মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়কের অভাবে সারা বছর নৌপথে চলাচল করতে হয় রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলার বাসিন্দাদের। স্বাধীনতার কয়েক দশকেও জেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ গড়ে না ওঠায় আর্থসামাজিক নানা দিক থেকে পিছিয়ে দুই উপজেলাবাসী।
জানা গেছে, বর্তমানে লংগদুবাসীকে নৌপথে জেলা সদরে পৌঁছতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। অন্যদিকে বাঘাইছড়ি থেকে জেলা সদরে আসতে ৫ ঘণ্টা সময় লাগে। দুই উপজেলা থেকে সড়কপথে খাগড়াছড়ি হয়ে ঘুরে আসতে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। নানিয়ারচরের বড়পুল থেকে লংগদু উপজেলার মধ্যে মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মিত হলে দুই ঘণ্টাতেই জেলা সদরে যাতায়াত করতে পারবেন বাঘাইছড়ি ও লংগদুর বাসিন্দারা। এ ছাড়া জেলা সদর থেকে পর্যটন স্পট সাজেক ভ্যালির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। বর্তমানে জেলা সদর থেকে সাজেক ভ্যালিতে খাগড়াছড়ি হয়ে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় লাগে। সড়কটি হলে মাত্র সাড়ে ৪ ঘণ্টাই সাজেক ভ্যালিতে যেতে পারবেন পর্যটকরা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, জেলার ১০ উপজেলার সঙ্গে আট উপজেলায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ থাকলেও এখন পর্যন্ত লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। ফলে এ দুই উপজেলাবাসীকে নৌপথে নানা ভোগান্তি নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমের সময় কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে গেলে এ দুর্ভোগ বহুগুণ বেড়ে যায়। 
এ ছাড়া পণ্য পরিবহনেও কয়েক গুণ বেশি ভাড়াও গুনতে হয়।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানায়, নানিয়ারচর-লংগদু সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৩৭ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে বগাছড়ি থেকে নানিয়ারচর পর্যন্ত  ১৩ দশমিক ৮২ কিলোমিটার বিটুমিনাস সড়ক রয়েছে। অবশিষ্ট ২৩ দশমিক ৭০ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ করা হলে জেলা সদরের সঙ্গে নানিয়ারচর ও লংগদু উপজেলার মধ্য নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ সম্ভব হবে। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন (ইসিবি) ২০২০ সালে চেঙ্গী নদীর ওপর ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যর চিত্রশিল্পী চুনীলাল দেওয়ান সেতু নির্মাণের ফলে নানিয়ারচরের সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগে নবদিগন্তের সূচনা হয়েছে। তা সম্প্রসারিত না হওয়ায় লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলাবাসী নানিয়ারচরের চুনীলাল দেওয়ান সেতুর সুফল সরাসরি ভোগ করতে পারছেন না। 
নানিয়ারচরের সাবেক্ষ্যং ইউনিয়নের বাসিন্দা জয়সাগর চাকমা, খোকন চাকমাসহ অনেকে জানান, ওই সড়কটি নির্মিত না হওয়ার কারণে যাতায়াতসহ উৎপাদিত পণ্য বাজারে নিয়ে যেতে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও গুরুতর রোগীর যাতায়াতে 
খুবই অসুবিধা হচ্ছে। সড়কটি নির্মিত হলে নানিয়ারচর, লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলাবাসী যাতায়াতের সুযোগ কৃষকরা বিভিন্ন উৎপাদিত 
পণ্য সহজেই জেলা সদরসহ বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যেতে পারবেন।
সাবেক্ষ্যং ইউপির চেয়ারম্যান সুপন চাকমা বলেন, নদীপথ ও অনুন্নত সড়কপথে পণ্য পরিবহনের কারণে কৃষিপণ্য পরিবহনে অত্যধিক খরচ হওয়ায় কৃষক তাদের পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। এ ছাড়া যাতায়াতের ক্ষেত্রে মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য মিনহাজ মুরশীদ বলেন, নানিয়ারচরের বড়পুল থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলে কৃষিপণ্য বিপণন ও পর্যটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ ছাড়া মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্যও কাজে আসবে। পর্যটকরাও সাজেক থেকে স্বল্প সময় ও খরচে কক্সবাজার যেতে পারবেন।
রাঙামাটি সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে এ সড়কটি নির্মাণের জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সরেজমিন পরিদর্শন করে সড়কটি সম্প্রসারণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত এলে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: নদ ২৪ ক ল ম ট র ন ন য় রচর র সড়ক য গ য গ উপজ ল ব স দ ই উপজ ল ব ঘ ইছড় উপজ ল র র জন য প রব ন র সড়ক

এছাড়াও পড়ুন:

ঘুঘুডাঙ্গার মনোরম তালসড়ক

অক্টোবরের প্রথম দিকে লম্বা এক ছুটিতে বেড়াতে গেলাম বগুড়া। দেশের উত্তরের জনপদ বরাবরই আমার পছন্দ। মানুষ কম, হালকা বসতি। পথে বা হাটবাজারে ততটা ভিড়ভাট্টা নেই। বাজারে কম দামে টাটকা শাকসবজি মেলে। এসব কেনার চেয়ে দেখেই তুমুল আনন্দ পাই। নিঝুম গ্রামের ভেতর ফসলের মাঠে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি বেশ উপভোগ করি। যত দূর চোখ যায়Ñ গ্রামের পর গ্রাম। মুঠো মুঠো সবুজের ভেতর এঁকেবেঁকে ছুটে চলা মেঠো পথ মাড়িয়ে আমরা প্রতিদিন দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। দিনের মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতটা নিপুণভাবে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেতে পারে,Ñ এসব গ্রামে না এলে তা বোঝার উপায় নেই। কৃষিনির্ভর এই জনপদে প্রতিমুহূর্তের ব্যস্ততা যেন অনিবার্য নিয়তি।

বগুড়ার গ্রামীণ জনপদ ঘুরে, দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে মনে হলো যথেষ্ট নয়! চোখের তৃষ্ণা মেটেনি। মনের ক্ষুধাও যায়নি! তখনই মনে পড়ল নওগাঁর ঘুঘুডাঙ্গার বিখ্যাত তালসড়কটির কথা। এত কাছে এসে তালসড়কটি দেখতে যাব না, তা কি হয়? স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার পারভেজ বললেন, ‘বগুড়া থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টারই তো জার্নি। ঘুরে আসুন।’ আমারও মনে হলো, এমন একটি অসাধারণ দৃশ্যের জন্য এই দূরত্ব কিছুই না।

সকালে তুমুল বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার থেমেও গেল। গাড়িতে ওঠার সময় স্থলপদ্মের গাছটি চোখে পড়ল। গাছভর্তি ফুলগুলো বৃষ্টির দাপটে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। অথচ বিকেলে ভেবে রেখেছিলাম, সকালে শরতের মধুর আলোয় স্থলপদ্মের ছবি তুলব। তা আর হলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে গেলাম নওগাঁর সাপাহারের কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার বাগানে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যখন স্বপ্নমণ্ডিত সেই তালসড়কে পৌঁছাই, তখন ঠিক দুপুরবেলা।

কিন্তু দুপুর হলেও দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর তালসড়ক। শুধু বৃহত্তর রাজশাহী নয়, দূরদূরান্ত থেকেও পর্যটকেরা এখানে আসেন। নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নে এই তালসড়কের অবস্থান। মূলত ঘুঘুডাঙ্গা-শিবপুর সড়কের দুপাশজুড়ে থাকা বীথিবদ্ধ তালগাছের জন্যই সড়কটি ‘তালসড়ক’ বা ‘তালতলী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। হাজীনগর গ্রামের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়কজুড়ে এই তালসড়কের অবস্থান।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন রাস্তা ও খালপাড়ে ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গাজুড়ে লাগানো হয়েছে কয়েক লাখ তালগাছ। তখন বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, পত্নীতলা ও ধামইরহাট, রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, রহনপুর উপজেলার রাস্তার দুপাশে রোপণ করা হয়েছে অনেক তালগাছ। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে অনেক গাছই হারিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে বেঁচে আছে কিছু। তবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গার এই গাছগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। বর্তমানে গাছগুলো ৫০ থেকে ৬০ ফুট উঁচু হওয়ায় রাস্তার দুপাশে শোভাবর্ধন করছে।

একসময় নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙা-শিবপুর সড়কটি ছিল একটি মেঠো পথ। ২০১২ সালের দিকে সড়কটি পাকা করা হয়। বর্তমানে তালসড়কের দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ থাকায় সড়কটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

ভাদ্র মাসে তাল পাকার মৌসুমে তালসড়ক ঘিরে উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। নানা স্বাদের তালের পিঠা এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। তবে বেড়াতে আসা পর্যটকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এখানে মানসম্পন্ন পর্যটনসেবা থাকা প্রয়োজন।

শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলই নয়, বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানেও প্রচুর পরিমাণে তালগাছ চোখে পড়ে। খেতের আলপথ, বাড়ির সীমানা, খালপাড়, পুকুরপাড় বা পথের ধারে এসব সুদৃশ্য তালগাছ প্রকৃতিতে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে থাকা এসব তালগাছের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও আছে। দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দৃশ্যমান তালগাছের রস থেকে ভালো মানের সুস্বাদু গুড় ও মিছরি তৈরি করা হয়। বাজারে এসব গুড়-মিছরির চাহিদাও ব্যাপক। আমাদের দেশেও এসব গাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে তালের গুড় তৈরি করা সম্ভব। প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার।

 মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঘুঘুডাঙ্গার মনোরম তালসড়ক
  • চলন্ত অবস্থায় বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করতে সক্ষম সড়ক চালু ফ্রান্সে