ভোগান্তির আরেক নাম ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
Published: 6th, October 2025 GMT
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট, অনিয়ম, দালালচক্র আর জনবল ঘাটতির কারণে ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা।
এই হাসপাতাল শুধু ভেড়ামারা নয়, দৌলতপুর, মিরপুর ও ঈশ্বরদী অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল। অথচ চিকিৎসকের অপ্রতুলতা আর দুর্নীতির কারণে রোগীরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
ডা.
জানা গেছে, ভেড়ামারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনুমোদিত ২৫ জন চিকিৎসকের মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন), একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থো-সার্জারি) ও তিনজন মেডিকেল অফিসার।
ভেড়ামারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পদশূন্য রয়েছে- জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (এনেসথেসিয়া), জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চর্ম ও যৌন), আইএমও, এনেসথেটিস্ট এবং এমও (এ.এমসি)।
এছাড়া হাসপাতালে একজন মিডওয়াইফ, একজন জুনিয়র নার্স, একজন অ্যাকাউন্টেন্ট, একজন ক্যাশিয়ার, তিনজন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিন), একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই), দুইজন স্বাস্থ্য পরিদর্শক, ১২ জন স্বাস্থ্য সহকারী, একজন কম্পাউন্ডার, অফিস সহায়ক, তিনজন ওয়ার্ড বয়, দুইজন আয়া, দুইজন কুক, একজন মালি, একজন নিরাপত্তার প্রহরী, তিনজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দুইজন অফিস সহায়কের পদ শূন্য রয়েছে।
উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে একজন করে মেডিকেল অফিসার থাকার কথা থাকলেও সবগুলো পদই শূন্য। শুধু সাতবাড়ীয়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নিয়োগ করা মেডিকেল অফিসারকে পার্শ্ববর্তী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা প্রায় অচল।
প্রতিদিনই হাসপাতালে বরাদ্দকৃত সিটের বাইরে রোগী ভর্তি হচ্ছেন। তাই তাদের ফ্লোরে অথবা বারান্দায় বিছানা পেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। গাইনি ও এনেসথেসিয়া ডাক্তার না থাকায় অপরেশন বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিন আউটডোরে প্রায় ৪০০ রোগী সেবা নিয়ে থাকেন। জরুরি বিভাগ ও প্রসূতি সেবাও ভেঙে পড়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের অদক্ষ অপারেটার ও এক্স-রে মেশিন বিকল রয়েছে। প্রয়োজনীয় ল্যাব টেস্টও করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে রোগীরা বাধ্য হচ্ছেন, কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল বা বেসরকারি ক্লিনিকে ছুটে যেতে। ডাক্তার না থাকায় হাসপাতালে সনো করা বন্ধ রয়েছে।
হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. পলাশ চন্দ্র দেবনাথ (কোড নং-১৩১৯০০) ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনদিনের নৈমিত্তিক ছুটি নেন। কিন্তু ছুটি শেষে আর অফিসে যোগ দেননি।
জনশ্রুতি রয়েছে, তিনি কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে চলে গেছেন। এ ঘটনায় এলাকায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
রোগীরা বলছেন, সরকারি বেতন খেয়ে ডাক্তার যদি অবৈধভাবে বিদেশে চলে যান, তাহলে আমাদের চিকিৎসা সেবা কে দেবে? ডা. দেবনাথের দীর্ঘ অনুপস্থিতি ইতোমধ্যে হাসপাতালের চিকিৎসা সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
হাসপাতালের ভেতরে থাকা সক্রিয় দালালচক্র এখান থেকে রোগীদের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়। সরকারি বরাদ্দের খাবারও রোগীরা ঠিকভাবে পান না।
হাসপাতালের গেটের সামনে রয়েছে তিনটি প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অভিযোগ রয়েছে, যেকোনো টেস্টের সময় এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা রোগীদের হাত ধরে টানাটানি করে নিজেদের সেন্টারে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এতে রোগীরা বিব্রত ও চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
সম্প্রতি জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের নির্দেশে হাসপাতালের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারী বদলি হয়েছেন। এতে স্বাস্থ্য সহকারী, দফতরি, ওয়ার্ড বয়, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সংকট আরো তীব্র হয়েছে।
এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন দৌলতপুর, মিরপুর ও ঈশ্বরদী অঞ্চলের মানুষও। কিন্তু চিকিৎসকের অভাব, পরীক্ষার সীমাবদ্ধতা আর অনিয়মের কারণে তাদের অবস্থাও নাভিশ্বাস। শেষ পর্যন্ত অনেককে বাধ্য হয়ে কুষ্টিয়া শহরের হাসপাতালে যেতে হয়, যা সময়, অর্থ ও কষ্ট তিনটিই বাড়িয়ে দেয়।
ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট রয়েছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করি, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ডা. পলাশ চন্দ্র দেবনাথ (কোড নং- ১৩১৯০০) অনুপস্থিত থাকায় বিষয়টি জানিয়ে নতুন ডাক্তারের জন্য ঊর্ধ্বতন কার্যালয়ে একাধিককার আবেদন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল ইসলাম বলেন, “হাসপাতালের অনিয়ম ও চিকিৎসক সংকট বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে চিকিৎসক সংকট একটি জাতীয় সমস্যা।” হাসপাতালের অনিয়মের বিষয়েও যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে বলে জানান তিনি।
কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন ডা. শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন. “ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। স্টাফদের অনিয়ম ও দুর্ব্যবহারের বিষয়টি খতিয়ে দেখব। তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।”
ঢাকা/কাঞ্চন/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ব স থ য কমপ ল ক স একজন ম দ বন থ উপজ ল সরক র ত নজন দ ইজন
এছাড়াও পড়ুন:
জবি ছাত্র জোবায়েদ হত্যা মামলায় ২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জোবায়েদ হোসেন হত্যা মামলায় দুইজন সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
বুধবার (১৯ নভেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দীন তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
আরো পড়ুন:
সখীপুরে মেয়েকে হত্যার পর নিজেকে শেষ করলেন মা
নেত্রকোণায় চালককে হত্যা করে মোটরসাইকেল ছিনতাই
সাক্ষীরা হলেন, জবি শিক্ষার্থী সৈকত হোসেন এবং সালাউদ্দিন স্পেশালাইজড হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. ওয়াহিদুর রহমান। সৈকত নিহত জোবায়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই এবং ডা. ওয়াহিদ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি বর্ষার মামা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বংশাল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফ হোসেন সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য আবেদন করেন।
জবানবন্দিতে সৈকত বলেন, “আমি জবির ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ও জোবায়েদ ভার্সিটির বড় ভাই। আমি জোবায়েদ ভাইয়ের ক্লোজ ছোট ভাই হওয়াতে বর্ষা আমার নাম্বার জোবায়েদ ভাই থেকে নেয়। মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপ হাই, হ্যালো কথাবার্তা হত। ২-৩ মাস আগে বর্ষা আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। তখন থেকে বর্ষার সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। জোবায়েদ ভাই প্রায় ১ বছর ধরে বর্ষাকে বাসায় টিউশন পড়াত।”
তিনি বলেন, “ভার্সিটি এলাকায় থাকাকালে গত ১৯ অক্টোবর বিকেল ৫টা ৫৮ মিনিটের দিকে বর্ষা তাকে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ দেয়, ‘ভাইয়া কই তুমি?’ আমি জানাই ক্যাম্পাসে। বর্ষা বলে, ‘স্যারের আম্মুর নাম্বার আছে?’ কারণ জানতে চাইলে বর্ষা বলে, ‘লাগবে।’ ভাইয়ের কিছু হয়ছে কি না জানতে চাইলে বর্ষা বলে, ‘ভাইরে (জোবায়দে) কে জানি মাইরা ফেলছে।’ আমি বলি, মাইরা ফেলছে বলতে? বর্ষা বলে, ‘খুন করে ফেলছে।’ তখন বর্ষাকে কল দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। এরপর বিষয়টি বড় ভাইদের জানাই।”
ডা. ওয়াহিদুর রহমান জবানবন্দিতে বলেন, “গত ১৯ অক্টোবর সাপ্তাহিক নৈশ্যকালীন ডিউটি থাকায় বাসায় অবস্থান করছিলাম এবং ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছিলাম। হঠাৎ আমার স্ত্রীকে দ্বিতীয় তলার চাচাতো ভাই ফোন করে জানায়, সিঁড়িতে কোনো একজন লোক পড়ে আছে। আমরা তখন সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেখি সিঁড়ির মাঝামাঝি একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।”
তিনি বলেন, “তাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির লোকজন জড় হয়ে যায় এবং সেখানে শনাক্ত হয় যে, আমার ভাগ্নি বর্ষার প্রাইভেট টিউটর জুবায়েদের মরদেহ। তাৎক্ষণিক ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশকে অবহিত করি।”
বর্ষার মামা জানান, পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন তার ভাগ্নি বর্ষার সঙ্গে মাহির নামক এক ছেলের প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং জোবায়েদ মাস্টারের সঙ্গেও বর্ষার প্রেম ছিল। এই দ্বন্দ্বের কারণে মাহির রহমান, জোবায়েদ মাস্টারকে হত্যা করে ঘটনার দিন দৌড়ে পালিয়ে যায়।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, মো. জোবায়েদ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করতেন। প্রতিদিনের মতো গত ১৯ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বংশাল থানাধীন ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে নুর বক্স লেনের ১৫ নম্বর হোল্ডিং রৌশান ভিলায় বর্ষাকে পড়ানোর জন্য যান।
সন্ধ্যা ৫টা ৪৮ মিনিটের দিকে ওই ছাত্রী জোবায়েদ হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই সৈকতকে ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে জানায়, “জোবায়েদ স্যার, খুন হয়ে গেছে। কে বা কারা জোবায়েদ স্যারকে খুন করে ফেলছে।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. কামরুল হাসান ৭টার দিকে জোবায়েদের ভাই এনায়েত হোসেনকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তথ্যটি জানান। এনায়েত তার শ্যালক শরীফ মোহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে সাড়ে ৮টার দিকে ঘটনাস্থল রৌশান ভিলায় পৌঁছান। ভবনের নিচতলা থেকে ওপরে ওঠার সময় সিঁড়ি এবং দেয়ালে রক্তের দাগ দেখতে পান। ওই ভবনের তৃতীয় তলার রুমের পূর্ব পার্শ্বে সিঁড়িতে জোবায়েদের রক্তাক্ত মরদেহ উপুড় অবস্থায় দেখতে পান।
ঘটনার দুইদিন পর ২১ অক্টোবর জোবায়েদের ভাই এনায়েত হোসেন বংশাল থানায় মামলা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজসে জোবায়েদকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলার ডান পাশে আঘাত করে হত্যা করেছে।
মামলায় বর্ষা, তার প্রেমিক মো. মাহির রহমান, মাহিরের বন্ধু ফারদীন আহম্মেদ আয়লান ২১ অক্টোবর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছে।
ঢাকা/লিমন/মেহেদী