ট্রাম্পকে যে কৌশলে বশে আনলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান
Published: 8th, October 2025 GMT
২৫ সেপ্টেম্বর ওভাল অফিসে যা ঘটেছিল, কয়েক বছর আগে সেটা কল্পনা করাও যেত না। সেখানে এক পাশে বসেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। তাঁদের অপর পাশে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প প্রশংসা করে অতিথিদের বলেন, ‘খুব দারুণ মানুষ।’
এ বছর হোয়াইট হাউসে এটিই ছিল মুনিরের দ্বিতীয়বারের মতো বৈঠক। কয়েক দশকের মধ্যে পাকিস্তানের কোনো সেনাপ্রধান এমন সুযোগ পাননি। ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর এ সাক্ষাৎ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পরিবর্তনের বড় ইঙ্গিত। একসময়ের অবিশ্বস্ত ও সমাজচ্যুত দেশ থেকে আঞ্চলিক অংশীদার মর্যাদায় পাকিস্তানকে পুনর্বাসন।
ট্রাম্প সেই একই প্রেসিডেন্ট, যিনি তাঁর প্রথম মেয়াদে পাকিস্তানকে প্রকাশ্যেই কঠোর সমালোচনা করে বলেছিলেন, দেশটি ‘মিথ্যা ও প্রতারণা ছাড়া’ কিছু দেয়নি।
পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দেওয়াও তিনি বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু এখন অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সম্পর্ক ঘুরে গেছে। বাইডেন প্রশাসনের সময় উপেক্ষার পাত্র হওয়া পাকিস্তানের সেনা নেতৃত্ব এখন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ পাচ্ছেন।
আরও পড়ুনপাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি, এখন কী করবে ভারত-ইসরায়েল২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের এ মোড় পরিবর্তন নতুন কোনো মূল্যবোধ বা বড় কোনো কৌশলগত পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে হয়নি; বরং এটি এমন কিছু কার্যকর পদক্ষেপের ওপর নির্মিত হয়েছে, যেটা সরাসরি ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মোহাম্মদ শরিফুল্লাহর গ্রেপ্তার। তিনি ২০২১ সালে কাবুলে অ্যাবি গেট বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলে অভিযুক্ত। ওই হামলায় মার্কিন ১৩ সেনা নিহত হয়েছিলেন। গত মার্চে সিআইএর তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে আটক করে।
ট্রাম্পের জন্য এটি ছিল মার্কিন জনগণের সামনে পরিষ্কার বিজয় দেখানোর মতো একটি ঘটনা। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে বিশৃঙ্খলভাবে সরে আসার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে যে ব্যর্থতাবোধ তৈরি হয়েছিল, তার বিপরীতে এ গ্রেপ্তার ছিল একটা সাফল্য।
দ্বিতীয়টি ছিল ট্রাম্পের অহংবোধকে বুঝে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সেটা খুশি করার কৌশল। মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ বন্ধের পর ইসলামাবাদ অতি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপকে শান্তি স্থাপনের কারণ হিসেবে স্বীকার করে।
ওয়াশিংটনের জন্য সরাসরি পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের সঙ্গে কাজ করা সুবিধাজনক। কারণ, দেশটির প্রকৃত ক্ষমতার কেন্দ্রের সঙ্গে এটা সরাসরি যোগাযোগ। যদিও পাকিস্তানের গণতন্ত্রের সমর্থকদের জন্য এটি উদ্বেগের বিষয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটিই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ।নয়াদিল্লি যদিও ট্রাম্পের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল। অন্যদিকে পাকিস্তান চতুরতার সঙ্গে আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে। একজন নেতা যিনি পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যক্তিগতভাবে নেন, তাঁর জন্য তোষামোদ হলো খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতোই ব্যাপার।
তৃতীয়ত, এখানে অর্থনৈতিক মধুও আছে। পাকিস্তানের বিরল খনিজ ও তেল অনুসন্ধান থেকে শুরু করে ট্রাম্পের পরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রকল্প—সবকিছুর জন্য চুক্তি করা হচ্ছে।
ট্রাম্প তাঁর নিজের বক্তব্যে বলেছেন, পাকিস্তানে ‘বিশাল তেলের মজুত’ রয়েছে। কিন্তু তাঁর এ দাবি জ্বালানিবিশেষজ্ঞদের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকেছে। ট্রাম্পের এ বক্তব্য যতটা ভূতত্ত্ব বা জ্বালানিসংক্রান্ত, তার চেয়ে বেশি নতুন অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব–সম্পর্কিত ইঙ্গিত।
যুক্তরাষ্ট্র ইসলামাবাদকে (১৯ শতাংশ) ভারতের (৫০ শতাংশ) সঙ্গে তুলনায় অনেক কম শুল্ক ধার্য করেছে। মনে করা হচ্ছে পাকিস্তানের সম্পদ ব্যবহারে যুক্তরাষ্টের প্রবেশাধিকারের বিনিময়ে এ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুনট্রাম্প আবার যেভাবে মোদিকে ধোঁকা দিলেন২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫পাকিস্তানের জন্য এই আমেরিকান আলিঙ্গন দেশটিকে বড় ধরনের কূটনৈতিক সুরক্ষা দেয়। এটি ইসলামাবাদকে ওয়াশিংটন বিরক্ত হবে কি না, এ ভয়ের বাইরে বেরিয়ে নিজেদের আত্মবিশ্বাসী ভূ-অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করার সুযোগ করে দেয়।
সৌদি আরবের সঙ্গে সম্প্রতি প্রতিরক্ষা চুক্তি (আগের যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন যেটিকে গভীর সন্দেহের চোখে দেখত) করেছে পাকিস্তান। এটা সম্ভব হয়েছে পাকিস্তানের নেতৃত্ব হোয়াইট হাউসের সঙ্গে নিজেদের অবস্থান নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হওয়ায়।
এই নতুন স্বাধীনতা পাকিস্তানকে একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার সুযোগ দেয়। ফলে পাকিস্তান বিশ্বের এমন বিরল দেশের একটি, যারা বিশ্বের দুই পরাশক্তির মধ্যে সমন্বয় করতে পারে।
সাম্প্রতিক সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন অনেক ক্ষেত্রে মার্কিন-পাকিস্তান সম্পর্কের ঐতিহাসিক স্বাভাবিক স্তরে ফিরে যাওয়ার মতো। এ অংশীদারত্ব সব সময় সুবিধা ও সমস্যার মিশ্রণ হিসেবে ওঠানামা করেছে।
শীতল যুদ্ধের সময় পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত’। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার সম্পর্ককে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। তখন পাকিস্তানকে সোভিয়েত সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে একটি দুর্গ হিসেবে দেখা হতো।
৯/১১–পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ‘সামনের সারির দেশে’ পরিণত হয়। কোটি কোটি ডলারের কোয়ালিশন সাপোর্ট ফান্ডের বিনিময়ে পাকিস্তানের এ সহযোগিতা কেনা হয়েছিল। তবে ড্রোন হামলা এবং ২০১১ সালে অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে আবিষ্কারের ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সেই তিক্ত সম্পর্কের যৌক্তিক সমাপ্তি দেখা গিয়েছিল। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা বাতিল করেছিল। বর্তমান উষ্ণ সম্পর্কও সেই একই চক্রের ওঠানামা। যৌথ আদর্শের কারণে নয়; বরং নতুন পারস্পরিক স্বার্থের কারণেও সম্পর্ক আবার উষ্ণ হয়েছে।
পেন্টাগন ও ল্যাংলির (সিআইএর সদর দপ্তর) ঝানু কর্মকর্তারা ভালো করেই জানেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের রাস্তাটি হলো রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দপ্তর।
এমনকি যখন রাজনৈতিক সম্পর্ক চূড়ান্ত শীতল থাকে, তখনো দুই দেশের সামরিক সম্পর্ক টিকে থাকে। মুনিরের বারবার যুক্তরাষ্ট্র সফর (প্রথমে জুনে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজ, তারপর সেন্টকম কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং সর্বশেষ ওভাল অফিস) এ বাস্তবতারও স্বীকৃতি।
আরও পড়ুনভারত ও পাকিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন খেলা০৬ আগস্ট ২০২৫ওয়াশিংটনের জন্য সরাসরি পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের সঙ্গে কাজ করা সুবিধাজনক। কারণ, দেশটির প্রকৃত ক্ষমতার কেন্দ্রের সঙ্গে এটা সরাসরি যোগাযোগ। যদিও পাকিস্তানের গণতন্ত্রের সমর্থকদের জন্য এটি উদ্বেগের বিষয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটিই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পথ।
যাহোক যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের এ পরিবর্তন বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। ২০ বছর ধরে ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ ঐকমত্য ছিল যে চীনের উত্থানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে গণতান্ত্রিক ও কৌশলগতভাবে শক্তিশালী করবে। পাকিস্তানের সঙ্গে ট্রাম্পের লেনদেনভিত্তিক সহযোগিতা সেই নীতিকে উল্টে দিয়েছে।
রাশিয়ার তেল কেনার জন্য ভারতের ওপর শুল্ক চাপানো এবং মে মাসের সংঘাতে পাকিস্তানের পাশে হোয়াইট হাউসের দাঁড়ানোর ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘদিনের মিত্রকে ক্ষুব্ধ করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় নরেন্দ্র মোদি সাত বছরের মধ্যে প্রথমবার চীন সফর করেন।
যাহোক, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এখন চুপচাপ করে সম্পর্ক মেরামত এবং একটি বাণিজ্যচুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
হোয়াইট হাউসের কাছে আপাতত ইসলামাবাদের নেতারা ‘খুব দারুণ মানুষ’ হতে পারেন। কিন্তু ইতিহাস দেখায়, এই রোলারকোস্টারে পরের ঢাল খুব কাছেই।
এলফাদিল ইব্রাহিম একজন লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র য ক তর ষ ট র প ইসল ম ব দ ন র জন য হয় ছ ল কর ছ ল অব শ ব সবচ য় ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
গণভোটের ব্যালট পেপার হবে রঙিন
এর আগে গতকাল দুপুরে গণভোট অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গণভোট অধ্যাদেশের বিষয়বস্তু এবং এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব আখতার আহমেদ ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এর আগে ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর ওই ভাষণের আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এ আদেশ জারি করেন। তাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট একই দিনে করার কথা জানানো হয়। এর মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ আইনি ভিত্তি পায়।
এর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনায় ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে তৈরি করা হয় জুলাই জাতীয় সনদ। এর মধ্যে ৪৮টি প্রস্তাব সংবিধান-সংক্রান্ত। তবে বেশ কিছু প্রস্তাবে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের ভিন্নমত আছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়। কিন্তু সনদ ও গণভোটের আইনি ভিত্তি, সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত থেকে যায়। গত ২৮ অক্টোবর সনদ বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প সুপারিশ সরকারকে দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে গণভোটের সময় নিয়ে সিদ্ধান্তের ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
এখন গণভোট আয়োজনের লক্ষ্যে এ–সংক্রান্ত নতুন অধ্যাদেশ জারি করল সরকার।
গণভোটে প্রশ্ন কী হবে
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাদেশের বিষয়বস্তু তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেন, চার বিষয়ে গণভোটে প্রশ্ন থাকবে একটি। প্রশ্নটি হলো ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার–সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’ যাঁরা সম্মতি জানাবেন তাঁরা ‘হ্যাঁ’ ভোট দেবেন এবং যাঁরা সম্মতি জানাবেন না তাঁরা ‘না’ ভোট দেবেন।
যে চারটি বিষয়ের ওপর গণভোট হবে সেগুলো হলো:
ক. নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
খ. আগামী জাতীয় সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
গ. সংসদে নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও কয়েকটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেসব বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
ঘ. জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
অধ্যাদেশে জুলাই সনদ অনুসারে যে ৩০টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো তফসিল আকারে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের বিষয়ে বলা হয়েছে একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে যত মেয়াদ বা যতবারই হোক, সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন, এ জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। এ রকম ঐকমত্য হওয়া অন্যান্য প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে।
আরও যেসব বিধান আছে
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করা হবে, সেগুলোতেই গণভোট হবে। সংসদ নির্বাচনের জন্য তৈরি করা ভোটার তালিকাই হবে গণভোটের ভোটার তালিকা। সংসদ নির্বাচনের সময়ই হবে গণভোটের সময়। তবে গণভোটের ব্যালট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালট থেকে পৃথক হবে। গণভোটের ব্যালট হবে ভিন্ন রঙের; যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয়।
আসিফ নজরুল বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বা পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে, তাঁরা গণভোটেও দায়িত্ব পালন করবেন।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, যদি কোনো কারণে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মনে করেন ভোট নেওয়া যাচ্ছে না, তাহলে তিনি তা স্থগিত করতে পারবেন। এ–সংক্রান্ত অন্যান্য নিয়মকানুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই থাকবে।
গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল একই দিনে হবে বলে জানান উপদেষ্টা। আর গণভোট নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো হবে বলেও জানান আইন উপদেষ্টা।
ভোটের মহড়া শনিবার
সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের প্রস্তুতির তথ্য তুলে ধরেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ। তিনি বলেন, এখন ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তাঁর ধারণা, সব ঠিকমতো চললে আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটার তালিকা সম্পন্ন হয়ে যাবে। সেই তালিকা অনুযায়ী তাঁরা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবেন। এ সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ অন্যান্য প্রস্তুতির কথা তুলে ধরেন তিনি।
ইসি সচিব বলেন, দুই ধরনের ব্যালট পেপার থাকবে, দুই রঙের ব্যালট পেপার হবে। প্রথাগতভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যালট পেপার হয় সাদা-কালো। এ ক্ষেত্রে গণভোটের জন্য একটা রঙিন কাগজ ব্যবহার করা হবে।
যে চার শ্রেণির নাগরিকেরা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন, তাঁরা হলেন প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবী যাঁরা কর্মসূত্রে নিজের নির্বাচনী এলাকার বাইরে দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করেন, যাঁরা আইনি হেফাজতে আছেন এবং যাঁরা নির্বাচনের দিন দায়িত্ব পালন করেন।
গণভোটের কারণে ভোটকেন্দ্র বাড়াতে হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ২৯ নভেম্বর শনিবার একটা রিহার্সাল (মহড়া) করবেন। তারপর সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন ভোটকেন্দ্র বাড়াতে হবে কি না।
প্রসঙ্গত, ইসি আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য সারা দেশে ৪২ হাজার ৭৬১টি ভোটকেন্দ্র এবং ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯টি ভোটকক্ষ (বুথ) নির্ধারণ করেছে। ইসি এবার গড়ে ৩ হাজার ভোটারের জন্য একটি ভোটকেন্দ্র এবং ৫০০ পুরুষ ভোটারের জন্য একটি করে ও ৪০০ নারী ভোটারের জন্য একটি করে ভোটকক্ষ নির্ধারণ করেছে।
ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষের হিসাব করা হয়েছিল শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে করতে ভোটকেন্দ্র না হলেও ভোটকক্ষ বা বুথের সংখ্যা বাড়াতে হতে পারে। কারণ, দুটি ভোট দিতে সময় বেশি লাগবে। ভোটকেন্দ্র বা ভোটকক্ষ বাড়ানো হলে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যাও বাড়াতে হবে।