তরুণদের এই মৃত্যুযাত্রা থামাতেই হবে
Published: 6th, February 2025 GMT
ইতালিতে ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে লিবীয় উপসাগরে নৌকা ডুবে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে মাদারীপুরের সুজন ফরাজীসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি তরুণের। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দানে ড্রোন হামলার শিকার হয়ে নিহত হন নাটোরের হুমায়ুন কবির। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ে ভাগ্যান্বেষী তরুণদের মৃত্যু নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ইতালি গিয়ে ভাগ্য ফেরাতে চেয়েছিলেন সুজন ফরাজী। বাবা রাজি না হওয়ায় তাঁকে না জানিয়ে ফুফুর কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা নিয়ে সুজন ফরাজী ইতালি যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু ইতালি যাওয়া তাঁর হয়নি। ৫৬ জন আরোহী নিয়ে নৌযানটি ২৫ জানুয়ারি ভূমধ্যসাগরে ডুবে গেলে ২৩টি লাশ সৈকতে ভেসে আসে। এর মধ্যে সবাই যে ডুবে মারা গেছেন, তা নয়। ফরিদপুরের কামারখালীর হৃদয় হাওলাদারের বাবা মিন্টু হাওলাদার জানিয়েছেন, ২৪ জানুয়ারি রাতে তাঁদের জাহাজে করে ইতালি নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছোট বোটে করে নিতে চাইলে অনেকে বোটে উঠতে চাননি। যাঁরা উঠতে চাননি, তাঁদের গুলি করে হত্যা করেছে। যাঁরা উঠেছেন, তাঁরা ডুবে মারা গেছেন।
কী ভয়াবহ পরিস্থিতি! যে দালালদের খপ্পরে পড়ে দেশের তরুণেরা বিদেশে গিয়ে হারিয়ে যান, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। জনশক্তি রপ্তানির নামে একশ্রেণির দালাল বিদেশে ভাগ্যান্বেষী তরুণদের খুঁজে বের করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার মজুমদারকান্দি এলাকার মনির শেখ নামের এক দালাল সুজনের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকায় ইতালি নেওয়ার চুক্তি করেছিলেন। লিবিয়ায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মাদারীপুর ও ফরিদপুরের অন্তত ১২ জন আছেন বলে স্বজনদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
দালালদের একটি চক্র লিবিয়ায় ইতালিগামী তরুণদের বন্দিশিবিরে আটক করে নির্যাতন চালায়। দেশে থাকা স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করার পরই তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, গত দেড় বছরে লিবিয়ার বিভিন্ন বন্দিশালা থেকে মুক্ত করে ৪ হাজার ২০০ বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এখনো হাজারের বেশি অবৈধ বাংলাদেশি আটকে আছেন লিবিয়ায়। ১০ বছর ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যাঁরা ইউরোপে যান, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৮৪ হাজার বাংলাদেশি এভাবে সমুদ্রপথে ইউরোপে গেছেন। প্রতিবছর গড়ে অন্তত ১০০ বাংলাদেশি নৌকা ডুবে মারা যান।
অভিবাসনবিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনির ডয়চে ভেলেকে বলেন, এর সঙ্গে শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক চক্রও জড়িত। প্রত্যেকের ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকা লাগে। কিন্তু এই টাকা খরচের পর অনেকেই বিপদে পড়েন, মারা যান, বন্দী হন, ক্যাম্পে আটক হন।
সরকার আন্তর্জাতিক চক্রকে ধরতে না পারলেও দেশি চক্রকে তো ধরতে পারে। সরকার কি কেবল হতভাগ্য যুবকদের লাশ দেশে এনে দায়িত্ব শেষ করবে? যারা ভাগ্যান্বেষী তরুণদের বিদেশে নিয়ে লাশ বানায়, তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেবে না? এই দালাল চক্রের পেছনে কিছু অনুমোদিত জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জড়িত, যাদের মাধ্যমে তারা বিদেশে লোক পাঠিয়ে থাকে।
অতীতে এ রকম অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কেননা এ চক্রের সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই ছিলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি নিতে হবে।
বিদেশে মানব পাচার বন্ধ করতে হলে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। বাংলাদেশি তরুণদের এই মৃত্যুযাত্রা সরকারকে অবশ্যই থামাতে হবে। তরুণদের জন্য ভালো কর্মসংস্থান সৃষ্টিই এই মৃত্যুযাত্রা থামানোর সবচেয়ে ভালো বিকল্প।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আজও আছে পরতে পরতে সৌন্দর্য
কারুকার্যখচিত বিশাল ভবন। দেয়ালের পরতে পরতে মনোহর সৌন্দর্য। মনোরম পরিবেশে ভবনের চারপাশে দাঁড়িয়ে সুন্দরী পরীর আবক্ষ মূর্তি। ছবির মতো সাজানো ‘পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি’ এখন কালের সাক্ষী।
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কলমাই নদীতীরে ১৫ একর জমিতে জমিদারবাড়িটি। ঢুকতেই চোখে পড়ে পুরোনো মন্দির। লোকমুখে প্রচলিত, শরতের দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরিতে এখানে ব্যস্ত থাকতেন ভারতবর্ষের নামকরা কারিগররা। কালের বিবর্তনে স্থানটি এখন নির্জন। নেই আগের গৌরব-আভিজাত্যের ছাপ, এমনকি প্রতিমা তৈরির ব্যস্ততাও।
মন্দির ঘুরে দেখা যায়, এর কোথাও কোথাও ইট খসে পড়েছে। পুরোনো দিনের নকশা হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য। মন্দিরের পেছনে বিশাল তিনটি মহল, যা সেকালে তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। মহলগুলোর আলাদা কোনো নাম পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে বড় মহলে বর্তমান পাকুটিয়া বিসিআরজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিচালিত হচ্ছে।
দোতলা ভবনের নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করবে সবাইকে। যদিও সংস্কারের অভাবে ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। পাশেই অপূর্ব লতাপাতার কারুকার্যখচিত বিশাল আরেকটি ভবন, যার মাথায় ময়ূরের মূর্তি। এ ছাড়া কিছু নারী মূর্তিরও দেখা মেলে। জমিদার আমলের টিনের চৌচালা ঘরে অস্থায়ীভাবে সরকারি তহশিল অফিস স্থানান্তর হলেও, সেটি এখন স্থায়িত্ব পেয়েছে।
লতাপতায় আচ্ছন্ন ভবনের একাংশ বর্তমানে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং আরেকাংশে একটি বেসরকারি দাতব্য সেবা সংস্থা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভবনটির পিলারের মাথায় এবং দেয়ালেও অসাধারণ নকশা মুগ্ধ করে।
দোতল আরেকটি মহল, যার সামনে বিশাল শান বাঁধানো সিঁড়ি। অন্য সব ভবনের সঙ্গে এটির নকশার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভবনটির বারান্দা ও পুরোনো কাঠের দরজা সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ। ভবনটির মাথায় ময়ূরের সঙ্গে দুই পাশে দুই নারী মূর্তির দেখা মেলে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেলে গাছগাছালির সবুজে ঘেরা পুরো জমিদারবাড়ির সৌন্দর্য বিমোহিত করতে বাধ্য। যদিও ভবনের ভিন্ন অংশ খসে পড়ছে, হারাচ্ছে রূপ-লাবণ্য।
জমিদারবাড়ির পেছনে রয়েছে দীঘি ও দুটি পরিত্যক্ত কূপ। এ ছাড়া জমিদারবাড়ির বিশাল মাঠের এক কোণে নাটমন্দির। জানা যায়, নাগরপুরের সঙ্গে কলকাতার একটি বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে আসেন ধনাঢ্য ব্যক্তি রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল। তিনিই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশদের কাছ থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে জমি কিনে জমিদারি শুরু করেন।
রামকৃষ্ণ সাহার দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধাগোবিন্দ। রাধা নিঃসন্তান। তবে বৃন্দাবনের তিন ছেলে– ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন ও যোগেন্দ্র মোহন দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। এভাবে পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি তিন ভাইয়ের তরফে বিভক্ত থাকলেও, জমিদাররা সবাই ছিলেন প্রজানন্দিত। বৃন্দাবনের মেজ ছেলে উপেন্দ্রকে কাকা রাধাগোবিন্দ দত্তক নেন। ফলে উপেন্দ্র কাকার জমিদারির পুরো সম্পত্তি লাভ করেন।
দৃষ্টিনন্দন পাকুটিয়া জমিদারবাড়িতে প্রতিনিয়ত পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। ইতিহাসের সাক্ষী বাড়িটি সংস্কার না হওয়ায় একদিকে যেমন সৌন্দর্য হারাচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে ইতিহাস। জমিদারবাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জোরালো হচ্ছে।