রাজনীতি একটি শাস্ত্র বটে। কিন্তু শাস্ত্র মেনে রাজনীতি হয় না। এর নিজস্ব একটি ভাষা আছে। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ, অনুরাগ-বিরাগ ইত্যাদি অনেকটাই নির্ধারণ করে দেয় রাজনীতি কোন পথে, কোন ছন্দে, কোন গতিতে চলবে।

রাজনীতি করতে তাই পলিটিক্যাল সায়েন্স বা রাজনীতিবিজ্ঞানের ডিগ্রি না হলেও চলে। এমনকি বকলম হলেও অসুবিধা নেই। আমাদের নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের জন্য আবেদনপত্রে কয়েকটি তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। তার মধ্যে একটি হলো শিক্ষাগত যোগ্যতা। এই যোগ্যতার অর্থ হলো, প্রার্থীর পড়াশোনা কোন স্তরের, তিনি কী ডিগ্রি পেয়েছেন। কেউ কেউ তথ্য পূরণ করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, তিনি ‘স্বশিক্ষিত’। কথাটা জুতসই। ডিগ্রির একটা বাজারমূল্য আছে। কোনো ডিগ্রি নেই—এ কথা জানাজানি হয়ে গেলে ভাবমূর্তির সংকট হতে পারে। তাই স্বশিক্ষিত বলা। কেউ কেউ অবশ্য ফান করেও এটা লিখতেন।

 রাজনীতির লাইসেন্স নেয় যারা, আমরা তাদের বলি রাজনৈতিক দল। দলের এক বা একাধিক শাস্ত্র আছে। দল কীভাবে চলবে, সে জন্য আছে গঠনতন্ত্র বা দলীয় সংবিধান। দল কী চায়, কোথায় যেতে চায়, সে জন্য আছে ঘোষণাপত্র। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও পবিত্র শব্দমালায় সাজানো হয় এই ঘোষণাপত্র। এখানেই শেষ নয়। নির্বাচন এলে নতুন করে অনেক কিছু বলতে হয়। এর নাম ইশতেহার বা ইস্তাহার, যে বানানেই লেখা হোক না কেন। সেখানে থাকে একটি প্রলম্বিত মুখবন্ধ বা ভূমিকা। সেখানে বলা হয়, এই একটিমাত্র দল, যারা
ধরায় এসেছে ত্রাতার ভূমিকায়। তারাই মানুষের সত্যিকারের বন্ধু। বাকি সবাই শত্রু। এরপর থাকে প্রতিশ্রুতির এক দীর্ঘ তালিকা।

দলগুলোকে মোটাদাগে দুভাগ করা যায়—পুরোনো ও নতুন। পুরোনো দলগুলো তুলে ধরে তাদের অতীতের কাজকারবারের ফিরিস্তি। কখনো ক্ষমতায় গিয়ে থাকলে তার অর্জন আর সফলতার বয়ান। সেখানে সবকিছু ভালো। তারা কখনো কোনো খারাপ কাজ করেনি। কাউকে কষ্ট দেয়নি। কোনো কটুকথা বলেনি। সরকারি দপ্তরে কোনো ফাইল আটকে থাকেনি। চারদিকে শুধু সুখ আর সুখ। তাদের বিরুদ্ধে কোনো খারাপ কাজের অভিযোগ থাকলে সেটি হচ্ছে দুষ্ট লোকের অপপ্রচার।

দল পুরোনো, কিন্তু ক্ষমতার উঠানে কিংবা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করলেও খাসকামরায় কখনো ঢুকতে পারেনি, তাদের ওয়াজ এ রকম: নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ায় আমরা হেরেছি বা আমাদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি একবার ক্ষমতায় যেতে পারি, তাহলে দেশটা সোনায় মুড়ে দেব। দেশে কোনো সমস্যা থাকবে না। চারদিকে শুধু শান্তি আর শান্তি।

কেউ কেউ এ কথাও বলেন, এই ঘুণে ধরা বুর্জোয়া সমাজে গরিবের সরকার হবে না। তাই বিপ্লব করতে হবে। এ দেশে বিপ্লবীর সংখ্যা মশা-মাছির চেয়েও বেশি। এমন কোনো বছর নেই, যে বছর বিপ্লবীদের দল ভাঙেনি। তারা অনবরত ভাঙে। তারপর ভাঙা টুকরাগুলো মিলে ঐক্য গড়ে, জোট বানায়। সেই জোট আবার ভাঙে। একেকটা টুকরা নানান ‘বুর্জোয়া’ দলের সঙ্গে জোটে। কারণ হিসেবে বলে, এটা হচ্ছে কৌশলগত ঐক্য। ওই যে মাও সে–তুং একদা চিয়াং কাইশেকের সঙ্গে ঐক্য করেছিলেন!

একেবারে আনকোরা দল আছে কিছু। তাদের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নেই। এরা আগে কোনো দলের সঙ্গেও ছিল না। তারা রাজনীতির জলে সাঁতার কাটছে। হাবুডুবু খাচ্ছে। অতল জলে পায়ের নিচে মাটি পাচ্ছে না। তাদের কারও কারও অতীতে কালো দাগ নেই। রাজনীতির কূটচালে অভিজ্ঞতা নেই। কখন কী বলতে হয়, জানে না। একদিন মুখ ফসকে একটা কথা বলে ফেলে। পরদিন বুঝতে পেরে বলে উল্টো কথা।

আমাদের দেশে একটা গোষ্ঠী আছে। আমরা তাদের বলি ফেসবুকার বা টিকটকার। তারা বেশ সেয়ানা। এই একটা প্রযুক্তি, যেখানে আমাদের কিশোর-তরুণদের পারঙ্গমতা সিলিকন ভ্যালি কিংবা নাসার বিজ্ঞানীদেরও হার মানায়! কে, কবে, কোথায় কী বলেছে, তার রেকর্ড রেখে দেয়। সুযোগমতো সেটা ছড়িয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।

 আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার কথা কী আর বলব! এখানে যত ‘অসামাজিক’ কাজ হয়, তাতে অ্যান্টিসোশ্যাল মিডিয়া নাম দিলেও ভুল হবে না। এটা এমন একটা প্ল্যাটফর্ম, যেখানে কে কাকে ওঠাবে, নামাবে, বাঁচাবে, ঠেঙাবে, মারবে বলা মুশকিল।

 একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, আমি একটা লেখা লিখেছিলাম ১২ বছর আগে। এখন লিখছি অন্য রকম। তো এক ফেসবুকার আমার টুঁটি চেপে ধরল—তুমি তখন ওই কথা বলেছ, এখন কেন এ কথা বলো? এই ১২ বছরে যে কত বই, কত তথ্য-উপাত্ত হাতের নাগালে এসেছে এবং সেসব জেনে-বুঝে আমি যে আগের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়েছি, এটা তাকে বোঝাই কী করে? কারণ, সে তো বদ্ধ জলাশয়ের জীব। সেখানে স্রোত নেই। তাই সে মননে-মগজে বাড়ে না। স্কুলে ক্লাস সেভেনে উঠে আমি অ্যালজেব্রা শিখতে শুরু করি। আমাকে কেউ যদি বলে, তুমি ক্লাস ফোরে কেন এটা শিখলে না!

 এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রসঙ্গ এসে যায়। একটা দল একসময় ক্ষমতায় ছিল। ওই সময় দলটি অনেক ভুল করেছে, খারাপ কাজ করেছে। দলটি এখনো রাজনীতি করে। আবারও ক্ষমতায় যেতে যায়। ক্ষমতায় গিয়ে আবারও সে খারাপ কাজগুলো করবে না, তার কী নিশ্চয়তা আছে? এখানে দলকে আত্মবিশ্লেষণ করতে হয়। কাজ করতে গেলে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। যে কাজ করে না, তার ভুল হয় না। তো ভুল হয়ে থাকলে সেটি স্বীকার করতে সমস্যা কোথায়?

আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে একধরনের মনস্তত্ত্ব কাজ করে। তাঁরা মনে করেন, ভুল স্বীকার করলে বুঝি তাঁর রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে। এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। মানুষ আসলে দেখতে চায়, কেউ ভুল করে থাকলে সে তার ভুল স্বীকার করুক, অনুতপ্ত হোক।

বলুক, এ রকম ভুলের আর পুনরাবৃত্তি হবে না। রাজনৈতিক নেতারা সে পথে হাঁটেন না। তাঁদের কাছে তাঁদের অতীত পূর্ণিমার জোছনায় উজ্জ্বল। সেখানে কৃষ্ণপক্ষ নেই। মানুষ তো কিছুই ভোলে না। সে ধরেই নেয়, ওই দল, ওই নেতা মিথ্যাচার করছে। এটা যে
দলের নেতারা বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু তাঁদের মনে ভয়, ভুল স্বীকার করলে রাজনীতিতে ‘আউট’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

সমাজে নতুন-পুরোনোর দ্বন্দ্ব চিরন্তন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। একদা যে তরুণ মানুষের জন্য, দেশের জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে ইতস্তত করেনি, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয়। একসময় তার মগজে জং ধরে যায়। সে হয়ে ওঠে মিথ্যাবাদী, লোভী, দুর্বৃত্ত, ক্ষমতালিপ্সু, অত্যাচারী। তারপরও আমাদের আশা আর ভরসা তরুণদের ওপরেই। যুগে যুগে তারাই আলো হাতে এসেছে আমাদের মতো আঁধারের যাত্রীদের পথ দেখাতে। তাদের নিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন ‘ঐতিহাসিক’ নামে একটি কবিতা। সেখানে তিনি বলছেন:

মূর্খ তোমরা

লাইন দিলে: কিন্তু মুক্তির বদলে কিনলে মৃত্যু,

রক্তক্ষয়ের বদলে পেলে প্রবঞ্চনা।

ইতিমধ্যে তোমাদের বিবদমান বিশৃঙ্খল ভিড়ে

মুক্তি উঁকি দিয়ে গেছে বহুবার।

লাইনে দাঁড়ানো আয়ত্ত করেছে যারা,

সোভিয়েট, পোল্যান্ড, ফ্রান্স

রক্তমূল্যে তারা কিনে নিয়ে গেল তাদের মুক্তি

সর্বপ্রথম এই পৃথিবীর দোকান থেকে।

এখনও এই লাইনে অনেকে প্রতীক্ষমাণ

প্রার্থী অনেক; কিন্তু পরিমিত মুক্তি।

হয়তো এই বিশ্বব্যাপী লাইনের শেষে

এখনও তোমাদের স্থান হতে পারে—

এ কথা ঘোষণা করে দাও তোমাদের দেশময়

প্রতিবেশীর কাছে।

তারপর নিঃশব্দে দাঁড়াও এ লাইনে প্রতিজ্ঞা আর প্রতীক্ষা নিয়ে

হাতের মুঠোয় তৈরি রেখে প্রত্যেকের প্রাণ।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ভ ল স ব ক র কর ক ষমত য় র জন ত ক জ কর আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

গণভোটের ব্যালট পেপার হবে রঙিন

এর আগে গতকাল দুপুরে গণভোট অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গণভোট অধ্যাদেশের বিষয়বস্তু এবং এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব আখতার আহমেদ ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

এর আগে ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর ওই ভাষণের আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এ আদেশ জারি করেন। তাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট একই দিনে করার কথা জানানো হয়। এর মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ আইনি ভিত্তি পায়।

এর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনায় ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে তৈরি করা হয় জুলাই জাতীয় সনদ। এর মধ্যে ৪৮টি প্রস্তাব সংবিধান-সংক্রান্ত। তবে বেশ কিছু প্রস্তাবে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের ভিন্নমত আছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য হয়। কিন্তু সনদ ও গণভোটের আইনি ভিত্তি, সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত থেকে যায়। গত ২৮ অক্টোবর সনদ বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প সুপারিশ সরকারকে দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে গণভোটের সময় নিয়ে সিদ্ধান্তের ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
এখন গণভোট আয়োজনের লক্ষ্যে এ–সংক্রান্ত নতুন অধ্যাদেশ জারি করল সরকার।

গণভোটে প্রশ্ন কী হবে

সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাদেশের বিষয়বস্তু তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেন, চার বিষয়ে গণভোটে প্রশ্ন থাকবে একটি। প্রশ্নটি হলো ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার–সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’ যাঁরা সম্মতি জানাবেন তাঁরা ‘হ্যাঁ’ ভোট দেবেন এবং যাঁরা সম্মতি জানাবেন না তাঁরা ‘না’ ভোট দেবেন।

যে চারটি বিষয়ের ওপর গণভোট হবে সেগুলো হলো:
ক. নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।

খ. আগামী জাতীয় সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।

গ. সংসদে নারী প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও কয়েকটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেসব বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।

ঘ. জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।

অধ্যাদেশে জুলাই সনদ অনুসারে যে ৩০টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো তফসিল আকারে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের বিষয়ে বলা হয়েছে একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে যত মেয়াদ বা যতবারই হোক, সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন, এ জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। এ রকম ঐকমত্য হওয়া অন্যান্য প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে।

আরও যেসব বিধান আছে
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করা হবে, সেগুলোতেই গণভোট হবে। সংসদ নির্বাচনের জন্য তৈরি করা ভোটার তালিকাই হবে গণভোটের ভোটার তালিকা। সংসদ নির্বাচনের সময়ই হবে গণভোটের সময়। তবে গণভোটের ব্যালট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালট থেকে পৃথক হবে। গণভোটের ব্যালট হবে ভিন্ন রঙের; যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয়।
আসিফ নজরুল বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বা পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে, তাঁরা গণভোটেও দায়িত্ব পালন করবেন।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, যদি কোনো কারণে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মনে করেন ভোট নেওয়া যাচ্ছে না, তাহলে তিনি তা স্থগিত করতে পারবেন। এ–সংক্রান্ত অন্যান্য নিয়মকানুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই থাকবে।
গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল একই দিনে হবে বলে জানান উপদেষ্টা। আর গণভোট নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো হবে বলেও জানান আইন উপদেষ্টা।

ভোটের মহড়া শনিবার
সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের প্রস্তুতির তথ্য তুলে ধরেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ। তিনি বলেন, এখন ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তাঁর ধারণা, সব ঠিকমতো চললে আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটার তালিকা সম্পন্ন হয়ে যাবে। সেই তালিকা অনুযায়ী তাঁরা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবেন। এ সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ অন্যান্য প্রস্তুতির কথা তুলে ধরেন তিনি।

ইসি সচিব বলেন, দুই ধরনের ব্যালট পেপার থাকবে, দুই রঙের ব্যালট পেপার হবে। প্রথাগতভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যালট পেপার হয় সাদা-কালো। এ ক্ষেত্রে গণভোটের জন্য একটা রঙিন কাগজ ব্যবহার করা হবে।

যে চার শ্রেণির নাগরিকেরা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন, তাঁরা হলেন প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবী যাঁরা কর্মসূত্রে নিজের নির্বাচনী এলাকার বাইরে দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করেন, যাঁরা আইনি হেফাজতে আছেন এবং যাঁরা নির্বাচনের দিন দায়িত্ব পালন করেন।

গণভোটের কারণে ভোটকেন্দ্র বাড়াতে হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ২৯ নভেম্বর শনিবার একটা রিহার্সাল (মহড়া) করবেন। তারপর সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন ভোটকেন্দ্র বাড়াতে হবে কি না।

প্রসঙ্গত, ইসি আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য সারা দেশে ৪২ হাজার ৭৬১টি ভোটকেন্দ্র এবং ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯টি ভোটকক্ষ (বুথ) নির্ধারণ করেছে। ইসি এবার গড়ে ৩ হাজার ভোটারের জন্য একটি ভোটকেন্দ্র এবং ৫০০ পুরুষ ভোটারের জন্য একটি করে ও ৪০০ নারী ভোটারের জন্য একটি করে ভোটকক্ষ নির্ধারণ করেছে।
ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষের হিসাব করা হয়েছিল শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে করতে ভোটকেন্দ্র না হলেও ভোটকক্ষ বা বুথের সংখ্যা বাড়াতে হতে পারে। কারণ, দুটি ভোট দিতে সময় বেশি লাগবে। ভোটকেন্দ্র বা ভোটকক্ষ বাড়ানো হলে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যাও বাড়াতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ