দূর থেকে দেখলে মনে হবে ভাগাড়। শেষ কবে সেখানকার ময়লা অপসারণ কিংবা খাল খনন করা হয়েছে, জানাতে পারেননি স্থানীয়রা। কুমিল্লা নগরীর সুজানগর সেবক (সুইপার) কলোনীর দক্ষিণ পাশ দিয়ে পূর্বে জগন্নাথপুর ইউনিয়নের দিকে প্রবহমান খালটি এলাকার লোকজনের কাছে যন্ত্রণাদায়ক। ময়লার গন্ধে নিঃশ্বাস নেওয়া দায়।
এই খাল দিয়ে নগরীর পূর্বাঞ্চলের পানি প্রবাহিত হওয়ার কথা। স্থানীয়দের দখল আর ময়লা-আবর্জনার কারণে ওই খাল দিয়ে এখন আর পানিপ্রবাহের তেমন সুযোগ নেই। এমন অভিন্ন চিত্র নগরীর ইপিজেডের পূর্বে রাজাপাড়া ডেইরির পাশের খালের। এ ছাড়া নগরীর উত্তর চর্থার নওয়াববাড়ি-নোয়াগাঁও চৌমুহনী পর্যন্ত খাল এবং উত্তর রেসকোর্স-পাসপোর্ট অফিসের কাছ দিয়ে প্রবহমান খালও দীর্ঘদিন খনন করা হয়নি। যে কারণে এবারের বর্ষায় নগরবাসীকে জলাবদ্ধতায় ভুগতে হতে পারে। তবে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে খালের মাটি খনন করতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
২০১১ সালের ১০ জুলাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কুমিল্লা পৌরসভা ও পাশের সদর দক্ষিণ পৌরসভা বিলুপ্ত করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) ঘোষণা করে। কিন্তু যানজট ও জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে মুক্তি মেলেনি নগরবাসীর। তাদের অভিযোগ, বর্ষায় এক ঘণ্টার ভারী বর্ষণের পানি সরতে সময় লাগে ৪-৫ ঘণ্টা।
সরেজমিন দেখা গেছে, সুজানগর এলাকার প্রবহমান খালের মাটি ও ময়লা-আবর্জনা দীর্ঘদিন অপসারণ করা হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, যে খাল দিয়ে নগরীর পানি বের হওয়ার কথা, সেই খাল শেষ কবে পরিষ্কার করা হয়েছে, জানে না এলাকার মানুষ। ওই খালের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে, খালের অধিকাংশ স্থানে ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। কোথাও কচুরিপানা ও আবর্জনায় পানি চলাচল প্রায় বন্ধের পথে। একই অবস্থা নগরীর ইপিজেডের পূর্ব পাশ থেকে রাজাপাড়া ডেইরি ফার্মের কাছ দিয়ে যাওয়া খালে। দীর্ঘদিন খনন না হওয়া আর কচুরিপানায় পূর্ণ এ খাল দিয়ে নগরীর পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলেও নগর কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ নেই।
কুমিল্লা বাঁচাও মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব হোসেন মজুমদার জানান, নগরী ও ইপিজেডের বিষাক্ত বর্জ্য এ খাল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কচুরিপানা ও ময়লায় খাল ভরপুর। দীর্ঘদিন এসব আটকে থাকার কারণে এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই খালের মাটি ও ময়লা অপসারণের দাবি জানান তিনি।
এদিকে নগরীর উত্তর চর্থার নওয়াববাড়ি চৌমুহনী থেকে নোয়াগাঁও চৌমুহনী হয়ে সদর দক্ষিণ উপজেলার পুরাতন ডাকাতিয়া নদীতে মিশেছে। প্রায় ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই খালের সিএস নকশা অনুযায়ী কোনো কোনো স্থানের প্রস্থ ৪৫ ফুট থেকে ৯৫ ফুট পর্যন্ত। এ ছাড়া নগরীর মনোহরপুর থেকে কান্দিরপাড় পর্যন্ত এ খালের শাখা রয়েছে। কিন্তু দখলদারদের কবলে পড়ে কান্দিখালটি ৮ ফুট থেকে ২৫ ফুট প্রস্থের ড্রেনে পরিণত হয়েছে। ময়লা-আর্বজনার কারণে এ খালেও পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। সাবেক সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু ২০২২ সালে টমছমব্রিজ থেকে জাঙ্গালিয়া পর্যন্ত ৪১টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দখলদার ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করেন। এরই মধ্যে কিছু সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার অংশবিশেষ খাল সম্প্রসারণে ছেড়ে দেওয়া হলেও অধিকাংশ স্থাপনা এখনও ছাড়েনি। ওই খাল খনন ও সম্প্রসারণ এখনও শেষ হয়নি। এতে বর্ষায় নগরীতে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের পশ্চিম দিকে উত্তর রেসকোর্সে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার খাল দীর্ঘদিন খনন করা হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন জানান, সিটি করপোরেশন হওয়ার আগে খালের যে অবস্থা ছিল, এখনও তাই। সামান্য বৃষ্টিতেই খাল উপচে বাসাবাড়িতে পানি ওঠে। এ ছাড়া ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও পাসপোর্ট অফিস-সংলগ্ন এলাকা দিয়ে প্রবহমান খালের অংশও দীর্ঘদিন খনন না করায় নগরীর পানিপ্রবাহে সমস্যা হচ্ছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-কুমিল্লার সভাপতি রোকেয়া বেগম শেফালী বলেন, কুমিল্লাকে আমরা বলি ব্যাংক আর ট্যাংকের শহর। দিন দিন সে ঐতিহ্য বিলীন হওয়ার পথে। পুকুর ও খাল ভরাট হচ্ছে। কান্দিখালের নামেই কান্দিরপাড়। এক সময় বাণিজ্যিক নৌযান চলতো এসব খালে। জলাবদ্ধতামুক্ত নগরীর জন্য নাগরিক ও নগর কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল হতে হবে।
কুসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, কুসিকের পানিপ্রবাহের সুজানগর, রেসকোর্স, রাজাপাড়া, টমছমব্রিজ খালসহ বড় কিছু খাল খননের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সুজানগর ও রেসকোর্স এলাকার খালের বেশ কিছু অংশ ইউনিয়ন এলাকায় পড়েছে। তবে পানি চলাচলের স্বার্থে ওই অংশটুকুও খনন করা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র প ন প রব হ নগর র প স জ নগর এল ক র সরক র হওয় র
এছাড়াও পড়ুন:
গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও
রংপুরের গংগাচড়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ঘিরে সহিংসতার শিকার হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে ঘটনার তিন দিন পরেও এলাকায় ফেরেনি অনেক পরিবার। আতঙ্কে এখনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।
গত ২৭ জুলাই রাতে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার আগে এলাকায় মাইকিং করে লোকজন জড়ো করা হয়।
পুলিশ, প্রশাসন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, যারা হামলা করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ‘বহিরাগত’। পাশের নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা থেকে লোকজন এসে হামলা চালিয়ে চলে যায়। হামলার সময় ২২টি ঘরবাড়ি তছনছ ও লুটপাট করা হয়।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পুলিশ টহল। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢেউটিন, কাঠ, চাল-ডাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছে এবং ঘরবাড়ি মেরামতের কাজও শুরু হয়েছে। তবু আতঙ্কিত পরিবারগুলো।
ক্ষতিগ্রস্তদের একজন অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত বলেন, “সেদিনের ঘটনা ছিল এক ভয়াবহ। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননাকারী কিশোরকে থানা হেফাজতে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও ঘরবাড়ি রক্ষা হয়নি। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি এবং কিছু মুরুব্বি আমাদেরকে অভয় দিয়েছিলেন, কিন্তু রক্ষা হয়নি।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা নিজেরাই অভিযুক্ত কিশোরকে থানায় সোপর্দ করেছি। তারপরও মিছিল নিয়ে এসে দুই দফায় আমাদের ২০ থেকে ২৫টি ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়ে লুটপাট করেছে তারা। এদের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই অপরিচিত।”
আরেক ভুক্তভোগী দেবেন্দ্র চন্দ্র বর্মন জানান, “প্রথমে অল্পসংখ্যক কম বয়সী কিছু ছেলে আসে। পরে হাজারো লোকজন এসে আমাদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালায়। অনেকেই এখনো আত্মীয়দের বাড়িতে। আমরা চরম আতঙ্কে আছি।”
রবীন্দ্র চন্দ্রের স্ত্রী রুহিলা রানী বলেন, “ছোট ছেলেটা যদি ভুল করে থাকে, আমরা তাকে থানায় দিয়েছি। কিন্তু তারপরও এমন ধ্বংসযজ্ঞ কেন? আমাদের গরু, সোনা-টাকা সব লুটে নিয়েছে। শুধু চাল-ডাল আর টিনে কি জীবন চলে?”
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকুসহ একটি প্রতিনিধি দল। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করেন এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
গংগাচড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আল এমরান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে কিশোরটিকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনা হয় এবং পরে আদালতের মাধ্যমে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তারপরও পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক নিরাপত্তায় নিয়োজিত।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ হাসান মৃধা বলেন, “অপরাধীদের ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হচ্ছে সহায়তা। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।”
উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যমতে, হামলায় ১৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে ২২টি পরিবার বসবাস করতেন। ঘর মেরামতের পর কিছু পরিবার ফিরলেও অভিযুক্ত কিশোর ও তার চাচার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি।
ঢাকা/আমিরুল/ইভা