ঝিনাইদহে আওয়ামী লীগের দুই নেতার টানাপোড়েন ও পাল্টাপাল্টি রিট আবেদনে মুখ থুবড়ে পড়েছে জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যক্রম। বিষয়টি আদালতে থাকায় গঠিত হচ্ছে না কমিটি। ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব আয়োজনে তেমন কোনো টুর্নামেন্টও হচ্ছে না। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ক্রীড়া প্রশিক্ষকরা। তারা বলছেন, ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতি কাম্য না। যদিও জটিলতা কাটিয়ে সংস্থার কার্যক্রমে গতি ফেরানোর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্টেডিয়ামে অনুশীলন করছিল খুদে ক্রিকেটার নুর আল সাফিয়া। তার ভাষায়, ‘আমরা অনুশীলন করি, কিন্তু নিয়মিত টুর্নামেন্ট হয় না। অনুশীলনের জ্ঞানটা ধরে রাখতে পারি না।’ এ বিষয়ে মীনা স্মৃতি ক্রিকেট একাডেমি ও জেলার অনূর্ধ্ব-১৪ দলের প্রধান কোচ সৈকত হোসেন বলেন, ক্রীড়াঙ্গন স্বয়ংক্রিয় জায়গা। রাজনৈতিক নেতাদের কোন্দল, গ্রুপিং, ক্ষমতা দখলের প্রভাব কেন ক্রীড়াঙ্গনে পড়বে? নির্বাচিত কমিটির মাধ্যমে রাজনীতিমুক্ত সংস্থা গড়ে উঠুক। 
শহরের স্টেডিয়ামপাড়ায় রয়েছে জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রধান কার্যালয়। চার বছর মেয়াদ থাকে ক্রীড়া সংস্থার কমিটির। ক্রীড়া-সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৪ সালের শেষদিকে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয় ২৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি। এতে পদাধিকারবলে সভাপতি জেলা প্রশাসক। সহসভাপতির চার পদের মধ্যে দুটিতে পদাধিকারবলে থাকেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও পুলিশ সুপার। বাকি পদগুলোয় ভোটের মাধ্যমে সদস্য নির্বাচিত হন।
এ কমিটির মেয়াদকালে কোন্দল দেখা দেয় পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তখনকার জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জীবন কুমার বিশ্বাস এবং যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশিদুর রহমান রাসেলের মধ্যে। পরের সাধারণ সম্পাদক কে হবেন– এ নিয়ে ছিল তাদের বিরোধ। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হয়। তখন বিরোধ বাড়লে নির্বাচন স্থগিত করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। 
ক্রীড়া সংস্থার ভোটার রয়েছেন প্রায় ১০০ জন। জানা গেছে, ভোটার তালিকায় ত্রুটির কথা উল্লেখ করে নির্বাচন স্থগিত করা হয়। এরই মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক পদে থাকতে চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন জীবন কুমার বিশ্বাস। এভাবে দু’দফা পদ বহাল রেখে তৃতীয়বার শুনানির আগে সাধারণ সম্পাদক পদ বহাল রাখার আদেশ বাতিল করে নির্বাচন চেয়ে আরেকটি রিট করেন রাশিদুর রহমান রাসেল।

এ কারণে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ১১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে ছয় বছর ধরে চালানো হচ্ছে ক্রীড়া সংস্থার কার্যক্রম। রিট নিষ্পত্তি না হওয়ায় গঠিত হচ্ছে না নির্বাচিত কমিটি। ক্রীড়া সংস্থা নিজস্বভাবে টুর্নামেন্টও আয়োজন করতে পারছে না। পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কবে এর সুরাহা হবে– নিশ্চিত করতে পারেননি কেউ।
জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুজ্জামান ঝন্টু বলেন, রিটের কারণে ক্রীড়া সংস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেখভাল করার কেউ নেই। সরকারি লোক আসায় ও নির্বাচিত কমিটি না থাকায় নিয়মিত টুর্নামেন্ট হচ্ছে না। ভালো ফুটবলার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে সভার মাধ্যমে টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। সাধারণ সম্পাদক বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষক (স্পন্সর) জোগাড় করেন। এটি প্রশাসনিক কমিটির মাধ্যমে সম্ভব না। ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব আয়োজনে ২০১৮ সালের পর শুধু ২০২০ সালে একটি ক্রিকেট লিগ, একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট, ২০২৩ সালে দুটি ফুটবল টুর্নামেন্ট ও একটি ভলিবল টুর্নামেন্ট হয়। গত বছরে সংস্থার নিজস্ব আয়োজনে কোনো টুর্নামেন্ট হয়নি।
কমিটি গঠন না হওয়া পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক পদে থাকতে চেয়ে রিট করেছিলেন বলে স্বীকার করেছেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি জীবন কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘পুনরায় নির্বাচনের জন্য রাসেল পাল্টা রিট করেন। তিনি সাধারণ সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন। এ কারণেও রিট করতে পারেন।’
ক্রীড়া সংস্থার সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশিদুর রহমান রাসেল ৫ আগস্টের পর একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জেলা প্রশাসক ও ক্রীড়া সংস্থার আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল বলেন, কমিটি গঠনের জন্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছেন। সে অনুসারে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হয়ে আসার পর সংস্থার নিয়মিত কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দ র রহম ন র ট কর কম ট র ফ টবল

এছাড়াও পড়ুন:

নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন

দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।

নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।

মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।

ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।

শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।

চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।

কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।

পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।

ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।

এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ