একজন ভালো শিক্ষক পাওয়া এবং না পাওয়াই হয়তো জীবনের রেখা অনেকটাই নির্ভর করে
Published: 5th, October 2025 GMT
ছোটবেলায় নাদিরা ম্যাডামের গণিত ক্লাসের কথা, তৃতীয় শ্রেণিতে ভাগ অঙ্কের সঙ্গে পরিচয়। ভাজক, ভাজ্য, ভাগফল, ভাগশেষ—এসব কোনো কিছুই ঠিক মাথায় ঢুকছে না। সংজ্ঞাগুলো মাথায় তালগোল পাকাচ্ছে। নাদিরা ম্যাডাম বই বন্ধ করে বললেন, ‘চলো আমরা একটা আম কাটি। এইখানেই ভাগ অঙ্ক আছে। আমরা যেটাকে ভাগ করি তা হলো ভাজ্য। যেমন, আমটা। একে আমরা টুকরা করে ভাগ করছি। আমরা যা দিয়ে ভাগ করি তা হলো ভাজক। যেমন এই ছুরিটা, এটা দিয়েই আমরা আমটা কেটে ভাগ করছি। পুরোটাকে যে কয়টা ভাগে ভাগ করে, সেটাই ভাগফল। ভাগ করে আমের টুকরাগুলোকে পেলাম, সেগুলো ভাগফল। যেটা আর ভাগ করা যায় না, থেকে যায়, সেটাই ভাগশেষ। আমের আঁটিকে আর ভাগ করা যাচ্ছে না!’
পুরো ক্লাস এবার বলল, আম-ভাজ্য, ছুরি-ভাজক, আমের টুকরা-ভাগফল, আঁটি-ভাগশেষ।
কয়েক দিন আগে আমার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া পুত্রকে ভাগ অঙ্ক শেখাতে গিয়ে শৈশবের নাদিরা ম্যাডামের ক্লাস থেকে সেই জ্ঞান ধার করলাম। সেই উদাহরণে পুরো ক্লাস যেভাবে এক নিমেষেই ভাগ অঙ্ক শিখে ফেলেছিল, আমার পুত্রটিও তেমনি শিখে ফেলল।
আরও পড়ুনঅক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি অনলাইন কোর্স, ঘরে বসেই শিখুন নতুন দক্ষতা৮ ঘণ্টা আগেজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে নাদিরা ম্যাডাম আমার জীবনে এমন একজন শিক্ষক যিনি সেই শিশুমনে দারুণ প্রভাব রেখেছিলেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেক শিক্ষকের দেখা মিলেছে, প্রত্যেকের কাছেই আমি কিছু না কিছু শিখেছি। আর প্রত্যেক মানুষের কাছ থেকে ভালো কিছু গ্রহণ করবার মানসিকতা আমাকে তৈরি করে দিয়েছেন নাদিরা ম্যাডাম।
আমরা ৯০ দশকের শিক্ষার্থী। তখন চাইলেই ইন্টারনেটে যেকোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জন সম্ভব ছিল না। নাদিরা ম্যাডাম বই পড়তে শেখাতেন। মনে আছে, ম্যাডাম ইতিহাসের একটা অধ্যায় পড়াচ্ছিলেন, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। খুব সামান্যই ছিল সেই পাঠ্যবইতে। অন্য একটা ক্লাসের বই এনে তিনি আরও বিস্তারিত গল্পের মতো বললেন। জানতে চেষ্টা করলে বই পড়ে জানা যায়, শুধু চেষ্টা—ম্যাডাম শিখিয়েছিলেন।
আরও পড়ুনতরুণদের জন্য গ্লোবাল লিডারশিপ চ্যালেঞ্জ ২০২৫: স্নাতকে করুন আবেদন৬ ঘণ্টা আগেমফস্বলে বেড়ে ওঠা মেয়েদের স্বপ্নগুলোও হয়তো ছোট হয়। ম্যাডামের কাছে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প শুনি, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলজীবনের নানান ছোট ছোট গল্প শুনি। বলাবাহুল্য, বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যয়টির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটান তিনি। ঘর ছেড়ে একা অচেনা শহরে পড়তে যাওয়ার সাহস, আত্মবিশ্বাস আর প্রত্যয় গড়ে তুলতে তাঁর সেই ছোট ছোট গল্প অনেকটা জুড়ে আছে।
আজ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি, হয়তো শৈশবে একজন নাদিরা ম্যাডাম ছিলেন বলে! আমি তাঁর গড়া অসংখ্য মানুষের মধ্যে নিতান্তই ক্ষুদ্র একজন। নাদিরা ম্যাডাম শিক্ষকতাকে কেবল পেশা হিসেবে না নিয়ে কোমলমতি শিশুদের ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ার দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি পাঠকে শিশু যেন মুখস্থ না করে আত্মস্থ করতে পারে, সে বিষয়কে সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন। নিয়মের ব্যাপারে তিনি ছিলেন কঠোর, যা পুরো স্কুলের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বড় উদাহরণ ছিল। জেলা পর্যায়ের একটা স্কুলে তিনি বিতর্ক চর্চা অনুশীলন করাতেন, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা বা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করতেন সুচারুভাবে। সে সময় স্কুলটি বিভাগীয় পর্যায়ে এমনকি জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক করেছে। কোমলতা-কঠোরতার এক দারুণ সমন্বয় তাঁর ব্যক্তিত্ব। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ার অনুপ্রেরণা তিনি। শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে এমন একজন শিক্ষক পেলে শিক্ষার্থীদের জীবনবোধ তৈরি হয়, যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় অবদান। তিনি স্বপ্ন দেখতে শেখান, সৎ হতে শেখান, যৌক্তিক হতে শেখান, নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবেসে চর্চা করতে শেখান, দায়িত্ববান মানুষ হতে শেখান।
আরও পড়ুনকেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা মূল্যে অনলাইন কোর্স, নেই বয়সের সীমা৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫প্রথম শিক্ষক হিসেবে মায়ের কাছে হাতেখড়ির পরেই আমার কাছে শিক্ষক অবতার ছিলেন তিনি। আমি আমার জীবনের সব সম্মানিত শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমি যেটুকু, তা তাঁরা প্রত্যেকে পরম যত্নে তিলে তিলে গড়েছেন। শিক্ষকতা পেশায় সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর সম্মান, ভালোবাসা। সুন্দর সমাজ গড়তে শিক্ষকের মর্যাদার কোনো বিকল্প নেই। যিনি শিশুর মানস গড়েন, যিনি কিশোরকে প্রশ্ন করতে শেখান, যিনি তরুণকে বিকল্প ভাবনার দরজা উম্মুক্ত করে দেন; তাঁদের শ্রদ্ধা করতে না শিখতে পারলে সমাজের সৌন্দর্য অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়।
আজ শিক্ষক দিবসে আমি শিক্ষার্থী হিসেবে আমার শিক্ষকদের জানাই অকৃত্রিম ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা!
*লেখক: শেখ জিনাত শারমিন, সহকারী অধ্যাপক, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুনবিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধেকের বেশি শিক্ষকের নেই উচ্চতর ডিগ্রি০৪ অক্টোবর ২০২৫আরও পড়ুনহাঙ্গেরিতে স্কলারশিপ, পড়াশোনা ইংরেজিতে হলে আইইএলটিএস বা টোয়েফলের প্রয়োজন নেই ০৪ অক্টোবর ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ গ কর পর য য় জ বন র
এছাড়াও পড়ুন:
জবি ছাত্র জোবায়েদ হত্যা মামলায় ২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জোবায়েদ হোসেন হত্যা মামলায় দুইজন সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
বুধবার (১৯ নভেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দীন তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
আরো পড়ুন:
সখীপুরে মেয়েকে হত্যার পর নিজেকে শেষ করলেন মা
নেত্রকোণায় চালককে হত্যা করে মোটরসাইকেল ছিনতাই
সাক্ষীরা হলেন, জবি শিক্ষার্থী সৈকত হোসেন এবং সালাউদ্দিন স্পেশালাইজড হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. ওয়াহিদুর রহমান। সৈকত নিহত জোবায়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই এবং ডা. ওয়াহিদ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি বর্ষার মামা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বংশাল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফ হোসেন সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য আবেদন করেন।
জবানবন্দিতে সৈকত বলেন, “আমি জবির ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ও জোবায়েদ ভার্সিটির বড় ভাই। আমি জোবায়েদ ভাইয়ের ক্লোজ ছোট ভাই হওয়াতে বর্ষা আমার নাম্বার জোবায়েদ ভাই থেকে নেয়। মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপ হাই, হ্যালো কথাবার্তা হত। ২-৩ মাস আগে বর্ষা আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। তখন থেকে বর্ষার সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। জোবায়েদ ভাই প্রায় ১ বছর ধরে বর্ষাকে বাসায় টিউশন পড়াত।”
তিনি বলেন, “ভার্সিটি এলাকায় থাকাকালে গত ১৯ অক্টোবর বিকেল ৫টা ৫৮ মিনিটের দিকে বর্ষা তাকে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ দেয়, ‘ভাইয়া কই তুমি?’ আমি জানাই ক্যাম্পাসে। বর্ষা বলে, ‘স্যারের আম্মুর নাম্বার আছে?’ কারণ জানতে চাইলে বর্ষা বলে, ‘লাগবে।’ ভাইয়ের কিছু হয়ছে কি না জানতে চাইলে বর্ষা বলে, ‘ভাইরে (জোবায়দে) কে জানি মাইরা ফেলছে।’ আমি বলি, মাইরা ফেলছে বলতে? বর্ষা বলে, ‘খুন করে ফেলছে।’ তখন বর্ষাকে কল দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। এরপর বিষয়টি বড় ভাইদের জানাই।”
ডা. ওয়াহিদুর রহমান জবানবন্দিতে বলেন, “গত ১৯ অক্টোবর সাপ্তাহিক নৈশ্যকালীন ডিউটি থাকায় বাসায় অবস্থান করছিলাম এবং ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছিলাম। হঠাৎ আমার স্ত্রীকে দ্বিতীয় তলার চাচাতো ভাই ফোন করে জানায়, সিঁড়িতে কোনো একজন লোক পড়ে আছে। আমরা তখন সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেখি সিঁড়ির মাঝামাঝি একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।”
তিনি বলেন, “তাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির লোকজন জড় হয়ে যায় এবং সেখানে শনাক্ত হয় যে, আমার ভাগ্নি বর্ষার প্রাইভেট টিউটর জুবায়েদের মরদেহ। তাৎক্ষণিক ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশকে অবহিত করি।”
বর্ষার মামা জানান, পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন তার ভাগ্নি বর্ষার সঙ্গে মাহির নামক এক ছেলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং জোবায়েদ মাস্টারের সঙ্গেও বর্ষার প্রেম ছিল। এই দ্বন্দ্বের কারণে মাহির রহমান, জোবায়েদ মাস্টারকে হত্যা করে ঘটনার দিন দৌড়ে পালিয়ে যায়।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, মো. জোবায়েদ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করতেন। প্রতিদিনের মতো গত ১৯ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বংশাল থানাধীন ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে নুর বক্স লেনের ১৫ নম্বর হোল্ডিং রৌশান ভিলায় বর্ষাকে পড়ানোর জন্য যান।
সন্ধ্যা ৫টা ৪৮ মিনিটের দিকে ওই ছাত্রী জোবায়েদ হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই সৈকতকে ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে জানায়, “জোবায়েদ স্যার, খুন হয়ে গেছে। কে বা কারা জোবায়েদ স্যারকে খুন করে ফেলছে।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. কামরুল হাসান ৭টার দিকে জোবায়েদের ভাই এনায়েত হোসেনকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তথ্যটি জানান। এনায়েত তার শ্যালক শরীফ মোহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে সাড়ে ৮টার দিকে ঘটনাস্থল রৌশান ভিলায় পৌঁছান। ভবনের নিচতলা থেকে ওপরে ওঠার সময় সিঁড়ি এবং দেয়ালে রক্তের দাগ দেখতে পান। ওই ভবনের তৃতীয় তলার রুমের পূর্ব পার্শ্বে সিঁড়িতে জোবায়েদের রক্তাক্ত মরদেহ উপুড় অবস্থায় দেখতে পান।
ঘটনার দুইদিন পর ২১ অক্টোবর জোবায়েদের ভাই এনায়েত হোসেন বংশাল থানায় মামলা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজসে জোবায়েদকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলার ডান পাশে আঘাত করে হত্যা করেছে।
মামলায় বর্ষা, তার প্রেমিক মো. মাহির রহমান, মাহিরের বন্ধু ফারদীন আহম্মেদ আয়লান ২১ অক্টোবর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছে।
ঢাকা/লিমন/মেহেদী