প্রতিদিন হাসপাতালে বসে আমি একধরনের পরিবর্তন খুব স্পষ্টভাবে দেখি। অনেক নারী ৩৫–৪০ বছর বয়স পার করে প্রথমবার গর্ভধারণের চেষ্টা করছেন। তাঁরা জীবনের নানা ক্ষেত্র গুছিয়ে নিয়ে, ক্যারিয়ারে স্থিতি আনার পর মাতৃত্বের কথা ভাবছেন।

শহরাঞ্চলে এটি এখন প্রায় স্বাভাবিক দৃশ্য। কিন্তু এর আড়ালে আছে এমন কিছু জটিল বাস্তবতা। যেগুলো অনেকেই বিবেচনায় আনেন না। আর সেই অদৃশ্য ঝুঁকিগুলোই পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নারীর প্রজনন ক্ষমতা সর্বোচ্চ থাকে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সে। এই সময়ে ডিম্বাণু সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর থাকে এবং সংখ্যাও যথেষ্ট থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণের সম্ভাবনাও বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণমান ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে।

আর ৩৫ পার হলে এই পতন অনেক দ্রুত হয়। তখন গর্ভপাত, গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, প্লাসেন্টার জটিলতা, এমনকি সিজারিয়ানের ঝুঁকিও অনেক বেড়ে যায়।

আরও পড়ুনডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে প্রতারণা এড়াতে ১০টি পরামর্শ১ ঘণ্টা আগে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ক এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, নারীর প্রজনন ক্ষমতা বয়সের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

প্রতি মাসে একজন নারীর স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।

৪০ বছর পার হলে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ। এর কারণ হলো, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণমান দুটিই উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়া।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ক এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, নারীর প্রজনন ক্ষমতা বয়সের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে কমতে থাকে। প্রতি মাসে একজন নারীর স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। ৪০ বছর পার হলে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ।

বয়স বাড়লে ডিম্বাণুর ক্রোমোজোমজনিত ত্রুটি বেড়ে যায়, যা গর্ভপাত বা ব্যর্থ গর্ভধারণের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণা বলছে, ২৫ বছর বয়সে ডিম্বাণুতে ক্রোমোজোমজনিত ত্রুটি ২৫ শতাংশ হলেও ৪০ বছর বয়সে তা দাঁড়ায় প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশে।

ডব্লিউএইচও বলছে, ৪০ বছরের পর প্রাকৃতিক গর্ভধারণের সম্ভাবনা খুবই সীমিত হয়ে পড়ে এবং অনেক সময় সহায়ক প্রজনন চিকিৎসা (যেমন আইভিএফ) ছাড়া গর্ভধারণ সম্ভব হয় না।

আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনেক নারী যখন ৩৮ থেকে ৪০ বছর বয়সে এসে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেন, তখন প্রজনন ক্ষমতা অনেক কমে যায়। অনেকে বহু বছর ধরে চেষ্টা করেও গর্ভধারণে ব্যর্থ হন।

আবার অনেকে বহুবার আইভিএফ বা টেস্টটিউব চিকিৎসা করেও সফল হতে পারেন না। বয়সের কারণে ডিম্বাণুর গুণমান দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে চিকিৎসার সফলতার হারও কমে যায়।

যুক্তরাজ্যের হিউম্যান ফার্টিলাইজেশন অ্যান্ড এমব্রায়োলজি অথরিটির (এইচএফইএ) তথ্য বলছে, ৩৫–এর নিচে নারীদের আইভিএফ সফলতার হার গড়ে ৩১ শতাংশ। যেখানে ৪০–এর পর তা নেমে আসে ১১ শতাংশে।

এই প্রক্রিয়াগুলো নারীর শরীরে প্রচণ্ড শারীরিক চাপ তৈরি করে। আর মানসিক চাপও অনেক সময় হতাশার দিকে ঠেলে দেয়।

আরও পড়ুনএকমাত্র সন্তান বউ নিয়ে দেশের বাইরে থাকে, একা আমি কী করব ১৭ ঘণ্টা আগেঅতি অল্প বয়স আর অতি দেরি-দুটিই বিপজ্জনক। মাঝখানেই রয়েছে সবচেয়ে নিরাপদ সময়; ২০ থেকে ৩০ বছর। এই সময়ে নারীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিপক্ব থাকেন, প্রজনন ক্ষমতাও সর্বোচ্চ থাকে, আর গর্ভাবস্থার জটিলতার ঝুঁকি তুলনামূলক কম থাকে।

অন্যদিকে দেশের গ্রামীণ চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশ জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য সমীক্ষার তথ্যমতে, গ্রামে প্রথমবার মা হওয়ার গড় বয়স এখনো প্রায় ১৯ বছর। যেখানে শহরাঞ্চলে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ বছর। কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের ফলে মা ও নবজাতক উভয়ের মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু সমীক্ষা ২০২২ দেখিয়েছে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েদের মাতৃমৃত্যুর হার ২০ থেকে ২৪ বছরের মায়েদের তুলনায় দ্বিগুণ। অল্প বয়সে গর্ভধারণে মা অপুষ্টিতে ভোগেন, শিশুর ওজন কম হয়, এবং পরবর্তীতে বিকাশগত সমস্যার আশঙ্কাও বেশি থাকে।

অতি অল্প বয়স আর অতি দেরি—দুটিই বিপজ্জনক। মাঝখানেই রয়েছে সবচেয়ে নিরাপদ সময়; ২০ থেকে ৩০ বছর। এই সময়ে নারীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিপক্ব থাকেন, প্রজনন ক্ষমতাও সর্বোচ্চ থাকে, আর গর্ভাবস্থার জটিলতার ঝুঁকি তুলনামূলক কম থাকে।

এর মানে এই নয় যে ৩০ পার করলেই সন্তান নেওয়া অসম্ভব, বরং এর মানে হলো—বয়স যত বাড়ে, সিদ্ধান্ত তত বেশি সচেতনভাবে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই নিতে হবে।

মাতৃত্ব কোনো দেরিতে ফেলে রাখা স্বপ্ন নয়, এটি সময়মতো সযত্নে বোনা একটি বাস্তবতা। তাই প্রত্যেক দম্পতির উচিত তাদের শিক্ষা, ক্যারিয়ার, আর্থিক অবস্থা ও পারিবারিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সময়মতো সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া।

গর্ভধারণের আগে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, জীবনযাত্রার মান ঠিক রাখা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াও একেবারেই অপরিহার্য।

ডা.

রেশমা শারমিন: বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও নারী স্বাস্থ্য অধিকারকর্মী

আরও পড়ুনতরুণ-তরুণীরাও কেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে২২ ঘণ্টা আগে

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বছর বয়স ৪০ বছর সন ত ন ২০ থ ক র বয়স সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে প্রজনন হার হঠাৎ বাড়ছে

বাংলাদেশ কি উল্টো পথে হাঁটছে? দেশের নারীদের মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) এখন ২ দশমিক ৪। বাংলাদেশ অনেক চেষ্টা করে প্রজনন হার কমিয়ে ২ দশমিক ১৭ করতে পেরেছিল। এখন আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে এই উল্টো যাত্রা আগে কখনো দেখা যায়নি।

একজন নারী তাঁর প্রজনন বয়সে (১৫ থেকে ৪৯ বছর) যত সন্তানের জন্ম দেন, সেটাকে বলা হয় মোট প্রজনন। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের নারীরা গড়ে ছয়টি বা তার বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ টিএফআর কমানোর চেষ্টা করেছে। অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বড় অর্জনের একটি এই জন্মহার কমানো।

গতকাল রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ইউনিসেফ যৌথভাবে মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিকস) ২০২৫ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ময়মনসিংহ বিভাগে প্রজনন হার সবচেয়ে বেশি, ২ দশমিক ৮। সবচেয়ে কম রাজশাহী বিভাগে, ২ দশমিক ২। সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের নারীদের মধ্যে এবং কম শিক্ষিত বা নিরক্ষর নারীদের মধ্যে টিএফআর বেশি।

টিএফআর বাড়ছে, এর অর্থ আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। এটা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক নীতি ও কর্মকৌশল সঠিক পথে নেই। এমনিতেই দেশে বেকারত্ব বেশি। টিএফআর বৃদ্ধি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারেজনসংখ্যাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে টিএফআর ছিল ৬ বা তার বেশি। মিকস ও অন্যান্য উৎসের তথ্য ব্যবহার করে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮২ সালে টিএফআর ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৭। এরপর তা কমতে থাকে। ১৯৯৪ সালে টিএফআর কমে হয় ৩ দশমিক ৪। টিএফআর আরও কমতে থাকে, ২০০৪ সালে তা কমে হয় ৩। ২০১২ সালে ছিল ২ দশমিক ৩ এবং ২০২২ সালেও একই হার। ২০২৪ সালের দিকে তা ছিল ২ দশমিক ১৭ বা তার কাছাকাছি।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে টিএফআর কখনো কমতে দেখা যায় না। হয় ক্রমাগত কমেছে, না হয় কয়েক বছর ধরে স্থির অবস্থায় ছিল। যেমন ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টিএফআর ৩ দশমিক ৩ ছিল। আবার ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টিএফআর ২ দশমিক ৩ ছিল। অর্থাৎ এক দশক ধরে টিএফআর স্থির ছিল। টিএফআর কেন কমছে না, তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।

টিএফআর কীভাবে কমেছিল

স্বাধীনতার পর জনসংখ্যাকে বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল অধিক জনসংখ্যা জাতীয় অর্থনীতির বাধা। সরকার জনসংখ্যা কমানোর নীতি গ্রহণ করে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ওপর জোর দেওয়া হয়। মানুষের হাতের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কর্মকৌশল দেওয়া হয়। পাশাপাশি ব্যাপক জনসচেতনতা কর্মকাণ্ড চালু করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালিত টেলিভিশন ও বেতার এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী ছাড়াও এনজিওরা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।

গত কয়েক দশকে সক্ষম দম্পতিদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার বেড়েছে। মানুষ সহজে হাতের কাছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা দোকান থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কিনতে পারে। এর পাশাপাশি নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এসব উপাদানও টিএফআর কমাতে সহায়তা করেছে।

১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টিএফআর ৩ দশমিক ৩ ছিল। আবার ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টিএফআর ২ দশমিক ৩ ছিল। অর্থাৎ এক দশক ধরে টিএফআর স্থির ছিল। টিএফআর কেন কমছে না, তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।

বাংলাদেশের উদ্দেশ্য ছিল টিএফআর ২ দশমিক ১–এ নিয়ে যাওয়া; তা হয়নি। টিএফআর বেড়ে যাওয়ার অর্থ জনসংখ্যার চাপ বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ এমনিতেই জনবহুল দেশ। তারপরও জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি বেড়ে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি আছে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে।

জনসংখ্যাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিএফআর বাড়ছে, এর অর্থ আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। এটা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক নীতি ও কর্মকৌশল সঠিক পথে নেই। এমনিতেই দেশে বেকারত্ব বেশি। টিএফআর বৃদ্ধি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দেশে প্রজনন হার হঠাৎ বাড়ছে