পরিকল্পনার পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সুষম উন্নয়ন ও উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও উন্নয়নের কেন্দ্রে রয়ে গেছে ঢাকা। ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ননীতি দেশের সামগ্রিক ভারসাম্য নষ্ট করছে।

‘বাংলাদেশের সুষম নগরায়ণ ও উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ: নীতি ও পরিকল্পনা প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক পরিকল্পনা সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান কথাগুলো বলেন।

আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরের বিআইপি কনফারেন্স হলরুমে এ সংলাপের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ ‍মুহম্মদ মেহেদী আহসান।

সংলাপে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানীতে নতুন বড় প্রকল্প বন্ধ করে আঞ্চলিক শহরগুলোয় প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা স্থানান্তর জরুরি। তাঁর মতে, ন্যাশনাল স্পেশাল প্ল্যান কার্যকর করে আঞ্চলিক প্রবৃদ্ধি কেন্দ্র গড়ে তুললেই সুষম উন্নয়নের পথ তৈরি হবে।

বিআইপি সভাপতি বলেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও নাগরিক সুবিধা প্রতিটি জেলা শহরে নিশ্চিত করা গেলে ঢাকার ওপর অযাচিত চাপ কমে আসত। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্র—উভয়ই ঢাকাকেন্দ্রিক স্বার্থে আবদ্ধ থাকায় বিকেন্দ্রীকরণের বাস্তব উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

উন্নয়নের জন্য শুধু অবকাঠামো নির্মাণ নয়, বরং মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা প্রতিটি জেলায় পৌঁছে দেওয়াই এখন জরুরি—এমন মন্তব্য করে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, প্রতিটি জেলা শহরে আধুনিক হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় থাকলে মানুষকে চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য রাজধানীতে আসতে হতো না। একইভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে শিল্পাঞ্চল ও অর্থনৈতিক অঞ্চল ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দিতে হবে।

জেলা বাজেট প্রণয়নকে বিকেন্দ্রীকরণের কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা ও অন্যান্য জেলার বরাদ্দের বৈষম্য প্রকাশ্য করা হলে জনগণের দাবি আরও স্পষ্ট হতো। তিনি রাজধানীতে নতুন মেগা প্রকল্প বন্ধ করে আঞ্চলিক শহরগুলোতে প্রশাসনিক দপ্তর, শিল্প ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরের পক্ষে মত দেন।

সংলাপে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, রাজধানী ঢাকায় জনসংখ্যা ও চাপ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঢাকা ইতিমধ্যেই স্যাচুরেটেড (পরিপূর্ণ), এখনই এটি থামাতে হবে। কিন্তু থামাতে হলে বিকল্প সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। একজন রোগীর যেন আইসিইউর (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) জন্য ঢাকা ছুটে আসতে না হয়, তার ব্যবস্থা রাজশাহী বা সিলেটেই গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান—সবকিছু বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।

আশরাফুল আলম বলেন, ঢাকা যদি প্রতিদিন বাংলাদেশের সবকিছুকে অ্যাবজর্ভ (শোষণ) করে, তাহলে কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যেন বুঝতে পারি কোথায় কী ধরনের শিল্প হতে পারে, সেই অনুযায়ী অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে।’

ঢাকা ও চট্টগ্রামমুখী জনস্রোত রোধ করতে হলে অন্যান্য বিভাগীয় শহরে বাস্তবভিত্তিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে—এমন মত দিয়ে রাজউকের এই প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ বলেন, নইলে বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা শুধু কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইপির ফেলো মেম্বার আনিসুর রহমান (তুহিন)। তিনি তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে নগরায়ণের গতি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক দ্রুত। ১৯৬০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নগর জনসংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের প্রধান নগরগুলোতেই মানুষের বসতি ঘন হচ্ছে। ফলে রাজধানীমুখী চাপ বেড়ে যাচ্ছে। এই অতি দ্রুত নগরায়ণ দেশের অর্থনীতি ও পরিবেশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।

জনসংখ্যা বণ্টনের ভারসাম্য রক্ষায় বিকেন্দ্রীকরণ এখন সময়ের দাবি—এমন অভিমত তুলে ধরে মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক উন্নয়ন নয়, বরং আঞ্চলিক নগর ও জেলা শহরগুলোতেও পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা দরকার। এতে রাজধানীর চাপ কমবে এবং সুষম উন্নয়ন সম্ভব হবে।

মূল প্রবন্ধে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক—এই তিন ধরনের বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে আরও ক্ষমতায়ন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সেবাদানকে তৃণমূলে নিয়ে যাওয়া এবং আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছে। এসব নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সুষম নগরায়ণ নিশ্চিত হবে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। তবে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর নীতি এবং পরিকল্পিত সমন্বয় প্রয়োজন বলেও প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সংলাপে স্বাগত বক্তব্য দেন বিআইপির যুগ্ম সম্পাদক তামজিদুল ইসলাম। আরও বক্তব্য দেন থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ইমেরিটাস অধ্যাপক এ টি এম নুরুল আমিন, বিআইপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের সিনিয়র প্ল্যানার মাকসুদ হাসেম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফৌজিয়া ফারজানা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফরহাদুর রেজা, বিআইপির সহসভাপতি সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন ও ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্টস লিমিটেডের (ডিডিসি) পরিচালক মাহবুবুর রহমান।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব ক ন দ র করণ র র জন ত ক ব আইপ র প রবন ধ র ক উন

এছাড়াও পড়ুন:

ইতালিকে হারিয়ে ২৮ বছর পর বিশ্বকাপে নরওয়ে

আরলিং হালান্ড যেন নিজেই ইতিহাস লিখে চলেছেন। দুই মিনিটের ব্যবধানে তার দুর্দান্ত দুই গোল ইতালিকে সান সিরোতে ৪-১ ব্যবধানে হারিয়ে নরওয়েকে নিয়ে গেল ১৯৯৮ সালের পর তাদের প্রথম বিশ্বকাপে। ম্যানচেস্টার সিটির এই সুপারস্টারের গ্রুপপর্বে গোলসংখ্যা দাঁড়াল ১৬। যা পোল্যান্ডের রবার্ট লেভানদোভস্কির রেকর্ডের সমান।

‘গ্রুপ–আই’ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোয়ালিফাই করতে নরওয়ের সামনে ছিল শুধু গণিতের হিসাব মেলানোর অপেক্ষা। তাদের বাদ দিতে ইতালির দরকার ছিল অবাস্তব এক নয় গোলের ব্যবধান। যা মাঠে সম্ভব হয়নি। তাই দীর্ঘ ২৮ বছর পর বিশ্বমঞ্চে ফিরতে যাচ্ছে নরওয়ে। আত্মবিশ্বাসও আকাশছোঁয়া।

আরো পড়ুন:

আসিফের মন্তব্যে বাফুফের কাছে বিসিবি সভাপতির দুঃখ প্রকাশ

অদম্য স্পেন বিশ্বকাপের দোরগোড়ায়

গত জুনে ইতালিকে ৩–০ গোলে হারানো ম্যাচটাই শেষ পর্যন্ত লুচিয়ানো স্পালেত্তির চাকরি শেষ করে দেয়। তার উত্তরসূরি জেনারো গাত্তুসো এবার প্লে-অফের প্রস্তুতি নেবেন।

গাত্তুসো তার সেরা খেলোয়াড়দেরই দলে ফেরান। মোলদোভার বিপক্ষে খেলা দলে কেবল জিয়ানলুকা মানচিনি টিকে থাকেন। অন্যদিকে নরওয়ের একমাত্র পরিবর্তন, এস্তোনিয়ার বিপক্ষে খেলা অস্কার ববের জায়গায় নামেন ক্রিস্টিয়ান থরস্টভেট।

প্রথমার্ধজুড়ে ইতালি ছিল আধিপত্যে। ফেদেরিকো দিমারকোর ভলিটি সামান্য বাইরে গেলে ১১তম মিনিটে আলো ছড়ান মাত্র ২০ বছর বয়সী ফ্রানচেস্কো পিও এসপোসিতো। দুর্দান্ত টার্ন আর নিখুঁত ফিনিশ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলেন তিনি।

এরপর এসপোসিতো আরেকটি হেড বাইরে পাঠালেও দুই দলই তেমন পরিষ্কার সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। মাঝপথে রেফারির সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে গাত্তুসো কার্ডও দেখেন।

বিরতির পর যেন নতুন উদ্যমে মাঠে নামে নরওয়ে। আলেকজান্ডার সর্লোথের শট বার ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। এরপর চুলের অনন্য সাজে পরিচিত জুলিয়ান রাইয়েরসনও লক্ষ্যভেদ করতে পারেননি।

অবশেষে ৬৩তম মিনিটে গোল মেলে। সর্লোথের পাস থেকে দারুণ ড্রাইভে দূর কোণে বল পাঠান আন্তোনিও নুসা। জিয়ানলুইজি দোনারুম্মা নিকটের পোস্টে চেষ্টা করেও আটকাতে পারেননি।

এরপর নুসার আরেকটি নিশ্চিত গোল দোনারুম্মা ঠেকালেও ম্যাচের মঞ্চ তখন তৈরি হালান্ডের জন্য। মানচিনির ঘন পাহারা ভেদ করেই তিনি নিজের ছন্দ খুঁজে নেন।

৭৮ মিনিটে বদলি নেমে চমৎকার ফুটওয়ার্কে বল এগিয়ে দেন অস্কার বব। সেখান থেকেই ভলিতে দুর্দান্ত ফিনিশ করেন হালান্ড। মাত্র এক মিনিট পর থরস্টভেটের ডান দিকের ক্রসে আবার গোল। ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে পৌঁছে সহজ ট্যাপ-ইনে বল জালে জড়ান।

শেষ দিকে মাতেও পোলিতানোর শট অল্পের জন্য বাইরে গেলেও ইতালির আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল না। যোগ করা সময়ে উলভসের ইয়র্গেন স্ট্র্যান্ড লার্সেন ডান দিক দিয়ে দারুণ দৌড়ে মানচিনিকে কাটিয়ে বক্রশটে দোনারুম্মাকে পরাস্ত করলে ব্যবধান দাঁড়ায় ৪-১।

রাতটা তাই নরওয়ের। হালান্ডের জোড়া গোলের উৎসবে তারা ফিরল বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে, দুই যুগের বেশি সময় পর।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ