পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দিল্লিতে বাঙালি উচ্ছেদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন। ভারতজুড়ে ‘বাঙালিবিরোধী’ এক ‘অপচেষ্টা’ চলছে বলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ তোলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই উদ্যোগ নিলেন।

দক্ষিণ দিল্লির বসন্ত কুঞ্জে সম্প্রতি চলা উচ্ছেদ অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে এই আবেদন করা হয়। এই উচ্ছেদ অভিযান এমন জায়গায় হচ্ছে, যেখানে মূলত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকেরা বসবাস করেন। তাঁদের মধ্যে থেকে বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণের নামে উচ্ছেদ অভিযান চলছে বলে অভিযোগ। গতকাল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং এই অভিযোগ করেছেন।

মমতা বলেন, ‘নয়াদিল্লির বসন্ত কুঞ্জের জয় হিন্দ কলোনি থেকে উঠে আসা একের পর এক ভয়ংকর হেনস্তার ঘটনার খবর শুনে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও বিচলিত। এই বসতি মূলত সেই বাংলাভাষী মানুষেরা তৈরি করেছেন, যাঁরা দিল্লিকে গড়ে তোলার অসংগঠিত শ্রমশক্তির গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ।’

মমতার এই বক্তব্যের পরেই আদালতে ওই ঘটনার বিরুদ্ধে আবেদন করা হয়েছে। তবে সেটি তিনি করেননি। এই বিষয়ে ওডিশা রাজ্য থেকে বাঙালি উচ্ছেদ নিয়ে আরেকটি মামলাও হাইকোর্টে চলছিল।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিবৃতিতে বলেন, শোনা যাচ্ছে, বিজেপি পরিচালিত সরকারের নির্দেশে তাঁদের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দিন কয়েক আগে হঠাৎ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে ও বিদ্যুতের মিটার তুলে নেওয়া হয়েছে।

বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, তাঁরা নিজেদের অর্থে যে নিজস্ব পানির ট্যাংকের ব্যবস্থা করেছিলেন, তা দিল্লি পুলিশ এবং আরএএফের সহায়তায় আটকে দেওয়া হয়েছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘এই মুহূর্তে একপ্রকার জবরদস্তি উচ্ছেদ চলছে। অথচ এই বিষয়ে গত ডিসেম্বরে দিল্লি পুলিশের অনাকাঙ্ক্ষিত এক হস্তক্ষেপের পর আদালতে এই মামলা বিচারাধীন। আশ্রয়, পানি ও বিদ্যুৎ—এই মৌলিক অধিকারগুলো যদি এভাবে পদদলিত করা হয়, তাহলে আমরা কীভাবে নিজেদের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলে দাবি করব?’

মমতার এই বিবৃতির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আজ শুক্রবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন কলকাতা হাইকোর্ট। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যসচিবকেও এই বিষয়ে আদালতকে পৃথকভাবে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাঁকে দিল্লির মুখ্যসচিবের সঙ্গেও এই বিষয়ে কথাবার্তা বলতে হবে।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন মারফত জানা যাচ্ছে, এই শ্রমিকদের একাংশকে ইতিমধ্যেই প্রতিবেশী বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে একটি আট বছরের শিশু রয়েছে বলে আবেদনকারীদের আইনজীবী হাইকোর্টকে জানান। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এই নির্দেশ দেন কলকাতা হাইকোর্ট। আগামী বুধবার কলকাতা হাইকোর্টে এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে।

বাঙালিবিরোধী অপচেষ্টা শুরু হয়েছে

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিবৃতিতে আরও বলেছেন, সারা দেশে বাঙালিবিরোধী একধরনের অভিযান শুরু হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঙালিদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, রাজ্য থেকে বিতাড়ন করা হচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে মমতা বিবৃতিতে লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গে দেড় কোটির বেশি পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন, যাঁরা সম্মানের সঙ্গে বসবাস করেন। কিন্তু বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে সেই কথা জোরের সঙ্গে বলা যায় না। ওই সব রাজ্যে বাংলাভাষীদের নিজের দেশেই অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখা হচ্ছে। কেউ বাংলায় কথা বললে তিনি বাংলাদেশি হয়ে যান না। ভাষা নির্বিশেষে তাঁরা ভারতেরই নাগরিক, যেকোনো ভারতীয় নাগরিকের মতোই সমান অধিকারসম্পন্ন।

মমতা বিবৃতিতে আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার যেসব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এবার সেই বাংলাবিরোধী অপচেষ্টাকে দেশের অন্যান্য প্রান্তে শুরু করার কৌশল নিয়েছে বিজেপি। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, ওডিশা ও মধ্যপ্রদেশ থেকেও বাংলাভাষীদের ওপর নিপীড়নের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এখন সেই বিদ্বেষের ছায়া এসে পড়েছে দেশের রাজধানীতেও।

পশ্চিমবঙ্গে আট মাস পর বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তার আগে বিষয়টি এমনভাবে সামনে চলে এসেছে যে মনে করা হচ্ছে আগামী নির্বাচনের অন্যতম প্রধান ইস্যু হতে চলেছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে বহিষ্কার, গ্রেপ্তার ও হেনস্তার বিষয়টি। পশ্চিমবঙ্গ যে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে, সেটাও তাঁর বিবৃতিতে পরিষ্কার করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘এই দেশেই বাংলার মানুষ যদি অনাহূত অতিথির মতো আচরণের শিকার হন, তাহলে আমরা চুপ করে থাকব না। বাংলা সব নির্যাতিত কণ্ঠের পাশে দাঁড়াবে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা সর্বত্র আওয়াজ তুলব।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বন দ য প ধ য য কলক ত

এছাড়াও পড়ুন:

ফরিদা পারভীন: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার

মল্লিকাদি’রূপী ফরিদা পারভীন যে আরেকটা পরিচয়ে দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছেছেন সেটা আমরা আবিষ্কার করলাম ধীরে ধীরে। কৈশোরে এসে আমাদের কাছে উন্মোচিত হলো―বিস্ময়, গর্ব ও গৌরবের অন্য এক অধ্যায়। কুষ্টিয়াকে বলা হয় লালনের পুণ্যভূমি। কিন্তু সেই অর্থে তিনি সর্বজনে পরিচিত ছিলেন না। আদৃত হতেন না নাগরিক জীবনের কোথাও। লালনের গানকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলা হতো ‘ফকির-ফাকরার গান’। 

শিষ্যরা পরিচিত ছিলেন আখড়ার ফকিররূপে। সমাজের ওপরতলার মানুষের চশমায় ওদের দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল গঞ্জিকাসেবনকারী, নেশাখোর-অভব্য বলে। শুধু কি তাই? এমন কথাও চাউর ছিল যে, ওখানে গেলে জাত খোয়াতে হয়। ধর্ম নাশ হয়। সমাজচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কারণ ওটা নাকি অসামাজিক মানুষের সংঘ, আখড়া। ওরা নাস্তিক, বিধর্মী, বিপথে যাওয়া মানুষ। ওরা হঠকারী, সমাজ রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। এক কথায় সমাজের কর্তাবাবুরা যা কিছু মন্দ, যা কিছু অকল্যাণকর তার সবটাই চাপিয়ে দিয়েছিলেন লালনের ভক্ত-অনুসারীদের ওপর। যেমনটা করা হয়েছিল জীবদ্দশায় লালনের ওপর। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা এই দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পাল্টে যায় একজনের সাধনায়। প্রথমবারের মতো লালনের গান বড়ো রকমের অভিঘাত তৈরি করে শিক্ষিত শহুরে মানুষদের মাঝে। গানে-গানে মানুষের মন জয় করে তিনি দেখিয়ে দেন―এটা নিছক কেবল গান নয়, দর্শন-মানবমুক্তির অমেয় বাণী। 

নদীয়ার বাউল সম্রাট, কুষ্টিয়ার লালন; নদীয়া-কুষ্টিয়া অঞ্চল ছাড়িয়ে আদৃত হতে থাকেন দেশের সর্বত্র, বিদেশেও। ছুঁয়ে যায় বাংলা ভাষাভাষি মানুষ ছাড়াও অন্য ভাষাভাষিদের মাঝেও। লন্ডন, প্যারিস, রোম, টোকিওর মানুষেরা আসতে থাকেন লালন ধামে; কুষ্টিয়ার বাউল সংস্কৃতির সকাশে। ফরিদার কণ্ঠে লালনের যে দার্শনিকতা হাজির হয়, তা ভাবিত করে বিদ্বৎসমাজকে। লালনপ্রশ্নে সমাজের নেতিবাচক মনোভঙ্গি ও বিশ্বাসের জায়গাটা পাল্টে দেন। সর্বপ্লাবি বন্যার মতো করে ইতিবাচকতার তরঙ্গ আনেন লালন ভাবনায়, সঙ্গীতায়োজনে। এখানেই ফরিদা পারভীনের জয়মাল্য, জাদুকরি শক্তির প্রকাশ।

লালনকে সর্বজনমান্য, স্মরণীয় ও বরণীয় করে হাজির করতে আরও অনেকের অবদান রয়েছে নিশ্চয়। তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যরা তো বটেই, কবি-লেখক-গবেষক-বুদ্ধিজীবী সমাজের পাশাপাশি সংগীতশিল্পীরাও চেষ্টা করে গেছেন নিরন্তর। কিন্তু তাঁর অবদান রূপকথার গল্পের সেই রাজকুমারের মতো; যিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেন। সমাজের প্রচলিত ভুল সংশোধনপূর্বক মূল আবিষ্কার করেন। স্রোতের বিপরীতে হেঁটে উন্মোচন করেন প্রকৃত সত্য, আড়ালে পড়া সংস্কৃতির ষড়ৈশ্বর্য।  গল্পের রূপকথার রাজকুমার বাস্তবে আমাদের মাঝে হাজির হন রাজকন্যা হয়ে। 

সেই রাজকন্যার নাম ফরিদা পারভীন। ভালোবেসে সবাই বলেন ‘লালন সম্রাজ্ঞী’। লালনসংগীতে যিনি নতুন প্রাণ যুগিয়েছেন দরদী এক গায়কী দিয়ে। প্রমাণ করেছেন নগর-সমাজের স্বঘোষিত হর্তাকর্তাদের সেইসব অভিযোগ সত্যি নয়। কেবলই অতিরঞ্জনবিশেষ। লালনকে নিয়ে, সংগীত সম্পর্কে, ভক্ত-অনুরাগীদের প্রতি যে ধারণা পোষণ করা হয় তাতে রয়ে গেছে অবিমিশ্র ভুল। কানকথার অসম্ভব রকমের বাড়াবাড়ি, বর্গের রাজনীতি আর প্রণামী পাওয়া না-পাওয়ার মানসাঙ্ক। 

নাগরিক মানুষ যে সন্দেহ পোষণ করেন প্রকৃতপক্ষে আখড়াবাড়িতে তার বিপরীতটাই উৎকর্ষিত হয়, প্রতিনিয়ত। ওরা নিজেদের নিয়মে আপনার মতো করে জগত দেখেন, বুঝতে চান। নিত্যদিনের যাপিত জীবনের যে কড়চা তার ঊর্ধ্বে থেকে ওরা সবকিছু প্রত্যক্ষ করেন, সাধনায় নিমগ্ন হন, ব্রক্ষ্মাণ্ডকে অবলোকন করে যান। এই সাধনায় উৎসর্গীত হতে নিজেরা কিছু নিয়ম মানেন, কিছু রীতির মধ্যে যান। ফলে, ওদের জীবনাচার আলাদা, সাধন পদ্ধতিও সঙ্গত কারণে ভিন্নতর, স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত; যার নাম বাউল সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির প্রাণ হলো গান। বাউলের চাওয়া পাওয়ার সকল অভিপ্রায় হাজির হয় গানে গানে। যে গান ইহজাগতিকতাকে দেখেন প্রচলিত ধারণার বাইরে। অন্যরকম এক প্রেক্ষাপটে। উপমায়, প্রতীকে, রূপকে, উৎপ্রেক্ষায় ওরা মহাকাল অনুভব করতে চান ওদের আয়নায়, বাউল ভাবনার আলোকে, দেহতত্ত্বের নিরিখে, যার ভরকেন্দ্রের নাম আধ্যাত্মিকতা। 

বাউলের এই ভাবনা সাধারণ্যে পুরোপুরি বোধগম্য নয় বলে তাকে কলঙ্কিত করা হয় নানাভাবে। এমন অন্ধ-অহমিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফরিদা পারভীন হয়ে ওঠেন লালন সংগীতকে নাগরিক জীবনে প্রবেশের যুৎসই এক সেতুবন্ধ। লালনকে বোঝাপড়ার আকাঙ্ক্ষিত এক ঘরোয়া পরিসর। তাঁর কণ্ঠমাধুর্য্যে লালন পৌঁছে যান শহুরে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে। সংস্কৃতির মূলধারায়। নাগরিকজনের মননে। নীরবে-নিভৃতে রীতিমতো এক বিপ্লব ঘটে যায়, লালনের গানে, বাউল সংগীতের ইতিহাসে। এই বিপ্লবের নেপথ্য নায়ক ফরিদা পারভীন। 
নদীয়া অঞ্চলে বাউল-সংস্কৃতির ইতিহাস বেশ পুরনো, মধ্যযুগে রয়েছে এর শেকড়। তারপরও বাউল গান ও সংস্কৃতি প্রবলভাবে শক্তভিত্তি পায় লালন-এ এসে; তাঁর সৃজননৈপুণ্যে। কিন্তু সেটা সীমাবদ্ধ ছিল কেবল তাঁদের মধ্যেই―বাউল ঘরাণার, ভক্ত অনুরাগীর পরিসরে। লালন সংগীতের এই বাস্তবতাকে সার্বজনীনতায় নিয়ে যান ফরিদা পারভীন। যে বাউল গান একদা কেবলই গীত হতো প্রকৃতির নির্জনতম সব স্থানে, ফকিরের ধামে বা আখড়ায়-আখড়ায়। সেখানে রীতিমতো একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে যায়। লালন সরাসরি ঢুকে যায় মধ্যবিত্তের বাসগৃহে-সংগীত সারথী হয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসে বলেছেন, ‘নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায়, কিন্তু বিচার করতে গেলে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়’। নিন্দার বাস্তবতা থেকে লালন এবং তাঁর গান হয়ে উঠলো বিচারের সম্পদ। দৃষ্টিভঙ্গিজনিত এই পরিবর্তনে ফরিদা পারভীন পালন করলেন রাজসিক এক ভূমিকা। লালন বিচারের এই পরিবর্তনকে কীসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে?

রামকৃষ্ণ পরমহংসকে বিশ্বমাঝারে হাজির করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। একজন বিবেকানন্দ না-থাকলে রামকৃষ্ণ হয়তো হারিয়ে যেতেন। কিংবা সীমিত থাকতেন ছোট্ট পরিসরে। কিন্তু বিবেকানন্দ তাঁকে নিয়ে গেলেন বিশ্বমাঝারে। দেশে-দেশে ছড়িয়ে দিলেন পরমহংসের বাণী, কর্ম, সাধনা ও উদ্দীপিত জীবনের মন্ত্রসমূহ। যা কেবল কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশে শতবর্ষ ধরে কাজ করে যাচ্ছে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট নামক এক প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকত্বে-প্রযত্নে। রামকৃষ্ণের হয়ে যেমন বিবেকানন্দ করেছিলেন প্রকৃত অনুরাগী-অনুসারীর কাজ; লালনের হয়ে ঠিক তেমনটাই করেছেন ফরিদা পারভীন। এক্ষেত্রে দুজনে এসে দাঁড়িয়ে যান একবিন্দুতে। কীভাবে?
লালন সাঁই ও রামকৃষ্ণ পরমহংস দু’জনেই ছিলেন সমসাময়িক। জন্ম অবিভক্ত বঙ্গের পূর্ব ও পশ্চিমে। ‘হিতকরী’ পত্রিকার সুবাদে জানা যায়, ১৭৭৪ থেকে ১৮৯০ ছিল লালনের ইহজাগতিক সময়। অন্যদিকে, ১৮৩৬ থেকে ১৮৮৬ হলো রামকৃষ্ণের পার্থিব জীবন। রামকৃষ্ণ যখন বলছেন, ‘যত মত তত পথ’; তখন লালন বলছেন―
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।’
কিংবা―
‘জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা।
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তা না না না।।
আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে।
কি জাত হবা যাবার কালে
সেই কথা ভেবে বলো না।।’

রামকৃষ্ণ যখন একরৈখিক চিন্তার পরিসর থেকে বেরিয়ে এসে একাধিক পথ ও মতকে দেখলেন উদার দৃষ্টিতে । স্পষ্ট করলেন, এই বলে যে, মুক্তি কেবল একক কোনো পথে সীমাবদ্ধ নয়। বরং মত যত বেশি দেখা দেবে, পথও তত বেশি তৈরি হবে। তাই শ্রদ্ধা রাখলেন সকল মতে-সবার পথে। ঠিক তখন, কিংবা আগে-পরে, লালন ভাবলেন অন্যকথা, আরও একটু এগিয়ে, আরও একটু বলিষ্ঠতায়-বিপ্লবে-সর্বপ্লাবি মানবিকবোধে উজ্জীবিত হয়ে। তিনি সকল মত ও পথকে হাজির করলেন মানুষের মাঝে, মানুষের তরে। বললেন, মানুষ ভজলেই মানুষের মুক্তি। এ যেন চণ্ডিদাসের সেই আহ্বানেরই প্রতিধ্বনি―
‘শুনহে মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।’

দ্ব্যার্থহীনভাবে উচ্চারিত হলো সেই আহ্বান, ‘এই মানুষে হবে মাধুর্য্য ভজন/ তাইতে মানবরূপ গড়লেন নিরঞ্জন’। লালনের হাত ধরে মানুষের স্থান হলো, দেব-দেবতাগণের উপরে। গানে গানে বললেন―
‘অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবরূপের উত্তম কিছু নাই।
দেব দেবতাগণ করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে।।’

অসীম এক সাহসিকতায় আখড়াবাড়ির লালন দেব দেবতার মানবায়ন ঘটালেন । কী সাংঘাতিক এক কথা! মানুষের জন্য বড় প্রাপ্তি এর চেয়ে আর কী হতে পারে? ‘দেব দেবতাগণ করে আরাধন/জন্ম নিতে মানবে’- লালনের আগে আর কয়জন ভেবেছেন এভাবে, এমনকি পরেও? মানুষের ভেতরেই মানুষের মুক্তি অন্বেষণ করার সাহস, যুক্তিবাদ ও চিন্তাকে লালনের আগে আর কয়জন উচ্চকিত করেছেন? মানুষের জাগরণে, মানবতাবাদের পক্ষে লালন যখন সোচ্চার এভাবে, তখনও তিনি অচ্ছ্যুৎ, সমাজপতিদের কাছে, তথাকথিত সমাজ সংস্কারকদের চৌহদ্দীতে, এমনকি ঊনবিংশ শতকের বঙ্গে যে নবজাগরণ চলছিল, সেই ‘বঙ্গীয় রেনেসাঁ’র প্রতিভূ পুরুষদের কাছেও। অথচ তখন রামকৃষ্ণ পরমহংস সর্বজনে আদৃত, সম্মানীয়। নিজেদের বৃত্তে তো বটেই, বৃত্তের বাইরে দেশ ছাড়িয়ে বৃহৎ বিশ্বের কাছেও হয়ে উঠলেন শ্রদ্ধেয়। রামকৃষ্ণের বাণী-দর্শন ক্রমাগত আকৃষ্ট করে চললো মানুষকে, তরঙ্গের মতো তা কেবল ছড়িয়েই পড়তে থাকল। কেমন করে, কীভাবে এটা সম্ভব হলো? 

রামকৃষ্ণের পরমসৌভাগ্য যে, বিবেকানন্দের মতো একজন শিষ্য পেয়েছিলেন। বিবেকানন্দের নেতৃত্বে এবং অন্যান্যদের সহযোগে রামকৃষ্ণের বাণীকে ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের মতো প্রতিষ্ঠান। যা, শত বছরের অধিক সময় ধরে রামকৃষ্ণ চর্চায়-মানবিকবোধের উজ্জীবনে যুগান্তকারী এক দায় ও দরদের ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছেন, আজোবধি। 

রামকৃষ্ণের হয়ে যেমন বিবেকানন্দ, ঠিক তেমনি লালনের হয়ে ফরিদা পারভীন পালন করে গেছেন সমান্তরাল এক ভূমিকা। বেদনার হলো, বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ চর্চাকে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে পেরেছেন, ফরিদা পারভীন সেই প্রাতিষ্ঠানিকতায় যেতে পারেননি। তবে, সেটা করার ইচ্ছে ছিল প্রবল। কিন্তু সকলের সহযোগিতায় ও সম্মিলনে কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব, সেটা হয় জানা ছিল না, কিংবা এ ব্যাপারে যে ত্যাগ-সাহস-শক্তি ও ধৈর্য্য প্রয়োজন তার অপ্রতুলতা ছিল। অথচ এটা করতে পারলেই কেবল লালন চর্চায় তাঁর যে অভিপ্রায় ও মনোবাঞ্ছা ছিল; তা পূরণ হতো সর্বাঙ্গীণভাবে।

লালনকে আজোবধি প্রাতিষ্ঠানিকতার ভেতরে নিতে না পারার ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের সকলের। এখানে বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন এই প্রাতিষ্ঠানিকতা হবে বাউলদের মতো করেই; তাঁদের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই। লালন চর্চায়, বাউল সংস্কৃতির প্রতিপালনে আমরা যে এখনও সন্তোষজনক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারিনি, তার পেছনে রয়েছে এই প্রাতিষ্ঠানিকতার ধারণা ও প্রয়োজনীয়তা বুঝতে না পারার দুর্বলতা ও ঘাটতিসমূহ। সরকারিভাবে যেভাবে লালনকে সম্মানিত করা হয় তা কেবল যে দিবস ও দুই উপলক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা নিশ্চয় সকলেই অবগত। আমরা যদি দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়ে লালন চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারতাম, তা হলে সেটা হতো মানবতার পক্ষে যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ।

ফরিদা পারভীনকে কেন্দ্র করে আমাদের মাঝে হাজির হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিকতা তৈরি ও বাস্তবায়নের অপূর্ব ও অভাবিত এক সুযোগ। কিন্তু আমরা কেউই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারিনি। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? আমাদের কি প্রাতিষ্ঠানিকতার গুরুত্ব বোঝাপড়ায় গুরুতর সংকট রয়ে গেছে? এটা কি আমাদের নদীমাতৃক বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত দুর্বলতা? অথচ লালন কিন্তু সেই সময়ই প্রাতিষ্ঠানিকতার গুরুত্ব বুঝেছিলেন। বাউলেরা প্রাতিষ্ঠানিকতা বুঝে বলে স্বতন্ত্র ‘আখড়া’ নির্মাণ করার মধ্যে দিয়েই সমবেতভাবে গভীরতর সাধনায় নিবিষ্ট হন।  বাউলের আখড়া তো প্রতিষ্ঠানেরই আরেক রূপ, এবং শক্তিশালী এক একাডেমিয়ার প্রতিভূ। সেই বাউলের মানবতাবাদ বুঝতে, ওদের অমেয় বাণী বিশ্বমাঝে ছড়িয়ে দিতে দেশে বিদেশে ‘আখড়া’ অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান করার কোন বিকল্প নেই। লালনের প্রতি শ্রদ্ধায়, ফরিদা পারভীনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অংশ হিসেবে আমরা কি পারি না, প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বকে নতুন করে আমলে নিতে?

দুই.
এবার একটু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করা যাক। দীর্ঘ একটা সময় ধরে ফরিদা পারভীন আমাদের কাছে ছিলেন ‘মল্লিকাদি’। মনে আছে, সাংবাদিকতা পেশার সূত্রে তাঁর বাসায় গেছি একাধিকবার। প্রথম যেবার গেলাম দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারের জন্য। আমি তাঁকে সম্বোধন করেছিলাম, ‘কেমন আছেন মল্লিকাদি’ বলে। তিনি প্রশ্রয়ের এক হাসিতে বলেছিলেন, ‘মল্লিকাদি’? তারপর অনেক কথা হয়েছিল সেদিন, সাক্ষাৎকারের বাইরে গিয়ে। যার ভরকেন্দ্রে ছিল, শহর কুষ্টিয়া―জেলখানার মোড়, সরকারি কলেজ, লালনের মাজার, লাহিনীপাড়া, পাবলিক লাইব্রেরির মাঠ, কাটাইখানার মোড় প্রভৃতি জায়গার স্মৃতি। সেইসূত্রে দৌলতপুর, ভেড়ামারা, মিরপুর হয়ে কুমারখালী, খোকসার কথকতা।
একটা সময় ছিল, যখন কুষ্টিয়া অঞ্চলে তো বটেই, বাংলাদেশের সর্বত্রই স্কুল-কলেজ, ক্লাব-থিয়েটার-পাঠাগার চর্চার পাশাপাশি সুধীজন সম্মিলনের সকল অনুষ্ঠানে ফরিদা পারভীনের গান থাকতো অবশ্যাম্ভাবি এক অনুষঙ্গ। তাঁর গান, চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক সিঙ্গারের বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক আবেদন ও আগ্রহ তৈরি করায় সববয়সীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। সেসময় এমন কোনো অনুষ্ঠানের দেখা মেলা দুরুহ ছিল যেখানে ফরিদা পারভীনের গান গীত হয়নি। বিশেষ করে, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা’ এবং ‘‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদি’র নাম’’ গান দুটো। এর সঙ্গে হয়তো আরও অনেক গানের কথায় বলা যায়। যেমন : ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে/প্রেমের কী স্বাদ আছে বলো’। প্রধানত ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা’ ও ‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম’ -এই গান দুটো হয়ে উঠেছিল, ওই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সমার্থক নাম, অবিকল্প এক দর্শক চাহিদা।

একটা সময় কুষ্টিয়া অঞ্চলে যাত্রাগানের প্রচলন ছিল খুউব। তখন আমাদের শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা আর অহেতুক কৌতূহলের ক্ষণ। মনে পড়ে না, এমন কোন যাত্রাপালার কথা যেখানে বন্দনা হিসেবে ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা’ গানটা গাওয়া হয়নি। বারংবার শুনতে শুনতে ওই বয়সে এই প্রতীতি তৈরি হয়েছিল যে, ‘আমার সোনার বাংলা’ যেমন জাতীয় সংগীত; ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা’ বোধ করি ঠিক সেইরকমের বন্দনা গীত; রাষ্ট্রের তরফে নির্ধারিত সংগীতায়োজন।

গানটার পুরোটা শুনে শুনে আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। এর আগে আমরা বইয়ে যে বন্দনা-গীত পেতাম, তা ছিল এরকম, ‘পূবেতে বন্দনা করি, পূবের ভানুশ্বর; একদিকে উদয়রে ভানু চৌদিকে পশর’। এর বাইরে গিয়ে ওরকম একটা বন্দনা-গীত আমাদের মুগ্ধ করতো না কেবল, ভাবিত করতো ভিন্ন কিছু।

যাত্রাপালার মেয়েরা সবাই শাড়ি পরে এসে গাইতো সেই গান। এমনকি নাচের মেয়েরাও, নাচের পোশাকের ওপর শাড়ি পরে হাজির হতো। পুব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ ঘুরে ঘুরে অদ্ভুত এক মায়ার ঘোর তৈরি করতো তাঁরা। যে ঘোরে হাজির থাকতো প্রাণ-প্রকৃতিকে ভালবাসার মন্ত্র, দেশকে জানা-বোঝার দীপিত উচ্চারণ। এই কারণে শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোর তারুণ্যের কাছে ফরিদা পারভীন মানে তো ছিল, যাত্রাপালায় গাওয়া সেই বন্দনা-গীতের স্বদেশপ্রেম, ‘সবার উপরে দেশ’ এই প্রতীতির বলিষ্ঠবারতা।

মল্লিকাদি’র গান শুনতে শুনতে আমাদের কাছে ফরিদা পারভীন হয়ে উঠেছিলেন ‘মল্লিকাদি’র প্রতিচ্ছবি-প্রতিমূর্তি। মানুষ মূলত বাস করে অতীতে, এই গানের আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে এই কথায় অতিকথন নেই মোটেই। কারণ, মানুষের চিরন্তন অভ্যাস হলো অতীতচারিতায় নিজেকে সঁপে দেওয়া। যে অতীত আমাদের সঙ্গে লেপ্টে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। যেমনটা শেলী বলেছেন : `We look before and after,/And pine for what is not:/Our sincerest laughter/With some pain is fraught:/Our sweetest songs are those that tell of saddest thought,’ (To a Skylark : PERCY BYSSHE SHELLY)।

‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম…’ গানটা কেন এতো জনপ্রিয় হলো? কেন জায়গা করে নিল হৃদয়ের গভীরে? এমনও হয়েছে, কুষ্টিয়া অঞ্চলের কোন অনুষ্ঠানে জাতীয় পর্যায়ের, জাতীয় পুরস্কার পাওয়া কিংবা জনপ্রিয় তারকা খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীরা এলেও সেই অনুষ্ঠানে ‘মল্লিকাদি’ গানটা ঠিকই গীত হয়েছে। এখন হয়তো সেটা উপলব্ধি করাও কঠিন, ফরিদা পারভীন কীভাবে অর্জন করেছিলেন আকাশচুম্বি এই জনপ্রিয়তা? এখন তো মনে হয়, তাঁর জন্মই বুঝি হয়েছিল, লালন সংগীতের বৈশ্বিক দূত বা কুষ্টিয়া অঞ্চলের সাংস্কৃতিক আইকন হওয়ার জন্যই। 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গানে আছে এরকম চরণ―
‘‘অনেক কথা যাও যে ব’লে কোনো কথা না বলি।
তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।।
… আমার চোখে যে চাওয়াখানি ধোওয়া সে আঁখিলোরে-
তোমারে আমি দেখিতে পাই, তুমি না পাও মোরে।’’

মল্লিকাদি গানে স্মৃতির মোড়কে যে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সমাজ-সংস্কৃতি হাজির হয়েছে তাকে ওই পঙ্‌ক্তির আলোকে দেখলে কিছুটা হয়তো অনুভব করা যায়। কুষ্টিয়া অঞ্চল দেশভাগের নির্মমতার নীরব সাক্ষী। ইতিহাসের সেই দাঙ্গাক্রান্ত সময়গুলোতে হিন্দু-মুসলমানের বাস্তুচ্যুত হওয়ার যে অধ্যায় সংঘটিত হয়েছে তার হাহাকার ভরা জনপদ। সীমান্তবর্তী সকল জেলার সেদিনের বাস্তবতা একই রকম হলেও কুষ্টিয়া অঞ্চল ছিল পুরোপুরি ব্যতিক্রম, সেটা কেবল সাংস্কৃতিক নয়, ঐতিহাসিক কারণেই। যার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে যুক্ত রেখে তত্ত্ব-তালাশ করলেই উপলব্ধি করা যাবে এর অন্তর্নিহিত কারণ ও তাৎপর্য। 

আবু জাফরের লেখা ও সুরে ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে গীত ‘মল্লিকাদি’ গানে মেলে সেসবের সুলুকসন্ধান। তাঁর দরদী কণ্ঠে উন্মীলিত হয়েছে হৃদয় বিভাজনের শোকাঞ্জলি। মল্লিকাদি’রা আমাদের আত্মার অংশ ছিল। দেশভাগ সেই আত্মাকে খণ্ডিত করার মধ্যে দিয়ে, ব্যক্তিকে করেছে ক্ষতাক্ত ও নিঃসঙ্গ । চার্লস কিংসলি’র ‘দি স্যান্ডস অব ডি’কে যে কারণে আমরা ভুলি নাই আজও- `They rowed her in across the rolling foam,/The cruel crawling foam,/The cruel hungry foam,/To her grave beside the sea:/But still the boatman hear her call the cattle home/Across the sands of Dee. (The Sands Of Dee: Charles Kingsley)।

কুষ্টিয়া বা নদীয়া অঞ্চল ছিল, এখনও আছে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির এক ঊর্বর জমিন। এখানে হিন্দু-মুসলমানের অধিবাস বা বেড়ে ওঠা ছিল সম্প্রদায়গত বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে একান্তই সজ্জন প্রতিবেশী হিসেবে। কিন্তু এসবের পরও ঐতিহাসিক বিবিধ ঘটনার বাণপ্রস্থে তাদের হতে হয়েছে ক্রীড়ানক ও বলির পাঁঠাবিশেষ। ‘মল্লিকাদি’ গানকে বলা যেতে পারে সেই ক্রীড়ানক বাস্তবতার মূর্ত প্রতীক। এ কারণেই বোধ করি এই গান কুষ্টিয়া অঞ্চলকে নীরবে কাঁদিয়েছিল, স্বজন হারানোর বেদনায় করেছিল উদ্বেল।

ফরিদা পারভীনের গানের সঙ্গে পরিচয় আশৈশবের। কুষ্টিয়া শহরের হাউজিংয়ে-আমাদের বাসার একেবারে কাছাকাছি ছিল তাঁদের বাসা; জেলখানার মোড়ে। আব্বা চাকরি করতেন জজকোর্টে; তাঁর বাবা হাসপাতালে। দুই মুরুব্বি ছিলেন অফিসে আসা যাওয়ার সঙ্গী. সান্ধ্যাকালীন দাবা খেলার বন্ধু। সন্ধ্যার পরপরই মোড়ের চায়ের দোকানে বসতেন সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো বাদে, চলতো রাত নয়টা-দশটা অবধি। আব্বা সপ্তাহান্তে যখন গ্রামের বাড়ি যেতেন, তখন সেই দাবার আসরের গল্প শুনতাম আমরা; যার বেশীরভাগই থাকতো ফরিদা পারভীনকে ঘিরে। কোথায় কোথায় গান গাইতে গেলেন, সেসব আসরে কীসব হলো, তার ফিরিস্তি। মেয়েকে নিয়ে তাঁর বাবার গর্বের অন্ত ছিল না, সেটা অস্বাভাবিকও নয়। ফরিদা পারভীন ততদিনে তারকা শিল্পী। কুষ্টিয়া ছাড়িয়ে দেশজোড়া খ্যাতি, বিদেশেও প্রসারিত হচ্ছে সেই সুনাম ও জনপ্রিয়তা। 

আমাদের বাবা-মা, ভাইবোনেরা সবাই ছিল লালনগীতির ভক্ত, বিশেষ করে ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে। ছোটবেলাতেই বাসায় দেখেছি লালনের গানের বই। অবশ্য সেসব ছিল একেবারে ছোট কলেবরের, নিউজপ্রিন্টে ছাপা, সাধারণ বাঁধাই। লালনের মেলা ছিল এসব সংগ্রহের উপযুক্ত স্থান। ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহ’ ‘লালন সঙ্গীত’ প্রথম খণ্ডের প্রথম সংস্করণ আব্বাকে উপহার দিয়েছিলেন, অটোগ্রাফসহ। এই বইটা অবশ্য হার্ডকাভারের ছিল। সেসব বই পড়ে বুঝতে চাইতাম লালনের গানের মর্মার্থ। বিশেষ করে জনপ্রিয় গানগুলোর বাণী পড়তাম। তেমন কিছুই বুঝতাম না, তবে পাঠ করে যেতাম। ওই বয়সটাই হয়তো ছিল, বোঝাবুঝির চেয়ে পাঠ করাতেই আনন্দ পাওয়ার মতো।
এই পাঠ অভিযানের দিনগুলোয় পাঠ্য বইয়ের কোথাও লালনকে না পেয়ে বিস্ময় বাড়ছিল কেবলই। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম, আমাদের বড়ভাই অ্যাডভোকেট আব্দুর রশীদের পাঠ্য বইয়ে লালন হাজির রয়েছেন। আমার সেকি আনন্দ, অবাক বিস্ময়! আর্কিমিডিসের মতো করে সেদিন বলতে ইচ্ছা করছিল ‘ইউরেকা’, ‘ইউরেকা’। গ্রাজুয়েশন লেভেলের কবিতার বইয়ে হাজির লালনের পদ, তবে গান হিসেবে নয়, কবিতা নাম দিয়ে। যদিও আদতে তার রূপ গীতি কবিতা-ই। ওখানে দেখলাম লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ গানটা, শিরোনাম ‘খাঁচা’। লালন আমার সত্তায় হাজির হতে থাকল এভাবে, তবে ভরকেন্দ্রে থাকলেন ফরিদা পারভীন, আমার কৈশোরের মল্লিকাদি। 

দৌলতপুরে এসএসসি’র পর্ব শেষে হিতু হলাম শহর কুষ্টিয়ায়। এইচএসসি ভর্তি হলাম সরকারি কলেজে। আবু জাফর তখন আমাদের শিক্ষক, ফরিদা পারভীনের স্বামী। কোথায় যেন একটা আনন্দ, একটা গর্ব ছুঁয়ে যায়। কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান করেন তাঁরা দু’জনেই। লালনের গান, আবু জাফরের লেখা আধুনিক ও দেশাত্মবোধক দুটোই। আমাদের আনন্দ ও বিস্ময়কে আকাশ ছুঁয়ে দিয়ে তাঁরা একদিন গাইলেন―
‘আমি হেলেন কিংবা নুরজাহানকে দেখিনি
ক্লিওপেট্রা কি মোমতাজকেউ নয়
আমি তোমাকে দেখেছি
তোমাকে দেখেই জেনেছি
কেন গড়েছিল তাজমহল
কেন পুড়েছিল ট্রয়!!’

নদীয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কয়েক হাজার বছরের যে লেজিটিমেসি তা কুষ্টিয়ার মধ্যে আজও বহমান। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় লালন গুরুত্ববহ এক নাম। কুষ্টিয়াকে যে সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়, এর কারণ যতটা বর্তমানের বাস্তবতায় তার চেয়ে অধিক রয়েছে ইতিহাসের সুদূর অতীতে। যা উন্মোচন হওয়া জরুরি।

নদীয়ার আদিনাম ছিল নবদ্বীপ। অবিভক্ত ভারত অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান মিলিয়ে যে ভারতবর্ষ- ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে তার পরিচয় ছিল নানা নামে। একসময় ভারতের পরিচয় ছিল নবদ্বীপ নামে। ছিল জ্ঞানসাধনা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কেন্দ্রভূমি। সম্ভবত ভূ-অবস্থানগত বাস্তবতায় ছিল এর নেপথ্যের কারণ।

আমরা যদি প্রাচীন ও মধ্যযুগের নদীয়ার দিকে দৃষ্টি দিই তা হলে দেখব, অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে নদীয়া অঞ্চলকে ঘিরে কিংবা পার্শ্বে রেখে। ফলে, সরাসরি নদীয়া কিংবা নদীয়া অঞ্চলসংলগ্ন জনপদ হয়ে উঠেছে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নির্মাণের সূতিকাগার; যা কালে কালে সমৃদ্ধ করেছে অবিভক্ত ভারতবর্ষকে। আমাদের বাংলাভাষার যে শ্রীরূপ বা প্রমিতস্বভাব তার ক্ষেত্র তৈরিতেও রয়েছে নদীয়ার বিশেষ অবদান। 

আমাদের ভেতর এই প্রশ্ন কি তৈরি হয়েছে কখনো? আদি জনপদ ‘বঙ্গ’র যে সময়কাল, একইসময়ে আরও অনেকগুলো জনপদ কাছাকাছি-পাশাপাশি থাকার পরও কেন ‘বঙ্গ’ হয়ে উঠল প্রতিনিধিস্থানীয়। কেনইবা বঙ্গ জাতির একটা পরম্পরা কয়েক হাজার বছর ধরে হাজির থাকলো; রয়েছে আজও? যদিও তর্কসন্ধানী বাঙালি, বাঙালি মুসলমানের কেউ কেউ মানতে নারাজ যে, আজকের বাঙালিরা সেই বঙ্গ অঞ্চলেরই উত্তরাধিকার। তাদের জন্য করুণা! যদিও এই প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘ, এ পরিসরে সম্ভব নয় স্পষ্ট করে বলা। শুধু নুক্তার মতো করি এটুকু বলি, বঙ্গ’র অবস্থানই এর প্রকৃত কারণ। বঙ্গ’র মানচিত্রের দিকে খেয়াল করলেই পাওয়া যায় এর সুলুকসন্ধান। একই কথা নদীয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নদীয়ার অবস্থানই এই জনপদকে যেমন ভারতবর্ষের ভরকেন্দ্র করে তুলেছিল। তেমনি এই অবস্থানগত কারণেই নদীয়া- বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুরসহ উত্তর, পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। চৈতন্যের মতো লালনও সেই নদীয়ারই উজ্জ্বল এক প্রতিভূ, গর্বের ধন। বেদনার হলো, চৈতন্যের মতো করে লালনকে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি, আজও হচ্ছে না। ফরিদা পারভীন এই কাজটা করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে লালনের গানকেই তিনি জ্ঞান করেছিলেন জীবনের অপর নাম বলে।

আমরা কি পারি না, লালনকে নিয়ে ফরিদা পারভীনের যে স্বপ্ন ছিল, তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে? লালনের যে মানবতাবাদের দর্শন তা ছড়িয়ে দিতে। রামকৃষ্ণ মিশনের মতো করে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠান করে লালনের বাণীকে-সাধনাকে মানুষের সামনে হাজির করতে? আজকের বিশ্বে, দেশে দেশে যেভাবে হিংসা উৎপাদন করা হচ্ছে; তার বিপরীতে লালনের দর্শনই হতে পারে মানবমুক্তির সোপান। যুদ্ধ উন্মাদ এই পৃথিবীতে যখন আমরা শুনি, ‘সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার/ মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’- তখন মনে হয় আলো আছে; আমাদের করণীয় হলো সেই আলোর কাছে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’ 

লেখক: চিন্তক, সাংবাদিক ও গবেষক
 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ