সম্মিলিত ও কার্যকর উদ্যোগ জরুরি
Published: 26th, September 2025 GMT
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও এক নতুন এবং গুরুতর মোড় নিয়েছে। এত দিন ডেঙ্গুর ধরন ডিইএনভি–২–এর প্রকোপ বেশি থাকলেও সম্প্রতি ধরন ডিইএনভি–৩–এর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর এই নতুন ধরনের জোরালো বিস্তার স্পষ্ট বিপৎসংকেত। কেবল সংক্রমণের হার নয়, রোগ অনুপাতে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার এবার আগের দুই বছরের চেয়েও বেশি—যা প্রমাণ করে ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকদের মতে, ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে যাওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একবার ধরন-২–এ আক্রান্ত রোগী দ্বিতীয়বার নতুন ধরন-৩–এ আক্রান্ত হলে তাঁর মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। আগেকার ধরন-২–এর বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছিল, নতুন ধরন-৩–এর বিরুদ্ধে তা অকার্যকর। নতুন ধরনগুলো প্রায়ই নতুন উপসর্গ নিয়ে আসে। এতে রোগনির্ণয়ে দেরি হয় ও রোগী জটিলতার মুখে পড়েন। ডেঙ্গুতে ডায়রিয়ার মতো নতুন উপসর্গ চিকিৎসকদের দ্রুত রোগ শনাক্ত করতে বিভ্রান্ত করতে পারে, যা রোগীর জীবন বিপন্ন করে তোলে।
ডেঙ্গু সংক্রমণের মাত্র ২৬ শতাংশ ঢাকা মহানগরীর হলেও মোট মৃত্যুর ৬৩ শতাংশ ঘটেছে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে। যদিও ঢাকার বাইরের রোগীরা জটিলতা নিয়ে রাজধানীতে আসছেন, তবু এই উচ্চ মৃত্যুহার ঢাকার চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর বড় প্রশ্ন তোলে। জাতীয় গড় মৃত্যুহার যেখানে শূন্য দশমিক ৪৪, সেখানে ঢাকায় তা দ্বিগুণ—শূন্য দশমিক ৯৮। ঢাকার বাইরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ডেঙ্গুর জটিলতা ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকাও কেন্দ্রীয় মৃত্যুহার বাড়ানোর জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী।
ডেঙ্গুর নতুন ধরন মোকাবিলায় এখন জরুরি ভিত্তিতে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শুধু মশকনিধন অভিযান নয়, বরং প্রয়োজন আরও সুনির্দিষ্ট ও তথ্যভিত্তিক পদক্ষেপ। সরকারকে আইইডিসিআরের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করে নতুন ধরনগুলোর গতিবিধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নতুন ধরন-৩–এর উপসর্গগুলো (যেমন ডায়রিয়া) সম্পর্কে দেশের সব চিকিৎসককে দ্রুত প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে রোগনির্ণয়ে কোনো বিলম্ব না ঘটে। ঢাকার বাইরের জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর জটিল চিকিৎসা (যেমন শক সিনড্রোম ব্যবস্থাপনা) এবং পরীক্ষার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে জটিল রোগীদের ঢাকায় আসার প্রয়োজন না হয়। ডেঙ্গুর উৎপত্তিস্থল ধ্বংসের জন্য মশকনিধনে সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ডে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
ডেঙ্গু এখন আর কেবল একটি মৌসুমি রোগ নয়, এটি বছরব্যাপী স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দীর্ঘসূত্রতা বা অবহেলা নয়, চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সময়োপযোগী কঠোর পদক্ষেপ। আশা করি, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এ ব্যাপারে আন্তরিকভাবে মনোযোগী হবেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবস থ র ধরন ত করত
এছাড়াও পড়ুন:
রংপুরে আরও তিনজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত, জনসচেতনতায় জোর নেই
রংপুরের কাউনিয়া ও মিঠাপুকুর উপজেলায় আরও তিনজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। কাউনিয়া ও মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে দুজন কাউনিয়ার এবং একজন মিঠাপুকুরের বাসিন্দা। এ নিয়ে জেলায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ জনে। তবু আক্রান্ত এলাকাগুলোতে অ্যানথ্রাক্স নিয়ে তেমন সচেতনতামূলক কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র বলছে, চলতি বছরের জুলাই ও সেপ্টেম্বরে রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজন মারা যান। একই সময়ে উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে অর্ধশত ব্যক্তির শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা যায়। ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে অসুস্থ গরুর মাংসের নমুনা পরীক্ষা করে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করেছিল প্রাণিসম্পদ বিভাগ। পরে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একটি প্রতিনিধিদল ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর পীরগাছা সদর এবং পারুল ইউনিয়নের অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ থাকা ১২ জন নারী-পুরুষের নমুনা সংগ্রহ করেছিল। এর মধ্যে আটজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়।
আরও পড়ুনপীরগাছায় ৮ জনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত, রংপুরের আরও দুই উপজেলায় উপসর্গের রোগী৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫আরও পড়ুনরংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজনের মৃত্যু, আক্রান্ত অর্ধশত১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫কাউনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুজন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ২৩ সেপ্টেম্বর কাউনিয়ায় অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ আছে এমন ছয়জনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে দুজনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে। সুজন সাহা বলেন, আক্রান্ত রোগীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। হাসপাতালের কর্মী রোগীর বাসায় গিয়ে চিকিৎসা দেবেন।
মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ১৫–২০ দিন আগে ইমাদপুর ইউনিয়নের আমাইপুর গ্রামে একটি গরু অসুস্থ হলে জবাই করা হয়। পরে ওই মাংস কাটাকাটি করার পর গ্রামের পাঁচ–ছয়জনের শরীরে ঘা হয় ও অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দেয়। এরপর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাঁরা চিকিৎসা নিতে আসলে সেখানে থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। এই পাঁচজনের মধ্যে একজন পুরুষের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে।
মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা (রোগনিয়ন্ত্রণ) এম এ হালিম লাবলু প্রথম আলোকে বলেন, ইমাদপুরে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁরা অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদিপশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবু রোগী যাতে সামাজিকভাবে কোনো হেয় পরিস্থিতির মধ্যে না পড়েন, সে জন্য তাঁদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। তিনি জানান, এ রোগ গবাদিপশু থেকে মানুষে ছড়ায়, তবে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। তাই মানুষকে সচেতন হতে হবে। অসুস্থ গরু জবাই করা বা মাংস খাওয়া যাবে না।
বুধবার দুপুরে আমাইপুর গ্রামে গেলে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ও সোহরাব আলীর সঙ্গে। তাঁদের দাবি, গরুর মালিক গরু অসুস্থের কথা বলেননি। বলেছিল, দড়ি দিয়ে গরুর ফাঁস লেগেছিল। এ কারণে প্রতিবেশীরা মাংস কাটাকাটিতে যুক্ত হন। এই দুই স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী রহমতপুর বাজারে কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা জানান, অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসনের কোনো সচেতনতামূলক কার্যক্রম তাঁরা দেখেননি।
মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরেকটি সূত্র বলছে, উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের জীবনপুর গ্রামের একজন নারীর অ্যানথ্রাক্স উপসর্গ পাওয়া গেছে। তিনি অসুস্থ গরুর সংস্পর্শে আসেননি। তবে তাঁর বাড়িতে গরু-ছাগল আছে। ওই নারী নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, মাটি বা ঘাসের সঙ্গে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু বছরের পর বছর ধরে থেকে যায়। বেশির ভাগ সময় পানি জমা ঘাস গবাদিপশু খাচ্ছে। সেখান থেকে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এ জন্য অ্যানথ্রাক্স প্রতিষেধক টিকা কার্যক্রমে জোর দিতে হবে।
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত ইমাদপুর এলাকার বাসিন্দারা প্রথম আলোকে জানান, ১০ থেকে ১২ দিন আগে তাঁদের এলাকায় গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। তবে পার্শ্ববর্তী পচার হাটের মমিনুল ইসলাম ও মহেন্দ্র দাস বলেন, তাঁদের এলাকায় টিকা দেওয়া হয়নি। তাঁরা গরু-ছাগল নিয়ে আতঙ্কে আছেন।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু ছাইদ প্রথম আলোকে বলেন, গবাদিপশুর অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করার পরেই গত আগস্ট থেকে তাঁরা টিকা কার্যক্রম শুরু করেছেন। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ মানুষের নমুনা পরীক্ষা করতে দেরি করেছে। এ কারণে এখন আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দাবি, পীরগাছা ছাড়াও কাউনিয়া, মিঠাপুকুর, রংপুর সদর, পার্শ্ববর্তী গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ, কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী, উলিপুর ও রাজাটহাটেও অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধী টিকা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিরাপদ মাংসের জন্য বিভিন্ন জবাইখানায় গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।
অ্যানথ্রাক্স বিষয়ে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ দেরি করেনি দাবি করে ডেপুটি সিভিল সার্জন রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন জানতে পারছি, সঙ্গে সঙ্গে আইইডিসিআরকে জানানো হয়েছিল। প্রতিটি উপজেলাকে সতর্ক করা আছে এবং অ্যানথ্রাক্স চিকিৎসার গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। এটার জন্য যে অ্যান্টিবায়োটিক বা চিকিৎসাব্যবস্থা, সেটাও পর্যাপ্ত আছে। এ মুহূর্তে যেটা বিষয়, জনগণকে সচেতন করা। অসুস্থ প্রাণী জবাই না করা, নিজেরা না খাওয়া, লুকিয়ে বিক্রি না করা। অসুস্থ প্রাণী মারা গেলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।’