বাংলাদেশের দেড় কোটির বেশি প্রবাসী প্রতিবছর তাঁদের আয় দেশে পাঠান। দেশের ব্যাংক, মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (এমএফএস), অর্থ স্থানান্তর প্রতিষ্ঠান ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রসারে প্রবাসী আয় পাঠানো এখন অনেক দ্রুত ও সহজ হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লক চেইন ও স্টেবলকয়েন ব্যবহার করে প্রবাসী আয় পাঠানোর প্রক্রিয়া আরও আধুনিক করা গেলে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা বাড়বে।

গাজীপুরের ভাওয়াল রিসোর্টে গতকাল বৃহস্পতিবার 'বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের পরিবর্তিত চিত্র ও উদীয়মান সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক কর্মশালায় এ মন্তব্য করেন বক্তারা। গাজীপুরের ভাওয়াল রিসোর্টে এই কর্মশালা আয়োজন করে এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ। এতে অংশ নেন বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। দিনব্যাপী কর্মশালায় ছিল তিনটি অধিবেশন। প্রথম অধিবেশনে বক্তব্য দেন বিকাশের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আলী আহম্মেদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিকাশের বাণিজ্যিক বিভাগের প্রবাসী আয় শাখার প্রধান মোহাম্মদ জাহিদুল আহসান।

বিকাশের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আলী আহম্মেদ বলেন, ‘আগে ব্যাংকের প্রতিনিধিরা বিদেশে গিয়ে শ্রমিকদের হিসাব ও লেনদেন বাড়াতে কাজ করতেন। এখন বিভিন্ন এমএফএস ও অর্থ স্থানান্তর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাল হয়েছে। এই কর্মশালা থেকে আমাদের আগামী এক বছরের জন্য একটি পথনকশা (রোডম্যাপ) তৈরির চেষ্টা থাকবে।’

মূল প্রবন্ধে মোহাম্মদ জাহিদুল আহসান বলেন, দেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ বিশ্বের ১৭৬টি দেশে আছেন। তবে সব চিত্রই যে ইতিবাচক, তা নয়। এখনো ৫০ শতাংশের বেশি শ্রমিক অদক্ষ। ফলে প্রবাসী আয় আসার পরিমাণ প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না।

কর্মশালায় একটি প্যানেল আলোচনায় ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মকর্তা শাহরিয়ার জামিল বলেন, আগে প্রবাসী আয় মানেই ছিল ‘ক্যাশ ওভার দ্য কাউন্টার’। গ্রাহকেরা দূর থেকে ব্যাংক শাখা কিংবা এনজিও কার্যালয়ে গিয়ে টাকা তুলতেন। এতে সময় ও খরচ দুটোই বেশি ছিল। বর্তমানে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ প্রবাসী আয় ডিজিটাল মাধ্যমে আসে। তবু নগদ অর্থে প্রবাসী আয় পাঠানোর চাহিদা পুরোপুরি কমে যায়নি।

ট্রাস্ট ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান জহুরুল করিম চৌধুরী বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটকালে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব ভালোভাবে সামনে এসেছে। তদারকি ও নীতিনির্ধারণের কারণে অনেক সময় ব্যাংকের প্রবাসী আয় গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

দ্বিতীয় অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিকাশের বিপণন শাখার মহাব্যবস্থাপক জয়ন্ত সেন। তিনি বলেন, প্রবাসী আয়নির্ভর পরিবারগুলোর ৯২ শতাংশ এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করে। এদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত।

তৃতীয় অধিবেশনে বক্তব্য দেন ফিনট্যাক স্টার্টআপ ট্যাপট্যাপ সেন্ডের হেড অব গ্রোথ সুদর্শন শুভাশীষ দাস। তিনি বলেন, এখন মানুষ টাকা পাঠাতে চান দ্রুত, সহজ ও কম সময়ে। এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রবাসী আয়ে অনেক সুবিধা নিয়ে এসেছে।

কর্মশালায় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের নন রেসিডেন্ট ব্যাংকিং ডিভিশনের প্রধান খন্দকার আসিফ খালেদসহ অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তারা বক্তব্য দেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত আয় প ঠ ন প রব স

এছাড়াও পড়ুন:

ক্যাশলেস ডিজিটাল লেনদেনে নতুন সম্ভাবনা 

বাংলাদেশে ডিজিটাল আর্থিক সেবা গত এক দশকে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। এর মূল চালিকা শক্তি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস), যা দেশের লাখো মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সহজ করেছে। বর্তমানে দেশে ৯ কোটির বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা লেনদেন করছেন এমএফএস সেবার মাধ্যমে।

ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কার্ড পেমেন্ট ও অন্যান্য ডিজিটাল চ্যানেলেও প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলার প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের যেকোনো ব্যাংক, এমএফএস বা পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য যেকোনো অ্যাকাউন্টে তাৎক্ষণিক টাকা পাঠানো যাবে। এটি বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা ডিজিটাল অর্থনীতির নতুন যুগের সূচনা করবে।

ভারতে ক্যাশলেস পেমেন্ট সফল হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সেখানে পিটুপি ট্রান্সফার ও অধিকাংশ কিউআর লেনদেনে কোনো চার্জ নেই। পাকিস্তানে পিটুপি ট্রান্সফারে কোনো খরচ নেই। দেশটির সরকার কিউআর পেমেন্ট উৎসাহিত করতে প্রোভাইডারদের লেনদেনের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ভর্তুকি প্রদান করছে।

ক্যাশলেস ডিজিটাল লেনদেনের দুটি প্রধান ভিত্তি হলো কুইক রেসপন্স (কিউআর) কোড পেমেন্ট এবং পি টু পি (পারসন টু পারসন) ট্রান্সফার। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালে বাংলা কিউআর স্কিমের মাধ্যমে সর্বজনীন কিউআর পেমেন্ট চালু করে। ফলে গ্রাহকেরা যেকোনো ব্যাংক বা ওয়ালেট অ্যাপ দিয়ে কোডটি স্ক্যান করলেই টাকা তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপকের অ্যাকাউন্টে পাঠাতে পারেন।

এখন বাংলাদেশ ব্যাংক পারসন টু পারসন ট্রান্সফার চালু করছে। এর মাধ্যমে দেশের যেকোনো অঞ্চলের কেউ নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অঞ্চলের কারও এমএফএস অ্যাকাউন্টে সহজেই টাকা পাঠাতে পারবেন।

বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ও সার্ভিস চার্জ

বাংলাদেশের ক্যাশলেস লেনদেন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে লাভবান হতে পারে। ভারত ২০১৬ সালে ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস (ইউপিআই) চালু করে। যার মাধ্যমে মাসে ১ হাজার ৭০০ কোটি লেনদেন হয়, যা প্রায় ২৮০ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যে। শ্রীলঙ্কা ২০১৮ সালে পিটুপি ট্রান্সফার ও ২০১৯ সালে কিউআর পেমেন্ট চালু করে। পাকিস্তান ২০২২ সালে রাস্ত ডিজিটাল পেমেন্ট পারফর্ম চালু করে।

ভারতে ক্যাশলেস পেমেন্ট সফল হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সেখানে পিটুপি ট্রান্সফার ও অধিকাংশ কিউআর লেনদেনে কোনো চার্জ নেই। পাকিস্তানে পিটুপি ট্রান্সফারে কোনো খরচ নেই। দেশটির সরকার কিউআর পেমেন্ট উৎসাহিত করতে প্রোভাইডারদের লেনদেনের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ভর্তুকি প্রদান করছে।

আরও পড়ুনক্যাশলেস ব্যাংকিংয়ের স্বপ্ন কি অধরাই থেকে যাবে?০৫ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের বাস্তবতা অনেকটা ভিন্ন। এখানে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস সবচেয়ে জনপ্রিয়। গ্রাহকেরা বিনা খরচে এখানে টাকা গ্রহণ করছেন। যদিও টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ প্রযোজ্য।

এ বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক এমএফএস, ব্যাংক ও পিএসপিদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রাইসিং কাঠামো নির্ধারণ করেছে। পিটুপি ট্রান্সফারে, প্রেরক এমএফএস থেকে পাঠালে হাজারে ৮ দশমিক ৫০ টাকা, ব্যাংক থেকে পাঠালে হাজারে ১ দশমিক ৫০ টাকা এবং পিএসপি থেকে পাঠালে হাজারে ২ টাকা সর্বোচ্চ সার্ভিস চার্জ দেবেন গ্রাহক। কিউআর পেমেন্টে গ্রাহককে কোনো চার্জ দিতে হবে না, তবে মার্চেন্ট লেনদেনের খরচ গ্রহণ করবেন এবং সর্বোচ্চ এমডিআর হবে লেনদেনের ১ দশমিক ১৫ শতাংশ।

প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে সেবার মান ও নিরবচ্ছিন্ন কার্যকারিতা। যাতে প্রতিটি লেনদেন সফলভাবে সম্পন্ন হয় এবং ব্যবহারকারীরা আস্থা ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পাশাপাশি সব গ্রাহক ও ব্যবসায়ীকে ডিজিটাল পেমেন্টের সুবিধা সম্পর্কে জানাতে হবে। এ উদ্যোগে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সব সার্ভিস প্রোভাইডারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

ভারত ও পাকিস্তানের মতো প্রণোদনা কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ক্যাশ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হয়। যদি এর অল্প অংশ (যেমন ৫ শতাংশ বা বছরে এক হাজার কোটি টাকা) ডিজিটাল লেনদেন প্রচারে বিনিয়োগ করা যায়, তবে তা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিতে বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাস্তবায়নের জন্য নেতৃত্ব

বাংলাদেশ ব্যাংক এ রূপান্তরের নেতৃত্ব দেবে, তবে সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা। ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি—সব অংশীদারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ জন্য একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সেবার মান নিশ্চিত করতে হবে এবং যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তা দ্রুত যোগাযোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।

ক্যাশলেস লেনদেন ত্বরান্বিত করার জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। নিশ্চিত করতে হবে যে বাজারের সব ব্যবসায়ী পেমেন্টের জন্য বাংলা কিউআর কোড ব্যবহার করছেন। বিদ্যমান নিজস্ব কিউআর কোডগুলো দ্রুত বাংলা কিউআর দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। ট্রেড লাইসেন্সধারী সব দোকানে ট্রেড লাইসেন্সের পাশে কিউআর কোড প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা করা যায়।

দেশের ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি ব্যবহারকারীদের জন্য কিউআর কোড ইস্যু করা যায়, যাতে একজন গ্রাহক অন্যজনের কিউআর স্ক্যান করে সহজে লেনদেন করতে পারেন। ফলে দেশে অল্প সময়ে ১০ কোটির বেশি কিউআর কোড ইস্যু হবে, সচেতনতা ও লেনদেন বাড়বে। পল্লী বিদ্যুৎসহ সব ইউটিলিটি বিলে কিউআর প্রিন্ট করতে হবে। মেট্রোরেলসহ সব সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে কিউআর কোডের মাধ্যমে টিকিট কাটা ও পেমেন্টের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যাশলেস লেনদেন উদ্যোগ দেশের নগদনির্ভরতা কমিয়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে শক্তিশালী করবে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করবে। সঠিক নেতৃত্ব, বাস্তবসম্মত নীতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে এ উদ্যোগ ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির নতুন অধ্যায় রচনা করবে।

ড. শাহাদাত খান প্রতিষ্ঠাতা, সিইও, টালিখাতা ও টালিপে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ক্যাশলেস ডিজিটাল লেনদেনে নতুন সম্ভাবনা