংয়ে পরিণত হয়।মুহাম্মদ শেহাদা, ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ভিজিটিং ফেলো

নিজের গোত্র তারাবিন পর্যন্ত গাজায় আবু শাবাবের আজকের ভূমিকা সমর্থন করে না। এটি প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে আবু শাবাবকে পরিত্যাগ ও ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ ধরনের প্রকাশ্য বিবৃতি দেওয়ার ঘটনা খুব বিরল।

গাজার দক্ষিণের শহর রাফায় ইসরায়েলের আক্রমণের পর গত বছরের মে মাসের শেষ দিক থেকে আবু শাবাবের নাম ছড়াতে শুরু করে।

শেহাদা বলেন, ‘এক মাস পর আবু শাবাবের গ্যাং প্রকাশ্যে আসে এবং গাজায় প্রবেশ করা খাদ্য ও ত্রাণসহায়তার বিপুল অংশ পরিকল্পিতভাবে লুট করা প্রধান গ্যাংয়ে পরিণত হয়।’

জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজায় প্রবেশ করা প্রতি ১০ ট্রাকের মধ্যে প্রায় ৯টিই লুট করা হয়েছে।

শুরুতে ইসরায়েল এ লুটের জন্য হামাসকে দায়ী করেছিল। কিন্তু মানবিক সহায়তাদানকারী সংস্থাগুলো সে দাবি খণ্ডন করে। এমনকি ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের দাবির পক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।

আন্তর্জাতিক সহায়তাকর্মীরা বলেছেন, পরিকল্পিতভাবে ত্রাণ লুটের পেছনে রয়েছেন আবু শাবাব ও তাঁর দল।

বরং আন্তর্জাতিক সহায়তাকর্মীরা বলেছেন, পরিকল্পিতভাবে ত্রাণ লুটের পেছনে রয়েছেন আবু শাবাব ও তাঁর দল।

ওয়াশিংটন পোস্টের হাতে পাওয়া জাতিসংঘের একটি অভ্যন্তরীণ নথিতে আবু শাবাবকে গাজায় ‘পরিকল্পিত ও ব্যাপক লুটপাটের পেছনে প্রধান ও সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি’ হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এ বছরের শুরুর দিকে গাজায় যে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি হয়েছিল সে সময়ে আবু শাবাব নিখোঁজ হন। মার্চে ইসরায়েল একতরফাভাবে ওই যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেয়। মে মাসের মাঝামাঝি আবার প্রকাশ্যে আসেন আবু শাবাব। বিশেষ করে ওই সময়ে তীব্র আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরায়েল যখন গাজায় সামান্য পরিমাণ ত্রাণ ঢুকতে দেওয়া শুরু করে।

শেহাদা বলেন, ‘আক্ষরিক অর্থে (যেদিন থেকে ত্রাণ প্রবেশ শুরু হয়) ঠিক সেদিনই আবু শাবার হঠাৎ আবার প্রকাশ্যে আসেন। তিনি ইসরায়েলের অনাহারে রাখার অভিযানের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। একই সঙ্গে তিনি ইসরায়েলকে এ ব্যাপারে (ত্রাণ লুটপাট) পুরোপুরি দায়মুক্তির সুযোগ দিচ্ছেন এবং ইসরায়েল অন্য কাউকে দিয়ে সহজে নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছে।’

জাতিগত নির্মূল অভিযানে সহায়তা করা এক ফিলিস্তিনি মুখ

বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে তাঁদের জন্য নির্ধারিত ত্রাণ লুট করাই নয়, বরং আবু শাবাব ও তাঁর মিলিশিয়া দল গাজায় ইসরায়েলের জাতিগত নির্মূল অভিযানের বিস্তৃত পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও অবদান রাখছে।

ইসরায়েল বর্তমানে আবু শাবাবের সঙ্গে সম্পর্কিত মিলিশিয়া দলগুলোকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। দেশটি আশা করছে, মিলিশিয়া দলগুলো ব্যবহার করে তারা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এলাকা আরও বাড়াবে এবং ওই মিলিশিয়া সেসব এলাকা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে।তারিক কেনি শাওয়া, মার্কিন নীতি ফেলো

চলতি বছর আবু শাবাব ও তাঁর দল এ ভূমিকা পালনে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
আল-শাবাকা নামে একটি ফিলিস্তিনি নীতি নেটওয়ার্কের মার্কিন নীতি ফেলো তারিক কেনি শাওয়া বলেন, ‘ইসরায়েল বর্তমানে আবু শাবাবের সঙ্গে সম্পর্কিত মিলিশিয়া দলগুলো শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। দেশটি আশা করছে, তাদের ব্যবহার করে তারা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এলাকা আরও বাড়াবে এবং ওই মিলিশিয়ারাই সেসব এলাকা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। এভাবে ইসরায়েল নিজেদের ওপর থেকে এলাকা দখলে রাখার বোঝা কমাতে চায় এবং একই সঙ্গে জাতিগত নির্মূল অভিযান সহজতর করতে চায়।’

গত মাসের শুরুতে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাত্জ ছয় লাখ ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণ গাজায় একটি অস্থায়ী শিবিরে সরে যাওয়ার এক পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। তিনি ওই পরিকল্পনাকে ‘স্বেচ্ছায় অভিবাসন’ বলে উল্লেখ করেন।

কাৎজের এ পরিকল্পনা সে সময়ে ইসরায়েলি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। বিভিন্ন মানবিক সংগঠন থেকেও ওই পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।

আবু শাবাবের মিলিশিয়া দল দক্ষিণ গাজায় এমন সব স্থাপনা তৈরি করছে, যেগুলো বিশ্লেষকেরা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বলে উল্লেখ করছেন। ক্যাম্পগুলো তৈরির লক্ষ্য সেখানে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেওয়া এবং সেখান থেকে পাঁচ লাখের বেশি মানুষকে তৃতীয় কোনো দেশে স্থানান্তর করা।

মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের ফেলো ওমর রাহমান বলেন, ‘এসব ক্যাম্প তৈরির উদ্দেশ্য হলো, ফিলিস্তিনিদের সেখানে রাখা; যতক্ষণ না ফিলিস্তিনিদের গাজার বাইরে পাঠানোর সুযোগ আসে। সেটা হতে পারে মিসর বা কোনো তৃতীয় দেশ।’

ফিলিস্তিনিদের ছোট ছোট শিবিরে ঠাসাঠাসি করে রাখা এবং পরে সীমান্ত পার করে মিসরে পাঠানোর পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিকভাবে গুরুতর প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

এরই মধ্যে মিসর ফিলিস্তিনিদের সে দেশে স্থানান্তরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।

শেহাদা আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইসরায়েল বুঝতে পেরেছে, যদি (ইসরায়েলি বাহিনী) রাফায় একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প পরিচালনা করে, সেটা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই তারা তাদের এ অভিযানে এমন একটি মুখ বেছে নেবে যিনি একজন ফিলিস্তিনি, ফিলিস্তিনিদের মতো পোশাক পরবেন, ফিলিস্তিনি পতাকা বহন করবেন ও আরবি ভাষায় কথা বলবেন।’

গত মাসের শুরুতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাত্জ ৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণ গাজায় একটি অস্থায়ী শিবিরে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।

এসব তৎপরতার পাশাপাশি আবু শাবাব ফেসবুকে দুটি অত্যন্ত কার্যকর প্রচারণা চালাচ্ছেন। এ প্রচারণা দীর্ঘ যুদ্ধে হতাশ গাজার বাসিন্দাদের তাঁর শিবিরে আশ্রয় নিতে প্রলুব্ধ করতে পারে। বিশেষ করে ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনিদের সেখানে জোর করে ঠেলে পাঠাতে শুরু করে।

কেনি শাওয়া বলেন, আবু শাবাবের মিলিশিয়ারা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় ছোট ছোট কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প চালাচ্ছেন এবং সেগুলো মানুষের জন্য ‘নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ হিসেবে প্রচার করছেন, যেখানে তাঁরা সহায়তা পেতে ও তাঁবু স্থাপন করতে পারেন।

আরও পড়ুনগাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরায়েলের হামলায় ৭০ জনের বেশি নিহত৩১ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনগাজায় একটি প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে: জাতিসংঘ১২ আগস্ট ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ