আগামী অর্থবছর প্রবৃদ্ধি হবে ৫ শতাংশ
Published: 25th, June 2025 GMT
বাংলাদেশের অর্থনীতি অস্থিরতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে এগোচ্ছে বলে মনে করছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (এসসিবি) বাংলাদেশ। ব্যাংকটি বলছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল হয়েছে ও টাকার মানের উন্নতি হচ্ছে। একই সঙ্গে রপ্তানি খাতেও দেখা যাচ্ছে ইতিবাচক গতি। ফলে আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে আশা করছে এসসিবি।
রাজধানীর একটি হোটেলে আজ বুধবার এসসিবি বাংলাদেশ আয়োজিত বার্ষিক ‘গ্লোবাল রিসার্চ ব্রিফিং’ অনুষ্ঠানে এ প্রত্যশার কথা তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি ছাড়াও ব্যাংকটির বেশ কিছু গ্রাহকও অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের বৈশ্বিক গবেষণা দল বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের বিশ্লেষণ তুলে ধরে। তারা বলছে, সাম্প্রতিক অস্থিরতা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে দেশ। মূল্যস্ফীতি উচ্চপর্যায়ে থাকলেও তা ধীরে ধীরে কমছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্থিতিশীলতা এসেছে এবং টাকার মান কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি রপ্তানি খাতেও ইতিবাচক গতি দেখা যাচ্ছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয় বলেন, ‘স্বল্প মেয়াদে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেলেও আমাদের আস্থা দীর্ঘমেয়াদি মৌলিক ভিত্তির ওপর। এখনকার স্থিতিশীলতা ভবিষ্যতের টেকসই প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করছে। তবে তার জন্য দরকার পরিকল্পিত নীতি, চলমান বিদেশি সহায়তা ও কাঠামোগত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। এসব উদ্যোগ বৈশ্বিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও দেশের প্রবৃদ্ধিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবে।’
স্বল্প মেয়াদে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেলেও আমাদের আস্থা দীর্ঘমেয়াদি মৌলিক ভিত্তির ওপর। এখনকার স্থিতিশীলতা ভবিষ্যতের টেকসই প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করছেনাসের এজাজ বিজয়, সিইও, এসসিবি বাংলাদেশঅনুষ্ঠানে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ সৌরভ আনন্দ জানান, গত বছর নেওয়া সরকারের নীতিগত পরিবর্তনগুলো বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে একটি মজবুত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। প্রবৃদ্ধির সূচকগুলোয় উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে।
তবে ব্যাংকটির গবেষণায় কিছু কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের কথাও উঠে এসেছে। বহুজাতিক ব্যাংকটি বলছে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হারও অনেক বেশি। রাজস্ব আদায় প্রত্যাশার তুলনায় কমে গেছে, যা আগামী দিনে বাড়তি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে রাজস্ব ও ভর্তুকি খাতে সংস্কার ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না বলে মনে করছে ব্যাংকটি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক দূত লুৎফে সিদ্দিকী। তিনি বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক অস্থিরতায় বৈদেশিক মুদ্রা ও সুদের হারজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় নীতিনির্ধারকদের সচেতন পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার ব্যবসা সহজ করা এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ জন্য নীতিগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা বৈদেশিক মুদ্রাবাজার, বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা ও বিশ্বব্যাপী চাহিদার পরিবর্তন নিয়েও মত বিনিময় করেন। পাশাপাশি নির্বাচনী সংস্কার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরপ্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখার দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ১২০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে কার্যক্রম চালিয়ে আসা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক দেশের বিভিন্ন বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ ছাড়াও আমদানি-রপ্তানি, এসএমই ঋণ ও গ্রাহক সেবায় সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রব দ ধ অন ষ ঠ ন এসস ব সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
পাল্টা শুল্ক ও এনবিআরে কর্মবিরতির কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ১২%
বিদায়ী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিক এপ্রিল–জুনে দেশ থেকে ৯১১ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি তার আগের জানুয়ারি–মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ কম। তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের কর্মবিরতিকে দায়ী করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে।
তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, গত এপ্রিল–জুন প্রান্তিকে তৈরি পোশাক খাত বেশ কিছু গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হয়। এর মধ্যে ছিল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও বাণিজ্য নীতির পরিবর্তন, যা ওই প্রান্তিকের রপ্তানি দক্ষতাকে দুর্বল করে দেয়। নীতিগত পরিবর্তনের মধ্যে অন্যতম ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ (পরে কমে হয়েছে ২০ শতাংশ) পাল্টা শুল্ক আরোপ। তখন পর্যন্ত সেটি কার্যকর না হলেও তা ক্রয়াদেশ স্থগিত ও অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
মার্কিন প্রশাসন গত ৩১ জুলাই অন্য অনেক দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশি পণ্যেও পাল্টা শুল্কের হার সংশোধন করে। এবারে বাংলাদেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক কমে ২০ শতাংশ হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে পাল্টা শুল্ক কার্যকর হয়েছে। তাতে বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। কারণ, এ বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের মূল প্রতিযোগী ভিয়েতনামের পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতের ওপর পাল্টা শুল্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। আর চীনের শুল্ক এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনবিআরের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের ধর্মঘটের কারণে শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় দেরি হয়, যা পণ্যের চালান প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে। সময়মতো পণ্য পাঠানোকে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত করে। এদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রতিকূল পরিস্থিতি, দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদন ব্যয় ও রপ্তানি বাজারের বৈচিত্র্যহীনতা ইত্যাদি কারণে রপ্তানির গতি শ্লথ হয়ে পড়ে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধর্মঘটের কারণে শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় দেরি হয়, যা পণ্যের চালান প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে। এতে পণ্য পাঠানো ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। আবার বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রতিকূল পরিস্থিতি, উৎপাদন ব্যয় ও বাজারের বৈচিত্র্যহীনতা রপ্তানির গতি শ্লথ করে দেয়।গত ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ করার অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর পর থেকে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে প্রায় দুই মাস আন্দোলন করেন। ২৮ ও ২৯ জুন সারা দেশে কাজ বন্ধ করে দেন তাঁরা। এরপর ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় তাঁরা আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। এরপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে এনবিআর কর্তৃপক্ষ। গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবিরতি ও শাটডাউন কর্মসূচি পালনের কারণে যে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণে আন্তমন্ত্রণালয়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মূল্য সংযোজন কমেছেবিদায়ী ২০২৪–২৫ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে (এপ্রিল–জুন) তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন কিছুটা কমেছে। এই প্রান্তিকে দেশ থেকে মোট ৯১১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে ৩৯৪ কোটি ডলারের কাঁচামাল আমদানি হয়। তার মানে মূল্য সংযোজন দাঁড়িয়েছে ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। তার আগের প্রান্তিকে মূল্য সংযোজন ছিল ৫৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, পোশাক রপ্তানি থেকে তুলা, সুতা, কাপড় ও সরঞ্জামের আমদানি ব্যয় বাদ দিয়ে নিট রপ্তানি বা মূল্য সংযোজন হিসাব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার অনেকে প্রকৃত রপ্তানি আয়কে পোশাক খাতের মূল্য সংযোজন হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন।
গত ২০২২–২৩ ও ২০২৩–২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি বাড়িয়ে দেখিয়েছিল রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। তখন রপ্তানির পাশাপাশি মূল্য সংযোজনও কৃত্রিমভাবে বেড়ে গিয়েছিল। পরিসংখ্যানের গরমিলের বিষয়টি গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সামনে আনে। এরপর রপ্তানির পরিসংখ্যান সংশোধন হয়। তাতে গত দুই অর্থবছরের সাত প্রান্তিকে পোশাক খাতে মূল্য সংযোজন কমে যায়।
রপ্তানি আয় বাড়িয়ে দেখানোর কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর–ডিসেম্বর) তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন একলাফে ৫৯ থেকে বেড়ে ৬৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। তারপরের পাঁচ প্রান্তিকে মূল্য সংযোজন আরও বেড়ে ৭০ থেকে ৭২ শতাংশের মধ্যে ছিল। যদিও সংশোধনের পর দেখা যায়, ওই অর্থবছরের জানুয়ারি-মার্চ ও এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে মূল্য সংযোজন কমে ৬২ শতাংশে নেমেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চার প্রান্তিকে মূল্য সংযোজন কমে সাড়ে ৫৭ থেকে সাড়ে ৬১ শতাংশ হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই–সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন ছিল ৫৭ শতাংশ। পরের প্রান্তিকে, অর্থাৎ অক্টোবর–ডিসেম্বরে সেটি বেড়ে ৬১ শতাংশে উন্নীত হয়। তারপরের দুই প্রান্তিকে মূল্য সংযোজন কমে হয় যথাক্রমে ৫৮ দশমিক ৯০ ও ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।