জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, সুদানের গৃহযুদ্ধের সময় সশস্ত্র পুরুষরা ছোট শিশুদেরও ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন করছে। এক বছর বয়সী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রায় দুই বছরের সংঘাতের সময় যৌন সহিংসতাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে দেশটিতে। 

মঙ্গলবার (৪ মার্চ) এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, সুদানের ছোট শিশুদের ওপরও ধর্ষণ চালানোর বিষয়টি ইউনিসেফ প্রতিবেদনে প্রথম জানিয়েছে।

ইউনিসেফের মতে, সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়, ভুক্তভোগীরা এ ধরনের ধরনের অপরাধের সম্পর্কে অভিযোগ করতে এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য চাইতে ‘বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়।’ 

আরো পড়ুন:

ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘে রাশিয়ার পক্ষ নিল যুক্তরাষ্ট্র

জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশে আসছেন মার্চের মাঝামাঝি

ইউনিসেফ বলেছে, যদিও ২০২৪ সালের শুরু থেকে শিশুদের বিরুদ্ধে ২২১টি ধর্ষণের ঘটনা আনুষ্ঠানিকভাবে রেকর্ড করা হয়েছে, তবে প্রকৃত সংখ্যাটি সম্ভবত আরো অনেক বেশি।

সুদান সামাজিকভাবে রক্ষণশীল একটি দেশ, যেখানে বিশাল সামাজিক কলঙ্কের কারণে ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবার ধর্ষণ সম্পর্কে কথা বলতে চায় না, আবার রয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে প্রতিশোধের ভয়।

ইউনিসেফের প্রতিবেদনটি দেশটির গৃহযুদ্ধে শিশুদের ওপর নির্যাতনের একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। ইউনিসেফ এ ঘটনার জন্য কে দায়ী তা প্রতিবেদনে জানায়নি। 

তবে জাতিসংঘের অন্যান্য তদন্তে বেশিরভাগ ধর্ষণের জন্য আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে দায়ী করা হয়েছে। তারা বলেছে, আরএসএফ যোদ্ধারা বেসামরিক লোকদের আতঙ্কিত করতে এবং তাদের বিরোধিতা দমন করতে যৌন সহিংসতা ব্যবহার করার একটি ধরন ব্যবহার করেছে।

আরএসএফ তাদের সাবেক মিত্র সুদানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে লড়াই করছে। তবে তারা কোনো ধরনের অন্যায় কাজ করার কথা অস্বীকার করেছে।

জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ চান্দে ওথমান গত বছরের অক্টোবরে তাদের পূর্ববর্তী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার সময় বলেছিলেন, “সুদানে আমরা যে মাত্রার যৌন সহিংসতা নথিভুক্ত করেছি তা বিস্ময়কর।”

সুদানের জন্য জাতিসংঘের মানবিক প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যেই পর্যাপ্ত তহবিল পায়নি। মার্কিন সাহায্যের সাম্প্রতিক কর্তন ভুক্তভোগীদের সাহায্য করার কর্মসূচিগুলো আরো কমিয়ে আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে পরিস্থিতির ভয়াবহতা

ওমনিয়া (আসল নাম নয়) নামে প্রাপ্তবয়স্ক এক নারী বলেছেন, তাকে অন্য আরো অনেক মহিলা এবং মেয়েদের সঙ্গে সশস্ত্র ব্যক্তিরা একটি ঘরে আটকে রেখেছিল। ওমনিয়া বলেন, “রাত নয়টার পর কেউ একজন দরজা খুলে চাবুক হাতে নিয়ে একজন মেয়েকে বেছে নেয় এবং অন্য ঘরে নিয়ে যায়। আমি ছোট্ট মেয়েটির কান্না এবং চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। তারা তাকে ধর্ষণ করছিল।”

ওমনিয়া বলেন, ‘প্রতিবারই তারা তাকে ধর্ষণ করত, এই মেয়েটি রক্তাক্ত অবস্থায় ফিরে আসত। সে এখনও একটি ছোট শিশু। রাতে নিয়ে গেলে কেবল ভোরেই মেয়েটির মুক্তি মিলত। সবাই প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় ফিরে আসত। তাদের প্রত্যেকেই কাঁদে এবং অসংলগ্নভাবে কথা বলে। সেখানে ১৯ দিন আমি কাটিয়েছি। আমি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম যে আমার জীবন শেষ করে ফেলতে চেয়েছিলাম।’

যুদ্ধে ভেঙে পড়া একটি জাতি হিসেবে, সুদান পৃথিবীর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং স্থানগুলোর মধ্যে একটি। যেখানে পরিষেবা এবং ফ্রন্টলাইন কর্মীদের প্রবেশাধিকার পাওয়া কষ্টকর। যুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত বিপুল সংখ্যক নারী ও শিশুদের আক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলেছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, সুদানে প্রতি চারজন স্কুল-বয়সী মেয়ের মধ্যে তিনজন স্কুলে যেতে পারে না।

ট্রাম্প সরকার গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য বন্ধ করে দিচ্ছে

এই অপরাধের ভয়াবহ পরিণতি আরো খারাপ হচ্ছে। কারণ ভুক্তভোগীদের চিকিৎসা সহায়তার জন্য খুব কম জায়গা রয়েছে। অনেক চিকিৎসা সুবিধা যুদ্ধরত পক্ষগুলো ধ্বংস, লুটপাট বা দখল করেছে। সাম্প্রতিক মার্কিন সাহায্য হ্রাস শিশুদের সুরক্ষার জন্য উপলব্ধ সীমিত পরিষেবাগুলোকেও বিপন্ন করে তুলতে পারে।

ইউনিসেফ স্থানীয় কর্মীদের একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শিশুদের জন্য নিরাপদ স্থান প্রদান করছে, যারা তাদের সম্প্রদায়ের সংকট মোকাবেলা করার জন্য জরুরি প্রতিক্রিয়া কক্ষ নামে পরিচিত একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।

কর্মীরা মার্কিন সাহায্যের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল ছিল এবং তাদের পর্যবেক্ষণকারী একটি সুদানি সমন্বয়কারী কমিটির মতে, বেশিরভাগই তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।

নারী অধিকার রক্ষায় নিবেদিত জাতিসংঘের সংস্থার মতে, যৌন সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের সহায়তা প্রদানে নারীদের নেতৃত্বে স্থানীয় সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা জাতিসংঘের সুদান মানবিক মোট তহবিলের ২ শতাংশেরও কম পায়।

নারী পরিচালিত এমনই একটি স্থানীয় সংস্থা ‘শি লিডস’। মার্কিন তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে বাধ্য হয়েছে।

সুদানের মানবাধিকার কর্মী সুলাইমা এলখলিফা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবিলায় একটি সরকারি ইউনিট পরিচালনা করেন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগটি সংগঠিত করতে সহায়তা করেন।

তিনি বিবিসিকে বলেন, “সশস্ত্র পুরুষদের দ্বারা ধর্ষিত নারীদের হতাশ হওয়ার বিলাসিতা নেই এখানে।” তিনি আরো জানান, “যুদ্ধের চাহিদা- খাবার খুঁজে বের করা, পালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন, মানসিক আঘাত মোকাবেলা করার জন্যও কোনো জায়গা নেই।”

ঢাকা/ফিরোজ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইউন স ফ সশস ত র য ন সহ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পর্যালোচনা

অর্থনীতির আলোচনায় বিনিয়োগের পরিবেশ যতটা গুরুত্ব পায়, কর্মের পরিবেশ ততটা মনোযোগ পায় না। অথচ টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের যথাযথ কর্মপরিবেশ অর্থাৎ ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মস্থল, সংগঠিত হওয়ার অধিকারসহ সব ধরনের আইনি স্বীকৃতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

দেশের অর্থনীতির বিকাশ এমন পথে ঘটেছে যে বেশির ভাগ শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে; যেখানে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, ওভারটাইম, সবেতন ছুটি, বিমা, পেনশন ও গ্র্যাচুইটির অধিকার থাকে না। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও কারখানার মালিকেরা শ্রমিকদের যে মজুরি দেন, তা মানসম্পন্ন জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়। শ্রমিকদের কাজের পরিবেশও ভয়ংকর অনিরাপদ, যার ফলে নিয়মিত অকালমৃত্যু ঘটছে। কর্মস্থলে সরাসরি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়াও অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশের কারণে প্রতিবছর ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেন বহু শ্রমিক, যার কোনো হিসাব কারও কাছে থাকে না।

অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৮ নভেম্বর ‘শ্রম সংস্কার কমিশন’ গঠন করে। এই কমিশন সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে শ্রম অধিকারবিষয়ক ২৫টি ক্ষেত্রে ৪৫০ পৃষ্ঠাজুড়ে যে সুপারিশগুলো তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণির অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স হিসেবে কাজ করবে। এই প্রবন্ধে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো সুপারিশ নিয়ে আলোচনা করা হলো।

কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ

শ্রম সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহভিত্তিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক শ্রম আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, দেশের সব শ্রমিকের জন্য একটি সর্বজনীন জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, মজুরি তিন বছর পরপর পুনর্নির্ধারণ, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মজুরি না দিলে শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, আপৎকালীন তহবিল, নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান, ট্রেড ইউনিয়ন করার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস, স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

দেশে বর্তমানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রায় সাত কোটি শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি এবং আইনি সুরক্ষা কিছুই নেই। সুপারিশে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ক্ষেত্রে প্রত্যেক শ্রমিককে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র বা প্রমাণপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। কমিশনের সুপারিশ হলো লিভিং ওয়েজ বা জীবনী মজুরির ধারণাকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে প্রতি তিন বছর পরপর জাতীয় ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। এরপর এই জাতীয় ন্যূনতম মজুরিকে ভিত্তি ধরে কাজের প্রকৃতি, খাতভিত্তিক চাহিদা, ঝুঁকি এবং অঞ্চলভেদে বিশেষ খাত ও পেশার জন্য পৃথক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে, যা কোনোভাবেই জাতীয় ন্যূনতম মজুরির কম হতে পারবে না।

বর্তমানে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয় মালিক শ্রমিক দর–কষাকষির মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে মজুরি নির্ধারণের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করা হয় না। বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোয় দুর্বল শ্রমিকপক্ষের বিপরীতে শক্তিশালী মালিকগোষ্ঠীর ইচ্ছাতেই মজুরি নির্ধারিত হয়।

এ পরিস্থিতির অবসানে কমিশন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য একটি মানদণ্ড তৈরির সুপারিশ করেছে, যেখানে শ্রমিক পরিবারের মাসিক খাদ্য ব্যয়, খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় (যেমন বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক ও বিনোদন) এবং ন্যূনতম মাসিক সঞ্চয় বিবেচনায় নিতে হবে। পরিবারের একক উপার্জনকারীকে বিবেচনায় নিয়ে এমন মজুরি নির্ধারণ করতে হবে যেন শ্রমিক তাঁর পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে পারেন।

কমিশন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রতিটি সেক্টরের মজুরি সুপারিশ করার সময়ে মজুরির পরিমাণ নির্ধারণের ভিত্তি, মজুরির হিসাবপদ্ধতি ও মজুরির পরিমাণ নির্ধারণে ব্যবহৃত তথ্য–উপাত্ত প্রকাশ করার সুপারিশ করেছে। মজুরি নির্ধারণে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হিসেবে কমিশন শ্রম, অর্থনীতি ও মজুরি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, শ্রমিক ও মালিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কমিশন গঠনের কথা বলেছে। খাত ও পেশাভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে স্থায়ী কমিশনের অধীন এক বা একাধিক কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট গড় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করার কথা বলেছে কমিশন।

অনেক সময় দেখা যায়, সময়মতো মজুরি না পেয়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য কমিশন একটি বাধ্যতামূলক আপৎকালীন তহবিল গঠনের সুপারিশ করেছে। এই তহবিলে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের দুই মাসের সমপরিমাণ মজুরি জমা রাখবে। তহবিলটি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, সরকার ও সংশ্লিষ্ট শিল্পের মালিকদের সংগঠনের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে।

মজুরি পরিশোধসংক্রান্ত তথ্য প্রতি মাসে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে অনলাইনে জমা করতে হবে। সময়মতো মজুরি প্রদান না করা হলে নির্দিষ্ট হারে ক্ষতিপূরণ আদায়েরও সুপারিশ করা হয়েছে। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হলে ও নিয়মিত তদারক করা হলে বকেয়া মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের রাস্তা অবরোধের ঘটনা অনেকাংশে কমবে।

শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া এবং সম্মিলিত দর–কষাকষির ক্ষেত্রে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা সহজ করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এ জন্য প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে মোট শ্রমিকের অনুপাতের শর্তের পরিবর্তে ন্যূনতম শ্রমিকসংখ্যা বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। এই সংখ্যা নির্ধারণের জন্য কমিশন একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে।

প্রতিষ্ঠানপুঞ্জের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ সদস্যের শর্তের বদলে ন্যূনতম ৫০ জন এবং অপ্রতিষ্ঠানিক খাতে অঞ্চলভিত্তিক ইউনিয়নের জন্য ন্যূনতম ৫০ জন ও জাতীয়ভিত্তিক ইউনিয়নের জন্য ৪০০ জনের সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশন রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোকেও (ইপিজেড) অভিন্ন শ্রম আইনের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে।

কমিশন কাজের পরিবেশ নিরাপদ করার জন্য কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে, যেমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ চিহ্নিত করে সুরক্ষা ও ঝুঁকি ভাতা নিশ্চিত, কর্মস্থলে সেফটি কমিটি গঠন ও প্রশিক্ষক কর্মকর্তা নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা, শ্রম পরিদর্শনে সেক্টরভিত্তিক চেকলিস্ট প্রণয়ন ও হালনাগাদ এবং পরিদর্শন প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশের ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটলে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন ও বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি রোগব্যাধি ও দুর্ঘটনার হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রতি তিন বা ছয় মাস অন্তর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।

বর্তমানে শ্রম আইন অনুসারে, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে মাত্র দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, যা একেবারেই অপ্রতুল। কমিশন তাই ক্ষতিপূরণের হার বৃদ্ধি করে সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে। এ জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন ১২১ ও হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড নির্ধারণ করার কথা বলেছে। এ ছাড়া শ্রমিকের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও অযথা হয়রানি বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নিতে বলেছে কমিশন।

কমিশন জাতীয় পেনশন স্কিমের অধীন শ্রমিকবান্ধব পেনশন স্কিম চালু করার সুপারিশ করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে কারখানা বা প্রতিষ্ঠানকে পেনশন স্কিমে অংশ নিতে উৎসাহিত করতে হবে। অপ্রতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য আয় অনুসারে কন্ট্রিবিউটারি, নন-কন্ট্রিবিউটারি বা ভলান্টারি পেনশন স্কিম চালু করতে হবে। প্রান্তিক শ্রমিকদের পেনশানের চাঁদা সরকার ও নিয়োগকারী যৌথভাবে বহন করবে। সেই সঙ্গে শিল্পাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় শ্রমিকদের জন্য কার্ডভিত্তিক রেশন দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ ছাড়া কমিশন শিল্পাঞ্চলগুলোয় শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বিনা মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে দিবাযত্ন কেন্দ্র, স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যকর খাবারের ক্যানটিন, সাশ্রীয় আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন, শিল্পাঞ্চলে হাসপাতাল স্থাপন, শ্রমিক স্বাস্থ্য কার্ড চালু, শ্রমিকের প্রয়োজন বিবেচনায় হাসপাতালে বিনা মূল্যে সন্ধ্যাকালীন সেবার ব্যবস্থা, সরকারি স্কুল, বিনোদনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

বিশেষ শ্রম-জনগোষ্ঠীর জন্য সুপারিশ

শ্রম সংস্কার কমিশন বিশেষ শ্রম-জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদাভাবে সুনির্দিষ্ট কতগুলো সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো সুপারিশ হলো পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য স্থায়ী চাকরি ও ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মী আবাসিক এলাকা’ স্থাপন, কৃষিভিত্তিক শ্রমিকদের জন্য মৌসুমি কর্মহীনতা মোকাবিলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, চা–শ্রমিকদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা, চাতালশ্রমিকদের ঋণচক্র থেকে মুক্ত করতে সরকারি সহায়তা, রাত্রিকালীন কাজের জন্য নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধান ও নিয়োগকারীর পক্ষ থেকে পরিবহন নিশ্চিত করা, ট্যানারি শিল্পে স্বাস্থ্য ও রাসায়নিক ঝুঁকি বিবেচনায় বিশেষ প্রশিক্ষিত শ্রম পরিদর্শক নিয়োগ।

এছাড়া বন্দরশ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করা ও ঝুঁকি ভাতা প্রদান, জাহাজভাঙা শিল্পকে নিরাপদ করা, ইয়ার্ডভিত্তিক সেফটি কমিটি ও এলাকাভিত্তিক নিরাপত্তা কমিটি গঠন, পাথরভাঙা শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পাথরভাঙা সাইটগুলোর তদারকি বৃদ্ধি, পরিবহনশ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা, দোকান কর্মচারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে আশপাশে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা, হকারদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, রাইড শেয়ারিং, গিগ, প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের শ্রম অধিকার, ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা, বিশেষ মজুরিকাঠামো নির্ধারণ ও কোম্পানিগুলোর কমিশন যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা, অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য দূতাবাসে পর্যাপ্ত জনবল ও বাজেটের ব্যবস্থা করা, অভিবাসী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও সমস্যাগুলো সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো রয়েছে।

সুপারিশে আরও যা থাকতে পারত

শ্রমিকসংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে শ্রম আইনের ২৬ ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। এই ধারায় সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে মালিকপক্ষ কোনো ধরনের কারণ দর্শানো ছাড়াই শ্রমিকের চাকরির অবসান ঘটাতে পারে। কমিশন এই ধারা পুরোপুরি বাতিলের বদলে কেবল যৌথ দর–কষাকষি প্রতিনিধির (সিবিএ ইউনিয়ন) কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধক্ষকে ২৬ ধারায় টার্মিনেট করা যাবে না মর্মে সংশোধনের সুপারিশ করেছে। অথচ যেকোনো বিবেচনাতেই শ্রম আইনে যখন–তখন শ্রমিক ছাঁটাইয়ের এই বিধান পুরোপুরি বাতিল করা উচিত।

কমিশন মানদণ্ডভিত্তিক জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের পদ্ধতি কী হবে ও উপাত্ত কোথা থেকে সংগ্রহ করতে হবে, সে বিষয়ে একটি গাইডলাইন দিয়েছে। পাশাপাশি এই পদ্ধতি ও উপাত্ত ব্যবহার করে মজুরি নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট টেমপ্লেট বা ফর্মুলা প্রস্তাব করা হলে তা রেফারেন্স হিসেবে কাজ করত। তা ছাড়া কমিশন নিজেই একটা জাতীয় ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করতে পারত, যা স্থায়ী মজুরি কমিশন গঠিত হওয়ার আগপর্যন্ত বিভিন্ন সেক্টরের ন্যূনতম মজুরির ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারত। কমিশন দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড নির্ধারণের জন্য এবং প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে ন্যূনতম শ্রমিকসংখ্যা নির্ধারণে ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে।

১৮ সদস্যের শ্রম সংস্কার কমিশনই তো গঠিত হয়েছে বিশেষজ্ঞ, মালিক ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে। ফলে কমিশন নিজেই
এই মানদণ্ডগুলো নির্ধারণ করে দিতে পারত। এ ছাড়া অভিবাসী শ্রমিকদের অকালমৃত্যুর তদন্তের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা সুপারিশ করা প্রয়োজন ছিল।

সরকারের করণীয়

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শ্রমজীবী। তাঁদের জীবনে স্বস্তি এনে দিতে শ্রম সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কারের মতো কোনো জটিলতা নেই। মালিক, শ্রমিক, বিশেষজ্ঞসহ সব পক্ষের অংশগ্রহণে সুপারিশগুলো তৈরি হয়েছে, তাই এগুলো বাস্তবায়নে নতুন করে ঐকমত্য তৈরিরও কিছু নেই। সরকারের উচিত হবে দ্রুত এই গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া। অভ্যুত্থানের সরকার সংস্কারের প্রতি কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট করতে এই সংস্কারগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক

সম্পর্কিত নিবন্ধ