বাংলা একাডেমিতে অভিযান, নিয়োগ জালিয়াতিসহ অনিয়মের তথ্য পেয়েছে দুদক
Published: 17th, February 2025 GMT
বাংলা একাডেমিতে জনবল নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। ২০২২ সালের একটি নিয়োগে বাংলা একাডেমিতে অনিয়ম ও জালিয়াতিরে মাধ্যমে গোপনে ১৭৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ ছাড়াই গোপনে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ৪৫ জন আগেই বাংলা একাডেমিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত। আর এই ৪৫ জন লিখিত পরীক্ষায় নম্বর কম পেলেও বড় অংকের বিনিময়ে তাদের ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর বেশি দিয়ে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে বাংলা একাডেমিতে অভিযান চালিয়ে নথিপত্র পর্যালোচনা শেষে জনবল নিয়োগে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদক জানায়, বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শূন্য পদের (১৮০টি) বিপরীতে আবেদন আহ্বান করা হলে ৫০ হাজারেরও অধিক চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেন। ৪ হাজার প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দেখানো হয় কিন্তু ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষায় মাত্র ৫০০ জনকে ডাকা হয়। অধিকন্তু ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ না করে গোপনে ১৭৫ জনকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয় বলেন টিমের কাছে পরিলক্ষিত হয়।
আরো পড়ুন:
কবি গালিব রিমান্ডে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি চান বিশিষ্টজনেরা
শনিবার বইমেলার সময় পরিবর্তন
এছাড়া যোগদানকৃত ১৩৩ জনের মধ্যে ৪৫ জনি ইতোপূর্বে বাংলা একাডেমিতে চু্ক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত-এরকম তথ্যও পাওয়া যায়।
অভিযানে নিয়োগ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র ও বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলা একাডেমিতে বিভিন্ন পদে চুক্তিভিত্তিক কর্মরত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নিয়োগ পরীক্ষার লিখিত অংশে কম নম্বর পেলেও ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বেশি দেওয়া হয়েছে এবং তারা চূড়ান্তভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন।
এছাড়া, চূড়ান্ত ফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ না করে গোপনে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়-যা স্বাভাবিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় বলে টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়। অভিযানকালে সংগৃহীত রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণপূর্বক টিম কমিশন বরাবর বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
এর আগে অনিয়ম দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলা একাডেমিতে ১৭৫ জনের নিয়োগ নিয়ে অভিযোগ উঠে।
অভিযোগে বলা হয়, ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাংলা একাডেমির শূন্যপদ পূরণের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শূন্য পদের জন্য (১৮০টি) যথাক্রমে ১০০, ২০০, ৪০০ ও ৬০০ টাকা আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে বলা হয়। ৫০ হাজারেরও বেশি চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেন।
প্রায় দুই কোটি টাকা বাংলা একাডেমির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, পরীক্ষা কেন্দ্র ভাড়া, পরীক্ষকদের সম্মানি প্রদান তথা আনুষঙ্গিক ব্যয়ের পরও অর্ধকোটি টাকা থেকে যায়। মহাপরিচালক ও নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তারা নিজেদের পারিশ্রমিক হিসেবে তা ভাগাভাগি করে নেন।
এতে বলা হয়, চার হাজার প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দেখানো হয়। কিন্তু ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার ডাকা হয় মাত্র ৫০০ জনকে। তাদের ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ না করে গোপনে ১৭৫ জনকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ১৩৩ জন চাকরিতে যোগ দেন। বাকিরা চাহিদা মতো টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় যোগ দিতে পারেননি। যোগদানকারী ১৩৩ জনের মধ্যে বাংলা একাডেমিতে ইতোপূর্বে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকৃত ৮৪ জনের মধ্যে ৪৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা হচ্ছেন বাংলা একাডেমিতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পোষ্য (১৫ জন), কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের আত্মীয় যেমন-স্ত্রী, ভাই, বোন, ভাগ্নে, ভাগ্নি, ভাতিজা, ভাতিজি (৩০ জন) নিয়োগ দাতা কমিটির কর্মকর্তা ও কার্যনিবাহী পরিষদের সদস্যদের সুপারিশে নিয়োগ দেওয়া হয় ৩৪ জন। বয়স সীমা লঙ্ঘন করে নিয়োগ দেওয়া হয় ৪২ জনকে। যেখানে বাংলা একাডেমির নিয়োগবিধি এবং প্রবিধানমালার শর্ত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয় বলেও অভিযোগে বলা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য ১০ লাখ টাকা নিয়োগের জন্য দাম ওঠে। অন্য প্রার্থীদের জন্য বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। আর্থিক সুবিধা, রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে সবাইকে নিয়োগ দেওয়া হয়, বাংলা একাডেমির নিয়োগবিধি, পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি এবং প্রবিধানমালার শর্ত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে।
অবৈধ নিয়োগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে যাদের নামে অভিযোগ পাওয়া গেছে তারা হলেন-সাবেক মহাপরিচালক কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা, ডা.
এছাড়া সাবেক পিএ বর্তমানে সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ তার ভাগ্নে রফিকুল ইসলামকে সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সময় ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমিতে তৃতীয় শ্রেণির পদে চাকরি দিতে সমর্থ হন। এবার তিনি তার ছেলে রকিবুল ইসলাম এবং তার ভাতিজা ইব্রাহিম হোসেনকে তৃতীয় শ্রেণি পদে চাকরি দিতে সমর্থ হন এবং ঊর্ধ্বতনদের ইচ্ছা অনুযায়ী অবৈধ নিয়োগে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন বলেও অভিযোগে বলা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বা দৈনিক মজুরিভিত্তিক জনবল নিয়োগের দীর্ঘকাল ধরে বাংলা একাডেমিতে একটি কু-প্রথা চালু আছে। রাজনৈতিক প্রভাব, কর্মকর্তাদের খেয়ালখুশি এবং কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের সুপারিশের ভিত্তিতে বিভিন্ন পদে এভাবে লোক নিয়োগ করা হয়। প্রথমে চার মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। তারপর তাদের বারবার সময়সীমা বাড়ানো হয়।
এভাবে দেখা যায় কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী টানা ১০ বছর পর্যন্ত বাংলা একাডেমিতে চাকরি করে আসছেন। তাদের বেতন দেওয়া হয় একুশে বইমেলার স্টল ভাড়া আয়, বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত বই বিক্রির আয়, প্রেস থেকে আয়, ব্যাংক ভাড়া, ক্যান্টিন ভাড়া, এফডিআর, মিলনায়তন ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ভাড়ার আয় থেকে।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এসবি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব ল এক ড ম এক ড ম র এক ড ম ত পর ক ষ য় র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজর কখন পড়বে
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে দ্বিতল ভবনবিশিষ্ট একটি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রে ওষুধ নেই, চিকিৎসক নেই, বিদ্যুৎ–সংযোগ নেই। ফলে তেমন একটা রোগীও নেই। এই ‘নাই নাই’ হাসপাতালটির নাম মাস্টারদা সূর্য সেন মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্র। এভাবে কি একটা হাসপাতাল চলতে পারে? প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাওয়ার এমন নমুনা আমাদের হতাশ করে। দেশজুড়ে এ রকম আরও চিত্র আমরা দেখতে পাই, যা আমাদের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ইতিবাচক কোনো বার্তা দেয় না।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ২০০৩ সালে চালু হওয়া এই ১০ শয্যার হাসপাতালটির মূল সমস্যা জনবলসংকট। ১৬টি পদের ১টিতেও স্থায়ী জনবল পদায়ন করা হয়নি। অন্য হাসপাতাল থেকে প্রেষণে এসে মাত্র তিনজন কর্মচারী (একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, একজন মিডওয়াইফ ও একজন আয়া) সপ্তাহে কয়েক দিন করে দায়িত্ব পালন করেন। এটি একটি জরুরি প্রসূতিসেবাকেন্দ্র, যা ২৪ ঘণ্টা চালু থাকার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ নেই, ডাক্তার নেই এবং প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে এর কার্যক্রম এখন প্রায় স্থবির।
হাসপাতালের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় প্রায় তিন মাস ধরে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ফলে পানীয় জলের ব্যবস্থাও নেই। বিনা মূল্যের ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে প্রায় ছয় মাস ধরে। এ পরিস্থিতিতে একজন রোগী কীভাবে এখানে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসবেন? যেখানে হাসপাতালের বাইরের সাইনবোর্ডে জরুরি প্রসূতিসেবার জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার কথা লেখা, সেখানে মূল ফটকে তালা ঝোলানো। এটি জনগণের সঙ্গে একধরনের প্রতারণা। হাসপাতালটি চালু না থাকায় মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল বা চট্টগ্রাম শহরে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এতে সময় ও অর্থ—দুটোরই অপচয় তো বটেই, চরম ভোগান্তিরও শিকার হতে হয় মানুষকে।
যে মিডওয়াইফরা এখানে কাজ করছেন, তাঁরা জানান, এখন মাসে মাত্র চার-পাঁচজন প্রসূতি সেবা নিতে আসেন, যেখানে আগে শতাধিক প্রসূতি সেবা পেতেন। নিরাপত্তা প্রহরীরা দুই বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন না। তবু নিয়মিত বেতন পাওয়ার আশায় তাঁরা এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। এ অসহনীয় দুর্ভোগের কারণ হলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান, তাঁরা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জনবলসংকটের কথা জানিয়েছেন, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।
একটি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে কেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার ধরনা দিতে হবে? জনবল নিয়োগ, কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, বিদ্যুতের ব্যবস্থা কার্যকর করা—সব ধরনের সংকট দূর করতে হাসপাতালটির দিকে আন্তরিক মনোযোগ দেওয়া হবে, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।