ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বন্য প্রাণী শাখার একটি গবেষণা দল নিয়ে গত ১২ সেপ্টেম্বর গিয়েছিলাম মুন্সিগঞ্জ জেলার আড়িয়ল বিলে, বিশেষ প্রজাতির পাখির খোঁজে। ভোর থেকেই থেমে থেমে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, মেঘের আড়ালে সূর্য লুকিয়ে ছিল। এমন বিরূপ প্রকৃতির মধ্যেই পাখির খোঁজে রওনা দিলাম। কয়েকবার যানবাহন পরিবর্তন করে আড়িয়ল বিলের গাদিঘাটে পৌঁছালাম ঠিক সকাল ৯টায়।
ঘাট থেকে একটি ট্রলারে করে বিলে বিশেষ প্রজাতির পাখির খোঁজে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। শুরুতেই বেশ কিছু ফিঙে, শালিক আর পানকৌড়ির দেখা মিলল। কিছুক্ষণ পর চোখে পড়ল একটি জলময়ূর। পদ্মফুলের ভাসমান পাতার ওপর স্ত্রী জলময়ূরটি তার সঙ্গে থাকা তিনটি ছানাকে খাবার খাওয়া শেখাচ্ছিল। আনন্দের সঙ্গে এই সুন্দর মুহূর্তগুলোর বেশ কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দী করা হলো। পাখি খুঁজতে খুঁজতে বেশ কিছু দূর ট্রলার নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ করে পানিতে অর্ধেক নিমজ্জিত একটি গাছে কালো রঙের পিঠ এবং মাথায় ঝুঁটিওয়ালা একটি পাখি দেখতে পেলাম। আমাদের গবেষণা দলের উজ্জ্বল দাসকে বললাম দ্রুত বেশ কিছু ছবি তুলতে। সে পাখিটির বেশ কিছু সুন্দর ছবি তুলে নিল। ছবি দেখে বুঝলাম এটি মূলত পাকরা-পাপিয়া, যাকে ইংরেজিতে Jacobin Cuckoo অথবা Pied Cuckoo বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম Clamator jacobinus । এটি বাংলাদেশের একটি গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী পাখি। লোককথা অনুযায়ী, এই পাখি নাকি শুধু আকাশ থেকে পড়া বৃষ্টির পানি পান করে, আর অন্য কোনো পানি পান করে না। এটি সত্য কি না, তা এখনো কোনো গবেষণায় পাওয়া যায়নি। এভাবে পানি পানের কারণে এদের ‘চাতক’ নামেও ডাকা হয়।
বর্ষায় নানা রকম কীটপতঙ্গ বিশেষ করে শুঁয়াপোকা ও ঘাসফড়িং প্রচুর পাওয়া যায়, যা এই পাখিগুলোর প্রধান খাদ্য। তাই গ্রামবাংলার কোথাও কোথাও একে ‘বর্ষার দূত’ বা ‘বৃষ্টিপাখি’ নামেও ডাকা হয়।পাখিটির পিঠ, মাথা ও ঘাড় কালচে বর্ণের। ডানা ও লেজও কালচে। বুক, পেট ও গলা সাদা বর্ণের। পা ও ঠোঁট কালচে। মাথায় ছোট্ট একটি কালো ঝুঁটি। এই বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে এদের প্রাথমিকভাবে চেনা যায়। তবে এদের আরও দৈহিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন লেজের প্রান্ত সাদা, ডানার প্রাথমিক পালকের গোড়ায় সাদা ছোপ এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় এদের পিঠ কালচে বাদামি হয়ে থাকে।
এই প্রজাতির পাখিগুলোর বাসস্থান বেশ বৈচিত্র্যময়। এদের ঘন জঙ্গলে পাওয়া যায় না, বরং খোলা জায়গা এবং প্রান্তিক পরিবেশের ঝোপঝাড়, তৃণভূমি আর কৃষিজমির আশপাশে এদের পাওয়া যায়। এরা বাংলাদেশে মূলত বর্ষার আগেই চলে আসে, কারণ বর্ষায় নানা রকম কীটপতঙ্গ বিশেষ করে শুঁয়াপোকা ও ঘাসফড়িং প্রচুর পাওয়া যায়, যা এই পাখিগুলোর প্রধান খাদ্য। তাই গ্রামবাংলার কোথাও কোথাও একে ‘বর্ষার দূত’ বা ‘বৃষ্টিপাখি’ নামেও ডাকা হয়। কারণ, এর ডাক শোনা গেলেই মানুষ ধরে নেয় বৃষ্টি আসছে। যেহেতু এরা পরিবেশের কীটপতঙ্গ খেয়ে বেঁচে থাকে, তাই এরা বাস্তুতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং কীটপতঙ্গ খেয়ে ফসলের ক্ষতি কমিয়ে ফসল উৎপাদন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই বলা যায়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং অর্থনৈতিকভাবে এদের অবদান অনেক।
স্ত্রী চাতক পাখি সরাসরি ফিঙে, ময়না, বুলবুলসহ অন্য পাখির (হোস্ট পাখির) বাসায় ডিম দেয়। কখনো হোস্ট পাখি তার বাসায় প্রত্যাশিত ডিম চিনতে পারলে সেটি বাসা থেকে ফেলে দেয় বা ভেঙে ফেলে।এই গোত্রের পাখিগুলো সবাই পরিযায়ী নয়, কিছু কিছু আবাসিক রয়েছে অর্থাৎ সারা বছর একই এলাকায় থেকে যায় এবং বংশ বৃদ্ধি করে। তবে পরিযায়ীগুলো আফ্রিকার পূর্ব দিক যেমন ইথিওপিয়া, সুদান, কেনিয়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে আসে। বর্ষায় বাংলাদেশে এদের খাবারের প্রাচুর্য থাকায় এখানে প্রজনন করতে চলে আসে। তবে এদের প্রজননব্যবস্থা একটু ভিন্ন রকমের, কারণ এরা অন্য পাখির বাসায় ডিম পেড়ে থাকে। এ ধরনের প্রজনন আচরণকে প্রাণিবিদ্যার ভাষায় ব্রুড প্যারাসিটিজম বলা হয়।
স্ত্রী চাতক পাখি সরাসরি ফিঙে, ময়না, বুলবুলসহ অন্য পাখির (হোস্ট পাখির) বাসায় ডিম দেয়। কখনো হোস্ট পাখি তার বাসায় প্রত্যাশিত ডিম চিনতে পারলে সেটি বাসা থেকে ফেলে দেয় বা ভেঙে ফেলে।
আবার কখনো কখনো চাতক পাখির ডিমের রং অনেকটা হোস্ট পাখির ডিমের সঙ্গে মিলে যায়। এটি চাতক পাখির একটি অভিযোজন কৌশল। ডিমে তা দেওয়া থেকে শুরু করে ছানা লালন-পালন ও তাদের খাওয়ানো সব হোস্ট পাখিই করে থাকে। চাতক পাখি এ কাজে কোনো ভূমিকা রাখে না। চাতক পাখির ছানা সাধারণত দ্রুত বাড়ে, যাতে হোস্টের ছানাদের প্রতিযোগিতায় হারিয়ে খাবার বেশি খেতে পারে। অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে চাতকের ছানা হোস্ট পাখিটি তার বাসা থেকে ফেলে দেয়, যাতে চাতক পাখির ছানাগুলোর সঙ্গে হোস্ট পাখির ছানাগুলোর খাবারের প্রতিযোগিতা না হয়। ঘটনাটি হৃদয়বিদারক হলেও এটি প্রকৃতির জীববৈচিত্র্যেরই অংশ।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ আইইউসিএন ২০১৫ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এরা ঝুঁকিমুক্ত ক্যাটাগরিভুক্ত। তবে পরিবেশদূষণ, নগরায়ণ আর এই প্রজাতির পাখিগুলোর আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে এদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এদের প্রজননের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল ও গাছপালা অপ্রতুল থাকায় সহজে প্রজনন করতে পারছে না।
আড়িয়ল বিল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর একটি উল্লেখযোগ্য প্লাবনভূমি। এই জীববৈচিত্র্য সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে সমৃদ্ধ করছে। কেননা বাংলাদেশের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ জীবন–জীবিকার জন্য প্লাবনভূমির ওপর নির্ভরশীল। তাই গবেষণার মাধ্যমে আড়িয়ল বিলের জীববৈচিত্র্য উন্মোচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আড়িয়ল বিলের জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে পাখির বৈচিত্র্যের বিস্তারিত তথ্য উন্মোচন করতে পারলে তাদের সংরক্ষণ করা সহজ হবে।
মোহাম্মদ ফিরোজ জামান, অধ্যাপক ও প্রাণী গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ বব চ ত র য ক টপতঙ গ প রজনন পর ব শ র একট
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে প্রজনন হার হঠাৎ বাড়ছে
বাংলাদেশ কি উল্টো পথে হাঁটছে? দেশের নারীদের মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) এখন ২ দশমিক ৪। বাংলাদেশ অনেক চেষ্টা করে প্রজনন হার কমিয়ে ২ দশমিক ১৭ করতে পেরেছিল। এখন আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে এই উল্টো যাত্রা আগে কখনো দেখা যায়নি।
একজন নারী তাঁর প্রজনন বয়সে (১৫ থেকে ৪৯ বছর) যত সন্তানের জন্ম দেন, সেটাকে বলা হয় মোট প্রজনন। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের নারীরা গড়ে ছয়টি বা তার বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ টিএফআর কমানোর চেষ্টা করেছে। অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বড় অর্জনের একটি এই জন্মহার কমানো।
গতকাল রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ইউনিসেফ যৌথভাবে মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিকস) ২০২৫ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ময়মনসিংহ বিভাগে প্রজনন হার সবচেয়ে বেশি, ২ দশমিক ৮। সবচেয়ে কম রাজশাহী বিভাগে, ২ দশমিক ২। সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের নারীদের মধ্যে এবং কম শিক্ষিত বা নিরক্ষর নারীদের মধ্যে টিএফআর বেশি।
টিএফআর বাড়ছে, এর অর্থ আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। এটা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক নীতি ও কর্মকৌশল সঠিক পথে নেই। এমনিতেই দেশে বেকারত্ব বেশি। টিএফআর বৃদ্ধি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারেজনসংখ্যাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামস্বাধীনতার পর বাংলাদেশে টিএফআর ছিল ৬ বা তার বেশি। মিকস ও অন্যান্য উৎসের তথ্য ব্যবহার করে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮২ সালে টিএফআর ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৭। এরপর তা কমতে থাকে। ১৯৯৪ সালে টিএফআর কমে হয় ৩ দশমিক ৪। টিএফআর আরও কমতে থাকে, ২০০৪ সালে তা কমে হয় ৩। ২০১২ সালে ছিল ২ দশমিক ৩ এবং ২০২২ সালেও একই হার। ২০২৪ সালের দিকে তা ছিল ২ দশমিক ১৭ বা তার কাছাকাছি।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে টিএফআর কখনো কমতে দেখা যায় না। হয় ক্রমাগত কমেছে, না হয় কয়েক বছর ধরে স্থির অবস্থায় ছিল। যেমন ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টিএফআর ৩ দশমিক ৩ ছিল। আবার ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টিএফআর ২ দশমিক ৩ ছিল। অর্থাৎ এক দশক ধরে টিএফআর স্থির ছিল। টিএফআর কেন কমছে না, তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।
টিএফআর কীভাবে কমেছিলস্বাধীনতার পর জনসংখ্যাকে বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল অধিক জনসংখ্যা জাতীয় অর্থনীতির বাধা। সরকার জনসংখ্যা কমানোর নীতি গ্রহণ করে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ওপর জোর দেওয়া হয়। মানুষের হাতের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কর্মকৌশল দেওয়া হয়। পাশাপাশি ব্যাপক জনসচেতনতা কর্মকাণ্ড চালু করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালিত টেলিভিশন ও বেতার এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী ছাড়াও এনজিওরা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
গত কয়েক দশকে সক্ষম দম্পতিদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার বেড়েছে। মানুষ সহজে হাতের কাছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা দোকান থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কিনতে পারে। এর পাশাপাশি নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এসব উপাদানও টিএফআর কমাতে সহায়তা করেছে।
১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টিএফআর ৩ দশমিক ৩ ছিল। আবার ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টিএফআর ২ দশমিক ৩ ছিল। অর্থাৎ এক দশক ধরে টিএফআর স্থির ছিল। টিএফআর কেন কমছে না, তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।বাংলাদেশের উদ্দেশ্য ছিল টিএফআর ২ দশমিক ১–এ নিয়ে যাওয়া; তা হয়নি। টিএফআর বেড়ে যাওয়ার অর্থ জনসংখ্যার চাপ বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ এমনিতেই জনবহুল দেশ। তারপরও জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি বেড়ে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি আছে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে।
জনসংখ্যাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিএফআর বাড়ছে, এর অর্থ আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। এটা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক নীতি ও কর্মকৌশল সঠিক পথে নেই। এমনিতেই দেশে বেকারত্ব বেশি। টিএফআর বৃদ্ধি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।’